প্রবন্ধ- ৪
‘ক্ষুদ্র তবু তুচ্ছ নয়’ – শিশু চরিত্র বিনির্মাণে সফল
সৃজনে শ্রী সত্যজিৎ রায়:
—————-
– শ্যামাপ্রসাদ সরকার
যে শিশু প্রায় আড়াই বছর বয়সে তার পিতাকে হারিয়ে বড় হয়েছে আর তার এই বেড়ে ওঠার জগতের ছাপটিতে অতি আপনজনকে হারিয়ে উঠেও প্রগাঢ় এক দীর্ঘমেয়াদি অভাববোধটি যে আগামীদিনের সৃষ্টির একটা প্রমিথিয়ান অগ্নিসংযোগ ঘটাবে সেটা বোধহয় এতটা সহজ ছিলনা। জাগৃতির উত্তরধারাটিকে পরবর্তী সময়ে যিনি চিনবেন কেবলমাত্র বিদগ্ধ পিতামহ ও পিতা’র অজস্র সৃষ্টির সাথে পরিচিত হয়েই। যদিও আজন্ম ঐতিহ্যবাহী রায়পরিবারের বাকীসব বিদগ্ধ পরিজন ও জননী সুপ্রভা দেবীর বলিষ্ঠতা তাঁকে একদিন সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠা করবে দৈর্ঘিক উচ্চতার মত সাংস্কৃতিক এক বিশালত্বে। সেখানে অস্তগামী রবীন্দ্র-আশ্রয় যেমন দেবে আন্তরিকতা আবার তেমনই আচার্য্য নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য আর শান্তিনিকেতনের বুকে বয়ঃসন্ধিক্ষণের বেড়ে ওঠা জীবনবেদ চর্যার ঈপ্সিত ফসল আর তেমনই তা জন্ম দেবে জ্ঞানাণ্বেষী এক কৌতূহলী মনের যা তাঁকে আদতে সজীব রাখবে চিরায়ত জ্ঞানতাপসের অদম্য স্পৃহায়। তাই তিনি সব অর্থেই হয়ে উঠবেন একজন সেই দীঘদেহী সৃজনশীল মানুষটি, আমাদের প্রিয়.
‘ শ্রী সত্যজিৎ রায়’!
…..
পিতৃদেব শ্রী সুকুমার রায়ের কাছে “পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা” আবৃত্তিতে শোনা সেদিনের সেই ছোট্ট ‘মানিক’ পরবর্তীকালে তাঁর সারাজীবনের সমস্ত সৃজনেই সেই ছোটবেলাটির রসমাধূর্য্য এত সুন্দর ফোটাতে শিখে যাবেন যে কতকটা অবলীলায় চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ শিশু-কিশোর তোষক সৃজনের অজস্রশাখায় নিজেকে ছড়িয়ে রেখে সহজকঠিন ” children psychology” র এত সুনিপুণ ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন। এর প্রকাশে ঋদ্ধ হবে যেমন অজস্র চলচ্চিত্র, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন…ইত্যাদি। আবার উপযুক্ত অভিবাবকত্বের আদরে এক পুনর্যাপী পরম্পরায় ফিরে আসবে ” সন্দেশ ” পত্রিকা, যা তাঁর অনন্য প্রবাহধারার জীবন্ত অস্তিত্ব।
……
চলচ্চিত্রে তাঁর প্রখরতা যেমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আত্মিক আহার আবার তা তথাকথিত ছোটদের জন্যেও তা একইভাবে সমুজ্জ্বল।
এ প্রসঙ্গে প্রথমে আসি অপু, দূর্গা ও কাজল এই তিনটি চরিত্রের বিষয়ে। সিক্যুয়েলধর্মী তিনটি ছবিতে যে শিশু কিশোর-চরিত্রত্রয়কে উনি সহজ ভাবে আমাদের সামনে মেলে ধরেন তা আদতে তাঁর অবচেতনের প্রজ্ঞার সার্থক প্রতিফলন। তাই তো বিভূতিভূষণের লেখা চরিত্রগুলি এভাবে সার্থকভাবে ধরা দেয় তাঁর লেন্সে। এমনকি অপুর সংসারে আপাত অপ্রয়োজনীয় সেই টালা’র বাড়িতে প্রতিবেশী শিশুটির কথা মনে পড়ে? পুরো কাহিনীর একটা প্রিল্যুড ও চিরবিচ্ছেদবোধ আঁকা যায় ওই দৃশ্যে শিশুটিকে দেখে আপ্লূত অপর্ণার অপূর্ণ মাতৃত্ববোধের ঈপ্সা দৃশ্যটি দিয়েই।
দর্শক অনেকপরে শেষে আবিষ্কার করে সেই অবচেতনের চূড়ান্ত উদ্ভাসটিকে পিতার কাঁধে চড়ে ” তুমি যাবে আমার সাথে” র প্রত্যুত্তরের হাসিমুখের শিশুটিকে নিয়ে পাই অপু’র সাথে একটি ক্লোজআপ শট। সেই দৃশ্যে আমরাও এসে যেন হাত ধরি অপু’র উত্তরপ্রজন্মের ! অজান্তে অপু – দূর্গার সেই বৃষ্টিভেজা শট বা রেলগাড়ির শট আর এই শটটি ভিন্ন ভিন্ন ত্রিমাত্রিক ভাবে অঙ্কিত হলেও একরৈখিক হয়ে যায় সার্থক শিল্পীর চোখে। এখানেই তিনি সত্যজিৎ। আশ্চর্য বুননে তিনি বেঁধে নেন অপত্যবন্ধনকে।
….
আবার ‘দেবী’ ছবিতে দয়াময়ী চরিত্রটিই প্রধান। তাকে ঘিরে আবর্তিত হয় দৃশ্যপট। তার আরোপিত মাতৃত্বরূপটি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ” মা মা বলে আর ডাকবোনা…” গাওয়া সেই ভিখারী ও তার কোলের শিশুটির বিভঙ্গে। এই যে আরোপিত দেবীত্ব তাতে আসলে লুকিয়ে থাকে ” কতই যাতনা” সেটা রচনাকার স্বয়ং প্রভাতকুমারও বোধহয় এভাবে বলে উঠতে পারেন নি।
…
এবার আসি ‘জলসাঘর’ ছবিতে। বিশ্বম্ভর রায় আর তাঁর পুত্রটির সেই সঙ্গীতযাপনের দৃশ্য জলসাঘরের আসন্ন শূন্যতাকেই অর্থবহ করে তোলে। এখানে তারাশঙ্করের সৃষ্ট জমিদার চরিত্রটি আর সত্যজিৎ এর জমিদার চরিত্রের চেতনা এখানে দুটি পৃথক পথে হেঁটে আসে বলে সেই নির্মম একাকীত্বটি চরম আবেগের সাথে সেই পুত্রহীন বৃদ্ধ জমিদারটিকে এঁকে দেয় স্ক্রীনে। তাই যখন বিশ্বম্ভর রায় তাঁর পুত্রসম ঘোড়াটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন “তুফান ডাকছে…. ডাকছে!” এটাই যেন ফেলে আসা যুগের সব অকথিত স্মৃতিকথাগুলির পূর্ণতা পেয়ে যায় সাবলীল চিত্রায়ণে।
…..
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা ‘ ছবিতে এরপরে আমরা দেখব সেই ভিক্ষাজীবি নেপালী বালকটির দুচোখের বিস্ময়কে আর হাতে নেওয়া দামী ক্যাডবেরী বারের ব্যর্থ উপহারের এক নিছক রহস্যময়তা শেষমেশ কোথাও গিয়ে ” তুই তাহলে জিতে গেলি” এই সংলাপটিকে দ্ব্যর্থ ভাষায় প্রবল পরাক্রমী করে দেয় সিনেমায়। যেন যা অকপট তাকেই শেষে এসে জিততে হয় অন্তহীন সময়যাপনে।
আহা!এটাই তো সত্যজিৎ এর সেই জাদু! যেমন স্বল্পদৈর্ঘ্যের ” টু” ছবিতে অসম আর্থিকসংগতির ফসল দুটি শিশু চরিত্রকে তাই তিনি বদলে দেন আক্ষরিক সাজবদলের মুন্সীয়ানায়।
…
রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্র বা পোষ্টমাস্টার এদুটোই রবীন্দ্রশতবর্ষের বিনির্মাণ বলে বালক রবি’র চোখের বিস্ময় আর পোষ্টমাস্টারের অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতের বালিকা চরিত্র রতনের চোখ ভরা বাষ্পের কোলাজ ছবি দুটির মেরুদন্ড হয়ে ওঠে। বিভিন্ন শটে তোলা এই দুটি ভিন্ন পরিবেশের দুটি বিপরীত স্বভাবের শিশুমনোজগত ধরা পরে সত্যজিতের ক্যামেরায়। এরাই যে ছবির মূল, সেটা দর্শককে সত্যজিৎকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়না। ‘সোনার কেল্লা ‘ ছবিটি আসলে আবহমান কালের শিশুমনের স্বপ্ন দেখা ও তার জাগতিক স্বপ্নভঙ্গের আপাত রেটোরিক ক্যানডিড স্ক্রীনপ্লের নির্মাণ। সেই টিপিক্যাল ” হু ডান ইট্ ” কখন যেন তোপসে আর মুকুলের বিস্ময়বোধে এসে একসময় পথ হারিয়ে যায়। সেই দৃশ্যটা যেখানে স্বপ্নভঙ্গের শোচনীয়তায় মুকুল কাঁদে আর শেষ দৃশ্যে বলে – ” আমি বাড়ি যাব ! কলকাতা ! মা’র কাছে” এটাই যেন সত্যজিতের জীবন জুড়ে গড়ে ওঠা অবচেতনার সাধনা। পেনেটির বাগানবাড়ির জানলায় বসে যে শিশুটি কয়েকটি পালতোলা নৌকা আর মৃত্যুপথযাত্রী পিতা এই দুটো বৈপরীত্যভাবের সমান দর্শক সেই তো আসলে ‘মুকুল’কে চেনে।
তাই তার অবচেতনে এগুলো সার্থক চিত্রভাষে রয়ে যায়।
……
জয়বাবা ফেলুনাথের ‘রুকু’ বা ‘পিকু’ ছবির মূখ্য চরিত্র আর শাখাপ্রশাখার ডিঙ্গো এরা একটু যেন সিরিও এডাল্ট ক্যাটেগরীর চরিত্র। অর্থাৎ যেটা পরিণত চরিত্রগুলির করে যাওয়া ঘটনাগুলো আমরা দেখতে পাই যখন এরা যেন তাদের জ্বালিয়ে যাওয়া প্রদীপের প্রচ্ছায়া হয়ে জেগে থাকে বিবেকবোধের ঔচিত্য হয়ে।
তাই উদয়ন পন্ডিতের ছাত্ররা অবধারিতভাবে হীরকরাজার নাকে ঢিল মেরে ভেঙে দেয় ও শেষে ‘ দড়ি ধরে মার টান’ বলে ভবিষ্যতের পরিবর্তনকে সহজ করে আনতে জানে।
……
আবার ‘মহানগর’ ছবিতে হঠাৎ মা এর বাইরে কাজ করতে যাওয়ার উৎকোচরূপে শিশুটি তারই মায়ের কাছ থেকে একটি খেলনা বন্দুক উপহার পায় বটে কিন্তু সে অজান্তেই তার অভিবাবকদের অবচেতনে থেকে যায় সমাজের প্রচলিত নারীমাতৃক সভ্যতার বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য বিবেকবুদ্ধির হাতিয়ার হাতে অসম প্রতিবাদের পূর্বরাগে।
আমরা যেন তারই অনুচ্চারিত প্রতিভাস দেখি অন্য ছবি ‘ প্রতিদ্বন্দ্বী’তে ধৃতিমান ও বোনের শৈশব হঠাৎ ফিরে এসে যখন বলে ” দাদা! ওটা কি পাখি রে….? ” সেই দৃশ্যটিতে সহজসরল উন্মেষবোধে যা আমরা অনেকেই পরবর্তীতে এসে আমাদের জীবনাচরণে হারিয়ে ফেলি।
……
এইসব শিশুচরিত্রদের নির্মাণে স্বয়ং সত্যজিৎ যদি তাঁর নির্মোহ রূপটানে নিজে না দেখাতেন তাহলে জীবনবোধের সরলতা ও নিষ্পাপ গভীরতার চিহ্নটি হয়তো আমাদের অজানিতই থেকে যেত। আগন্তুকের ” সাত্যকি”কে তাই তার ছোট্ দাদু যেন সদর্পে বলতে চান “কূপমন্ডুক হয়োনা” ! তাদের নির্মলতর চোখ দিয়ে আজকের বিপর্যস্ত পৃথিবীকে আমাদের যে একবারের জন্য আমাদের দেখতে বড় সাধ হয়।
…..
এটাই তো আসলে সত্যজিৎ রায়ের চিন্তনের ঔদার্য্য। সেখানে আগামীকালের জানালাগুলোকে ঠিক করে খুলে রেখে দেন তিনি ” যাতে আলো আর হাওয়া এসে মনটাকে তাজা রাখে!”
শতবর্ষ তো কেবল একটা সংখ্যামাত্র। সত্যজিৎ রায়ের অনন্য শিশুচরিত্রের চিত্রায়ণ ও তার চিরন্তনময়তা এভাবেই আরো প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে ভাবীকালের যাদু আয়নায়।
—ooXXoo—