ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা
মধুমিতা
দ্বিতীয় পর্ব-
*দাদামশাই, মা জননী ও বসু পরিবার ও মাতৃসাধনা*
“…মানুষ জীবনে এমন একটি স্থান চায় যেখানে তর্ক থাকবে না –বুদ্ধি বিবেচনা থাকবে না –থাকবে শুধু Blind Worship।তাই বুঝি ‘মা’র সৃষ্টি। ভগবান করুন যেনো আমি চিরকাল এই ভাব নিয়ে মাতৃপুজা করে যেতে পারি।”
সুভাষচন্দ্র বসু
সেপ্টেম্বর ১৭,১৯২৭
নেতাজির মধ্যে ছিল প্রগাঢ় মাতৃ ভক্তি ও ভালোবাসা। তার কাছে গর্ভধারিনী জননী, জন্মভুমি (দেশমাতা) এবং দেবী দুর্গা-কালী ছিল এক।
নেতাজি কিশোর বয়সে রাঁচি থেকে সাল তারিখ বিহীন একটি চিঠি তার পূজনীয় মা জননী কে পাঠিয়েছিলেন – ‘মা, আমার মনে হয় এ যুগে দুঃখিনী ভারতমাতার কি একজন স্বর্থত্যাগী সন্তান নাই—মা কি প্রকৃতই এত হতভাগা! হায়! কোথায় সেই প্রাচীন যুগ ! কোথায় সেই আর্যবীরকুল যাঁহারা ভারতমাতার সেবার জন্য হেলায় এই অমূল্য মানব জীবনটা উৎসর্গ করিতেন।…. আমাদের দেশের অবস্থা কি দিনদিন এইরূপ অধঃপতিত হইতে থাকিবে— দুঃখিনী ভারতমাতার কোন সন্তান কি নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়া মা- এর জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করিবে না? মা, আমরা আর কয়দিন ঘুমাইয়া থাকিব?….’
জননী – জন্মভূমি র জন্য এই অনুভব ই তাকে মহান বানায়। সমপরিমাণে তার মধ্যে ছিল নিজের মাতৃ দেবী ও মা দুর্গা র প্রতি। সুভাষচন্দ্র আলিপুর জেলে থাকাকালীন সব বন্দীদের নিয়ে জেলে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন।এই সময়ে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর বিপ্লবী রসময় শুর ও এই জেলে বন্দী ছিলেন।তিনি তাঁর ‘মাতৃসাধক সুভাষচন্দ্র’ নিবন্ধে লিখেছেন – ‘প্রেসিডেন্সী জেলে তিনি যখন অবরুদ্ধ তখন শারদীয়া পূজা সমাগত। সুভাষন্দ্র সংকল্প
করলেন তিনি দুর্গাপূজা করবেন জেলের অভ্যন্তরে।সুভাষের মাতৃপুজার মতৃপুজার অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন সরকার।কারাগারের প্রাচীর অতিক্রম করে খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে।মায়ের পূজার উপকরণ নিমেষে এসে গেল শহর কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকে।ফুল বিক্রেতা ফুল দেবেন।অন্যান্য উপকরণ ও আসবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।প্রতিমা আসবে কুমোরটুলি থেকে।
মায়ের অশেষ কৃপা — সুভাষচন্দ্র এর মাতৃপুজা দেখার সৌভাগ্য হল আমার। কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হিজলী জেল থেকে আমাকে স্থানান্তরিত করেছে প্রেসিডেন্সী জেলে চিকিৎসার প্রয়োজনে।জেলে সবরকম বন্দীরা পূজায় যোগদান করতে পারবে জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এ ব্যবস্থা করলেন সুভাষচন্দ্র।মহাসমারোহে পূজার আয়োজন হল।ষষ্ঠীর দিন ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল এল ।রাশি রাশি ফল।পূজার বিভিন্ন উপকরণও এসে গেল। গোনা গুনতি নেই।প্রয়োজনের হিসাব নেই।একান্ত নিষ্ঠায় বিধিমতে পূজা শুরু হল পুরোহিত তন্ত্রধারককে নিয়ে পূজার কয়েকটা দিন পূজায় যোগদান করার সুযোগ পেলাম আমরা। সুভাষচন্দ্রকে তখন দেখেছি মাতৃপুজায় ভক্ত সন্তান। পরণে তার গরদ বস্ত্র সদ্য সদ্যস্নাত – শুচি – তন্ময় মূর্তি; ভক্তিশ্রদ্ধা উপচে পড়ছে চোখে মুখে।কখনো পূজার তদারক করছেন।কখনো সমাহিত চিত্তে মাকে দেখেছেন। তার এরূপ আমার কাছে নুতন। অপরূপ’ ।…….
নেতাজি তার মাতার প্রিয় পাত্র ছিল। মা জননীর মৃত্যুতে সে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন।সময়টা ছিল ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ। মহাযুদ্ধের সময়, নিজের মায়ের শেষ কৃতে তিনি থাকতে পারেননি।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পিতা জানকিনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবীর মোট ১৪ জন সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ পুত্র ও নবম সন্তান ছিলেন।নেতাজির জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি শনিবার হয়। প্রভাবতী দেবী ও জানকিনাথ বসু র ছয়টি মেয়ে যথাক্রমে- প্রমীলা দেবী,সরলা দেবী,তারুবালা দেবী,মলিনা দেবী, প্রতিভা দেবী, কনকলতা দেবী।প্রমীলা দেবী অল্প বয়সেই বিধবা হয় এবং বেশিরভাগই বসু বাড়িতে থাকতেন।বসু দম্পতির আট পুত্র ও ছিল যথেষ্ট প্রতিষ্ঠত।প্রথম পুত্র সতীশচন্দ্র বসু বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন, দ্বিতীয় পুত্র শরৎচন্দ্র বসু ছিলেন একাধারে ব্যারিস্টার , তৎকালীন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আইনসভার সদস্য ছিলেন এবং কংগ্রেস দলের নেতা,তৃতীয় পুত্র সুরেশচন্দ্র বসু ছিলেন কলকাতার ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ট্রাইব্যুনাল এর অ্যাকেসেসর, চতুর্থ পুত্র সুধীর চন্দ্র বসু ছিলেন জামশেদপুরে র টিসকো র অফিসার, পঞ্চম পুত্র ডা. সুনীল চন্দ্র বসু ছিলেন বিখ্যাত হৃদরোগ চিকিৎসক ,ষষ্ঠ পুত্র ছিলেন বিখ্যাত দেশনায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু,সপ্তম পুত্র শৈলেশচন্দ্র বসু বোম্বেতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ,অষ্টম অথবা সব থেকে ছোট পুত্র/সন্তান সন্তোষচন্দ্র জামডোবাতে ছিলেন – তিনি অসুস্থ হয়ে ২৪ বছর বয়সেই মারা যান।সব সন্তানদের মধ্যে শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসু ই রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিলেন। জানকিনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবী প্রচুর দান করতেন।জানকিনাথ নিজে খুবই অর্থাভাবের মধ্যে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন তাই তিনি প্রতিষ্ঠত হওয়ার পর দরিদ্র ছাত্রদের অনেক সাহায্য করতেন। সুভাষ পিতা নিজের পিতা – মাতার নামে দাতব্য চিকিৎসালয় ও একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।তিনি মৃত্যুর আগে পুরনো ভৃত্য দের ভরণপোষণের জন্য ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। প্রভাবতী বসু ছিলেন অত্যন্ত গুণবতী ও রূপসী। তখনকার দিনের মেয়েদের লেখা পড়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না তাও বসু পরিবার পুরোটা নিজে হাতে সামলাতেন। তার চারিত্রিক দৃরতা- বুদ্ধিমত্তা – কর্মদক্ষতা, নিয়মানুবর্তিতা অসাধারণ ছিল।ছেলেদের লেখাপড়ার দিকে তার করা নজর ছিল।তখনকার বসু পরিবার ছিল একান্নবর্তী।নেতাজি লিখেছেন – ‘বৃহৎ পরিবার জন্মগ্রহণ অসুবিধা অনেক। শৈশব এ যে বিশেষ যত্নের একান্ত প্রয়োজন তা লাভ করা যায় না’।
(এরপর ক্রমশঃ…..)