ভববন্ধন
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
…………….
সম্প্রতি কৃষ্ণনগরাধীশ প্রসাদের উপর তুষ্ট হয়ে একখানি দূত প্রেরণ করেছেন কুমারহট্টের এই সংসারদীর্ণ ভদ্রাসনে। আগমবাগীশ মহাশয়ের কাছে প্রসাদের নিরন্তর অন্নপানের সমস্যার কথা শুনে কিছু খাস-জমি ওর নামে লেখাপড়া করে দিতে তিনি এখন ইচ্ছুক। তাই এই দূতটির হাতে একটি চিঠিতে তিনি এই মনোবাসনার কথাটিই রাজাজ্ঞার অনুধ্যানে সবিনয়ে নিবেদন করেছেন। প্রসাদ চিঠির মর্মার্থ পড়ে এবারে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে,
” সংসারে ডরি কারে—
রাজা যার মা মহেশ্বরী
আনন্দে আনন্দময়ীর খাসতালুকে বসত করি।
নাই কো জরিপ জমাবন্দী
তালুক হয় না লাটে বন্দী—”
……….
প্রসাদের পিতা বৈদ্যরাজ রামরাম সেনের সদ্য প্রয়াণের পর ওদের গার্হস্থ্য এখন কিঞ্চিৎ টলায়মান। আসলে প্রসাদের মধ্যে ঠিক সেইভাবে এখনো জাগতিক দায় দায়িত্ব এসে ছাপ ফেলতে পারেনি যতটা সে আত্মমগ্ন হয়ে কাব্য সুধায় তরঙ্গযাপন করতে অভ্যস্ত। এদিকে তারও পরিবারবৃদ্ধি বেশ কিছু বছর আগেই ঘটেছে। কনিষ্ঠা কন্যা ব্রহ্মময়ীর বয়স এখন প্রায় দশ কি একাদশ বছরে পৌঁছনোর পথে।
পত্নী সর্বাণী স্বামীটির ঐহিকতা ছেড়ে সর্বদা সুদূরযাপনের পথে ব্রতী হওয়ায় যে অসন্তুষ্টা তা ঠিক নয়। তবে ” অন্নচিন্তা চমৎকারা”, কাজেই প্রসাদকে সে স্মরোদ্দীপনার অভিনিবেশকালেও আগামীকালের অর্থচিন্তার অনুযোগটিকে না বলে আর থাকতে পারেনা।
প্রসাদ এসব ইহজাগতিক সমস্যার কথা সর্বাণীর কাছে বসে বসে কিছুক্ষণ মুখ গোঁজ করে শোনে আর তার পরক্ষণেই তার আরাধ্যা মহাকালীর উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক পদ লিখতে বসে। তখন সে সমর্পণের ভেলায় একদম ভেসে যায় সব ভববন্ধনের উর্দ্ধে উঠে।
……….
সেদিন সর্বাণী দেখেছে একটি ভূর্জপত্রে তার স্বামীটি বেশ তরিবৎ করে লিখে রেখেছে-
” দিয়েছ এক মায়ার চিন্তে/সদাই মরি তারই চিন্তে/ না পারিলাম তোমায় চিন্তে/চিন্তাকূপে ডুবে মরি…” এইরকম একটা আবেগঘন পদাক্ষর। তখন গঙ্গায় দ্বিপ্রাহারিক স্নানের জন্য প্রসাদ সবেমাত্র নির্গত হয়েছে।
আসলে সর্বাণী সর্বান্তঃকরণে কবিরঞ্জনকে এইসব জাগতিক বিষয় থেকে মুক্ত রাখতেই চায়, কিন্তু কিছু কিছু বিষয় এতটাই স্পর্শকাতর যে তার মত সর্বংসহার পক্ষেও চুপ করে থাকটা ভীষণ কঠিন। তবে প্রসাদ কলহপ্রিয় নয়। সর্বাণীর অনুযোগের কারণ সকল সেও বোঝে। তাই ঠোঁটের কোণে নির্লিপ্তি রেখেও সে সর্বাণীর শ্যামাঙ্গী তনুটি যত্ন করে দু’হাতের বেড়ীতে ধারণ করে আর তার নিরাভরণ দেহটিতে ষড়ঐশ্বর্যের সাধনায় ব্রতী হয়।
………..
আজ সকাল থেকেই প্রসাদের মনটি বেশ প্রফুল্ল। ডিহি- কলকেতা থেকে ওর একসময়ের মনিব ধনী জমিদার দুর্গাচরণ মিত্র মহাশয় আসন্ন আগমনী তিথির কুশলসংবাদ নিতে দশটি তঙ্কা প্রণামী ও পত্নী সর্বাণীর জন্য একখানি ফুলিয়ার শাটিকা প্রেরণ করেছেন।
সে একসময় ওঁদের সেরেস্তায় কাজ করতে গিয়েছিল। কিন্তু পদাক্ষরের দায় তাকে বেশীদিন মুনশীগিরি করতে দেয়নি। মিত্তিরমহাশয় সস্নেহে প্রসাদকে ফিরিয়ে দিলেও বেশ কিছুদিন ওর বেতনটি পাঠিয়ে দিতেন।
তবে আজকাল সে দিনকাল আর আগের মত নেই। ইংরেজবণিকরা বোধহয় পাকাপাকি ভাবে নবাবী নিজামত গ্রাস করে দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে এ দেশের নিয়ন্তা হবার প্রচেষ্টা শুরু করতে চলেছে।
……….
তবে এটা ঠিক যে আশ্বিনের পূর্বকালে এই আর্থিক বদান্যতা আর একখানি বস্ত্র পাঠিয়ে মিত্র মশায় প্রসাদের বড় উপকার করলেন।
বর্ষায় তাদের গৃহের বেড়াটি একদম ভগ্নপ্রায় হয়ে গেছে। এখন দু-এক কাহন খড় এই অনুদানের তঙ্কা থেকেই নির্বিঘ্নে কিনে গৃহ সারাই সংক্রান্ত সর্বাণীর সকল অভিযোগের একটি অন্তত দূর করতে প্রসাদ এবারে সক্ষম হবে।
……….
বেলা দ্বিপ্রহরে দু-কাহন খড় বিশু ঘরামি এসে দিয়ে গেছে। বাকী তঙ্কার বেশীটাই প্রসাদ সর্বাণীর আঁচলে গেরো দিয়ে এসেছে আর পাঁচ আনা সে আরাধ্যা কালিমাতার নামে সামান্য কারণানন্দ সংগ্রহের জন্য নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছে।
বিকালে কনিষ্ঠা কন্যাটিকে পরম আহ্লাদে নিজের কাছটিতে ডেকে নেয় প্রসাদ।
কনিষ্ঠার নাম সে রেখেছে তার আরাধ্যা ব্রহ্মময়ীর সমনামে। তার কারণ ব্রহ্মময়ীর জন্ম আর ত্রিকালেশ্বরীর পদাম্বুজ ধ্যানে বসে মূলাধার চক্র থেকে উন্মার্গগমনে সহস্রারপদ্মের উন্মোচন যেন একই মাতৃশক্তির লীলারূপেই সে একইসাথে পেয়েছে। মা ও মেয়ে এই দুই অভিন্নাত্মাতেই প্রসাদের পদকীর্তনে সেজে উঠছে আগামীকালের শাক্ত-পদাবলীর গীতসুষমা।বৈদ্য বংশের সন্তান হয়ে প্রসাদ তার পিতৃকূলের ভিষগ-বিদ্যাটি সম্পর্কে উদাসীন। বরং সে চিরদিন কালীপদের নামামৃত পানেই মশগুল।
……….
কন্যার দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শনে বসে সে খড়ের গোছা দু হাতে নিয়ে বেড়া বাঁধতে বসে। আর কনিষ্ঠাটি সকৌতুকে পিছন থেকে এগিয়ে দিতে থাকে কাঙ্খিত বন্ধনের খড়ের সূত্রগুলি।
দেখতে দেখতে একঘন্টা সময় অতিক্রান্ত হলে কনিষ্ঠাটি এবারে তার ক্রীড়াসঙ্গীদের জন্য উচাটন হয়ে ওঠে। সে অগোচরে খড়ের গোছাটি নামিয়ে রেখে গোপনে চম্পট দেয়।
প্রসাদ তন্মধ্যভাবে বেড়া বাঁধার কাজে মগ্ন থাকে। সে যদিও কন্যার অভাবটি কিছুমাত্রেই টের পায়নি কারণ তার পিছন থেকে খড়ের গোছাটির একবারের জন্যেও তার হাতে আসার পর্যায়টি যে বন্ধ হয়নি। তাই সে জানতেই পারেনি যে ব্রহ্মময়ী কখন এ কাজে ক্ষান্ত দিয়ে অবসৃতা হয়েছে।
……….
খানিক পরে কনিষ্ঠাটি ভয়ে ভয়ে এসে দেখে তার পিতাটি তখনো কাজে মশগুল আর বেড়া বাঁধার কাজটিও প্রায় শেষের পথে। সে ভয়ে কাঠ হয়ে এবারে প্রসাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলে অজানিতেই।
প্রসাদও কন্যাসমীপে সবটা শুনে বিস্মিত হয়। তাহলে কি করে খড়ের গোছাটি এতক্ষণ ধরে সমানে হাতে এসে গেল! কে দিয়ে গেল খড়ের যোগান?
পরক্ষণেই অন্তর্লীন আলোয় সে দেখতে পায় জগৎপ্রসবিনীর সহাস্য মুখটি।
আহা! ওদের দুজনের নামই যে ” ব্রহ্মময়ী “!
তাই কারুবাসনার পরমানন্দে সেব্য-সেবকের রীতিনীতি, পিতা-পুত্রীর সহজয়তায় আজ এসে মিলে গেল।
প্রসাদ মহাশক্তির এই মানুষী লীলাটি আত্মস্থ করে আনন্দময় হয়ে ওঠে। অবশ্য তার বিস্ময়ের শেষাংশটিও বড় মধুর। প্রসাদ দেখে তার মৃন্ময়ী আরাধ্যা দেবীমূর্তির দক্ষিণকরে দু-একটি খড়ের গোছা হস্তধৃত রেখে অনির্বচনীয় ঐশী মায়ায় সহাস্য বদনে দাঁড়িয়ে আছেন শবশিবারুঢ়াং মহামায়া।
……….
প্রসাদের ভক্তপ্রাণে ধীরসমীরে পুলকিত হৃদিপদ্মেবেজে ওঠে অসমাপ্ত পদগীতিকাটির সম্পূরণের অনন্য পঙক্তিগুলি-
“সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া,
তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।
অদ্য অব্দশতান্তে বা,
ফসল বাজাপ্ত হবে জান না।
আছে একতারে মন এইবেলা,
তুই চুটিয়ে ফসল কেটে নে না।”
–~০০০XX০০০~–