গাড়ি থেকে নেমে চোখ তুলে সাইনবোর্ডটার দিকে তাকালেন লাবণ্য। শ্বেত পাথরের ফলকে অপূর্ব রাবিন্দ্রিক ঢঙে লেখা রয়েছে — শেষের কবিতা – — বাহ! অসাধারণ! আবার মনে মনে ভাবলেন লাবণ্য। বৃদ্ধাশ্রমের জন্য এর থেকে ভালো নাম আর কিই বা হতে পারে?যিনি এমন নাম নির্বাচন করেছেন তার রুচির প্রশংসা না করে পারা যায় না। যখন জায়গাটার কথা প্রথম শুনেছিলেন তখন ওই নামটাই যেন তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছিল মনকে। তাই আগুপিছু না ভেবেই আবেদন করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেন নি।সঠিক জায়গাতেই এসেছেন। “ আসুন ম্যাডাম। আমি অসীম চক্রবর্তী। এই ওল্ডেজ হোম এর ম্যানেজার। আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ” সামনের কার্পেটে মোড়া চওড়া চওড়া সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এক ভদ্রলোক। মোটা সোটা গোলগাল চেহারা। হাসিমাখা চাহনি। স্মিত মুখে দু হাত সামনে জড়ো করলেন লাবণ্য। মনে পড়েছে। যখন প্রথম এদের এখানে যোগাযোগ করেছিলেন ইনিই কথা বলেছিলেন। “এসেই পড়লাম আপনার শেষের কবিতায়। কি বলেন ?” “সুস্বাগতম ম্যাডাম। লাবণ্য ছাড়া কি শেষের কবিতা মানায়?” বটে ! চমকিত হলেন লাবণ্য। ভদ্রলোকের রসবোধ কম নয়! “ আপনার ঘরটা দোতালায়। যেমন বলেছেন। চলুন দেখবেন। ও মালপত্র থাক। ওরা পৌঁছে দেবে পরে।” পিছনের দু একজন অল্পবয়সী ছোকরার দিকে ইঙ্গিত করলেন ভদ্রলোক। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না।কি মনোরম বিকেল!পাহাড়ের গায়ে একটু পরেই সূর্যাস্ত হবে।রঙিন আলোর ফুলঝুরি ছুটবে শিখরে শিখরে।এমন সময় কি ঘরে থাকা যায়? ওদিকটায় একটা বাগান আছে বলে মনে হচ্ছে। কি চমৎকার! অজস্র মরসুমী ফুল আর গোলাপে যেন নন্দন কানন। একটা পুকুরের মতও দেখা যাচ্ছে না? বাহ্!বাহ্!বাগান সঙ্গে জলাশয়! তার ওপরে ওটা কি ? এপার থেকে ওপারে যাবার সেতু! রঙিন! কাঠের ওপর নকশাদার আল্পনা কাটা!কি অপূর্ব! ও: মন যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। “ ওদিকটায় একবার যেতে পারি ?” “ নিশ্চয় ম্যাডাম। সব তো আপনাদেরই জন্য।” “ এমন বাগান !” মুগ্ধ চোখে চাইলেন লাবণ্য। “ হ্যাঁ। বাগানটা খুবই সুন্দর আমাদের। আসলে যার জমিতে এই বাড়ি গড়ে উঠেছে তার বাগানের শখ ছিল। আর জায়গার যখন অসুবিধে হয় নি তখন আর বাগানটা নষ্ট করে কি লাভ?” ভাগ্যিস।মনে মনে ভাবলেন লাবণ্য। “ আপনি দেখুন না — ঘুরে ঘুরে দেখুন। বসার্ জন্য চেয়ারের ব্যবস্থাও আছে।আমি বরং এক কাপ চা পাঠিয়ে দিই। ঘরে মালপত্র গুলোও উঠল কিনা দেখি গে যাই।” ব্যস্ত সমস্ত হয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক। মনে মনে হাসলেন লাবণ্য। কাজপাগল মানুষ। তারপর এগোলেন সামনের দিকে। যখন শিলং পাহাড়ে থাকতেন ফুলের শখ বড় বেশি ছিল। ওখানে প্রকৃতি যেন অকৃপণ হস্তে সাজিয়ে রেখেছিলেন সব। বেড়ে ওঠা ওই রকম এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশে। তাই তার প্রভাবও পড়েছিল চরিত্রে। ওই নিস্তব্ধ, ধ্যানগম্ভীর পর্বতমালা, নিবিড় বনানী, বন্ধন হারা ঝর্না এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি করেছিল তার স্বভাবে। সেইজন্যই হয়ত সারা জীবন শহুরে , মেকি জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে চলতে পারলেন না। ওই প্রকৃতির কোল থেকে টেনে ছিঁড়ে নামিয়ে রুক্ষ কঠিন নগর জীবনে জুড়ে দিল ভাগ্য। জীবনসঙ্গী মানুষটিও ছিলেন ঘোর বাস্তববাদি। লাবণ্যর ছোট ছোট চাওয়াগুলো সেরকম মূল্য পেত না তার কাছে। তবে –– নিজের মনেই মাথা নাড়েন লাবণ্য। স্বামী হিসেবে খারাপ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তবু দুটো প্রাণ প্রায় চৌত্রিশ বছর একসাথে থেকেও মিলতে পারল না। শুধু মানিয়ে চলা। মেনে চলা। সংসারের সব দায়িত্ব মুখ বুজে পালন করা। আর আজ! এতদিন পর হঠাৎই যেন মুক্তির আস্বাদ পাচ্ছেন লাবণ্য। এই নির্জন শৈল শহরের এই নিরালা বৃদ্ধাশ্রমে আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগছে মনে। “ একি লাবণ্যে পূর্ন প্রাণ– প্রাণে এসো হে —” চমকিত হলেন লাবণ্য। এমন উদাত্ত কণ্ঠে কবির গান কে গায় ? গলাটা যেন বড্ড চেনা চেনা! কোথায় ? কবে শুনেছেন এই কণ্ঠ? একটা অদ্ভুত প্রাণের সংযোগ যেন ওই গানের সাথে! কে গাইছে? এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালেন লাবণ্য। চেয়ারে তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন একজন। একমাথা কাঁচা পাকা চুল। অগোছালো। আপন খেয়ালে এলোমেলো হাতে রক্ষিত। দীর্ঘ, ঋজু চেহারা। কে? সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর পরক্ষনেই বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলেন। গান থেমে গেল। সম্ভবত সামনে কেউ এসেছে আন্দাজ করেই চোখ খুলেছেন উপবিষ্ট ব্যাক্তিটি। “ কে ?” একঝলক অশ্রু হঠাৎ এসে কণ্ঠ রোধ করে দিল লাবণ্যর। আজ এত বছর পর! আবার যে দেখা হবে কখনো তো ভাবেন নি একটিবারের জন্যও!এইজন্যই কি এই জায়গা এভাবে টানছিল তাকে! এই দিনটির জন্য! “ বন্যা ! তুমি ! “ মিতা! তুমি এখানে? কবে থেকে? ” “ আমি তো এখানে অনেকদিন এসেছি। কিন্তু তুমি হঠাৎ — মানে এই বৃদ্ধাশ্রমে! এখানে তোমায় দেখব আশা করি নি।” “ জানি। তবু দেখা হল। কেমন আছো মিতা ?” “ আমি চির বাউন্ডুলে। যেমন ছিলাম তেমনি আছি। আমার নামেরই মত। সীমিত কিছুতে আটকে থাকতে পারি না। জানোই তো। কিন্তু বন্যা তুমি কত বদলে গেছো!” “ কি রকম ?” “ তোমার সেই হরিণ নয়ন ঢেকেছে ভারী চশমার কাচে। সেই তনুদেহটি ঈষৎ ভারী। এখন আর কালো পাড়ের আঁচলটি মাথায় তোলো না বুঝি? হাতে নাও না সেই চমৎকার বেতের ঝুড়ি ?” গভীর চোখে চাইলেন লাবণ্য। “ সব মনে আছে মিতা?” “ সব । সব বন্যা। ” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখে চোখ ফেলে তাকালেন লাবণ্য।হৃদয়ে একটা ব্যাথা অনুভব করলেন হঠাৎ। সেই উজ্জ্বল চোখে এখন আর দীপ্তির স্বচ্ছতা নেই। নেই সেই উদ্দামতার আবেশ! সেই অবুঝ ছেলেমানুষী মাখানো চিবুকে নেই জেদের চিহ্নও। সেই মিতা! সেই শিলং পাহাড়ের দিনগুলো! সেই উজ্জ্বল প্রভাতের আলোয় দুজনের বেড়িয়ে বেড়ানোর অগুন্তি মুহূর্ত! “ কেতকী কোথায় মিতা ?” “ বছর দশেক হল মারা গিয়েছে। ছেলে বিদেশে থাকে।কোন পিছুটান নেই। তাই আমিও সব গুটিয়ে নিয়ে এইখানে চলে এলুম। এখন ভাবছি ভাগ্যিস এসেছিলুম।” উত্তর দিয়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন লাবণ্য। “ চল। ওদিকটায় ঘুরে আসি।” “ চল। কিন্তু তোমার কথা তো কিছু বললে না বন্যা।” “ সেরকম কিছু বলার নেই মিতা। মেয়ে বিবাহিতা। মায়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে না কিন্তু কারুর বোঝা হয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। তাই —–” “ ভালই করেছ। দেখো বন্যা। যেমনটি তুমি চেয়েছিলে এখানে সেই স—-ব আছে।” “ মানে?” “ বাহ্ ! মনে নেই? কথা হয়েছিল যে তোমার আমার বাসস্থানের মধ্যে থাকবে এক ছোট্ট নদী।তার এক পারে হবে তোমার বাড়ি। অন্যদিকে আমার।নদীতে থাকবে এক অপূর্ব সাঁকো।তুমি সাঁকো পেরিয়ে আমার কাছে আসবে অথবা আমি যাব তোমার আহ্বানে। রঙিন কাগজ লিখে দেবে আমন্ত্রণ লিপি – এখানে অবশ্য নদী নেই। কিন্তু পুকুরটিও মন্দ নয়। কি বল?” হেসে ফেললেন লাবণ্য। “ মিতা দিন যে বদলেছে। আর কি তা হয়? ” “ বদলেছে! তাহলে বন্যা — আমাদের যে দিন গেছে তা কি একেবারেই গেছে?” গভীর চোখে তাকালেন লাবণ্য। “ মিতা রাতের সব তারারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।”