চিরাগনামা…
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
উৎসর্গ : আমার মাতৃকূলের ধারাপতনে পাওয়া মজুমদার ও সরকার পদবীর সকলের জন্যই….
(১)
” যতই ভাবি করব মানা কাম ছাড়ে না … মদনে
ও….সাঁই….তবে আমি প্রেমরসিক হব কেমনে?”
অনেকক্ষণ থেকে একটাই কলি গেয়ে এবার বৃদ্ধ ফকিরটি একটু থামল। তারপর একট মাটির বদনাতে করে খানিকটা ঠান্ডা পানি নিয়ে এরপর আরাম করে ওর গলায় ঢালে।
….
এখন জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। তাই পুরো এলাকার মাটি তেতে আছে দোজখের আগুনে। প্রাঋ বৈশাখের পর থেকে একটুও বৃষ্টির দেখা নেই।সেজন্য জনমনিষ্যি সব বেমালুম জ্বলতে লেগেছে। মোর্তাজা মোল্লা এই এলাকার জায়গীরদার। ক’দিন আগেই সেরেস্তাদার পদ থেকে তার হয়েছে। মোল্লার কোহিতুরের আম বাগানটিতেও এবছর যেন বেফসলী মড়ক লেগেছে। লড়াইএর পর স্বয়ং নবাবজাদা কোতল হওয়ার সাথে সাথে মুকসুদাবাদের সাথে সাথে যেন একটা অনন্ত পালাবদলের মেঘও ঘনিয়ে আসছে শাহী হিন্দুস্তানের খুশির আসমানে। অবশ্য দিল্লীরও অবস্থা যে খুব একটা ভাল তাও ঠিক নয়। সমস্ত দেশটাই তো ইদানীংকালে নানা সমস্যায় ধুঁকছে। আর সেই সুযোগে লাল রঙের বাহারি সাঁজোয়া পোশাক পড়া ফিরিঙ্গী ফৌজ ঢুকে ওলন্দাজ,আর্মানী, পোর্তুগীজ আর হিস্পানিওলাদের সবাইকে হটিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে কায়েম করে নিচ্ছে তখত্ এ তাউসের আপাত অটল মসনদ।
……
এটা এমনিতে সিদিকপুরের কাছে একটা অজ পাড়া-গাঁ। এখান থেকে বিস্তীর্ণ একটা লালচে কাঁকুড়ে মাটির ধূলোমাখা পথ অনেকদূরপর্যন্ত চলে গিয়ে আস্তে আস্তে গিয়ে শেষ হয়েছে মদিনা মহলের সীমানাকে ছাড়িয়ে আরও দূরে সেই ‘দাফন্ বাগের ‘ পথে।
গাঁয়ের সম্ভ্রান্ত তাঁতি মিসির জোলা’র মেয়ে আসরফি এবারে একটু গুড় আর বাতাসা এনে ওই ফকির বৃদ্ধটিকে ঠান্ডা পানির সাথে খেতে দেয়। পাশের গ্রাম দেউলপুরে ওর নিজের চাচাতো ভাই মিয়াজানের বেটা ‘ নওয়াজউদ্দিন ‘ এই ক’মাস হল নবাবের পল্টনে গোলন্দাজের কাজ পেয়েছে। তাই সামনের শাহ্ওয়ালেই আসরফি’র সাথে ওর শাদীর বায়নানামা মঞ্জুর করে এসেছে মৌলবী ইমাম হোসেনের সনির্বন্ধ তদারকিতে।
…..
গৃহস্থের নামে মোনাজাত জানাতে জানাতে সে বৃদ্ধটিও তা তখুনি হাতে তুলে নেয়। বড় খুশী হয়ে সে যখন চারদিন উপোসের পর সেটুকু তুলে আজ মুখে দেয় তখন তার অজস্র ভাঁজ পড়া সাদা দাড়ি গোঁফের ফাঁক দিয়ে উঠে আসা একধরণের অপার্থিব হাসি ছড়িয়ে যায় শিস্ মহলের হাজার আর্শিতে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু তৃপ্তির টুকরো টুকরো তসবিরের মতন।
জলপানের কিছুক্ষণ পরে ফকিরটি এবার পথের দিকে পা বাড়ানোর উপক্রম করতেই বছর তেরোর আসরফি তার মেহেদী রাঙানো হাতে আরও খানিটা চিঁড়ে আর গুড়ের ঢেলা নিয়ে ফকিরের নক্সীকাটা ঝুলিতে এনে ঢেলে দেয় নিশ্চুপে।বাপের হাতে মেহনতের মেজাজে চলা তাঁতের খটাংখটাং শব্দ আর বৃদ্ধ ফকিরের খটখট আওয়াজ তোলা চপ্পলের সাথে মিলিয়ে আসতেই সে আন্দাজ করে দুপুর গড়িয়ে এবারে যেন বেলাটাও পড়ে আসছে।
……
একদলা ঘুম আর স্বপ্নিল যাপনের অভ্যেসটা কাটিয়ে চোখ মেলাটা যেন নেহাৎ সহজ কাজ নয়। রবিবারে ঘুম ভেঙে মানসিক হোমের গথিক ঘরানার জানলা পথে আসা একটা তির্যক রোদের চাবুক এসে কমলিকার চোখদুটোকে ক্রমশ পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
সিস্টার কাজরী এসে ওর মুখহাত ধুয়ে দিয়ে যেতেই কমলিকা ব্রেকফাস্টের রুটি আর দুধ না স্পর্শ করে আরো কিছুক্ষণ থম্ মেরে বসে থাকল।
এই মানসিক সেবাকেন্দ্রটি সবে দু’বছর হল খুলেছেন ফাদার অতনু হেমব্রম বলে একজন প্রবীণবয়সী মানুষ। যাজক হওয়ার পূর্বে এই মনোবিদটি ডক্টর অতনু হেমব্রম নামে খ্যাত ছিলেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে দিল্লীতে থেকে সামলেছেন ভারতের শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞান সংস্থায় ডিন্ এর গুরুদায়িত্ব।
এখন সবে পাঁচবছর হল সে সমস্ত সংশ্রব ত্যাগ করে খ্রিষ্টের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করে
‘ আপন আলয়’নামে এই হোমটি তৈরী করে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার সিনড্রোমের চারজন রোগীকে নিয়ে চেষ্টা করছেন মূল জীবনের স্রোতে শীঘ্রই ফিরিয়ে আনতে।
এই চারজনের মধ্যে কমলিকাই সবচেয়ে কমবয়েসী ও আপাতভাবে এক অদ্ভূত রোগের শিকার। বছর কুড়ির কমলিকা হঠাৎ হঠাৎ করে মাসে দু-তিনটে রাত্রিবেলা দীর্ঘসময় ধরে ঘুমিয়ে পড়ে ও তারপর জেগে ওঠার পরে আরও বেশ কয়েকদিন ধরে সে যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। জাগৃতির পরেও বেশ অনেকদিন ধরে রেশ চলে তার সেই ঘুমের মধ্যে দেখা নিভৃত স্বপ্নচারণের।
আসলে জেগে ওঠার পরেও সে পরপর কয়েকদিন ধরে ওর স্বপ্নে দেখা কোন একটি চরিত্রের ভাবে তন্মধ্য থেকে অস্বস্তিকর আচরণ করতে থাকে। যেন সেই স্বপ্নময়তার মায়াকাজলটি লাগিয়ে সে হয়ে উঠতে চায় সেই চরিত্রটির মানসকন্যা বা অনুসৃতা।
……..
এখন ওর সেই অবস্থাটাই চলছে। একসপ্তাহ হয়ে গেল নিজের নাম জিজ্ঞাসা করলে সে সহজে বলেনা। আবার কখনো কখনো ” মরিয়ম”, “নানী বেগম ” বা ” রাজ কুঁয়ার” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। তবে সব চেয়ে বেশী সে ” লুফি বেগম” নামের এক কল্পলোকের চরিত্রর সাথে আপনমনে বেশী কথা বলে আর কাঁদে। সিস্টার শুনেছেন যে কমলিক এসব কথা বলার সময় ওর মুখে আশ্চর্যভাবে বেশ কিছু অপ্রচলিত ফারসী আর উর্দু বয়েৎের আশ্চর্য সব ধ্বনি বেরতে থাকে নিজের অগোচরেই।
(২)
– ” লাস্ট ইয়ারে পরীক্ষার পর ওর অবসরের ছুটিতে আমরা একবার বহরমপুরের বেড়াতে যাই। অবশ্য তখন ওর মা মানে আমার স্ত্রী সুচন্দ্রা জীবিত ছিলেন। সেবারের ট্রীপে হাজারদূয়ারী হয়ে মোতিঝিলের উদ্যানে আমরা থেমেছিলাম। সেখানকার এক বাহারী দোলনায় উঠে দোল খেতে খেতে হঠাৎ কমলিকা ওর ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে উল্টে পড়ে ও সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। মিনিট দশেক পর জ্ঞান ফিরলে ও বেশ খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে সবটা দেখছিল। বুঝতে পারছিলাম যে ও আমাদেরকে কাউকেই ও কোনভাবে তখন ঠিক আইডেনটিফাই করতে পারছিল না ! ”
…
আফশোসের সুরে বলতে বলতে মধ্য পঞ্চাশের কৃতী অধ্যাপক অতীন্দ্রবাবু তাঁর হালফ্যাশানের সোনালী চশমাটা খুলে একটু যেন উদাস হয়ে খানিকক্ষণ ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সদ্য স্ত্রী বিয়োগ ও একমাত্র মেয়ের এই মানসিক বৈগুণ্যের চাপে উনি এখন কার্য্যত বেশ দিশেহারা।
সুগন্ধী রুমালে মুখটা একটু মুছে নিয়ে সবিনয়ে উনি বললেন যে মেয়ে এখন একটু সুস্থ হলেই সবটা নিশ্চিন্তি। সামনের এপ্রিলেই ওকে নিয়ে ওনাদের দু’জনেরই ভবিষ্যতের বাকী জীবনটার জন্য বাপ-মেয়ে মিলে পাড়ি দেবেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে। ওঁর ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দোলজি বিভাগে অধ্যাপনার আহ্বানের কথাটা পাকা হয়ে গেছে। এখন কেবল ও দেশে যাওয়াটিই যা শুধু অনির্দিষ্টকাল ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে মেয়ের অসুস্থতার জন্য। এখন কমলিকার চলনসই গোছের সুস্থ হতে একমাসের বেশী দেরী হলে ওখানে সেটল্ করার সুযোগটি ফস্কাবে।
…….
আসরফী বাপকে লুকিয়ে খিড়কীর দরজা খুলে একটু বাইরে এল। এখান থেকে একটা লালচে মাটীর শুঁড়িপথ ” দাফন্ বাগে”র পথে গিয়ে মিশেছে। ও এখন একজনের খোঁজে সেদিকেই যাবে। কিছু দিন আগে অনেক লোক লস্কর, কোম্পানীর হাবিলদার সব ওখানে এসে কোনওমতে ছিন্নভিন্ন হওয়া লাশের ছোটে নবাবজাদাকে এসে গোর দিয়ে গেছে। যদিও ওই লাশ যে আসলে নবাবের অন্যায়ভাবে অবসৃত ও খুন হয়ে যাওয়া শতচ্ছিন্ন ও ধ্বস্ত মৃতদেহ সেটা এদিনের আগে ও অতটা ভাল জানত না।
এসবের অনেকদিন পরে এটা ওকে জানিয়েছে আর এক অন্য আওরাত। যে কালো ওড়নায় সারাক্ষণ মুখ ঢেকে থাকে আর ওই বাগিচার ভেতরে একটা কুটিরের ভিতরে থাকে আর প্রায় এখানকার গোর গুলোতে রোজ চিরাগ জ্বেলে কাঁদতে কাঁদতে কুরআন শরীফ পড়ে ।
যদিও তার নাম জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি
তবে তার সেই নিবিষ্ট কন্ঠের মোনাজাত ওখানে এন্তেকালের পর ঘুমিয়ে থাকা সব মূর্দাদের সবাইকে বেহেস্তের পথে রওনা করার জন্য রোজ দোয়া চাইতে বসে। আর তার প্রার্থনার সেই সুরের চিকন মেজাজটিও যেন তার সাথে নিয়ে খানখান হয়ে ছড়িয়ে যায় কাছেই বয়ে চলা ভাগীরথীর স্রোতে।
…….
বুঝতে হয় যে একজন মসনদের মালিক বদলে গেলে ফেলে আসা সবকিছুরও তার সাথে হাল হকিকৎও বদলে যায়।
নইলে বঢ়ে নবাব আলীবর্দী খাঁর পেয়ারের সেই ” খুশবাগ্” এর ফুল-ফলের সাধের বাগিচা আজ পরিবারের সবার লাশের “দাফন্ বাগে” বদলে যাবে কেন? তবে আসরফী ” নিমকহারাম দেউড়ী “তে ঘটে যাওয়া কিসসাটা ওই আজনবী খিদমৎগার বিবিজানের কাছে না শুনলে সবটা জানতে পারত না।
……
ওই বিবিজানের ঘুম জড়ানো গলায় বলতে থাকা হাজারো নবাবী কিসসা ওকে যেন যাদু করেছে। তাই সে প্রায়সই বাপের চোখ এড়িয়ে দাফনবাগে আসে আর সেই বিবিটির কাছে বসে এসব দুঃখের কিসসাগুলো শোনে, তখন যেন ওর সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ মনটা অনেকদূরে…..প্রায় সিন্দবাদের মত এক অলীক একটা দেশে অবলীলায় ঘুরে মরে। বিবিজান ওকে আজ বিশেষ করে যেতে বলেছে বলেই এতক্ষণ পরে ও দুপুরের একটু সুযোগ পেতে সে ওখানে যাবে বলে বেরিয়ে এল।
…..
(৩)
“ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলাইহে রাজেউউউউউনন….” বিবিজানের কন্ঠধৃত উচ্চারণের মনকেমনিয়া সুরটা এতক্ষণে ওর কানে আসতেই আবছায়া আলো আঁধারিতে দাফন্ বাগের অশ্রুধোয়া চাতাল ঢেকে যেতে থাকল।
আসরফী দেখল কখন যেন বিবিজান ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন হাতে একটা মাটির চিরাগ। লুফি বিবিজান আল্লাহ্ শরীফের নামে অস্ফূটে এবার খানিক ধন্যবাদ দিয়ে মাটিতে ঝুঁকে পড়েছে যেন নামাজ সারতে বসেছেন ।
বিবিজান বললেন যে খবর এসেছে যে পনেরদিন আগে এখনকার নতুন নবাব মীরজাফরের নির্দেশে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে প্রাক্তন নবাব মির্জার মা আমিনা বেগম ও মাসি ঘসেটি বেগমকে কায়দা করে বন্দী রেখেছিল। সবাই বলছে যে অবশেষে তাদের একটি নৌকায় তুলে নৌকাটি ইচ্ছে করে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিয়েছে তার পুত্র মীরণ।
দিন তিনেক হল এ মুলুকে এই খবরটা এসেছে। তবে অবাক ব্যাপার এই যে ঘটনার অল্প দিন পরে সেই কুচক্রী মীরণও এক নিদারুণ বজ্রপাতে নিহত হয়েছে।
আসলে খোদার রাজত্বে বসে কেউ যদি জাহান্নামের পাপের আগুন একবার জ্বালায় তবে তার নিজেকেও সেই আগুনে একদিন জ্বালিয়ে দিতে হয়। এটাই বোধহয় দিন-দুনিয়ার খুদা-ই-মালিকের ইচ্ছা।
…..
এতক্ষণে ও বুঝল এই খবরের কথাটাই বিবিজান বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। এবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বিবিজান ওর কাছে একটা কাজ করে দেবার আর্জি পেশ করল। তখন আসরফী দেখল যে এই লুফি বেগমের দুটি চোখ এক করুণ অশ্রুস্নানে যেন ভিজে আছে।
বিবিজান এবারে ওর হাতে একটা নারকেলের খালি হয়ে যাওয়া মালা ধরিয়ে দিয়ে বলল যে ও যদি দরগাহ্ থেকে কাল একটু সিমাই এই পাত্রে করে এনে দিতে পারে! কাল মির্জার নামে এই বিবিজান নাকি রসুলের কাছে একটু প্রার্থনা করবে। তাই যদি একটু সিমাই এর সাথে যদি ওর হতভাগ্য মির্জার নামে সে দোয়া চায় তাহলে বিবিজান আসরফীর কাছে বড় কৃতজ্ঞ থাকবেন।
এই বিবিজানের কন্ঠস্বরে এমন কিছু একটা যাদু আছে যা আসরফীও সহজে অস্বীকার করতে পারেনা। কিন্তু ওর মনে প্রশ্ন জাগল যে কিন্তু কে এই মির্জা ? বিবিজানের ছেলে? না মরদ? ঠিক কার জন্য দোয়া চাইবে বিবিজান?
আসরফীর বুকের ভেতরটা এবারে এক অজানিত আশংকায় ধুকপুক করতে থাকে।
ও তাও বুঝতে পারে তামাম হিন্দুস্তানের সামনে যে ভয়ানক দিনের প্রস্তুতি যে আজকাল শুরু হয়ে গেছে, এ যেন তারই রহস্য ইঙ্গিতের সাথে আস্তে আস্তে জুড়ে যাচ্ছে, এমনকি সেটা ওর অজানিতেই।
…….
কমলিকা অনেকক্ষণ ধরে আজ চুপ করে আছে। সামান্য কর্নফ্লেক্স বা দুধ এর কোনওটাই সকাল থেকে গলায় ঢালেনি। খালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে আর দু একবার ” লুফি বিবি” বলে অদৃশ্য অথবা কাল্পনিক কাউকে ডেকে তার কাছে নিজের অগোছালো মনটাকে সঁপে দিয়ে থম্ মেরে আছে। মাঝেমাঝে ওর এই অস্থিরতাটা দেখলে মনে হয় যেন কোন একটা মর্মান্তিক কাহিনীর শেষটুকু শোনার জন্য সমস্ত স্নায়বিক উত্তেজনাটাকে ও যেন নিজের এই সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ আধারটায় উন্মুখ করে রেখেছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এই অসমাপ্ত শ্রুতিবেদন কথিকার খোঁজটিকে সে নিজের কাছে, নিজের মনের মাঝে আজও সুতীব্র যন্ত্রণার সাথে তুলে রেখেছে।
…..
সিস্টার কাজরী এসে ওকে আদর করে নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু সে ডাক কমলিকার কানে এসে পৌঁছায় না। দিন পাঁচেক হল এটা কমলিকার একটা নতুন সিম্পটম্ ধরা পড়েছে, তা হল ” ইমোশনাল ইগনোরেন্স “!
ফাদার অতনু নিজেও দেখতে এসে তার এই অবস্থায় বিশেষ কিছু সুবিধা করে উঠতে পারেন নি।
……
(৪)
মুর্শিদাবাদের নবাবী মসনদ। এই প্রাসাদের কর্তৃত্ব নিয়েই একদিন ১৭৫৭-র ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তখন কেউ বুঝতে পারেনি যে সুবাহ্ বাংলার সাথে সাথে তামাম শাহী হিন্দুস্তানের আকাশেও ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে ফিরিঙ্গিয়ানার কালো মেঘ। আর সেই অমঙ্গলের আবহে রাজ কুঁয়ার নামে অখ্যাত এক হতভাগিনী হিন্দু পরিচারিকাই হয়ে উঠেছিল মসনদের শেষ মঙ্গলাকাঙ্খী।
নবাবের আম্মাজান আমিনা বেগম-এর জীবন তো তেমন সুখের ছিল না; আমিনা বেগমের স্বামীর নাম জৈনুদ্দীন। তিনি পাটনার (বিহার) নায়েব সুবাহ্দার ছিলেন। বিদ্রোহী আফগান নেতারা জৈনুদ্দীন কে হত্যা করে দু ছেলেসহ আমিনা বেগমকে বন্দি করে। আলীবর্দী খাঁ বিদ্রোহী আফগান নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদের মুক্ত করেন। এই আমিনা বেগমের এক ছেলের নাম মির্জা মেহেদী। আর তাকেই একদিন মসনদে বসতে হল দাদাজী খোদ আলীবর্দী খাঁ এর উত্তরাধিকার হয়ে। অবশ্য সেদিন থেকেই তা হয়ে উঠল এক শেষের আনজানের শুরুয়াৎ।
অবশ্য সেই রাজ কুঁয়ার কি করে যেন বাঁদীমহল থেকে একদিন খোদ মির্জার নেকনজরে পরে তামাম জেনানামহলের মালকিন হয়ে উঠল খুব তাড়াতাড়ি সেটাও কম রূপকথার কিসসা নয়! তবে সর্বস্ব হারানোটাই যার নিয়তি সে তার সমস্তটাই এরপর থেকে হারাতে বসল আরো দ্রুততার সাথে। সেদিনের চিত্রনাট্যে অবশ্য ‘রাজ কুঁয়ার’ বলে আর কেউ রইল না। ঝাঁ চকচকে শাহী প্রাসাদে ক’দিন আগেও যার বাহারি মল ঝমঝম করে বাজত সে হল বেগম “লুৎফাউন্নিসা” বা তার মির্জার অনেকগুলি বেগমদের মধ্যে একান্ত আদরের বেগম!
আজ সেসব যেন এক অন্য জন্মান্তরের যাদু কিসসা!
….
কমলিকার আবার একটা নতুন উপসর্গ শুরু হয়েছে। কোথাও একটুকরো আগুন বা মোমবাতির আলো দেখলেও ও কেমন যেন করে ওঠে। সারা শরীর জুড়ে একটা অস্থিরতা চেপে ধরে ওই নিষ্কম্প অগ্নিশিখাটিকে দেখলে। সেদিন প্রেয়ারে সময় সবাই মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেছে ঠিক তখনই সে অস্থির হয়ে উঠল। চ্যাপেলে রাখা প্রভু যীশু ও মাতা মেরীর ছবির সামনে জ্বালানো বাতির শিখাটি যেন ওর সারাটা গায়ে কেউ যেন ধরে ক্রমশ জ্বালিয়ে দিতে চাইছে সমস্ত শরীর। ওকে ধরে রাখাটাই সেদিন কঠিন হয়ে পড়েছিল।
……
(৫)
১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদ নগর থেকে একাকী পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেদিন বেগমসাহেবাও সেই বিপর্যয়ে খুব ভেঙে পড়েন, তাঁকে সঙ্গে নেয়ার আকুল আবেদন করেন।
তারপর এল ১৭৫৭ সনের ২৪ জুন। একটি অভিশপ্ত রাত। খাজা দিলীল খাঁ ইশারা করতে সেই রাতে নবাব নিজে তাঁর একমাত্র শিশুকন্যা জোহরা, বেগমসাহেবা স্বয়ং এবং একজন অনুগত খোজা ভৃত্য সহ মুর্শিদাবাদ শহর ত্যাগ করলেন। তবে তাঁদের সেদিন ধরা পড়ে যেতেও দেরি হয়নি। দানা শাহ্ ফকির ঘাটের পথে সপরিবারে নবাবকে চিনতে পেরে মীরজাফরের কানে খবর পৌঁছে দিয়ে মোটা ইনাম বখশিস্ পায়। তারপর কতকালের পুরনো নেমকহারাম দেউড়ির আকাশ বাতাসে মীরজাফরের দেওয়া নবাবকে হত্যার আদেশ শেষমেশ যবনিকা পতনের করুণ অথচ পরাজিত হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটির নির্মম অবতারণা করে জ্যান্ত ওঠে।
….
আজ আসরফী এইসব বৃত্তান্তটা যখন বিবিজানের কাছে শুনছিল তখন ওর চোখদুটো যেন আপনা থেকেই অশ্রুবাষ্পে ভিজে যাচ্ছিল। কি আশ্চর্য! ইবলিশের বাচ্চারা ওই দুধের শিশুটাকেও সেদিন ছাড়েনি!
মসনদের আনাচে কানাচে যে এরকম কত ঘটনা আছে, কে তার খবর রাখে? কিন্তু সে বোঝেনা যে এই বিবিজান সবটা হুবহু কি করে জানতে পারলো! তাহলে এখানে এই বিবিজান তাহলে কি……?
কমলিকাকে সিস্টার নিজে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন । তখন খুব ঠকঠক্ করে কাঁপছিল সে। দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার আওয়াজটা ক্রমশ মিলিয়ে আসতে আসতে তার দুটো চোখে গভীর ঘুম নেমে আসছিল। বড় প্রশান্ত মুখশ্রীর কমলিকাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলে বোঝা যায়না যে অন্য সময় ওর মধ্যে এরকম ঝড়ের তাণ্ডব চলতে থাকে।
কিন্তু আজ যেটা আর কেউ দেখতে পেলনা সেটা হল ওর ঢলা কামিজের একটা পকেটে ওখানে জ্বলন্ত একটা মোমবাতির টুকরো সন্তর্পণে ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে লুকিয়ে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে।
……
(৬)
কমলিকা আজও ঘুম থেকে খুব বেলা করে উঠেছে। এযাবৎকালের অভ্যাসে সে সবথেকে বেশী করে যেটা বারবার ঘটিয়েছে তা হল চূড়ান্ত অনীহা ও অসহযোগিতা। ও নিজে মনের কোন এক মনকেমনিয়া অতলে কেবল তলিয়ে যেতে থেকেছে মনখারাপের ধারাবর্ষণের এক অশান্তির পাগলাঝোরায়। কমলিকা যে শুধুই যে খাদ্যে অনীহা দেখিয়েছে তা নয়, সিস্টার কাজরীর দেওয়া ওষুধগুলোর বেশ কয়েকটা সে লুকিয়ে খুব সন্তর্পণে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে সবার অগোচরে। ফাদার অতনুও এসবের জন্য নিজেও খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। ফুলের মত একটা টিন-এজ মেয়ে এরকম ভাবে জীবনের প্রতি বীতরাগ দেখিয়ে আস্তে আস্তে নির্মোহতার চরমে চলে যেতে পারে সেটা গত তিরিশ বছরের পেশাদার জীবনে তিনিও দেখেন নি।
…..
আসরফী আর থাকতে না পেরে ঠিক করেছে আজ সন্ধ্যেয় বিবিজানকে জিজ্ঞাসা করবে তার কৌতুহলের উদগ্র যাচনাগুলি। কে তিনি? নবাব হারেমের এত খবর তিনি কি করে রাখলেন?
আর কেন ‘মির্জাজাদা’ র কথা বলতে বলতে তিনি অশ্রুমতী হয়ে যান ? ইনশাল্লাহ্! কে জানে কেন ‘জোহরা’র নামটি মুখে আসলে কেনই বা তিনি মাকরানা থেকে আনা পাথরের মত শক্ত হয়ে যান? মসৃণ অথচ অপার্থিব শৈত্যে কেন তাঁকে বড় অচেনা মানুষের মত লাগে?
….কেন? কেন? কেন?…..
…..
বিবিজান একবার তার চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিল। হাতের চিরাগটাকে উস্কে দিয়ে তারপর ততোধিক নম্রস্বরে রিনরিনে গলায় বলল যে কোম্পানি আর নবাব-নাজিম তাকে এখন থেকে এই কবর ও তার সংলগ্ন সম্পত্তির মুতাওয়ালি হিসেবে দেখাশোনা করতে বলেছে। এমনকি প্রতি মাসে তহবিল থেকে তিনশ’ পঞ্চাশ টাকার অনুদান অনুমোদন করেছে বলে জানিয়েছে। যদিও সে কোনওমতে সে চালিয়ে নিচ্ছে আর সমাধির ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সবার জন্য সে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করে ও বিকালে বাতি জ্বেলে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। মনের মধ্যে দোলাচল চলে নবাবী নিজামত আর হতভাগ্য নবাবের ভাগ্যটির কথা মনে করে।
কিন্তু তাও তো আসরফীর আন্দাজের পুরো হিসেব তো শেষমেশ মিলল না! ঠিক এই ধরণের কাজ তো এইরকম একটা সুন্দরী বিবিজানকে কোনওভাবে যেন মানায় না! বিবিজানের আসল নাম বা পরিচয়টি ঠিক কি? কে জানে?
এবার বিবিজান হাতের নিষ্কম্প চিরাগটিকে এনে অতিসন্তর্পণে এবার নবাব মির্জার কবরের ওপর এনে রাখে। সে নিজেও যেন বুঝতে পেরেছে যে আজ একরত্তি মেয়ে আসরফী যে ওর আসল পরিচয়টাও জানতে আজ সমানভাবে উদগ্রীব।
…….
(শেষপর্ব)
হঠাৎ কোত্থেকে যেন লবঙ্গফুলের গন্ধ আর ঈত্বরের গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা মেরে চলে যায়। দাফন-বাগের প্রতিটি কোণায় জন্নতের সেই খুশবু এসে আসরফীকে বিহ্বল করে দেয় খানিক। সে এবার গোরস্থানের চাতাল থেকে নেমে একটু ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে আসে।
সে হঠাৎ শুনতে পায় দ্রুতলয়ে খঞ্জরি বাজানোর একটা শব্দ। তার সাথে যেন ভারী ভারী মলের পদঝঙ্কারও যেন ভেসে আসছে কোত্থেকে! কিন্তু, না, না! ওই আওয়াজ যেন কোন গয়নার নয়। কত ভারী ভারী শিকলের মালা কারুর পায়ে জড়ানো আছে আর খুব ক্লান্ত অবসন্ন পদক্ষেপে সে যেন এবার এদিকে আসছে।
বিবিজান হঠাৎ খিলখিল করে বেমানান হাসিতে ঢেউ তোলে। এতদিনে শোকনম্রতা হঠাৎ চটুল বিভাবে বদলে গিয়ে আসরফীর কানে এসে ঝাপটা মারে। আসরফী ভয়ে ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে আসতে চায়।
অসাবধনতায় কখন যে তার ওড়নায় একটি জ্বলন্ত চিরাগের শিখা তার মরণকামড়ের উত্তাপ বসিয়েছে তা টের পাওয়ার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়। তার খালি মনে আছে যে প্রচন্ড তীব্র উত্তাপ আর সমস্ত গা সেই তাপের আগুনে জ্বলে যেতে যেতে সে শুনতে পাচ্ছিল তীব্র অট্টরোল ও হাসির আবেশে বিবিজানের গলায় যেন ঝরে পড়ছে নহবতের বিভিন্ন আলাপের মত ভেসে আসা একেকটা সুরের ওঠানামা যা কান্না, বদ্ নসিব আর অভিশাপের ব্যর্থ ফুৎকারের মত।
” ওফফ্! সবটা যে একেবারে এখন জ্বলে যাচ্ছে যে..গো…ও….ও বিবিজান….একটু পানী….পানী….ঈঈঈঈঈ” – সে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সজোরে ককিয়ে ওঠে।
কেউ এগিয়ে আসেনা। সবটা ভোজবাজির মত যেন চারপাশ থেকে আজ উবে গেছে।
খানিক পরে কেবল কানে আসে একটা কান্না মাখানো ধরা গলায় বিবিজান যেন বলছেন,
– ” বে-তমিজ! কি রে এখনও চিনলি না আমায়! হ্যাঁ, চিনলি না আমায়..! আমি তো সেই লুৎফা! আআআমিইইই সিরাআআজেএএর বেএএএগম! সাধারণ বাঁদী রাজ কুঁয়ার থেকে হয়ে ওঠা সেই লুফি বেগমসাহেবা…..! “
…….
খবরের কাগজে আজ খবরটা বড় করে বেরিয়েছে। আর তার জেরেই এখন পুলিশে পুলিশে ‘আপন আলয় ‘ সেবাকেন্দ্রটি ছয়লাপ হয়ে আছে।
গত রাত্রে এখানে এক চিকিৎসাধীন এক মানসিক রোগীণী কি ভাবে যেন তার ওড়নায় একটা মোমবাতির আগুন অজান্তে ধরিয়ে ফেলে আকস্মিকভাবে মারা গেছে ।
বিশ্রী এই দুর্ঘটনার জেরে এই অকালমৃত্যু এখন সেবাকেন্দ্রের ভিতর ও বাইরে এক ভীষণ আলোড়ন তুলেছে। জানা যাচ্ছে যে মেয়েটি এই দুর্ঘটনার শিকার সে নাকি আজকাল কয়েকদিন সর্বদাই স্বপ্নের ঘোরে থাকত। মেয়েটির নাম কমলিকা! তার এই অবধারিত অতীত যাপনের ফলেই কি তার এই হঠাৎ মৃত্যু? না কি এটি এক নিছক দুর্ঘটনা বা কোন ফেলে আসা অতীতচারণের বাহ্যিক সমাপতন?
সব সাংবাদিক আর বিদগ্ধজনেরা এখন মিডিয়ার টিভি স্ক্রীনসহ খবরের কাগজের পাতায় পাতায় যেন তারই খোঁজে উদ্বিগ্ন ……
…..
কমলিকার তবুও তার আধপোড়া শরীরে লড়াই করতে চেয়েছিল পুনর্যাপী নিয়তির বিরুদ্ধে।
তাও যেন আজ সব শেষ হয়ে গেছে এই আকস্মিকতার নির্মমতায়। দুঃখ লাগে যে নিয়তির কালমন্থনের আসরে তার আর নতুন করে আর বাকী কথা যে এইজন্মেও আর পুরোটা বলা হয়ে উঠল না।
কেউ তাই বুঝতেই পারলনা যে এটা দুঃস্বপ্নের আসমানী অন্ধকারময় এক জন্মের নিধনবিলাস নয়।
কেবল নির্মোহ সময়কাল প্রমাণ করে দেবে যে পর্যায়ক্রমে সে আবার ফিরে আসবে। হয়তো একা নয়, এইভাবে আমাদেরও পূর্বপুরুষের পাপের ভার না চাইতে একদিন চেপে বসবে আমাদের উত্তরধারাপথের নাম না জানা অজস্র ক্ষতলাঞ্ছিত বিয়োগব্যথায়।
……………………….সমাপ্ত………………………..