অথ কথা নালন্দা
কাকলি ঘোষ
অন্তিম পর্ব
দেখতে দেখতে হই হই করে এসে পড়ল সেই রোমাঞ্চকর দিন। পয়লা মে ২০১৬। কিন্তু হঠাৎই তার আগেই কাজলকে পেশার তাগিদে চলে যেতে হল গৌহাটি। সকলে একদিকে যেমন উত্তেজিত, উৎসাহিত অপরদিকে কিছুটা বিষন্নও বটে। যার লেখা নাটক —— এমন দিনে সেই উপস্থিত থাকতে পারবে না ? সাক্ষী হতে পারবে না জীবনের এমন একটা গৌরবময় ঘটনার ?
কিন্তু গৌহাটি এমন কি দূর যে এই দিনে আটকে রাখতে পারে নাট্যকারকে ? সবাইকে চমকে দিয়ে প্রাণের টানে একদিনের ছুটিতে কাজল এসে পৌঁছে গেলেন একাডেমী অফ ফাইন আর্টসে। ব্যস ষোল কলা যেন পূর্ন হল। সদলবলে হাজির হয়ে গেলাম একাডেমী চত্বরে। সেখানে তখন মানুষের মেলা। কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। টিকিটের হাহাকার।
বহুরূপীর জন্মদিন উপলক্ষে সেদিন একাডেমিতে উপস্থিত ছিলেন অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এঁদের মধ্যে কবি শঙ্খ ঘোষ, অভিনেতা সৌমিত্র বসু বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও আরো এক গুচ্ছ ছোট পর্দার তারকারাও ভিড় জমিয়েছিলেন সেই শোতে। সেদিন “কথা নালন্দা” র শো এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল দুটো। একটা তিনটে থেকে আর অন্যটা ছটায়। শুধু হাউজফুল বললে বোধ হয় ভুল বলা হয়। কারণ দুটি শোতেই অতিরিক্ত বসার ব্যাবস্থা করতে হয়েছিল কর্তৃ পক্ষকে। টিকিটের চাহিদা ছিল তুঙ্গে।
যাই হোক নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছু আগেই পৌঁছে গেছিলাম হলে। দলটি মোটামুটি বড়ই ছিল। আর টিকিট করতে দেওয়া হয়েছিল একজন পারিবারিক বন্ধুকে। তিনি করেও ছিলেন। কিন্তু একসঙ্গে অনেকগুলো টিকিট করার জন্য টিকিটগুলো হয়ে গেছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ফলে বণ্টনের সময় বেজায় গোলমাল দেখা গেল। ভদ্রলোক স্থিতধী । মাথা ঠাণ্ডা করেই কাজ করছিলেন। কিন্তু পড়লেন ভীষণ বিপদে। যাকে যেদিকের টিকিট ধরাচ্ছেন সে ই বেঁকে বসছে।
যেমন ধরুন একসঙ্গে এক রো তে পড়েছে তিনটে টিকিট। তো মিস্টার এবং মিসেস ঘোষ একসাথে বসবেন কিন্তু মিস চক্রবর্তী তাদের পাশে বসবেন না। তিনি তার বান্ধবীর সাথে যেখানে বসতে চান সেখানে দেখা যাচ্ছে একটিই মাত্র সিট আমাদের দলের । অন্যটি অপরিচিত কারুর দখলে।
মিস্টার পালের পায়ে ব্যাথা । সুতরাং তাকে দিতে হবে ধারের সিট টি। এদিকে মিসেস পাল স্বামীর পাশেও বসবেন অথচ ওই সিট টি তার পছন্দ নয়। কারণ তার সামনের সারিতে রয়েছেন দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এক দশাসই চেহারার ভদ্রলোক যার ফলে স্টেজ দেখতে তার অসুবিধে।
মিসেস নিয়োগীর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। চোখের অসুবিধে। একটু সামনের দিকে সিট হলেই তার ভালো। সেইমত খরচ করতেও তিনি রাজি। এদিকে সামনের সারির টিকিট একটিও পড়ে নেই। ফলে তাঁকে অন্যদের সঙ্গে মাঝের সারিতেই বসতে হচ্ছে।।
এক অবাঙালি ভদ্রলোক যিনি নাট্যকারের বন্ধু , সস্ত্রীক এসেছেন তারই অনুরোধে। তাকে এমন জায়গা দেওয়া উচিত যেখানে অন্তত একজনও পরিচিত ব্যাক্তি থেকে তাকে নাটক বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে আর হয়ে উঠল না।
এই রকম আর কি। বেচারি বন্ধুবাবু। সত্যিই সেদিন তার ফাঁপরে পড়া মুখ দেখে হাসি চাপা কঠিন হচ্ছিল। কিন্তু ভদ্রলোকটি কঠিন ব্যাক্তি। সব রকম সামলাচ্ছিলেন বেশ নরম গরমে।
অবশেষে হাজার রকমের পারমুটেশান কম্বিনেশন এর পর সকলের মোটামুটি বসার ব্যবস্থা হল। আর হলের তৃতীয় ঘণ্টা বাজিয়ে শুরু হয়ে গেল নাটক
“ কথা নালন্দা। “
এর পরেরটুকু শুধু চোখ টান করে দেখার পালা। চোখের সামনে তৈরি হয়ে ওঠা চরিত্রগুলোকে মূর্ত হয়ে উঠতে চাক্ষুষ করা। বহুরূপী দলের অভিনয় দক্ষতার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই নাটকে দেবেশ রায়চৌধুরী এক ঝাঁক নতুন মুখকে সুযোগ দিয়েছিলেন। আর সেই তরুণ প্রজন্ম সেই সুযোগের যথা যোগ্য সম্মান দিয়েছিল।
সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে অত্যন্ত মনোরম, উপভোগ্য এবং মননশীল একটি নাটক সে সন্ধ্যায় আমরা উপহার পেয়েছিলাম। নাট্যকার কাজল চক্রবর্তীর রচনা আর বহুরূপীর যথা যোগ্য অভিনয় এই দুইয়ের অপরূপ যুগলবন্দি সে সন্ধ্যায় রচনা করল এক ইতিহাস।
অন্তিম পর্যায়ে অগণিত দর্শকের মুহুর্মুহু করতালি প্রমাণ করে দিয়েছিল এই নাটক কতদূর মঞ্চ সফল। অবশেষে সকলের সামনে মঞ্চে এলেন নাট্যকার কাজল চক্রবর্তী। যিনি দুই এক কথায় তার এই নাটক রচনার ইতিহাস শোনালেন এবং ধন্যবাদ জানালেন বহুরূপীকে তার স্বপ্ন সার্থক করার জন্য।
এরপর তো খেলা ভাঙার খেলা।
“ কথা নালন্দা” র বেশ কিছু শো কলকাতা তো বটেই বাইরেও হয়েছে। তার মধ্যে খোদ নালন্দাতেই একবার অভিনয়ের জন্য ডাক পেয়েছেন তারা। এরপর আস্তে আস্তে কমেছে শো। এসেছে বহুরূপীর নতুন নাটক। সেই ট্র্যাডিশন চলছে। শুধু নাট্যকার কাজল চক্রবর্তী চলে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালে। কেমন আছেন তিনি ? আর কি কোন নাটক লিখছেন ? কোন বিষয় নিয়ে চলছে তার গবেষণা ? আবার কি আসবে “ কথা নালন্দা “ র মত আর কোন নাটক যা আবার নাট্য মোদী মানুষকে একেবারে ভিত থেকে নাড়িয়ে দেবে ? এর উত্তর তিনিই দিতে পারেন।
–~০০০XX০০০~–