জাতীয়তাবোধের জাগরণে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র
কলমে/ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
ভারতে ইংরেজ শাসনের সদর্থক ভূমিকায় রামমোহন -বিদ্যাসাগর থেকে ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষস্থানীয় এলিটদের চোখে এদেশে ইংরেজের শিল্প-সাংস্কৃতিক ও আধুনিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা-রূপটিই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই জালিয়নওয়ালাবাগের আগে পর্যন্ত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সমাজতন্ত্রের পুরোধা কার্ল মার্কস ভারতে ইংরেজ-প্রবর্তিত আধুনিক ব্যবস্থার পত্তন, স্থবির সনাতন সমাজ ভাঙা ইত্যাদি প্রসঙ্গে সাধুবাদ জানিয়েও ভারতে উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসন-শোষণের ভয়ংকর রূপটির সমালোচনা করতে ভোলেননি এবং এ-অবস্থা থেকে ভারতীয়দের সংগ্রাম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছিলেন।
ভারতে নবজাগরণের প্রাথমিক পর্বে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন থেকে শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য (অবশ্য এসবই ছিল হিন্দু সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা); এগুলোই মূখ্য ছিল। অপরদিকে আগ্রাসী বিদেশি শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া (নীলবিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রভৃতি) গণচেতনার উন্মেষ ঘটেনি। এই পটভূমিতেই রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
রবীন্দ্রনাথ বিলেতে অবস্থানরত বড়ো ইংরেজের ভারত বিষয়ক হিতব্রতা রূপকে সম্মান জানিয়েছেন আগে ঔপনিবেশিক শোষক ইংরেজকে চিনতে পেরেছেন পরে, পরিণত বয়সে এসে। রবীন্দ্রনাথকে সমণ্বয়সাধনার তত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উপনিবেশবাদী শোষক প্রমাণ করেছে যে কখনো উপনিবেশকে স্বদেশ হিসেবে ভাবে না।বাল্যের শিক্ষার কারণে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ভক্ত রবীন্দ্রনাথ দেখতে শিখেছেন ‘য়ুরোপের প্রদীপের মুখে শিখা জ্বলিতেছে। সেই শিখা হইতে আমাদের প্রদীপ জ্বালাইয়া লইয়া আমাদিগকে কালের পথে আর একবার যাত্রা করিয়া বাহির হইতে হইবে।
কিন্তু তখনো রবীন্দ্রনাথ ভেবে দেখেননি যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থেকে আধুনিক চেতনাকে গ্রহণ আর উপনিবেশবাদী শাসককে শোষকের আসনে বসিয়ে রেখে দেশজ সাংস্কৃতিক সম্পদ গ্রহণ দুটো আসলে এক বিষয় নয়।
” জনগণমনঅধিনায়ক ” আসলে সেই ‘ছোটো ইংরেজ’ অর্থাৎ ভারতে অবস্থানকারী শাসক ইংরেজ যে ভারতের সম্পদ লুন্ঠন করে বাজারে মুনাফা করে এসেছে এতদিন।
রবীন্দ্রনাথ অনেক পরে ইংরেজদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন ঠিকই কিন্তু তা উনিশ শতকের শেষদিক থেকে। সেখানে শরৎচন্দ্র শুধু নিজে কংগ্রেস দলের সভ্য হয়েই থেমে যাননি বরং সেখানে অহিংসাব্রতের গ্রহণযোগ্যতাকে নিয়ে বারংবার নানা ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর কলমে।
বস্তুত রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনায় স্বাদেশিকতার সুচিন্তিত রূপ প্রকাশ পেয়েছে বলা যায় ১৯০৫ সালে হওয়া বঙ্গভঙ্গের সময়ে এসে।
এখানে প্রথম তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা সমাজভাবনার রূপ নিয়ে প্রতিফলিত। তাঁর ভাষায় ‘মধ্যযুগে পড়ে থাকা’ গ্রামের সর্বতোমুখী উন্নয়ন ও পল্লিপুনর্গঠন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। স্বদেশবন্দনায় তিনি রচনা করেছেন ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সার্থক জনম আমার’, ‘বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই’ ইত্যাদি।
তবুও সামগ্রিকভাবে এই সব রচনাগুলিকে উন্নততর প্রাদেশিকতা বলা গেলেও সামগ্রিকভাবে সম্পূর্ণ ভারতীয়করণের অভাবটা রয়েই গেছে। আর ঠিক এইখান থেকেই শরৎ সাহিত্যে এসেছে মুক্তিকামী অবরুদ্ধ প্রাণে জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার ক্রমোউন্মেষের আহ্বান। ‘পথের দাবী’ যদি ইংরেজশাসনে বাজেয়াপ্ত নাও হতো তাও শরৎসৃজনে যে দেশবন্দনার ভাষা আমরা আরোও গভীরে গিয়ে পেয়ে যাই তা আদতে হল স্বাধীনতাকামী জনতার মৃত্যুহীন মুক্তিসংগ্রামের পথে হেঁটে যাওয়া। আর পর তার রক্তমাখা অবশেষ থেকেই অসংখ্য “সব্যসাচী” র আসল আবরণ উন্মোচন হয়ে ওঠাটাই।
যখন শিক্ষার মিলনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
‘এ কথা মানতেই হবে যে, আজকের দিনে পৃথিবীতে পশ্চিমের লোক জয়ী হয়েছে। পৃথিবীকে তারা কামধেনুর মতো দোহন করছে, তাদের পাত্র ছাপিয়ে গেল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, দিন দিন দেখছি আমাদের ভোগে অন্নের ভাগ কম পড়ে যাচ্ছে।ক্ষুধার তাপ বাড়তে থাকলে ক্রোধের তাপও বেড়ে ওঠে; মনে মনে ভাবি যে-মানুষটা খাচ্ছে ওটাকে একবার সুযোগ মতো পেলে হয়।…..বিশ্বকে ভোগ করার অধিকার ওরা কেন পেয়েছে? নিশ্চয় যে-কোনও একটা সত্যের জোরে’। এ লেখার প্রত্যুত্তরে শরৎচন্দ্র তাঁর ‘শিক্ষার বিরোধ’ প্রবন্ধে বললেন,
‘আজকের দিনে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পৃথিবীর বড় বড় ক্ষীর-ভাণ্ডেই সে মুখ জুবড়ে আছে,- তার পেট ভরে’দুই কষ বেয়ে দুধের ধারা নেমে’ছে –কিন্তু আমরা উপবাসী দাঁড়িয়ে আছি।
আসলে দেশ যে শুধু একটা শব্দমাত্র নয়, এর অন্তরে রয়েছে অসংখ্য নিপীড়নদীর্ণ জনতা যাদের জন্য শরৎচন্দ্র একদিন বলবেন ” সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই – যারা বঞ্ছিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, যাদের চোখের জলের কোনো হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনোদিন ভেবেই পেল না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধীকার নেই – এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠাল আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।”… এই বিতর্কিত সত্যভাষণ।
এক্ষেত্রে অযথা কখনো অনৃতভাষণে গা-বাঁচিয়ে মহৎ কথাকার হতে তিনি চাননি। তাঁর এই রচনাগুলি যেমন রবীন্দ্রমানসের “ঘরে-বাইরে” অথবা “গোরা”কে মনে করিয়ে দেয় আবার তেমনই যখন সশস্ত্র বাহুপাশের নির্মমতায় কবিগুরু কষ্ট পেতে পেতে সব শেষে মানবিকতার সেই পরম অস্তিত্বটিকেই কাঙ্খিত স্বরে “সভ্যতার শেষ পূণ্যবাণী ” বলে আহ্বান করেন তখন স্বদেশ ও স্বরাজ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র দুটি আপাত বিচ্ছিন্ন ভূমিখন্ডে অবস্থান করতে খানিকটা বাধ্য হলেও ব্যক্তিগতস্তরে সরাসরি সম্পর্কটাকে কখনোই নষ্ট হতে দেন নি সেই দুজনেই।
তাও সব শেষে বলতেই হয় যে শরৎচন্দ্রের এই বহ্নিমান ধারাতেই এরপর ধীরে ধীরে উঠে আসবেন “কাজী নজরুল” নামের এক কবিমানসের যুবক যিনি মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গণে বসে ” বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী” ই শুধু লিখে ক্ষান্ত হবেননা না বরং এই দুই মহান পূর্বজদের মাঝে অনস্বীকার্য এক যোজক হয়ে উঠবেন। এমনকি তারও কিছুদিন পরেই জাতীয় বীর ও দেশনায়ক হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসু হয়ে উঠবেন দেশাত্মবোধ ও মানবিকতা এই দু’য়ের দ্বন্দ্ববিরোধী এক সুতীব্র পরাকাষ্ঠা।
তাই নজরুল ও সুভাষ এঁরা দুজনে যেন সেই রবীন্দ্র-শরৎ এই দুই আপাত বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডেরই এক সম্মিলিত জাতক হয়ে শেষমেশ একদিন সুর মিলিয়ে বলে উঠবেন – ” শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে!” ফলতঃ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট লালকেল্লার ছাদে সদর্পে তেরঙা ঝান্ডা উড্ডীয়মান হবে দেশভাগের যন্ত্রণাকে নীরবে সহ্য করে, সেই মধ্যরাতের আনন্দগানের বিষাদগম্ভীর সুরের আবহে সাক্ষী থাকার জন্য রবীন্দ্রনাথ যেমন থাকবেন না তেমনই বঙ্গআকাশে থাকবেন না শরৎচন্দ্রও। এমন কি বিক্রম ও অনমনীয় স্বাদেশিকতার স্তম্ভ সেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও রহস্যের অবতারণায় সেদিন নিখোঁজ।
এত কিছুর পরে তবুও তো দেশ স্বাধীন হয়। আর শরৎের অমোঘ লাইনগুলোর সাক্ষী হয়ে ক্ষমতার হস্তান্তর দেখে যায় সেই ক্রন্দিত আর সর্বহারা মানুষের দল “সংসারে যারা শুধু দিলে…পেলে না কিছুই…”
স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণে তার অভিষেক ঘটিয়ে দিয়ে সমকাল ও ভাবীকালের প্রজন্মান্তরের কাছে তাই রবীন্দ্র-শরৎ এই দুজনেই ঋত্বিক হয়ে জেগে রইলেন হাজার নিপীড়নের পরেও। এঁরা আছেন ও থাকবেন জনমানসের প্রকৃত “জনগণমনঅধিনায়ক” হয়েই এমনকি ভবিষ্যতের মানবসভ্যতার সবরকম অস্তিত্বের সংকটের দিনেও।