নেপো ভুতের ছানা
সলিল চক্রবর্ত্তী
“সোনাই আর দু-বার নিলেই খাওয়া ফিনিশ, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও বলছি, না খেলে এবার কিন্তু নেপো ভুতের ছানাকে ডাকবো। নেপো ভুতের ছানা এসে সব মাছ ভাত খেয়ে যাবে——
আয় রে আয় নেপো ভুতের ছানা,
তোকে কেউ করবেনা মানা।
গাছের ডালে বসে খাবি-
নিত্য নুতন খানা।
মাছ ভাজা আর ডিম সিদ্ধ-
আরও আছে অনেক খাদ্য,
খেতে চাস যদি ডালিয়ার খিচুড়ি-
চলে আয় তুই খুব তাড়াতাড়ি।”
সোনাই, একটি বছর তিনের এর মেয়ে, কথার বহরে সে পাঁচ বছরের শিশুর সমান। তাকে নিয়ে বাড়ীতে কারোর কোনো সমস্যা নেই, একমাত্র খাওয়া ছাড়া। ছোট্ট আধ বাটি ভাত সঙ্গে একটু মাছ ভাজা খেতে তার পাক্কা দুই ঘন্টা সময় লাগে। তাও সবটা খায় না। মা, দিদার চিৎকার প্রতিবেশীদের বুঝিয়ে দেয় সোনাই এখন খাচ্ছে। সোনাই দুই গালে দুই দলা ভাত নিয়ে গালটা ফুলিয়ে জানালা ধারে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে , “কোথায় ভুতের ছানা?” ওর মা চোখ বড় বড় করে বলে -” তাড়াতাড়ি খাও এখুনি এসে পড়বে।” সোনাই মুখের ভাত না গিলেই বলে-” আগে ভুতের ছানা দেখি!— ইত্যাদি ইত্যাদি।” সোনাইএর মা বানিয়ে বানিয়ে ছড়া ধরে—
“গাছের ডালে বসে আছে-
নেপো ভুতের ছানা,
মাথাটি তার কলসির মতো-
চোখ দুটি নয় কানা।
দাঁতগুলো তার মুলোর মতো-
কান যেন তার কুলো,
হাড় সাজানো শরীর খানা-
নয়তো মোটেই তুলো।
চোখ দুটি তার ভাঁটির মতো-
,জ্বলতে থাকে রাতে,
দস্যি মেয়ের খোঁজ পেলে সে-
ধরতে আসে তাকে।
এটাই ছিল রোজকার রুটিন। এদিকে ,সোনাইদের বাড়ীর পশ্চিম দিকে ছিল এক প্রকান্ড পুরোনো পাকুড় গাছ। সেই গাছে সত্যি সত্যি নেপো ভুতের সাত পুরুষের বাস। নেপো ভুত , তার বউ পেত্নী, আর তাদের ছানা, এই তিন জনের ছোট্ট সংসার। পেত্নীর এই জায়গাতে থাকার একদম ইচ্ছা নেই। চারদিকে মানুষের বাস, তাদের কত ভয় দেখিয়ে টিঁকে থাকা যায়!! মানুষদের স্বভাব বড় গোলমেলে, একদিকে ভুতকে ভয় পায় ,আবার ভুত তুলেই যত বাচ্চা ভুলায়। পেত্নীর ইচ্ছা অন্য কোন বাগানে চলে যাবে, যেখানে ভূতই বেশি অর্থাৎ ভুতের পাড়া হবে। নেপো ভুত বউকে বোঝায় এটা তাদের সাত পুরুষের ভিটে বলে কথা, ছেড়ে গেলে চলে! ওদের ছানার নাম ডেপো, সার্থক নাম তার। বাবা মার কথা শোনে না একদমই। শুধু মানুষদের কাছে যাবে। ভয় দেখানোর মুরোদ নেই ,খালি মানুষের ছানা গুলো কি করে তাই দেখে ,আর গাছে এসে বায়না ধরে। একদিন সারারাত খেটেখুটে দিনের বেলা সবে নেপো গাছে ফিরেছে। ডেপো এসে নেপোকে জিজ্ঞাসা করলো -” বাবা মানুষেরা বলে, মানুষ মরলে ভুত হয়, তাহলে ভুত মরলে কি হয়? এত সব জটিল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষমতা নেপোর নেই। ডেপো বিজ্ঞের মতো বলে -‘ জাননাত, আমি জানি , ভুত মরে কাক হয়।” এই কথা শুনে পেত্নী চেঁচিয়ে ওঠে -” কি অলুক্ষুনে কথাবার্তা!! মানুষদের কাছ থেকে যা খুশি তাই শিখে আসছে। টিয়া, ময়না, কাকাতুয়া এত পাখি থাকতে শেষে কিনা কাক!! ডেপোর মাথাটাই মানুষেরা খারাপ করে দেবে। ফলে ডেপোকে নিয়ে পেত্নীর বড় চিন্তা।
কিছুদিন ধরে পেত্নী খেয়াল করছে ডেপো ভুতের গায়ে মানুষের গন্ধ। তার মানে মা বাবার কথা না শুনে মানুষে ধারে কাছে যাওয়া শুরু করেছে। সেদিন পেত্নী কত আশা করে ডেপোর জন্য চ্যাং মাছ পোড়া জোগাড় করে আনলো, তা ডেপো যদি একটু মুখে দেয়, বলে কিনা -” চ্যাং মাছ পোড়া খাবো না, ভাজা খাবো।” কখনো বলে চাউমিন খাবো, ক্যাডবেরি খাবো, একে বারে সমাজ ছাড়া কথা বাত্রা। এ সব কথা কি ভুতদের মুখে মানায়? সব ওই সামনের বাড়ীর বাচ্চাটাকে দেখে শিখছে। ওর মা, দিদার যা আদিখ্যেতা, মোরে যাই , মোরে যাই। অমন মা যেন কক্ষনো না হই। খাওয়াবি খাওয়া তা সব সময় আমাদের নাম নিয়ে টানাটানি কেন? আবার বাপ তুলে কথা বলে । আমরা কি তোদের খাবার খেতে গেছি! কৈ আমার ছানাকে তো মানুষের ভয় দেখিয়ে খাওয়াই না!!”
সোনাইকে ডেপোর খুব ভালো লাগে। সোনাই যখন যে পাখীকে নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কবিতা বলে, ডেপো অমনি তার সামনে সেই পাখির রূপ ধরে খেলা করে। সোনাই বেশ মজা পায় , ডেপোও খুশি হয়। ডেপো কখনো আসল চেহারায় সোনাইএর সামনে আসে না, পাছে যদি সোনাই ভয় পায়, তাহলে তো বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যাবে। যখন যে সময়ের ছোটখাটো ফল পাকে, ডেপো বড় পাখীর রূপ ধরে সেই ফল ঠোঁটে করে এনে সোনাইকে দেয়। সোনাইএর বাড়ীর লোকেরা একটু অবাক হয় বটে , তবে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।
সেদিন সোনাই জানালা ধরে আপন মনে ছড়া ধরেছে —–
আয় রে ময়ূর আয়,
নাচ দেখাবি আয়;
বড় বড় পাখা মেলে,
ছুটে চলে আয়।
সাপ ব্যাঙ তো ধরে খাবি,
না খুঁজে তুই আপেল পাবি;
আরো আছে শস্য দানা,
তাড়াতাড়ি আয়।
সোনাই এর সামনে গাছের ডালে বসে ডেপো ময়ূর সেজে নাচ দেখাতে থাকে, যেটা সোনাই ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায়না।
একদিন দুপুরে ঘটতে যাচ্ছিল এক বিরাট দুর্ঘটনা, সেদিন যদি ডেপো ভুত না থাকতো—
সোনাইএর মা আর দিদা কোমর বেঁধে সোনাইকে খাওয়ানোর যুদ্ধে নেমে পড়েছে। সোনাই খাবেনা বলে এঘর ওঘর ছোটাছুটি করছে। ওর মা, দিদা পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। সে এক মজাদার কান্ড কারখানা। ডেপো জানালায় বসে দেখছে এবং বেশ মজা পাচ্ছে। এরই মধ্যে সোনাই এঘর ওঘর করতে করতে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নামতে গেল। কয়েকটা ধাপ নামতেই পা পিছলে গেল। বাড়ী শুদ্ধু লোকজন চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ী মাথায় করে ফেললো। তারপর সবাই হঠাৎ করে একদম চুপ করে গেল। প্রত্যেকে নিজের চোখকে বিশ্বাস করত পারছিলনা, যা দেখলো তা কি সম্ভব!!! —– ভোজবাজির মতো, সোনাই পা পিছেলে পড়ার আগেই একটা ভল্ট খেয়ে মাথাটা উপর দিকে করে দাঁড়িয়ে পড়লো। সবাই ঠাকুরকে ধন্যবাদ দিতে থাকলো, কিন্তু আসল কাজটা যে ডেপো করলো সেটা কেউ বুঝতে পারল না।
পেত্নীর সমস্ত চেষ্টাই ব্যার্থ। ছানাকে আর ভুত করতে পারছে না। তার ঘাড়ে মানুষ ভর করেছে। ভুত সমাজে আর মুখ দেখানো যাচ্ছে না। ভুতদের আসরে গিয়ে সব ভুত ও তাদের ছানারা কত ভৌতিক কান্ড কারখানা করে , ডেপো সেখানে চুপ করে বসে থাকে। ভুতের ছানাদের আনন্দ ফুর্তির ধরন যেন তার একদম পছন্দ নয়। চিন্তায় পেত্নীর দিনের ঘুম ছুটে যাওয়ার জোগাড়। মায়ের মাথা ব্যাথা নিয়ে ডেপো ভুতের কোনো মাথা ব্যাথা নেই, সে সুযোগ পেলেই সোনাইদের জানালার ধারে চলে আসে। সোনাইএর দুস্টুমির কায়দা কসরত গুলো মনদিয়ে রপ্ত করে। সারাদিন না ঘুমিয়ে সোনাইদের জানালার ধরে বসে থাকবে, আর সন্ধে হলেই ঘুমে ঢুলতে থাকবে।
এদিকে সোনাই ক্যারাটে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, যোগা এবং ক্যারাটের কিছু প্রাথমিক পোজ শিখেছে। সোনাইএর মা বাড়িতে সোনাইকে খেলার ছলে প্র্যাকটিস করায়। হাত পা নাড়াচাড়া ডিগবাজি খাওয়া কসরত গুলো ডেপো শিখে নিয়েছে এবং গাছে ফিরে ডালে বসে দিব্যি নকল করে মজা পাচ্ছে।
এইসব কান্ড কারখানা পেত্নী তো কিছু জানেও না, বোঝেও না। সে ভেবেছে ভুতকে যদি মানুষে পায় তাহলে মনে হয় এমনিই হয়। পেত্নী কান্নাকাটি করে নেপোর সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দিলো। সে অনেক আগেই নেপোকে সাবধান করেছিল। নেপোর হয়েছে যত জ্বালা, সারারাত মাঠে ঘাটে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে দিনে এসে একটু ঘুমায়, পেত্নীর জ্বালায় তার উপায় নেই! পেত্নীকে বোঝায় ডেপো এখন ছোট বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন মানুষদের ঘেন্না করবে, ওর সামনে থেকে মানুষকে তাড়াবার জন্য ভয় দেখাবে। নেপো বোঝালে কি হবে, পেত্নী বুঝলে তো। অগত্যা নিরুপায় হয়ে ভুত পেত্নিতে মিলে ব্রহ্মদৈত্যের স্মরণাপন্ন হলো।
ব্রহ্মদৈত্যকে দেখলে ভুতেরাই ভয় পায়, মানুষ তো দুরস্ত। পেল্লায় চেহারা, গলায় গরু বাঁধা দড়ির মতো পৈতে, চোখে থালার মতো বড় কাঁচ লাগানো একটা চশমা, পায়ে কাঠের খড়ম। ন্যাড়া মাথায় বিরাট এক টিক্কি , বেল গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে হুঁকো টানে। ভীষণ রাগী , ভুতেরা তার নির্দেশ মতো চলে।
নেপো আর পেত্নী ডেপোর কথা সব ব্রহ্মদৈত্যকে বলল। ব্রহ্মদৈত্য চোখ বন্ধ করে নেপো আর পেত্নীর সব কথা মন দিয়ে শুনলো। তারপর হাতটাকে বাঁশের মতো লম্বা করে পাশে থাকা বট গাছের কোটর থেকে হুঁকোটা নিয়ে আসলো। দু চার বার হুঁকোতে টান দিয়ে চারদিক ধোঁয়া ধোঁয়া করে দিয়ে বলল–” দ্যাখ, সব ছানা ছানাই হয়,সেটা ভূতের হোক বা মানুষের। ওদের ভিতর ভুতত্ব বা মনুষত্ব কিছুই জন্মায় না। ওরা নিছক খেলার ছলে কাছাকাছি আসে, বড় হলে নিজেদের সমাজকে বুঝতে শিখবে,এবং দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হবে। এখন ডেপোকে মনের আনন্দে খেলতে দে, বাধা দিসনে, তাতে ডেপো তো খুশী হবেই তোরাও শান্তিতে থাকবি।”
পেত্নী ব্রহ্মদৈত্যকে ভুতেশ্বর মানে, ফলে পেত্নীর মনে আর কোনো দ্বিধা দ্বন্দ থাকলো না। পাকুড় গাছে ফিরে গিয়ে ডেপোকে সোনাইএর সাথে খেলার অবাধ অনুমতি দিয়ে দিল—
যা রে ডেপো যা-
সোনাইএর কাছে যা,
সে আছে যে অপেক্ষাতে-
বন্ধু আসবে এই আশাতে,
দ্বিধা দ্বন্দ থাকলো না আর-
খেলতে চলে যা।
—————————–/