জামাই ষষ্ঠী
সলিল চক্রবর্ত্তী
গোপাল বক্সীর আজ বছর পাঁচেক হলো কারখানা লকআউট হয়ে আছে। হঠাৎ করে লকআউট হওয়ায় টাকা পয়সার হিসাব ও পাননি। মৃতপ্রায় কারখানাটি ধিকধিক করে চলছিল, বাদ সাধলো দাবিদাওয়া। ইউনিয়ন লিডারদের কথা মতো চলতে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও নেতাদের কথা মানতে বাধ্য। আজ পাঁচ পাঁচটা বছর নুন আনতে পান্তা ফুরোনো অবস্থা। ঈশ্বরের কৃপায় তিনটি মেয়েকে কারখানা বন্ধের আগে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময় সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। ছেলেটি সবার ছোট, সে এখন তার ব্যাক্তিগত খরচই জোগাড় করতে পারে না। দুশ্চিন্তার ভারে গোপাল বাবুর বয়সটা আসল বয়সের থেকে অনেকটা বেশীই মনে হয়। হাই পাওয়ারের চশমা চোখে ,মুখে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরেঘুরে ধার দেনা করে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছোট জামাই কর্মসূত্রে থাকে দুবাই, বিয়ের পর মেয়েকে শশুর বাড়ীতে রেখে সে বিদেশে চলে যায়। ইচ্ছে করলে তো আর ফিরতে পারে না, ফলে এখনো পর্যন্ত জামাই ষষ্ঠীতে আসতে পারেনি। এবার জামাই ষষ্ঠীতে ছোট জামাই কলকাতাতে থাকায় বক্সী গিন্নি গোপাল বাবুর সাথে আলোচনা না করেই ,ছোট জামাইকে জামাই ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। একই জায়গাতে বাকি দুই জামাইকে তো বাদ দেওয়া যায় না।
নিমন্ত্রনের খবরটা গোপাল বক্সীর কানে যেতেই তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বার-তের জন মানুষের একদিনের খাবার আয়োজন করা যে কি দুঃসাধ্যের ব্যাপার তা একমাত্র তিঁনি আর তাঁর সমগোত্রীও কেউ বুঝতে পারবে।
সাধাসিধে নির্ভেজাল মানুষটি বেরিয়ে পড়লেন অর্থান্বেষণে। ধারের ব্যাপারে তিঁনি বড়ই সন্ধিহান, কারণ যেখানে যা ধার করেছিলেন কথা মতো শোধ করতে পারেননি। পাড়ার মুদি দোকানদাররা মনে হয় না ধার দেবে। অনেক ভেবেচিন্তে গেলেন কারখানার ইউনিয়ন লিডারের বাড়িতে। যদি কারখানার পাওনা গন্ডা থেকে কিছু মেলে। ঝান্ডা নিয়ে মিটিং মিছিলে প্রথম সারিতে থাকতেন বলে ইউনিয়ন লিডার রজত সাহা গোপাল বক্সীকে চিনতেন।
বিশাল ঝাঁ চকচকে তিনতলা বাড়ি, বাড়ির সামনে সিকিউরিটি আছে। গোপাল বাবু তার কাছে গিয়ে রজত বাবুর সাথে দেখা করার আর্জি জানালেন। আধ ঘন্টা পর রজত বাবু দেখা করলেন। গোপাল বক্সীর মুখ তাঁর চেনা ,তবুও মুখে একটা বিরক্তি প্রকাশ করে জানতে চাইলেন কেন তিনি এসেছেন। গোপাল বাবু সংক্ষেপে বললেন -” স্যার, বাজারে অনেক ধার দেনা হয়ে গেছে, সেই জন্য আপনার কাছে আসা।”
—- হ্যা, আপনাদের ভালোর জন্য তো আমাদের পার্টি মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে অবিরত লড়াই করে চলেছে।
—– জানি স্যার, তবুও যদি আমার পাওনা টাকা থেকে কিছু ব্যাবস্থা করে দেন। কাতর অনুরোধে কথাগুলো বললেন।
—- আরে ওই ভাবে দুম করে চাইলেই কি হয় নাকি!! টাকা কি আমার কাছে, যে আমি দেব। মুখের বিরক্তি আরো বেশি করে ফুটে উঠলো। বৃদ্ধ গোপাল বাবু প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন -” একটু দেখুন স্যার, আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সুইসাইড করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।”
রজত বাবু একটু নরম হয়ে বললেন —” ঠিক আছে সপ্তা দুই পর আসুন দেখি কি করা যায়!”
এক বুক হতাশা নিয়ে গোপাল বাবু রজত বাবুর বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। কাল যে জামাই ষষ্ঠী, কিংকর্তব্যবিমূঢ় গোপাল বাবু অর্থান্বেষণে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে ,বিফল হয়ে নিজ এলাকাতে ফিরে এলেন। তাঁর মাথা কাজ করছে না। অন্তত হাজার দুই টাকা না জোগাড় করতে পারলে তো জামাই ষষ্ঠী পর্ব থেকে নিষ্কৃতি নেই। এমতাবস্থায় গোপাল বাবুর মনে হলো- পাড়াতে একটা নতুন মুদি খানার দোকান হয়েছে, সাজানো গোছানো দোকান,ছাব্বিশ সাতাশ বছরের সদালাপী দোকানদার সোমনাথ ঘোষাল, হবে নাই বা কেন, বুদ্ধিমান ছেলে ,শিক্ষিত যে,পরিচয় নেই তবুও একবার যাবেন, যদি কোনো সুরাহা হয়।
দোকান ফাঁকাই ছিল, ফলে গোপাল বাবুর ধার চাইতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হলোনা। ভয় ছিল প্রতিবেশী কেউ থাকলে হয়তো ইশারা করে সোমনাথকে বাকি দিতে বারণ করে দিত। সাধাসিধে গোপাল বাবু দোকানে গিয়ে সোমনাথকে তাঁর সব কথা বলেন—– ” দেখো বাবা,তুমি তো আমার সব কথা শুনলে, এখন যদি তুমি প্রয়োজনীয় মুদি মশলাটা আমাকে দাও তো আমার মানটা বাঁচে। আমি তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব। তবে টাকাটা তুমি পাবে দুই সপ্তাহ পর। রজত বাবু আমাকে তেমনটিই বলেছেন।”
সোমনাথ তাঁর অসহয়তা উপলব্ধি করে আর না করতে পারলো না। ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তে ধার কোনো মতেই দেয়া যায় না। সব থেকে বড় কথা সোমনাথ শুধু মাত্র তাঁর মুখ টুকুই চেনে, তাঁর পরিস্থিতির কথা ভেবে বললো—” বলুন কি কি লাগবে? গোপাল বক্সী সাত আটটা মালের একটা ছোট লিস্ট করে দিয়ে, একটু নিশ্চিন্ত হয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে দোকানের পাশে একজায়গায় বসে ধূমপান করতে থাকেন। আর সোমনাথ অন্য খরিদ্দার সামলিয়ে তার ফাঁকে গোপাল বাবুর মালটা রেডি করতে থাকে। সেই সময় দোকানের সামনে দিয়ে বক্সী গিন্নী যাচ্ছিলেন, গোপাল বাবুকে বসে থাকতে দেখে কাছে এসে কারণ জানতে চাইলেন। গোপাল বাবু সবিস্তারে স্ত্রীকে সকাল থেকে যা ঘটেছে বললেন। স্ত্রী সব কথা শুনে বললেন-” সব তো হলো কাল সকালে কাঁচা বাজারের কি হবে? বার তেরশ টাকা তো লাগবেই, মাছ, মাংস, সবজি, ফল,মিষ্টি— গোপাল বাবু বিড়ির শেষ টানটি দিয়ে বিড়িটা ফেলে বললেন -” দেখি কার কাছে গিয়ে হাত পাতা যায়!!!” স্ত্রী একটু অভিমানের সুরে বললেন -” কে আর তোমাকে ধার দেবে? তার থেকে আমি বলি কি-আমার একটা সোনার চুড়ি আছে ওটা–গোপাল বাবু স্ত্রীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন -” না – না, তোমার সব বেচে খেয়েছি, বানিয়ে দিতে পারিনি কিছুই। শেষ সম্বল ওই একটা চুড়ি , ওটা থাক।” বক্সী গিন্নি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন -” যা পারো কারো, আমি ওদিকটা দেখিগে।”
দুজনের কথোপকথন হাতের কাজ করতে করতে সোমনাথ সব শুনলো। তারপর মুদি মসলা গুলো রেডি করে গোপাল বাবুকে ডাকলো। গোপাল বাবু মালটা নিতে নিতে বলল– ” তুমি চিন্তা করো না বাবু, আমার বাড়ী পঞ্চানন্দ ঠাকুর মন্দিরের ঠিক ডান পাশে। টাকাটা হাতে এলে আমি দিয়ে যাব।” সোমনাথ গোপাল বাবুর ভাগ্যের পরিহাসের কথা ভেবে, মুখে বলল ” ঠিক আছে”, মনে মনে ভাবল — হায়রে সামাজিকতার দায়বদ্ধ শশুর, দায়ের যাঁতাকলে পড়ে নিজের মান, সন্মান টুকুও পিষে ছাতু হওয়ার জোগাড়।
পশ্চিমবঙ্গের একটা অর্থনৈতিক উৎসব এই জামাইষষ্ঠী। জামাইরা সারা বছরে কতবার শশুর বাড়ীতে আসে সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। এই নির্দিষ্ট দিনে মেয়ে জামাই,যদি অপত্ত থাকে তারাও সবান্ধবে সসম্মানে শশুরালয়ে উপস্থিত হন। শশুর মশাইকেও চর্ব্য, চোষ্য,, লেহ্য পেয় সহকারে আপ্যায়ন করতে হয়। হেঁসেলের গুণমান বাড়াতে অগ্নি মূল্য বাজারই যথেষ্ট। আপাত নয়নে সবই সুন্দর লাগে,ব্যাবসায়ীরা কত টাকা ঘরে তুলছে তার হিসাব করছে, শাশুড়ি মাতা কতটা জামাই আপ্যায়ন করা যায় সেই চিন্তায় নিমগ্ন। শাশুড়ি মাতার সেই ইচ্ছাকে সামাল দিতে দুই হাত ভোরে শশুরকুল খরচ করছে। এতো পর্দার সামনের দিকের চিত্র, আর পেছন দিক!!
দিনমজুর, হকার, ফুটপাথ ব্যাবসায়ী, ছোটোখাটো কাজ কর্ম করা শশুরকুলদের ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে যায়। ধারদেনা করে সামাজিকতা পালন করতে হয়। আবার যাদের নূন্যতম আয় টুকু নেই, কল কারখানা বন্ধ হয়ে আছে, যা গোপাল বক্সীর ক্ষেত্রে হয়েছে। জামাই ষষ্ঠীর গুরুত্ব বড়লোক বা গরীবলোক সবার ক্ষেত্রে এক, শুধু অর্থের পার্থক্য।
রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ ধূমায়িত চা খেতে খেতে কথা গুলো সোমনাথ ভাবছিল। গোপাল বাবুর তিনটি মেয়ে, তাদের সন্তান, ভাগ্যিস ছেলের বিয়ে হয়নি। মা ষষ্ঠীর কৃপা না পেয়ে যদি মা লক্ষ্মীর কৃপা পেতেন তাহলে হয়তো এমন দুঃসমযের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গোপাল বাবুর ওপর সোমনাথের করুনা হলো। কি জানি আগামী কালকের বাজার খরচটা জোগাড় করতে পেরেছেন কিনা! সোমনাথ মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিল যে আগামী কাল সকালে দোকান খোলার আগে গোপাল বক্সীর বাড়ী যাবে। তখন যদি তিনি টাকাটা জোগাড় করতে না পারেন তবে বারোশ টাকা ওনার হাতে দিয়ে বলবে যে , গোপাল বাবুর হাতে টাকা এলে যেন একসাথে মুদি মসলার টাকা এবং নগদ টাকাটা দিয়ে দেন।
গোপাল বক্সী সমস্ত বিকালটাই ব্যায় করলেন, এ- দোর ও- দোর ঘুরে ঘুরে ,যদি হাজার বারশ টাকা ধার পাওয়া যায়। অবশেষে নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। বেশির ভাগ লোক পালটা তাদের অসুবিধার কথা জানিয়েছেন, কয়েক জন অবশ্য ধার দিতে চাননি, তবে পঞ্চাশ একশ টাকা সাহায্য করতে চেয়ে ছিলেন। গোপাল বাবু হাত পেতে তা নিতে পারেননি। সন্ধ্যার পর বাড়ী ফিরে মনমরা হয়ে চুপ করে চৌকির উপর বসে আছেন। বক্সী গিন্নী এক কাপ চা দিয়ে বললেন -” বিকালে চা না খেয়ে কখন বেরিয়ে গেছো বলেও যাওনি, টাকার কিছু ব্যাবস্থা হলো?” গোপাল বাবু গিন্নীর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন-” গরীব মানুষের হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়, আগুপিছু ভেবে চিন্তে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।” চা খেতে খেতে আপন মনে বলতে থাকেন-” নিজের কত টাকা মালিকের কাছে পড়ে আছে, আর কটা টাকার জন্য ভিখারীর মতো মানুষের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাকে দেখেই পরিচিত মানুষেরা পালাবার চেষ্টা করে। হা ভগবান এই ছিল কপালে।”কথা গুলো বক্সী গিন্নীকে না শুনিয়ে বললেও তিঁনি শুনতে পেয়ে বললেন-” বললাম কারোর কাছে যেতে হবেনা, এই চুড়িটা বিক্রি করে কাজ মিটিয়ে নাও, তা আমার কথা শুনলে তো!!” মাথায় হাত দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপাল বাবু বললেন-” কাল সকালে হয়তো তাই-ই করতে হবে।”