নলজাতক
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
মা চলে যাবার পরেও বেশ কিছুদিন এই শূন্যতাটা মানতে পারিনি। বাবা’কে দেখলেই মাএর অভাবটা আরো বেশী করে মনে পড়বে সেই অবধারিত সঙ্গত কারণেই ওই প্রৌঢ় ভদ্রলোকটির সান্নিধ্যটাও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতাম। এর অবশ্য আসল কারণটা হল আমার আকৈশোর বিভিন্ন বোর্ডিংবাসে কাটিয়ে আসা বিগতদিনের ছাত্রজীবন। এই বোর্ডিংবাস প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে সময়ের সাথে বেড়ে উঠতে গিয়ে আমাদের বাড়ির অলিন্দে কোন কোন পারিবারিক জমায়েতের মাঝে থেকেও আমি যে নিজের মত করে একাই থাকতে অভ্যস্ত ছিলাম সেটা মিথ্যা বলে কি করে! আমায় নিজেকে ওদের জগতে বরাবর বেমানান লাগত। আমি জানতাম যে সবার মত ঠিক ঘরকুনো বা পারিবারিক টাইপের নই বলেই কৈশোরকাল থেকে বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটানোর চেয়ে বরং ধলসা নদীর পাড়ে বা নিকটবর্তী অরণ্যপ্রকৃতির বুকে একটু বাইরের জগতে বেড়িয়ে হঠাৎ পাওয়া অলস সময়গুলোকে কাটানোটাই বেশী পছন্দের ছিল।
খালি ছুটিতে বোর্ডিং থেকে বাড়ি আসলে মা’র চোখে হাজার পিদিমের জ্বলে ওঠা আলোটার কথা পরবর্তীকালে তবু মনে পড়ে যেত।
সেটা তখনও যে একটা চিনচিনে বুকজ্বালা হয়ে ওঠেনি ঠিক তাও নয়।
আসলে মা’এর স্বভাব ছিল অন্তর্মুখী। আনন্দ বা শোক কোনওটাই যে ব্যক্ত করে একটা প্রাবল্যের প্রকাশ প্রয়োজন মা সেটা কখনোই মানার দরকার বোধ করেনি। এমনকি বাবা’র সাথেও কোন বিষয়ে মতান্তর হলেও সচরাচর মনান্তরের পথে মা হাঁটত না।
সেই জন্যেই বোধহয় মা চলে গিয়ে যেন আরো বেশী করে মনের গভীরে রয়ে গিয়েছিল।
এখন বরং বেশ রাগ হয় যখন এই বয়সে এসেও বাবা ছোটখাট অসুখেও ওষুধ খেতে চাইত না সেটা দেখলে। কি জানি! আসলে মা’র সাথে দেখা করতে যাওয়ার একটা তাড়া বোধহয় অবচেতনে বাবা’কেও তাড়া করে ফিরত।
……….
মা’র মৃত্যুদিন ছিল শীতের গোড়ার দিকে। তাই মরসুমী ফুলের নির্লজ্জ বাহারে মা’এর ফটো, ব্যবহারের ড্রেসিংটেবিল, বিছানা এসব সাজিয়ে দেওয়াটাই যেন গত চারবছরের একটা দস্তুর হয়ে গেছিল। বাড়ি থাকলে দেখতাম মা’র ছবিটাকে ওইসব ফুলের জলসায় আহ্লাদী মুখে হেসে উঠতে। বাবা তখন ওই কটাদিন যেন একটা অন্যজগতের মানুষ হয়ে উঠত। মা’র ছবিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে কিসব বিড়বিড় করে বলতে শুনলেও তা আমার ঠিক বোধগম্য হতনা।
আসলে মৃত্যু যেন একটা আপোষহীন রূপান্তর আর তার নাগাল পেয়ে ওঠাটাই যেন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। জীবনের সার্থকতাটা তার থাকা না আর তার ফেলে আসা মুহূর্তযাপনের মধ্যে কোনটা তা সদ্যযৌবনবেলা পার করে এসেও কখন যেন আচমকাই ওলোটপালট হয়ে গেছে বলে আলাদা করে সেটা বুঝতে শিখিনি।
……..
এর পরবর্তীতে জীবন চলছিল এই রকম মন্দগমন ছন্দের স্বভাবেই। এরমধ্যে আবার আমার বিদেশে গিয়ে পোস্ট ডক্টরেট করবার একটা সুযোগ এসে গেল। সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসের কারণগুলো নিয়ে কলকাতায় থাকতেই একটা গবেষণার পেপার জমা করেছিলাম ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওরা তাই জন্য কিছু বাছাই ডক্টরেটকে এখন ওদের ইন্দোলজি ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়ে আরো নানারকম গবেষণা চালাতে সে দেশে ডাকছে। অরুণাচলপ্রদেশের চেংথাম লিম্বাজি আর আমি আমরা হলাম এই দু’জন ভারতীয় আর দু’জন পাকিস্তানী অধ্যাপক সদ্য ডক্টরেট পাওয়া মেহেদী মেহেবুব নিশার আর তৌফিক আফরোজ আলম, যারা এই পাঁচবছরের জন্য স্পেশাল প্রজেক্টে সিলেক্টেড হয়েছি।
কাজেই আগামী জানুয়ারিতে যাওয়া হবে বলে তার আগে সবটা গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। কিছু বাক্স প্যাঁটরা খালি করে গোছাব বলে মা’এর জিনিষপত্র রাখার ঢাউস স্যুটকেসের ভিতরে মায়ের ব্যবহৃত সবকটা’ গরমজামার মধ্যে মা’য়ের বোধহয় সেই ছাত্রীজীবনে লেখা একখানা বাঁধানো ডায়েরী আর সাদাকালো ছবি’র একটা অ্যালবাম খুঁজে পেলাম। এ্যালবামটায় গোড়ার দিকে মা’এর কিছু ছবি থাকলেও বাকীটা জুড়ে কেবল আমার ছোটবেলার সাদাকালো / রঙীন ছবি-ই রাখা।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে সেগুলোর অস্তিত্ব এই সাতাশ বছরের জীবনে ঠিক আমিও জানতাম না। তাছাড়া মা’ও কখনো এইসব বার করে আমাদের দেখিয়ে যাকে আদিখ্যেতা করা বলে, সেটা কখনো করেনি।
এ যেন এতবছর এক নিভৃত অন্দরমহলের একটা উল্লাসময় জলতরঙ্গের মত যত্নে সেগুলো মা’ই এতদিন তুলে রেখে দিয়েছে। আজ না বাক্স খুললে সেগুলোর অস্তিত্ব আদৌ কি জানতাম?
……..
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে ওঠার পর ওই ডায়েরীটা খুলে বসলাম। দেখলাম ওই গোটা ডায়েরীর সিংহভাগটাই সংসারের নানা প্রয়োজনের হিসাবে ভর্তি। আর অক্টোবর মাসের পর থেকে কয়েকটা পাতা দেখলাম ছেঁড়া। এরপর বছরের শেষের দিকে ঠিক পরপর নয় তাও চারটে পাতায় এমন কিছু কথা লেখা আছে যেটা পড়ে এযাবৎকালের সমস্ত বোধবুদ্ধি আর মনস্তত্ত্ব সবটাই শিউড়ে উঠল। মা’এখানে লিখে রেখেছে এমন কিছু প্রসঙ্গের কথা যা অবিশ্বাস্য হলেও বুঝলাম তা বোধহয় বড় বেশীরকমের বাস্তব ও অস্বস্তিকর।
– ” আজ দু’মাস হল খোকা একটু বড় হয়েছে। ও যে সম্পূর্ণ অন্য বংশগতির ধারা পেয়েছে সেটা রঞ্জু’র মুখশ্রী আর খোকার মুখশ্রী দুটো মিলিয়ে দেখলে যে কেউ বলবে! তাও তো সে যে আমার গর্ভজাত। তাই এই অপরিসীম মাতৃত্বের ঋণভারে আমি সেই ছোট্ট শিশুকে বুকে ধরে নীরবে অশ্রুমোচন করি!…..”
এতদূর পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি।
তার…আআআআআর মানেএএ?
আমি তাহলে এই বংশের কেউ নই? সেজন্যই কি বাবা’ সাথে এই অপরিমেয় দূরত্ব? তাই বুঝি শৈশব থেকে আমি সবার মাঝে বড় বেমানান? মায়ের মাতৃত্বের দূর্বলতা কাজে লাগিয়ে কেউ কি তবে……
এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছে না!
বাথরুমে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠল। বমি করে একটু হাল্কা হয়ে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম বাবা’র ঘরের দরজা বন্ধ। উনি বোধহয় ঘুমাচ্ছেন।
……..
ডায়েরীটা থেকে থেকেই টানছে। একজায়গায় দেখি লেখা আছে, ” রঞ্জুর অ্যাজোস্পার্মিয়া ধরা পড়ায় ও গুমরে গেছে। ওকে বোঝানোই যাচ্ছে না যে সন্তান না হলেও দাম্পত্যের বিষয়টা একইরকম মূল্যবান থেকেই যায়। তারওপর ও আবার অবুঝের মত ভীষণ ড্রিংক করতে লেগেছে।
এছাড়া আমায় প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত টেস্ট টেউব বেবী’র জন্য সিটিং দিতে ওর সাথে ডক্টর মানসুখানির চেম্বারেও যেতে হচ্ছে!”
আর জায়গায় দেখি আবার মা’র লেখা,
“D19840706 নম্বর টিউবটায় রাখা অচেনা বীজতলা যে আমায় সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট করে দেবে সেটাই বা কে জানত?
তবুও দেখছি এরপর থেকে রঞ্জু যেন সবটাতে ইনভলভ্ড হয়ে থেকেও কোথাও একটা অপরিসীম দূর গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যেতে থাকল। এই সন্তানের জন্ম দেওয়াটায় ওর যে কেবল একজন ফাইন্যান্সারের ভূমিকা সেটা ওকে যেন আরও একটা ডিপ্রেশনের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে! ধন্য বিজ্ঞান! ধন্য টেকনোলজি! তুমি মানুষের মন আজও বুঝলে না!
তবে আমি আজ নিশ্চিত যে এই ছেলের জন্মের পরেও ও কি আর কখনো সেই নিষ্পাপ ছেলের প্রকৃত একজন বাবা হয়ে উঠতে পারবে? আমি এখনই জানি, পারবে না! অথচ আমি তো একজন মা! তাই সেটায় আর কোন ইনজাস্টিস করা যায় কী?”
এতদূর পড়ে থমকে বসে থাকলাম। আজ পরিষ্কার যে মা’ আমার জেনুইন হলেও এই বাড়ির আমি যেন সত্যিই কেউ নই।
এখন খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের ভিতর।
একসময় লাইটার জ্বালিয়ে ডায়েরীটা পুড়িয়ে দেব বলে ভাবলাম। এই অব্যক্ত অতীত বাবা, মা আর আমাকেও এখন কষ্ট দিচ্ছে এতদিন পরেও। তাই এটার থাকবার আর কোনও প্রয়োজন নেই।
তাছাড়া আমি তো বিদেশ চলে যাচ্ছি! এখানে আর না ফিরলেই হল। মানুষের জন্মপরিচয় কি তার সার্থকতার একমাত্র চাবিকাঠি?
……..
ভাগ্যিস ডায়েরীটা পোড়াইনি। খুব জোর একটা ভুল করছিলাম। অস্তিত্ব সংকটের কল্পনায় অযথাই নিজের পরিবারের থেকেই হঠাৎ দূরে চলে যাচ্ছিলাম।
ডায়েরীর শেষটায় এতক্ষণ ভাল করে চেয়ে দেখিনি। সেখানে জ্বলজ্বল করছে আমার মা’এর অপূর্ব সোনালী আলোর হস্তাক্ষর।
” এই গল্পটা মাঘ সংখ্যার জন্য দেশ পত্রিকা’র দপ্তরে পাঠিয়েছিলাম। আজ চিঠি পেলাম। আমার “নলজাতক” গল্পটা ওরা বৈশাখ সংখ্যায় বলেছে যে ছাপবে!
..ভাবতেই পারছি না যেন! আহা! কী আনন্দ যে হচ্ছে। “
………সমাপ্ত ……….