মুখরোচক
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
– “যদি গল্পই চাই সেটা আবার ইনবক্সে কেন? “
চা এর কাপ হাতে বেজায় চেঁচামেচি জুড়ল অনুপম।
আমি বললুম, ” দ্যাখ ভাই! ইনসেস্ট না চেয়ে ইনবক্স চাইছে তো!! চাপ কিসের রে…দিলে দিয়ে দে সবাই ই-মেলে নেয় কি…? “
অনুপম ব্যাজার মুখে বলল – ” সেটা তো বুঝেছি। কিন্তু বলতো এটা কি ওইভাবে সবটা বলা যায়! এটাও কি নাট্যশাস্ত্রে লিখে গেছিলেন তোদের ভরতমুনি?”
এবারে ধূমায়িত চা’সাথে গরমগরম আলুর চিপস্ আসতে অনুপম স্বস্তি পেল দেখলাম। অতঃপর দুটো চুমুক দিয়ে এক খাবলা চিপস্ তুলে উদাস গলায় বলল,
” তোর সর্বাণীবৌদি’কে মনে আছে? ওই যে সাত এর বি- বাড়িটায় স্বামী-স্ত্রী দু’ জনে ভাড়া থাকত! ”
……..
আমারও মনে আছে কনভেন্ট কেতাদূরস্ত সেই স্মার্ট মহিলাটিকে। তখন তো এত স্টাইল আর ফ্যাশনফিনিশ বা মোবাইল আসেনি। আর আমরাও তখন ক্লাস এইট কি নাইন হব।
অনুপম আবার বলল, ” আমাদের পুরনো বাড়িটার পিছনদিকেই ওই সাত এর বি! নিশ্চয়ই ভুলিসনি যে ওর স্বামী মলয়দা একটা পার্কস্ট্রীটে হোটেলে ব্যান্ড বাজাত আর কখনো কখনো পোর্ট্রেট আঁকত প্যাস্টেলে! মলয়দা বৌদিকে বিয়ের আগে কখনো ওদের হোটেলে এই গান গাওয়ার চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছিল আর সেটাই সেসময় ওদের প্রেমের সূত্রপাত ঘটিয়ে দেয় আর সেখান থেকেই এপাড়ায় এই সংসারপাতা।”
আমি বললাম, ” এতসব না জানলেও এটা মনে আছে যে মলয়দা খুব ড্রিঙ্ক করত। আর সেটার জন্যই আর বেশীদিন বাঁচলনা। তবে বৌদিকে নিয়ে কিছুদিন একটা গসিপ চলত ঠিকই কিন্তু মলয়দা মারা যাওয়ার পরের দিনই সব প্যাক করে বৌদি এ পাড়া ছেড়ে চলে যায় সেটা মনে আছে ! তবে কেনোই বা চলে যায় বা তারপরের কিছু আর জানিনা। ওই যে বললাম তখন আমরা এতটাও স্মার্ট হয়ে যাইনি যে…!”
অনুপম দেখি রুমাল বের করে চোখটা একটু রগড়ালো। তারপর বলতে শুরু করলো,
” আমাদের পিছনেই তো থাকত। তাই এটুকু জানি যে বৌদির গান গাওয়াটা নিয়ে ওদের মধ্যে রোজ ঝগড়া হত। এমনকি দাদা’র নেশা চড়লে বেশীর ভাগ সময়ে তার চরিত্র নিয়েই খারাপ ইঙ্গিতটাও করতে শুনতাম!
আসলে হোটেলে গান এই ব্যাপারটা তো আর ঠিক জলসায় গান গাওয়া নয়….!
তবু বৌদি গাইতে যেত ওখানে। মলয়দা ড্রিঙ্কটা বাড়ানোর কাজে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কাজেই ওকেই তখন সংসারের হাল ধরতে হল সেটা বুঝতেই পারছিস্!
…….
এবারে আসল ঘটনাটা শোন্! মলয়দা যেদিন মারা গেল সেদিন খুব বৃষ্টি। রক্তবমি তুলতে তুলতেই সবটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল। ওদিন বৌদি আর কাজে যায়নি। মৃত্যুপথযাত্রীর সেবাটাই দাঁতে দাঁত চিপে শেষ অবধি করে যাচ্ছিল।
এবার পাড়ার সবাই এল। কয়েকফোঁটা চোখের জল ফেলেই আস্তে আস্তে ওখানে বসেই সবর গলায় পি. এন. পি.সি চালু হল। সামনে তখনো মৃতদেহটা রাখা আর বলা বাহুল্য বৌদি ওদের সামনে ছিলনা। একটুআগে রান্নাঘরের দিকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কি সব করছিল।
…..
একটুপরে বাড়িটায় মাছভাজার গন্ধ ছাড়তেই সবাই এবার নড়েচড়ে উঠল। এইসময় আবার “মা-আআআছ ভাজাআআআআ!”
সবাই দেখল বৌদি ভাবলেশহীনমুখে একটা ফ্রাই এনে মলয়দার শয্যার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল আসলে মলয়দা এরকম ফ্রাই খেতে ভালবাসত…তাই ওকে শেষবার খাওয়াতেই…..
বলা বাহুল্য বৌদির এই সতীপনাটা সব শাস্ত্রজ্ঞ পড়শীদের এক্কেবালেই পছন্দ হলনা। এসময়ে আবার যতসব ন্যাকামো!
….
এরপর যেটা হল সেটা আরো সাঙ্ঘাতিক। সবার সামনে ওই ভাজাটা আলতো করে নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে বৌদি দাদার মৃত ঠোঁটে ভেঙে খাইয়ে দিল। তারপরে আবার সাফাইও গাইল যে, ” আমি না টেস্ট করলে ও তো কখনোই খেত না..তাই “
ভাব তো দেখি একবার, কনভেন্ট -টনভেন্টে পড়েছে বলে এত্তোওওও! সদ্য যে মেয়ে হিন্দুঘরের বেধবা! এখন সে সবার সামনে মাছভাজা ভেঙে মৃত স্বামীকে খাওয়াতে যাচ্চে! বল এসব সামনে বসে দেখলে কার সহ্য হয়…শালাআআআ!
সমবেত পাব্লিকের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো জোর। দেখলাম বেশীর ভাগ প্রতিবেশী এ নিয়ে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছে আর মুখে তাদের অগ্নিবর্ষণ। আড়াল না মেনেই তাদের কেউ একজন প্রকাশ্যে বলল
‘ ভাতারখাকী….খা….কি কোথাকার!’
….
বুঝতেই পারছিস কেন কাজেই কোনওমতে সেদিনের পরের দিনই বৌদিকে ও বাসা ছাড়তে হল। হাজারহোক এতবড় অধম্ম আমরা কি সইতে পারি রে! আর বেচারা মলয়দা…”
….
আমিও ওর গল্পটা শুনতে শুনতে সেই তথাকথিত অসতী বৌদিটির কথা ভাবতে বসেছিলাম। ভাবছিলাম মেয়েমানুষ কতটা অসতী আর অধার্মিক হলে স্রেফ ভালবাসার দোহাই দিয়ে একজন স্ত্রী হয়ে সে তার সদ্যমৃত স্বামীটি খেতে ভালবাসত বলে তক্ষুণি মাছভাজা ভেজে এনে শেষবারের জন্য খাওয়াতে যায় আর একমাথা অসম্মান আর কটূক্তি সম্বল করে নীরবে পাড়া ছেড়েও চলে যেতে পারে!
….
এবারে তাকিয়ে দেখলাম অনুপমেরও গলায় এখন জমাট অশ্রুবাষ্প। আর ওর সামনে রাখা আলুভাজাগুলো যেন ক্রমে মিইয়ে এসেছে, ঠিক যেমন মুখরোচক কোন মুচমুচে বিতর্কের স্বাদু কোন পদ কালের প্রকোপে তার মর্মার্থটাকে বুঝতে পেরে স্বাদহীন হয়ে যায়!
–~০০০XX০০০~–