ছোটগল্পের পাঠশালা’য়
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
……………………….
আলোচনায় – শ্যামাপ্রসাদ সরকার
গল্প- শাস্তি
রচনা – সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশ পত্রিকা- ১০টি গল্প
(১)
ছোটগল্পের আঙিনায় দেশ পত্রিকা সতত রেখেছে তার আদর্শ মূল্যায়ণ। তাই এই পত্রিকার গল্প সংকলনগুলিও কালোত্তীর্ণ ও প্রজন্মান্তরে সমুজ্জ্বল।
প্রিয় লেখিকা সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়’কে আজ হতে দুই দশক আগে প্রথম পড়ি তাঁর উদ্বর্তনের দিনের সূচনাকালে সেই ” শঙ্খিনী” উপন্যাসের পাতায়।
তারপর বেশ কিছুদিন ধরে ওনার অন্যান্য কিছু লেখা পড়তাম ও বলা বাহুল্য যে তিনি অজান্তেই আমাদের সদ্য বড় হয়ে ওঠার কালের নবীন “আইকন ” হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তা বুঝতেও পারতাম।
ঠিক তখন দক্ষিণ কলকাতায় একটি কবিতাপাঠের আসরে ওনাকে প্রথম চাক্ষুষ করি ওই আসরে, কম্পিত বক্ষে নিজের কবিতা পাঠ করতে পারার ধৃষ্টতায়। অনেক বিদগ্ধ গুণীজনের সান্নিধ্যে তখন কবিজীবনের উন্মেষপর্বটি কেটেছিল একটি সন্ধ্যা ও তার সাথে একটি দুপুরের আয়োজনেও।
সেই পাঠমুগ্ধতার বেশ পরে ওনাকে অল্পবিস্তর পড়েছি ও তারও পরে FBতে এসে উনি যে কি করে আমার প্রিয় লেখিকা থেকে একজন দিদি হয়ে উঠলেন সেটা ভাবীকালের অনুসন্ধিৎসার জন্য রেখে দেওয়াই সংগত।
ইতিমধ্যে নিজেও একটু আধটু লিখছি, কিছু আদ্যক্ষর মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে ও ওঁর সম্পর্কিত একটি জবর বন্ধুনী ও তার সঙ্গীদের সাথে পরিচিতও হয়েছি ও সৌজন্যের দিদি ডাকটিও যেন একটু একটু করে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। ঠিক এইসময় হল আমার পথদুঘর্টনা জনিত কালক্ষেপ ও ফলতঃ দীর্ঘ অসুস্থতা, স্বরযন্ত্রের আপাত ষড়যন্ত্র, এক লম্বা লড়াইয়ের সূত্রপাত। তাও এই সময়ে উনি জানতে চেয়েছেন আমার কুশল সংবাদ যা পরে জেনে জাস্ট “পায়া ভারী ” হয়েছে কিনা সেটাও রহস্য বটে ! এই কথাটা মনে মনে যখন নিজের কাছে নিজেও জানতে চেয়েছি গর্ব ও শ্লাঘা ছাড়া যা প্রত্যুৎত্তর পেয়েছি তা অগ্রজাটির ঔদার্য্য বলেই মানতে সাধ হয়।
…..
ইতিমধ্যে এখন হাতে এসেছে দেশ পত্রিকার সাম্প্রতিক ১০টি গল্প সংখ্যা ও তন্মধ্যে প্রিয় লেখিকার ( না দিদি বলব?) একটি সার্থক ছোটগল্প “শাস্তি”!
যে সময়ে উনি মুগ্ধ করতে শুরু করেছেন ওঁর লেখনীর ধারায় সেই কাহিনী বিন্যাসের রেশ দুই দশকের পরেও পেলাম। রণদেব ও তরীর কাহিনীর সেই স্বভাব গাম্ভীর্য এতেও সমান বিদ্যমান।
গল্পটি কেন সার্থক সেটার জন্য পাঠ ও সবার নিজস্ব বোধের প্রয়োগটি অবশ্য জরুরী। তবে
” চমনে”র সামনে একটি আরোপিত আনন্দঘন পারিবারিক উদযাপনের দিনে একটি বাঁধাইকরা অমরচিত্র কথা ও বাকী পরিবার, বিশেষতঃ দুই কন্যা ও স্ত্রীর প্রতি তার অনমনীয় রুক্ষতা তাঁর কলমের জাত চেনায় অবলীলায়। পর্যায়ক্রমে গল্পে উঠে আসে চমনের নকশাল কাকা অতনু বিশ্বাস, মাধব চাকী ও তার ফুটপাথের ক্যাসেটের দোকান, একদা খালপাড়ের একজনে আশ্রয়ে বিনা পয়সার শিক্ষা, হসপিটালে রাত জাগা ও দাঁতে দাঁত চিপে পড়া…..এরকম অজস্র অবধারিত অতীতচারণের দিনলিপি।
বেআব্রু অসংখ্য অতীতের সবটায় কারুণ্য থাকেনা তাও তাকে পরবর্তীকালে সাফল্যের সিঁড়িতে পা রেখে ভুলে যাওয়ার যে চিরাচরিত ধৃষ্টতা আমাদের মজ্জ্বাগত তা ভুলে থাকার নকল গড়ে নিত্যদিন আমাদের পচতে হয় ও হবেও। এই বিস্মৃতিবিলাসটাই তো আসলে চরম ” শাস্তি “, কারণ সর্বদাই তাকে মনে রেখে ভুলে থাকার অভিনয় বা রূঢ়তাকে আশ্রয় করতে অভ্যস্ত হতে হয়।
………..
কলমে – শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(ধারাবাহিক আলোচনা)
গল্প – অহল্যা
রচনা – মঞ্জুলিকা রায়
(২)
‘অহল্যা’ চরিত্রটি না থাকলে রামায়ণের মূল কাহিনীস্রোতের খুব একটা তফাৎ হতনা কারণ শেষমেশ এটি আর্যায়ণের দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে একটা দাম্পত্য -শৈথিল্যের কথাই বলে।
এখানে চিরাচরিত দাম্পত্য আসলে বদলে গিয়ে পুরুষ ও সাম্রাজ্যবাদী ‘ইগো’র গল্প। তা না হলে রামায়ণ ক্রৌঞ্চমিথুনের বধ ও একটি মূলধারা-বিচ্ছিন্ন দস্যুর শ্বাশ্বত সমাজে ফেরাটাই বড় করে দেখানো হত। পার্শ্ববর্তী এত ঘটনার প্রয়োজন হত না।
যদিও এই গল্পের অহল্যা পৌরাণিক নন, তবে মহাকাব্য আশ্রিত নামধারার সাযুজ্যটুকুই তার নামকরণে ব্যবহার হয়েছে।
এ গল্প তাই হয়ে উঠেছে এক সত্যি জীবনবোধের সার্থক গল্প।
‘মেলানকোলিয়া’ এক মনবৈগুণ্যের অসুখ।
তবে এই রোগটি জন্মগত নয় । জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার রেশ এর শিকারটিকে নিশ্চুপ, জড়বৎ করে দিলেও বুকে ধিকিয়ে ধিকিয়ে হলেও জ্বালিয়ে রাখে প্রত্যয় ও জীবনবোধের আগুন।
সেখানে সম্পর্কবোধের আপাত অধিকারের বদলে থেকে যায় অনন্ত সমর্পণ যা বাহ্যিক দূরত্বেরও অন্য পারে নিয়ে যায় মনকে।
এখানেই লিখতে বসে মঞ্জুলিকা’দি সততা রেখেছেন সবকটি চরিত্রায়ণে।
যদিও উত্তমপুরুষে লেখা এই গল্পটি কি সহজে আমার বা আমাদের নিজের গল্প হয়ে যেতে পারে এটা বস্তুত ভীষণভাবে লক্ষণীয়। উনি ‘মা’ চরিত্রটিতে বুনে গেছেন দরদী নিস্পৃহতা। খুব বলতে ইচ্ছে করছে ফরাসী সাহিত্যিক আলব্যের কাম্যুর লেখা “কলেরার দিনগুলিতে প্রেম ” লেখার নির্বেদ স্বাক্ষরের মত ওনার বাঙালীমনন বহুকাল পরে সমকালীন এই গল্পটিতে পেলাম।
এটা হয়ত উনি অজানিতেই সৃষ্টি করেছেন বলে এভাবে তুলনা করাটা হয়ত অনুচিত, তাও কিছু স্মৃতি সতত সংলাপ ও প্রলাপে এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে তাকে না বললে নেহাত অনৃতবাচনের অধিকারী হয়ে থাকতে হয়।
ফেসবুক অন্তত এ স্বাধীনতা দেয় বলে এ লেখার অবতারণা। মঞ্জুলিকা’দি ঠিক এইরকম একজন অগ্রজা ও সত্যনিষ্ঠ কলমকার হয়ে থাকুন এটাই আমাদের প্রজন্মের কাছে এটাই শিক্ষণীয় ও পরম প্রার্থনীয়।
এই গল্পটির শেষে এসে একটা দৃশ্যায়ণে উনি একটি শেষ অনুচ্ছেদ লেখেন যা আবার একটি অনন্য তুলনা বর্ণনায় আমাকে বাধিত করেছে।
হিচককের ” Psycho ” ছবিতে একটি দৃশ্য আছে যে অতিপ্রিয় একজনের মৃত্যুর পর মনবৈগুণ্য আর একজন জীবিত মানুষটিকে তার ছায়ারূপ দানে ব্যবহার করে ও তাদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চলে বেশ অনেকটা সময় ধরে।
সেখানে দুটি মানুষ যার একজন জীবিত ও একজন মৃত তাও যেন সেই দুজনেই কোথাও একটা একীভূত হয়ে যাপন করে অনবধানের চরম দৃশ্যকল্পে। তাই ছবিটি দেখে শিউরেই উঠতে হয়।
এখানেও মঞ্জুলিকা’দির শেষ অনুচ্ছেদটি এই পর্যায়ে এসে যেন একটি সেরকম কাল্ট মন্তাজ তৈরী করে দিতে পেরেছে। তাই সমগ্র লেখাটাই হয়ে উঠেছে এই শেষের কটি লাইনেই সফল ও সদাজাগ্রত।
“বিভোর হয়ে মা গাইছেন, ঝম্পক তালের মল্লারে গাওয়া গানটি আমি জানি, বাবার প্রিয় গান। মা নির্ভুলভাবে গাইছেন, প্রতিটি সুর ঠিকঠাক লাগছে। অবাক হয়ে গেলাম, আমার বাবাকে নিয়ে আমার যে গর্ব ছিল তা শতগুণ বেড়ে গেলো। আমার বাবা তো অসাধ্য সাধন করেছেন, নিজের ভালোবাসা, অধ্যাবসায়, মমতা দিয়ে একটা পাথরে পরিণত হওয়া জীবনকে তিনি অতলস্পর্শী খাদের কিনারা থেকে তুলেই শুধু আনেন নি, তার মধ্যে তিনি প্রাণ সঞ্চার করেছেন, সর্ব অর্থে ফুলে ফলে ভরিয়ে তুলেছেন, স্বয়ং সম্পূর্ণ করেছেন একটি জীবনকে। নিভন্ত চুল্লিতে তিনি আগুন জ্বালিয়েছেন।”
এটাই তো সার্থকনামা একটি কাহিনীকথন যেখানে পাষাণস্তুপও যেন একটি অন্তঃসলিলা নদীর আধার হয়ে ওঠে তা সে যতই অভিঘাতজর্জরিত জীবনের একটি অনন্য পর্যায়ে এসে হোক না কেন!
ধন্যবাদ! Manjulika Ray দিদি
…..
ছোটগল্পের পাঠশালা’য়
………………………….
কলমে- শ্যামাপ্রসাদ সরকার
গল্প- বৈকুন্ঠ যাত্রা
কলমে – সুপ্রিয় চৌধুরী
দেশ পত্রিকা- ১০টি গল্প
(৩)