দুখের পারাবারে
……………………..
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
সেদিন শেষরাতে সুপ্রভার ঘুম খুট্ করে একটি শব্দে ভেঙে যেতেই তিনি দেখতে পেলেন যে তাঁর স্বামীটি ঘুম ভেঙে আচমকা জেগে উঠে বিষণ্ণ মুখে তাঁর দিকে চেয়ে আছেন। তিনি দেখতে পেলেন বরাবরের আমুদে ও চিরহাস্যোচ্ছল মানুষটির দু’চোখ গড়িয়ে নামছে নীরব জলের ধারা। সেদিনের অসহনীয় নিস্তব্ধতার অন্যপ্রান্তে গভীর রাত্রের মায়াহীন চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে যে অন্যপাশে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে দম্পতির দু’বছরের একমাত্র শিশুপুত্রটি।
এই আলোড়নের পূর্বভাসটি যেন গভীর রাত্রে সেই শিশুটির সমস্ত শরীরের ওপর দিয়ে যেন বয়ে চলেছে এক অনন্ত বীক্ষণের আগামী স্বপ্নসন্ধানের সৃজনশীল পথের ভবিষ্যৎের শরীক করে তুলবে বলে।
এবারে যেন একটু ভাঙা ভাঙা স্বরে সুকুমার নিজের সহধর্মিণী সুপ্রভা দেবীর কাছে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ করে বললেন যে ঋষিকল্প ওই মানুষটিকে শেষবারের মত একবার দেখার ইচ্ছা হচ্ছে৷ একটু সংযত হয়ে স্বামীর কপালে নিজের কম্পিত করাঙ্গুলি বুলিয়ে সুপ্রভা বললেন, ” আচ্ছা বেশ! এখন একটু ঘুমাও। আমি কাল নিজে জোড়াসাঁকো গিয়ে ওঁকে না হয় একবার এখানে আসতে বলব। “
…….
পরের দিন সেই খবর রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে যেতে সব কাজকর্ম ফেলে তিনি উদ্বেগাকুল হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুকুমারের মৃত্যুশয্যার পাশে। স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে উঠছিল বাগ্মী, প্রতিশ্রুতিবান এক তরুণের প্রকাশকাল।
স্বল্প দিনেই সে প্রমাণ করে ফেলেছে তার প্রতিভার স্বরূপটি। এমনকি এসবের সাথে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নবীন প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি হয়ে উঠেও সে নিরহঙ্কারী ও সহজ মনের মানুষ। এবারে ঘরের পর্দা সরিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কে ঢুকতে দেখে সুকুমারের চোখে-মুখে জেগে উঠল ক্ষণকালীন আনন্দের অসীম স্পর্শযোগ।
আবদারের গলায় একটু শান্ত কন্ঠে সুকুমার তাঁর পিতৃবন্ধু রবীন্দ্রনাথ কে বললেন ‘আছে দুঃখ,আছে মৃত্যু’ গানটি গাইতে৷
প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ তার মুখে আজ এই আবদারটি শুনে আজ একটু যেন শিউড়ে উঠলেন। প্রসঙ্গান্তরের আভাস দিয়ে কবি বললেন আজ একটি অন্য গান আজ সুকুমারের জন্য বেঁধে এনেছেন। এই বলে তিনি ধরলেন ‘এত কালের ভয়-ভাবনা কোথায় যে যায় সরে,ভালোমন্দে ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে’৷
সুকুমার তবু অতৃপ্ত কন্ঠে আবার ফরমাশ করে বললেন, ‘এসব থাক! বরং তার বদলে – দুঃখ এ নয়,সুখ নয় গো,গভীর শান্তি এ যে’ গানটি আজ অন্তত একবার গাইতে হবে।’
রবীন্দ্রনাথ নিজের অতি প্রিয় তরুণটির কম্পিতকন্ঠের অনুরোধটি আর অস্বীকার না করে পরপর দু’বার তার অনুরোধের গানটি অবশেষে গেয়ে উঠলেন।
………
কবিকন্ঠের আবহে তৃপ্ত সুকুমার তাঁর রোগক্লিষ্ট মুখে এক অন্যরকমের হাসি হেসে করজোড়ে প্রণাম জানালেন তাঁর প্রাণের মানুষটিকে। আড়াই বছরের শিশুপুত্রটিকে কোলে চেপে ধর সুপ্রভার চোখ দুটিও ক্রমে ভিজে উঠতে লাগল অশ্রুর সাবলীল ধারায়।
কবিগুরুকে বিদায় দিয়ে আজ সুকুমার যেন একটু সুস্থ বোধ করতে লাগলেন অন্য দিনের চেয়ে। যেন এই ক্ষণটির জন্য তিনি এতকাল নীরবে অপেক্ষা করছিলেন বলেই স্বস্তি পেয়েছেন তার পরে।
সত্যি! আজ তাঁর মনটা যেন এক অন্য ভেলায় চেপে উজান বেয়ে যেতে চাইছে। গৃহভৃত্য প্রয়াগকে হাতের ইশারায় বোঝালেন তাঁর শিশুপুত্রটিকে একবার শয্যার কাছে নিয়ে আসার জন্য।
খোকা হাসিমুখে পিতার কাছে আসলে তিনি সস্নেহে দু’হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ক’দিন আগে ননসেন্স ছড়া সমণ্বিত যে নতুন বইটি এখন প্রেসে সেখান থেকে বিভিন্ন ছড়া সুর করে গেয়ে তাকে শোনাতে লাগলেন,
“আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত,
মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভুত!
হ্যাংলা হাতী চ্যাং দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা!
মক্ষিরাণী পক্ষীরাজ-
দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ!
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর।
তিনি কি জানতে পেরেছিলেন যে এই বইটিকে ছাপার অক্ষরে স্বচক্ষে আর তিনি কখনওই দেখে যেতে পারবেন না?
ইউ রায় এন্ড সন্স থেকে যখন ১৯২৩ সালে শেষমেশ বইটি প্রকাশিত হবে ‘আবোলতাবোল’, নামে তার মাত্র কয়েকটি দিন আগে স্রেফ ছত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি তখন না ফেরার দেশের পথে পাড়ি জমিয়েছেন ৷
…..
আনন্দময় ও সৃজনশীল এই কৃতী তরুণটির
অকাল প্রয়াণে কাতর হয়েছিলেন পিতৃসম রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য সুকুমারের অন্তিম সময়ে তিনি কলকাতা থেকে অনেক দূরে।
শান্তিনিকেতনে যখন রয়েছেন তখন একদিন আসা টেলিগ্রামে খবরটি পড়ে শোকস্তব্ধ কবি সুকুমারের স্মরণ সভায় সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি,কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ুটিকে নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষ কে অর্ঘ্য দান করতে প্রায় আর কাউকে দেখিনি৷ মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন’৷
……
আজও পেনেটিতে রায় পরিবারের সেই সাময়িক আবাসগৃহটির খোলা জানালার পাশে বয়ে চলছে প্রশস্ত গঙ্গা আর তার জোয়ার-ভাঁটার কালপ্রবাহে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত জাগতিক চরাচর। সেই নদীবক্ষে যেন আজও ভেসে আসে প্রতিভাবান ও প্রাণময় এক উদ্ভাসের প্রিয় নাম। ‘সুকুমার রায়….’!
……….
# কৃতজ্ঞতা-
Arunava Sen
তথ্যচিত্র/ সুকুমার রায় – সত্যজিৎ রায়
সাত রাজার ধন এক মানিক – নলিনী দাশ
—ooXXoo—