অথ কথা নালন্দা
কাকলি ঘোষ
প্রথম পর্ব
শিরোনাম দেখে অনেকে হয়তো ভেবে নেবেন আমি নালন্দা মহাবিহার সম্পর্কে একটি জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেবার উপক্রম করছি। কিন্তু আদপে তা নয়। নালন্দা নিয়ে বলার বা লেখার জন্য অনেক বিদগ্ধ ব্যাক্তি রয়েছেন। আমি অতি সামান্য একজন। ও নিয়ে কথা বলা আমায় সাজে না। আমি শুধু বলছি “কথা নালন্দা” র কথা। কি বলছেন ? আবার গুলিয়ে যাচ্ছে ? আর একটু স্পষ্ট করা দরকার ? বেশ বেশ। তবে আরো একটু প্রাঞ্জল করে বলি।
বেশি নয় মাত্র পাঁচ বছর আগে কলকাতার এবং কলকাতার বাইরেও বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে একটি নাটক রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল।বহু জ্ঞানী গুণী মানুষের পদধূলি পড়েছিল এই নাটকের অভিনয়ের দিনগুলিতে।
নাটকটির নাম “ কথা নালন্দা “
রচনা কাজল চক্রবর্তী
প্রযোজনা বহুরূপী
দ্বাদশ শতকের শেষের দিক। নালন্দার পূর্ব গৌরব ততদিনে অস্তমিত। গুটি কয়েক অধ্যাপক এবং উৎসাহী কিছু ছাত্রের অধ্যবসায়ে নালন্দার জ্ঞান প্রদীপ তখনও প্রজ্জ্বলিত। নালন্দার সে সময়ের আচার্য ছিলেন রাহুল শীরভদ্র আর এই মহাবিহারের শেষ নবাগত ছাত্র ধর্মস্বামী।এই নালন্দা মহাবিহারেরই শেষের কিছু দিন এবং তুর্কি আক্রমণে তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া ___ এই ছিল নাটকের বিষয়বস্তু। নালন্দার গৌরবময় দিন অতীত হলেও যতটুকু জ্ঞানের শিখা জাজ্জ্বল্যমান ছিল তাতে শেষ পেরেক টি পুঁতেছিল ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর নালন্দা আক্রমণ।
না। আগেই বলেছি নালন্দা বা তার ধ্বংসের ইতিহাস আমি লিখতে বসি নি। আমি লিখতে চলেছি এই নাটক “কথা নালন্দার” জন্ম ইতিহাস।সেই ইতিহাস যা একটু একটু করে রূপে, রসে, প্রাণে বিকশিত হয়ে উঠেছিল আমারই চোখের সামনে। কিন্তু তারও আগে একটা কথা বিশেষ ভাবে বলা দরকার যে এতগুলো বছর পর হঠাৎ এই পুরনো নাটকের কথা বলতে বসেছিই বা কেন ?
সত্যি বলতে কি কারণ যে বিরাট কিছু আছে তা নয়। এ শুধু এক ইচ্ছা। যে নাট্যকার অমন একখানি নাটক উপহার দিলেন নাট্যমোদী দর্শকদের আর তারপর একেবারে হারিয়ে গেলেন লোক চক্ষুর অন্তরালে তাকে আর একবার জনসমক্ষে আনার একটা প্রবল বাসনা পীড়া দিচ্ছিল ভেতরে ভেতরে।
এবার প্রশ্ন এতদিন এই কাজটা করিনি কেন ? কারণ এই নাটক যখন লেখা হয় এবং অভিনীত হয় তখন আমার হাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার সুবিধা ছিল না। ফলে সেভাবে প্রচার করারও উপায় ছিল না। পরে যখন হাতে উপায় এলো তখন নাট্যকার চলে গেছেন সবার বিস্মৃতির আড়ালে।
যাই হোক এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। জানতে অত্যন্ত কৌতূহল হয়েছিল এত বিষয় থাকতে, সামাজিক এত সমস্যা থাকতে, চটকদার এবং সস্তাচমক দিয়ে জনপ্রিয়তা পাবার উপায় থাকা সত্বেও নালন্দার মত একটা বিষয়কে নাট্যকার বেছে নিলেন কেন ? কি থেকে বা কোথা থেকে এই নাটক লেখার কথা তার মাথায় এলো।
নাট্যকার কাজল চক্রবর্তী তার উত্তরে জানান যে ২০১০ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় “ The last lecture in Nalanda” নামে একটি আর্টিকেল তিনি পড়েন। সেখানে আচার্য রাহুল শিরভদ্র এবং ধর্মস্বামীর নাম উল্লিখিত ছিল। এই আর্টিকেল পড়ার পরই এই নাটক লেখার চিন্তা ভাবনা তার মাথায় আসে।
কিন্তু মাথায় আসা আর নাটক লেখা এক নয়। তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা, গবেষণা, ঐতিহাসিক তথ্য। তো যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। শুরু করলেন নালন্দা নিয়ে চর্চা। এবং এই প্রসঙ্গে কাজল জানালেন এই নাটক লেখার জন্য তার ব্যাক্তিগত ভাবে মনে হয়েছিল খোদ নালন্দাতেই একবার যাওয়া দরকার। কারণ নাট্যকার নিজেও কখনো এর আগে নালন্দা দেখেন নি। সুতরাং যা নিজে একবারও চাক্ষুষ করেন নি সেটা নিয়ে লিখতে কিঞ্চিৎ সমীহ বোধ করেছেন এবং শুধুমাত্র সেই কারণেই নালন্দা ভ্রমণ।
এখানে বলে রাখি কাজল নিজের ব্যাক্তিগত জীবনে একজন সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট এর কাজ করেন। আর শখে এবং ভালোবাসায় লেখেন নাটক। সেই ভালোবাসা যেখান থেকে জন্ম নেয় “ কথা নালন্দা” র মত এক অবিস্মরণীয় নাটক।
লেখার তাগিদ এতই প্রবল ছিল যে জুন মাসের কাঠফাটা গরমে কাজল রওয়ানা দিলেন রাজগীরের দিকে। উদ্দেশ্য নালন্দা দর্শন। এখানে লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন যে সে সময় নালন্দার ওই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বার বার তার দেহ রোমাঞ্চিত হয়েছে। এই সেই নালন্দা। সেই পবিত্র বিহার ভূমি। যার প্রতিটি প্রস্তরে প্রস্তরে কত যশস্বী, জ্ঞানী, গুণী মানুষের পদধূলি, কত শ্রমনের নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের পূত চিহ্ন। এইখানেই আগমন ঘটেছে অসংখ্য দেশ বিদেশের জ্ঞানপিপাসু ছাত্র দলের। দ্বারপণ্ডিতের কাছে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবে তারা পা রাখতে পেরেছেন এই বিহার ভূমিতে। দর্শন, ধাতুবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা , ব্যাকরণ প্রভৃতি অর্থাৎ শিক্ষার প্রতিটি বিভাগেই যে বিহার ছিল পৃথিবীর অন্যতম আর ভারতের অহংকার।
এই নাটকে কাজল বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বেশ কিছু মানুষের প্রতি। এঁরা হলেন ডক্টর কৃষ্ণকিশোর পান্ডে, (নব নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারিক,) ডক্টর বীর বাহাদুর সিং , ( নব নালন্দা মহাবিহারের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ) এবং মিস্টার কমলা সিং , যিনি হলেন স্থানীয় শিক্ষক, গাইড এবং একজন কবি। এদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা এবং মূল্যবান পরামর্শ, বই বাছাইয়ে সাহায্য আর সর্বোপরি নালন্দার গ্রন্থাগারে বসে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া কাজলকে এই নাটক লিখতে উদ্দীপিত করেছিল।
বহু গবেষণা এবং তথ্য সঞ্চয় করে অবশেষে ২০১৪ তে কাজল শুরু করেন এই নাটক লেখা। এরপর কেমন ভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্য সজ্জিত হতে লাগল কিভাবে সৃষ্টি হল এই অপূর্ব নাটক সেই কাহিনী জানাবো পরের পর্বে।
(এরপর… ক্রমশ…)