স্বর্গ দর্শন
সলিল চক্রবর্ত্তী
” দাদু, আমাকে আজকে দুহাজার টাকা ধার দিতে হবে।”
– একটা টাকাও হবে না। আমি যখনই ব্যাংক থেকে টাকা তুলি, ওমনি তোর ধার করার প্রয়োজন হয়? আর ধার মনে, তুই কি বোঝাতে চাইছিস? আজ পর্যন্ত যত টাকা নিয়েছিস তার একটি টাকাও ফেরত দিয়েছিস?
নিরঞ্জন বসু, রিটায়ার্ড আর বি আই অফিসার, সত্তরউর্দ্ধ ভদ্র লোক, সস্ত্রীক থাকেন সল্টলেকের সি কে ব্লকে নিজের বাংলো বাড়ীতে। একমাত্র পুত্র প্রবীর বসু, চাকরি সূত্রে কমপ্লিটলি সেটেল্ড লাসভেগাসে। বাবা মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু নিরঞ্জন বাবুই যেতে চাননি। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীরা অবশ্য বলা বলি করে যে কি কপাল একমাত্র ছেলে পাশে থাকে না। বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে কোলকাতায় ফেলে রেখে নিজেরা দিব্যি আছে। নিরঞ্জন বাবু এই মন্তব্য কে নস্যাৎ করে বলেন -“ছেলেকে উচ্চ শিক্ষাতে শিক্ষিত করেছি কি স্টেট গভর্নমেন্ট এর স্কুল টিচার হয়ে বাড়িতে থেকে বাবা মাকে দেখভালের জন্য। ওর ও তো একটা ব্রাইট ফিউচার আছে। জীবনে ও অনেক দূর যাবে, স্ট্যান্ড করবে তবেইতো শিক্ষার স্বার্থকতা।” শেষ বয়সে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দেশের মাটিতে মরতে চান। রেশমি নামে এক মহিলা তাদের পরিচারিকার কাজ করে। সেও বৃদ্ধ বৃদ্ধার উপর অর্ডারসিটি চালায়। নিরঞ্জন বাবুরা সেটাই সহ্য করে রয়েছেন। কারণ দুই বছর কাজ করছে, সংসারটা ওর কন্ট্রোলে এসে গেছে। তাছাড়া নিরঞ্জন বাবুর স্ত্রী দয়াময়ী বসুর বয়স হয়েছে তিনি অসুস্থ। রেশমির স্বামী সমর এক মোদো মাতাল রিক্সা ওয়ালা। তার আরো কি সব নেশা টেসা আছে । ওরা থাকে বিধান নগর ফ্লাই ওভারের কাছের বস্তিতে।
নিরঞ্জন বাবু যখন বাড়ীর বাইরে যান তখন সমরের রিক্সাতে যান। কিন্তু প্রতি মাসে পেনশন তুলে এসে ভাড়া মেটানোর সময় অতিরিক্ত এক দুশো টাকা ধার চায় পরে দিয়েদেবে বলে। কিন্তু কখনোই তা ফেরত দেয়না। টাকা নিয়ে সমর কি করে তা নিরঞ্জন বাবু ভালোই বোঝেন। ওটা নিয়ে তাঁর মাথা ব্যথা নেই। কারণ রেশমিই সমরের কুকর্ম গুলোকে প্রশ্রয় দেয়।
দয়াময়ী বসু হাঁটুর ব্যাথাতে দীর্ঘদিন ভুগছেন। ডাক্তার দুটো হাঁটুরই মালাইচাকী চেঞ্জ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে, ছেলে বিদেশে, করবো করবো করে আর করা হচ্ছিলনা। এরই মধ্যে দয়াময়ী বসু বাথরুমে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে এক দুর্বিসহ অবস্থার সম্মুখীন হলেন। লাসভেগাস থেকে ছেলে এপেলো হসপিটালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলো। এপেলো থেকে এম্বুলেন্স এসে দয়াময়ী বসুকে নিয়ে গেল। ডাক্তার প্রাথমিক ভাবে পায়ে বেল্ট বেঁধে দিয়েছে, তবে এক মাসের মধ্যে অপরেশন করতেই হবে। আপাতত শয্যাশায়ী, বিছানাতেই সব কিছু এবং পরনির্ভরশীল।
মুদি মসলা এদিক ওদিক হয় তা নিরঞ্জন বাবু ভালোই বুঝতে পারেন। তীব্র প্রতিবাদ কখনো করেননি, করলে ঘরে বাইরে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সমরের ধার করার নামে মাঝে মধ্যে টাকা চাওয়া আর সেটা ফেরত না দেওয়াটা নিরঞ্জন বাবু একদম মেনে নিতে পারছিলেন না। তারপর স্ত্রীর এই অবস্থা, ছেলে পাশে নেই, ফলে এই বয়সে তিনিও একটু ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন,তাই মাথার ঠিক রাখতে পারেননি। আজ অপরেশনের জন্য যেই দুই লাখ টাকা তুলতে দেখেছে ওমনি দুই একশর ধার চাওয়াটা দুই হাজারে দাঁড়ালো। দোসর আবার রেশমি, কিছু বলতে গেলে কাজ ছাড়ার হুমকি দেয়। আজও তাই হলো, অপরাধ না করে অপরাধী বানিয়ে রেশমি প্রাইভেট কারে ওঠার ঢঙে সমরের রিক্সায় উঠে চলে গেল।
চিৎপুর রেল কলোনিতে উমেশ সাহানি তার ডেরায় বসে তিন সাগরেদকে নিয়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এর বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনা করছে। বিধান নগর পুলিশ কমিশনারেট এর অতি সক্রিয়তার ফলে উমেশের গ্যাং এর অপরেশন সাক্সেসফুল করতে খুব প্রবলেম হচ্ছে। ইনফরমেশন ও ঠিকঠাক আসছে না। এই ভাবে চলতে থাকলে দুই দিন পর থেকে তো না খেয়ে মরতে হবে। হঠাৎ ট্যাপা ডেরায় ঢুকে উমেশকে বললো-” বস খবর আছে।”
– কি খবর জলদি বল!
– খবর কি আমি জানিনা, তবে—
– তবে কি বাওয়ালি করতে এসেছিস?
– না বস, সমর নামে একটি ছেলে বলছ পাকা খবর।
– ও শালা পুলিশের টিকটিকি নয় তো! তুই চিনিস?
– হ্যাঁ বস, ছল্টলেকে রিস্কা চালায়।
– যা, ভালো করে চেক করে চোখ বেঁধে ডেরায় অনবি, এই পচা তুই ট্যাপার সাথে যা।
ট্যাপা আর পচা মিলে সমরকে ফিজিক্যালি চেকআপ করে, ভালো ভাবে চোখ বেঁধে উমেশের ডেরায় এনে হাজির করলো। পচা সমরের চোখ খুলে উমেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সমর চারদিকে রিক্সা চালিয়ে বেড়ায় ফলে উমেশকে তার চেনা চেনা লাগলো। সমর সেটা বলতে গেলে, উমেশ তাকে থামিয়ে আসল কথা বলতে বললো। সমর একটু গলা ঝেড়ে নিরঞ্জন বাবুর ব্যাংক থেকে নগদ দুই লাখ টাকা তোলার ব্যাপারটা বললো। তার সাথে এটাও বললো ওই বাড়ীর মেন গেটের ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে আছে। ফলে ঢুকতে কোনো অসুবিধা হবে না। উমেশ একটু বিরক্ত হয়ে বলল-” সব তো বললি, ঠিকানাটা তো বলবি!” ঠিকানা বলার আগে সমরের একটা শর্ত আছে, ডাকাতি করা টাকার ফিফটি পার্সেন্ট তাকে দিতে হবে। সমরের শর্ত শুনে উমেশ রেগে গিয়ে বলে-” এখানে বাওয়ালি করতে এসেছিস! টেন পার্সেন্ট পাবি।” এই ভাবে কিছুক্ষন দর কষাকষির পর টোয়েন্টি পার্সেন্টে রফা হয়, এবং নিরঞ্জন বাবুর বাড়ীর ডুপ্লিকেট চাবি উমেশের হাতে দিয়ে, বাড়ীর ঠিকানা বলে সমর সেখান থেকে চলে যায়। উমেশ চাবিটা দিকে তাকিয়ে সেটাকে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে-” শালা বেইমানের বাচ্চা রিলেশন ভালো থাকতে থাকতে ডুপ্লিকেট চাবিটা করে রেখেছে।”
এদিকে রেশমি সংসারের কাজ মাঝখানে ছেড়ে যাওয়ায় দুপুরের রান্নাবান্না তো অর্ধাবস্থায় থাকলো। দয়াময়ী বসু শয্যাশায়ী , নিরঞ্জন বাবু পুরুষ মানুষ সংসারের কাজ কখনো করেননি। দুপুরে খাওয়া দাওয়া তো করতে হবে, সুতরাং রাগে গজগজ করতে করতে স্ত্রীর ইন্সট্রাকশনে সংসারের হাল ধরলেন। ততক্ষণে নিরঞ্জন বাবুর স্ত্রী লাসভেগাসে ছেলেকে ফোন করে রেশমি ও সমরের কুকীর্তি গুলো অদ্যাপান্ত বললেন। ছেলে সব কথা শুনে বললো-” বাবা ঠিক করেছে, ওদের মধ্যে হিউম্যানিটি বলে কিছুই নেই। যত ওদের ডিমান্ড ফুলফিল করবে ওরা তত নিউ ডিমান্ড ক্রিয়েট করবে । বাবাকে টেনশন করতে বারণ করো। বাবা হাই প্রেশারের পেশেন্ট, মেডিসিন গুলো টাইমলি খেতে বলো। আমি আমার বন্ধু মৃণ্ময়কে বলে দিচ্ছি ইমিডিয়েট একটা নুতন কাজের লোকের ব্যাবস্থা করতে। আর একটা কথা, বাবাকে বলো মেনে গেটের লকটাকে চেঞ্জ করতে। এখন রাখছি, কোনো প্রবলেম এরাইজ করলে এস সুন এস পসিবল আমাকে জানিও।”
উমেশ; পচা, ট্যাপা, পটাইদের নিয়ে রাত বারোটায় ডেরায় একত্রিত হলো। পাঁচজন দুটো মোটর সাইকেল যাবে,গায়ে ক্যাটারিং এর সাদা পোশাক,বুকে নামজাদা ক্যাটারারের ফলস নেম প্লেট লাগানো। পাঁচটা হেলমেট, একটা এক নলা রিভালবার, গোটা চারেক ভোজালি। পচা উমেশকে বলল-” বস খবর নিয়েছি, পুলিশ ভ্যান রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে সি কে ব্লকে ফার্স্ট রাউন্ড দেয়, সেকেন্ড রাউন্ড দেয় রাত তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে।” উমেশ বললো-” ও কে, আমরা তাহলে রাত দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে অপরেশন সাক্সেস করে ফেলবো।”
ঠিক রাত দুটো, নিরঞ্জনবাবুর বাংলো বাড়ীর সামনে এসে উপস্থিত হলো উমেশ সহ পাঁচ জন; পচা, ট্যাপা কেলো , এবং পটাই। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিয়ে খুব সহজেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে কোলাপসিবল গেটটি খুলে ফেললো। পটাই দাঁড়ালো একদম বাইরে নিজেকে একটু আড়াল করে। কেলো মিডল ম্যান হিসাবে থাকলো কোলাপসিবল গেটের মধ্যে। ভারী একটা পাথরের চাঁই দিয়ে এক পাল্লার দরজার মাঝ বরাবর লক স্থানে এমন জোরে আঘাত করা হলো যে দরজাটা একটি ধাক্কাতেই খুলে গেল। উমেশ, পচা, ট্যাপা ঘরের ভিতর ঢুকেই চমকে উঠলো।
ঘরে লাইট জ্বলছে, এলোমেলো বিছানাতে নিরঞ্জন বাবু চিৎহয়ে মুদিত চোখে শুয়ে আছেন। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। নিরুপায় স্ত্রী কিংকর্তব্যবিমূরের মতো প্লেট লাগানো পা দুটি নিয়ে পাশে বসে আছেন। উমেশদের অসময়ে অপ্রত্যাশিত প্রবেশে বৃদ্ধার বুঝতে অসুবিধা হয়নি ওরা কারা। তিনি অসহায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললেন-” বাবা তোমাদের যা খুশি নিয়ে যাও, শুধু আমাদের প্রাণে মেরোনা। তাহলে মৃত্যুর সময় আমরা একটু ছেলেটাকে দেখতে পাবোনা। পাশের ঘরে টেবিলের ওপর মোবাইলটা আছে, শুধু ওইটা একটু এনে দাও বাবা। (স্বামীকে দেখিয়ে) এই মানুষটার ছয় সাত ঘন্টা আগে মনে হচ্ছে সেরিব্রাল এট্যাক হয়েছে। আমি দেখছি কিন্তু কিছু করতে পারছিনা। কাউকে যে খবর দেব তারও উপায় নেই, ফোন পাশের ঘরে,আর আমি হাঁটা চলা করতে পারিনা। তোমরা আমার সন্তানের মতো, সব নিয়ে যাও,শুধু ফোনটা একটু এনে দাও। ভগবান হয়তো তোমাদের সেই জন্যই পাঠিছেন।”
উমেশ এতদিন চুরি ডাকাতি করছে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনো হয়নি,এই অনাকাঙ্খিত দৃশ্য চাক্ষুস করে সে স্তম্ভিত হয়ে যায় ,নির্বিকারে ভদ্র মহিলার করুন আর্তি গুলো যতটা না শুনছে ভাবছে তার থেকেও বেশি —
তখন তার পাঁচ ছয় বছর বয়স হবে। মা অসুস্থ, বাড়ীওয়ালা তিন মাসের ভাড়া না দিতে পারার জন্য বাবার গলা ধাক্কা দিচ্ছে। বাবা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ীর মালিকের কাছে সময় ভিক্ষা চেয়েছিল কিন্তু পাইনি। সেখান থেকে লোটা কম্বল গুটিয়ে অসুস্থ্য মাকে আর তাকে নিয়ে তৎকালীন উল্টোডাঙা স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে ওঠে। শীতের দিনে খোলা প্লাটফর্মে থেকে অসুস্থ্য মা ধকল সইতে পারেনি। যেদিন মা তাকে আর বাবাকে ছেড়ে চলে গেল, সেইদিন ছোট্ট উমেশ খুব কেঁদেছিলো। আবার সেই ছোট চোখে আগুনও জ্বলেছিলো, বাড়ীওয়ালার আচরণ দেখে।
পচার কথায় উমেশের সম্বিৎ ফিরল-” বস তুমি কি চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই বুড়ির লাফরাবাজি শুনবে নাকি? আধ ঘন্টার মধ্যে কাজ সারতে হবে।” উমেশ একটু ভেবে বললো-” পচা যা পাশের ঘর থেকে ফোনটা এনে দে”
— খেপেছ বস, মোবাইল হাতে পেলে সব কেলো হয়ে যাবে!
— তোকে যা বলছি তুই তাই কর।
পচা পাশের ঘর থেকে মোবাইলটা এনে বললো– ” বস আবার বলছি যা বলার তুমি বলো, মোবাইল হাতে পেলে কিন্তু একশোতে ডায়াল করবে। তখন সব সমেত মামার বাড়ী গিয়ে রাত কাটাতে হবে।” দয়াময়ী দেবী কেলোর কথা শুনে বললো-” ঠিক আছে বাবা ,আমার হাতে ফোন দিতে হবে না। কি বলতে হবে বলে দিচ্ছি আর নম্বরটাও বলছি ,তুমি ফোন করো।” উমেশ বৃদ্ধার কথা শুনলো, কিন্তু পচার কথাও ফেলতে পারলো না। বৃদ্ধার দেওয়া নম্বরে ফোন করলো ,কিন্তু রিং হয়ে গেল। দয়াময়ী দেবী একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-” এখুনি রিং ব্যাক করবে।” তাঁর মুখের কথা শেষ হতে না হতে ফোন বেজে উঠলো। উমেশ ফোন রিসিভ করে – ” হেলো” বলতেই অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন করলো “হু আর ইউ?” নিশ্চই নিরঞ্জন বাবুর পুত্র অসময়ে মায়ের ফোনে অচেনা পুরুষ কণ্ঠ শুনে ভয় পেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন। উমেশ নিজের পরিচয় না দিয়ে বললো-” আপনার বাবার সেরিব্রাল এট্যাক হয়েছে, তাড়াতাড়ি হসপিটালে যোগাযোগ করুন।” ফোনে দুই চারবার হেলো হেলো আওয়াজ হলো।উমেশ উত্তর না দিয়ে বৃদ্ধার হাতে মোবাইলটা দিয়ে কেলো পচাকে বললো-” তোরা ডেরায় ফিরে যা। সাবধানে যাবি, পুলিশের নজরদারি ভ্যান আসার সময় হয়ে গেছে।” কেলো রীতিমতো ভয় পেয়ে বললো-” বস তুমি কিন্তু আগুন নিয়ে খেলছ! শোনো, ওদের ছেলেকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছো ব্যাস এবার চলো টাকা কড়ি নিয়ে সটকে পড়ি। ছেলে যদি থানায় ফোন করে তো——” এরই মধ্যে আবার ফোন বেজে উঠলো। এবার বৃদ্ধা ধরলেন। অন্য প্রান্তের কথা ভালোভাবে না শোনা গেলেও বৃদ্ধার কথা শোনা যাচ্ছে— হেলো-হ্যাঁ- সব বলছি, তুমি আগে এপেলো তে ফোন কারো– ও করেছ, আচ্ছা ঠিক আছে, শোনো তোমার বাবা রেশমি আর সমরের ব্যাবহারে এবং পরিস্থিতির চাপে খুবই দুশচিন্তায় ছিলেন। হঠাৎ রাত এগারোটা নাগাদ বললেন যে তাঁর বুকে ব্যথা করছে। তারপর বললেন, গা গুলাচ্ছে, তলপেট ব্যাথা করছে। আমি বললাম পটিতে যাও। না গিয়ে খাটে উঠে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষন পর নাক মুখ দিয়ে রক্ত গড়াতে থাকলো, উনিও নিস্তেজ হয়ে গেলেন। এই অবস্থায় নিরুপায় হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে থাকলাম। তোমাকে যে ফোন করবো সেটিও পাশে ছিল না। অগত্যা এক সময় ঈশ্বরই মুখ তুলে চাইলেন। সন্তানসম তিন চারটি ছেলে এসে আমাকে সাহায্য করছে। তুমি আবার ফোন করে এপেলোতে কন্টাক্ট কর, তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স পাঠাও—–“
এদিকে কেলো পচারা উমেশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারবেনা বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে গেল। উমেশ আস্তে আস্তে নিরঞ্জন বাবুর কাছে গেল। পায়ের তলায় হাত দিয়ে দেখলো, পা ঠান্ডা হয়নি। বুকের উপর নিজের কান রেখে দেখলো,শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। নিরঞ্জন বাবুর স্ত্রী সেলফোনটি রেখে বালিশের তলা থেকে আলমারির চাবিটা বার করে উমেশের হাতে দিয়ে বললো-” একটু পরেই এম্বুলেন্স এসে যাবে, তুমি আলমারির লকারটা খুলে দেখো টাকা আছে, ওখান থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বার কারো।” চাবিটা হাতে নিয়ে উমেশ বৃদ্ধার অনুরোধ গুলো শুনছিলো, কখন যে তার দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে গেল সে বুঝতেও পারলোনা। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে চোখে দাবানলের আগুনই জ্বলে আছে, নেভে তো নি-ই উল্টে মাঝে মাঝে তীব্র আকার ধারণ করেছে। উমেশের মনে পড়লো মা মারা গেলে তার চোখ দিয়ে এ ভাবেই অশ্রুপাত হয়েছিল। নবীন আঁখিতে সেই অশ্রু শুষে নিয়ে সেই যে দাবানল এসেছিল যেটা আজও নেভেনি। আজ এই মুহূর্তে তার শুধু মায়ের মুখটাই মনে পড়ছে। চাবিটা হাতে নিয়ে উমেশ দয়াময়ী দেবীর চোখের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। দয়াময়ী দেবী উমেশের মনের অবস্থা উপলব্ধি করে বললেন-” এখনই হয়তো এম্বুলেন্স এসে যাবে, যাও বাবা আমাদের একটু রেডি করে দাও।”
উমেশ আলমারির লকার খুলতেই ব্যাংক থেকে তোলা সমস্ত টাকা, ও কিছু গয়না দেখতে পেল। ডাকাতির উদ্দেশ্যে এসে এত অর্থ স্বর্ণলংকার হাতে পেলে ডাকাতদের মাথার ঠিক থাকে না। কিন্তু উমেশের কিছুই মনে হলো না। এ সব গুলো তার কাছে অতি সাধারণ বস্তু বলে মনে হলো। কয়কে ঘন্টা আগও তার শরীর দিয়ে জিঘাংসা মানসিকতার অর্থ পিপাসু তপ্ত রক্ত বইছিল, এখন তা শীতল হয়ে গঙ্গার জলের মতো হয়ে গেল। উমেশ সেখান থেকে একটা পাঁচশ টাকার বান্ডিল বার করে তালা বন্ধ করে দিলো। তারপর দয়াময়ী দেবীর কাছে গিয়ে টাকা আর চাবিটা দিতে গেল। দয়াময়ী দেবী বাধা দিয়ে বললেন-” তোমার কাছে থাক বাবা, এম্বুলেন্স আসলে ঘরে তালা দিয়ে যে তোমাকেই আমাদের সাথে যেতে হবে,তা না হলে আমাদের কে ভর্তি করবে, আর কেইবা বাড়ির দায়িত্ব নেবে?” কথা গুলো শুনে এবং দয়াময়ী দেবীর আচরণ দেখে উমেশ নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বড়লোকদের সম্পর্কে তার এত দিনের ধ্যান ধারণা নিমেষে বদলে যেতে থাকলো। তার চোখে প্রথম প্রতিহিংসার আগুন জ্বলেছিলো সেদিন, যেদিন তাদের বাড়ী ওয়ালা অসুস্থ্য মাকে সহ শীতের রাতে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বার করে দিয়েছিল। আর আগুন নিভেছিলো সেইদিন, যেদিন বাড়ীওয়ালাকে নিজে হাতে খুন করতে পেরেছিল। আবার সেইদিন তার চোখে আগুন জ্বলেছিল, যেদিন খিদের জ্বালায় মুদির দোকান থেকে একটা শুকনো রুটি চুরি করার জন্য মুদি ওয়ালার কাছে অমানুষিক মার খেয়েছিল। সেই আগুন নিভেছিলো সেইদিন, যেদিন ওই দোকান ভেঙে চুরি করে দোকানদারকে সর্বসান্ত করেছিল। ঠিক এই মুহূর্তে তার কাছে তার পূর্ব কর্মকে পাপ বলে মনে হলো। যা এতদিন সঠিক বলে মনে হতো। ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করা উমেশ অশ্রুসিক্ত নয়নে দয়াময়ী দেবীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঈশ্বরকে বললো-” হে ঈশ্বর কেন তুমি জীবনের শুরুতে এমন মানুষের সান্নিধ্যে আননি তাহলে জীবনটা যে অন্য রকম হতো!” এরই মধ্যে এম্বুলেন্সের হুটারের শব্দ গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙেচুরে খানখান করতে করতে নিরঞ্জনবাবুর বাংলোর দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো।
কেলো পচারা পুলিশের নজর এড়িয়ে অনেকটা পথই চলে আসে। বিধান নগর মোড়ের কাছে এসে ওরা পুলিশের জালে ধরা পড়ে যায়। বিধান নগর থানাতে ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা চলে। জেরাতে জেরবার হয়ে ওরা অদ্যাপান্ত সবিস্তারে জানিয়ে দিতে বাধ্য হয়। বড়ো বাবুর নির্দেশে ভ্যান ছোট বিধান নগর উড়াল পুল লাগোয়া বস্তিতে, সমর ও রেশমিকে ধরতে। কেলো পচাদের চারজনকে লকাপে ভোরে থানা থেকে চটজলদি প্রস্তুতি নেয়া হয় নিরঞ্জন বাবুর বাংলো হয়ে এপেলো হসপিটাল যাওয়ার।
অপেলোতে ভর্তির পর্ব সব মিটে যায়। নিরঞ্জন বাবু ডেঞ্জার পজিশনে থাকায় ওনাকে আই সি সি ইউ তে রাখা হয়েছে। নিরঞ্জন বাবুর স্ত্রী নরমাল বেডে আছেন, তবে ওনারও হাঁটুর অপরেশন ইমিডিয়েট করতেই হবে। ভর্তির কাগজপত্রে উমেশই অপরিণত হাতের লেখায় সই করলো। হসপিটালের প্রাথমিক কাজকর্ম মিটতে মিটতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। উমেশ ব্যালেন্স টাকা পয়সা বাংলোর চাবি নিয়ে নিরঞ্জন বাবুর স্ত্রীর কাছে দিয়ে বললো-” মাইজি আপনার ছেলে তো আসছে, আর এদিকে এখন কোনো কাজ নেই, এবার আমি যাই।” বৃদ্ধার চোখ অশ্রু পূর্ণ হয়ে গেল। অশ্রুসজল চোখে তিনি চাবি ও টাকাটা ফেরত দিয়ে বললেন-” তুমি আমার সন্তান নও? যাকে জন্ম দেওয়া হয় সেই কি শুধু সন্তান হয়? যে মানুষটা সারা রাত জেগে খাওয়া নয় দাওয়া নয় শুধু পিতা মাতার প্রতি তার কর্তব্য পালন করে সে সন্তান নয়?”উমেশ আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা, বৃদ্ধার পা দুটি ধরে হাউহাউ করে কাঁদে ফেললো। বৃদ্ধা উমেশের মাথায় হাত রেখে বললেন-” ওঠো বাবা, এ অশ্ৰু শুধু জল নয়, এটা যে মা গঙ্গার জল, যাতে তুমি ধুয়ে মুছে শুদ্ধ হয়ে গেলে। তুমি যে আমার বাহু বন্ধনে বন্দী হয়ে গেছ বাবা। আমার ছেলে এলেও তোমার মুক্তি নেই। কাল রাত থেকে তোমার খাওয়া হয়নি, যাও নীচে ক্যান্টিন আছে, হাত মুখ ধুয়ে টিফিন করে নাও।”
এপেলোর সামনে এসে পুলিশ ভ্যান দাঁড়ালো। বেশকিছু পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে হসপিটালের মেন গেটে পোস্টিং হয়ে গেল। ইনভেস্টিগেশন অফিসার ভ্যান থেকে নেমে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে সোজা অনুসন্ধান ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দাঁড়ালো। হসপিটালের একজন কর্মী তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলে ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করেন-” গতকাল শেষ রাতের দিকে সল্ট লেকের সি কে ব্লক থেকে ভর্তি হওয়ার কোনো ইনফরমেশন দিতে পারেন?”
অফিসার এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দয়াময়ী দেবীর কেবিনে চলে এলেন। দয়াময়ী দেবী তাঁর সামনে সাদা পোশাকে পুলিশ দেখতে পেয়ে তাঁর আর বুঝতে অসুবিধা হলোনা কেন তারা এসেছে। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন-” ম্যাম আপনাকে যে ভর্তি করিয়েছে সে কোথায়?” – একটু বেরিয়েছে, কেন কি হয়েছে স্যার?
দয়াময়ী বসুর সাথে যখন পুলিশ অফিসারের কথোপকথন চলছে, এদিকে উমেশ তখন ক্যান্টিন থেকে ব্রেকফাস্ট করে বেরুলো। ওর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলো। ধূমপানের উদ্দ্যেশ্যে উমেশ এপেলোর গেটের কাছে এসে ভ্যান সহ পুলিশ দেখে চমকে উঠলো। উমেশ স্বাভাবসিদ্ধ ভাবে পালানোর চেষ্টা করলো। পকেটে চাবির গোছা আর বেশ কিছু টাকা তাকে মনে করিয়ে দিল, সে যে এক গুরু দায়িত্ব নিয়েছে। উপায় থাকলেও অন্তরাত্মার সাড়া মিলল না। মনটাকে শক্ত করে সে দয়াময়ীর কেবিনের দিকে গেল। কেবিনে ঢুকতে গিয়ে সে দেখতে পেল,পুলিশের সাথে দয়াময়ী বসুর বাক্য বিনিময় চলছে। সে বুঝতে পারলো জেরা চলছে,উমেশ আবার পালানোর চেষ্টা করলো , কিন্তু দয়াময়ী বসুকে ছেড়ে যেতে পারল না।
সোজা পুলিশ অফিসারের সামনে গিয়ে বলল-” স্যার, আমিই উমেশ সাহানি,মাঈজী অসুস্থ,ওনাকে আর জেরা করার দরকার নেই। আমাকে প্রয়োজন তো চলুন।” পকেট থেকে চাবির গোছা টাকা পয়সা যা ছিল দয়াময়ী বসুর পায়ের কাছে রেখে দিল।
পুলিশ উমেশের হাতে হাতকড়া পরাল। দয়াময়ী বসুর কোনো অনুরোধই কাজে অসলনা। আইন তার পথ ধরেই চলবে। এক রাতের স্বর্গ দর্শন করে উমেশ আবার চললো নরকের পথে।