না মানুষের গল্প
কাকলি ঘোষ
দৃশ্যটা দেখেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল নিখিলের। এতবার বারণ করেছে তবু কিছুতেই কথা কানে তোলে না অপর্ণা। সে __ ই পোষ্যটাকে কোলের কাছে নিয়ে খাওয়াচ্ছে। জঘন্য কালো মিশমিশে একটা রাস্তার কুকুর ! কি করে যে ওটা ওর অত প্রিয় হতে পারে ভগবানই জানেন! ওর তো দেখলেই বিতৃষ্ণা জাগে। আর ও হতচ্ছাড়াও তেমনি। তাড়ালেও যায় না ! উল্টে দিন দিন গিলে গিলে খোদার খাসি হচ্ছে ! হবে না ? নিজেদের হোক না হোক ওর জন্য ঠিক বাজার থেকে মাংসের ছাঁট, মাছের তেল কাঁটা জোগাড় করে আনে অপর্ণা। নিষেধ করলেও শোনেনা। নিজের জন্য না হোক ছোট্ট নাতিটার কথাও তো ভাববে ! কত বার বলেছে নিখিল _
বাচ্চা কাচ্চার ঘর __ কোথায় কি লোম টোম পড়ে থাকবে__ বাচ্চাটা আবার এখন হামা টানতে শিখেছে __যা হাতের কাছে পায় মুখে দেয় __ কি থেকে কি হবে __ এবার এসব বন্ধ কর।
তা শুনলে তো ! বউ, ছেলে অসন্তুষ্ট হয়। তবু অপর্ণা অনড়। তাও নিখিল কতবার বলেছে __
__ আরে খাওয়াতে হয় তো দুটো গরীব দুঃখী মানুষকে ডেকে খাওয়াও ! তাতে তবু পরকালের কাজ হয়।
উত্তরে কি বাঁকা হাসি অপর্ণার !
“আমি নয় না মানুষকেই খাওয়ালাম ! তোমরা পরকালের কাজ কর। আমি ইহকালটা নিয়ে দিব্যি আছি। “
যত ত্যাড়া বাঁকা কথা ! কুকুরটাই যেন ওর সব। আশ্চর্য বেহায়া মেয়েমানুষ! কারুর কোন কথা কানেই যায় না। নিখিলকে তো মানুষ বলেই গণ্য করে না। আজ পর্যন্ত কোনোদিন একটা কথা শুনলো ? যেটা বলেছে ঠিক তার উল্টো! নাহ্ ! আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। এখন থাক। দিবাকরকে দোকানে বসিয়ে বাড়িতে এসেছে একটা দরকারি কাগজ নিতে। এখন আর সময় নেই। আজ বাড়ি ফিরে ___
মনে মনে গজরাতে গজরাতে অপর্ণার দিকে একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় নিখিল।
সারাদিন দোকানে বসে অনেক শক্ত শক্ত কথা ভেবে রাখলেও বাস্তবে অবশ্য নিখিলকে বলতে হল না কিছুই। কথা তুলল ছেলেই এবং শোনালোও বেশ কড়া সুরেই। শুনতে রুক্ষ হলেও নিশ্চুপ থাকলো নিখিল। শুনুক! বুঝুক অপর্ণা ! এটা প্রাপ্য ওর।
কিন্তু কি আশ্চর্য ! কি নির্বিকার অপর্ণা ! এতগুলো রুক্ষ কথা শোনার পরও দিব্যি হেসে হেসে ওদের মুখের ওপর বলে দিল __
যদি মায়ের ওপর ভরসা করে বাচ্চা রেখে যেতে না পারে __ তবে স্বচ্ছন্দে অন্য ব্যবস্থা করতে পারে ওরা। __অপর্ণা বাধা দেবেন না। কিন্তু কালু থাকবে।
মানে ! নিখিল তো হাঁ ! বলে কি অপর্ণা ! ওই একটা রাস্তার কুকুরের জন্য ( এ : সাধ করে আবার নাম রাখা হয়েছে কালু ! গা জ্বলে যেন।) শেষে নিজের সংসার ভাঙ্গতে চায় নাকি নির্বোধ মেয়েমানুষটা ! এ কি কান্ড ! ছেলে , বউয়ের লাল হয়ে যাওয়া মুখ, খাওয়া ফেলে উঠে যাওয়া __ দেখে __ রীতিমত ভয় পেয়ে গেল নিখিল। অথচ অপর্ণাকে দেখ ! ভ্রুক্ষেপও নেই ! একবার ছেলেকে পর্যন্ত বলল না খেয়ে উঠতে। এদিকে নিজে দিব্যি নির্লিপ্ত ভাবে রুটি চিবোচ্ছে ! __ ! এবার ! কি হবে ?
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না নিখিল। সহ্যের একটা সীমা আছে আর নির্লজ্জতারও।
“ হল তো ? এটাই চাইছিলে তাই না ? ছেলে বউ নিয়ে শান্তিতে সংসার করছি সেটা সহ্য হল না। এবার বুঝবে যখন আলাদা হয়ে চলে যাবে। বাপের জন্মে এমন বেহায়া আর নির্বোধ মেয়েমানুষ দেখিনি বাবা ! “
রুটি চিবনো বন্ধ করে চোখ তুলে কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপর্ণা। তারপর মুচকি হেসে বলে,
“ কেউ কোত্থাও যাবে না গো। অত ভয় পেও না। এই বাজারে রান্না করবে , ঘর সামলাবে, বাচ্চার দেখাশুনো করবে এমন লোক পাওয়া মুশকিল। আর পেলেও অনেক খরচ। বিনে পয়সায় এমন লোক কেউ এইটুকুতেই ছেড়ে দেয় ? মিথ্যেই ভাবছ।“
নিখিলের হতভম্ব মুখের সামনে দিয়ে এঁটো বাসন তুলে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় অপর্ণা।
আর এরপর কিই বা বলা যায় ? কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থেকে সবে ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে নিখিল তক্ষুনি একটা তীব্র আর্ত চীৎকারে থমকে দাঁড়ালো ! কি হল ! আওয়াজটা ও ঘর থেকেই এলো না ! দাদুভাই একাই শুয়ে ঘুমাচ্ছিল তো ওখানে ! এই তো সবে ছেলে বৌমা ঘরের দিকে গেল। কি ব্যাপার ? পড়ে টড়ে গেল নাকি ?
নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রায় দৌড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলো নিখিল। দাদুভাই !
পরের টুকু শুধু চোখ টান করে দেখে যাবার পালা। পালা শুধু অনুমান করে নেবার। দুরন্ত, দামাল শিশু কখন ঘুম ভেঙে চলে এসেছিল ওই উঁচু খাটের একেবারে কিনারায় __ কিভাবে কখন হাত, পা বাড়িয়ে দিয়েছিল নিচে নামার জন্য সেটা বাড়ির এতগুলো লোক জানতেও পারে নি। কিন্তু ওই প্রাণীটা ! ওটা কোথায় ছিল ? ও কি করে খেয়াল রাখলো ? কখন নিঃশব্দে ঢুকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল খাটের গা ঘেঁষে ? সামনের দু পা তুলে বার বার ভেতরে ঠেলে দিয়ে কি করে এতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখলো বাচ্চাটার অনিবার্য পতন ? আর বাচ্চাটাও খিল খিল করে হেসে কি সুন্দর খেলছে ওর সাথে!
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল নিখিল। তাকিয়ে রইল নিত্য দেখা ওই জন্তুটার দিকে। কই রোজের মত আর সেরকম কুৎসিত লাগছে না তো ওটাকে ! কি আশ্চর্য !
–~০০০XX০০০~–
অসম্ভব সুন্দর কাহিনী। মনন কে নাড়িয়ে দেয়।
ধন্যবাদ 💐