ডারবানে সেই রাতে
✍️ শিবপ্রসাদ হালদার
দুবাই পোর্ট ছেড়ে পনেরো দিনের সমুদ্রপথ অতিক্রম করে সবেমাত্র জাহাজ ডারবান এসে পৌঁছেছে। এখনও পোর্টে পৌঁছাতে পারেনি। কিছুটা দূরে অ্যাংকারে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সংখ্যায় তা প্রায় খান ষাটেক হবে। দুবাই হেড অফিস থেকে নির্দেশ এসে গেছে কোন অবস্থাতেই কোন নাবিক যেন সিকুউরিটি ছাড়া ল্যান্ডে না নামে এবং নামলেও দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসতে হবে। গ্যালিতে চিপ কুক মিঃ হালদারের কাছেও নির্দেশটা পৌঁছে গেল। প্রথম দিনেই শিপের চার জন নাবিক সিকিউরিটি নিয়ে ঘুরবার জন্য ল্যান্ডে নেমে পড়লো। ওরা গাড়ি করে দিব্যি ঘুরে ফিরে সুস্থভাবেই দুপুরের মধ্যে ফিরে এলো। চিপ কুক ওদের মুখে সব বিস্তারিত জেনে শুনে আরও উৎসাহিত হলো। পরের দিন বিকালে বেরিয়ে সন্ধ্যা ও রাতের দৃশ্য দেখবার সিদ্ধান্ত নিল। সঙ্গে নিল তার সব সময়ের সঙ্গী স্টুয়ার্ড মিস্টার সুরাজকে। দুপুরের লাঞ্চ সেরে ধীরেসুস্থে ওরা বেরিয়ে পড়ল। ভারতীয় সময় অনুযায়ী ডারবানের সময় সাড়ে চার ঘণ্টা পিছিয়ে। ভারতে সকাল দশটা বাজলে সেখানে ভোর সাড়ে পাঁচটা। বিকেল ছ টার পর সব রাস্তাঘাট হয়ে যায় শুনশান। তারা চিন্তা করলো- আফ্রিকায় যখন এসেছি- আর কবে আসবো! আদৌ আর আসা হবে কি না- এতদূর এসে এখানকার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাব?এ কথা ভেবেই মনের আশা পূরনের উদ্দেশ্যে নেমে পড়ল ওরা দুজনে। হাঁটতে হাঁটতে একপা দুপা করে ওরা এগোতে লাগলো। সব দৃশ্য দেখতে দেখতে সি বিচ থেকে উঠে এলো ফুটপাতে। আফ্রিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে সব দৃশ্য দেখার আনন্দে ওরা ভুলে গেছে সময় গড়িয়ে যাওয়ার কথা। ওদের বিদেশি টাকা চেঞ্জ এর প্রয়োজন কিন্তু নির্দিষ্ট দোকান খুঁজে পাচ্ছেনা। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ওরা দেখল ওখানে জিনিসের দাম প্রচুর। ভারতে সামান্য একটা ছোট্ট কোকাকোলা ক্যান যার মূল্য মাত্র কুড়ি টাকা তার মূল্য ওখানে পাঁচশ টাকা। কুড়ি লিটার জলের দাম আড়াই হাজার টাকা। সব জিনিসের এমন দাম দেখে ওরা অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল- সেখানে সমস্ত খাবার ও সব জিনিসপত্র বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়ে সাউথ আফ্রিকায় সরবরাহ হয়। তাও মাত্র তিন চারটি ডিস্ট্রিবিউটারের মাধ্যমে তাই জিনিসপত্রের দাম এতটা ঊর্ধ্বমুখী।এহেন গরীব দেশে এমন অগ্নিমুখি দ্রব্যমূল্যে এখানকার গরিব মানুষের কথা ভাবতে ভাবতে ওরা হেঁটে চলেছে। সময়ের দিকে ওদের খেয়াল নেই। রাতের অন্ধকার অনেক আগেই দিনের আলোকে গ্রাস করে নিয়েছে। আরো একটু এগোতেই ওদের চেতনা জাগলো। ততক্ষণে রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে সিকুউরিটি গার্ড। তারা রাস্তায় রাস্তায় রাউন্ড দিয়ে চলেছে। সবার কাছে একটা করে বড় বন্দুক, একটা ছোট্ট নাইফ, একটা ছোট লাঠি আর একটা টর্স। সবার পরিধানে মিলিটারি ড্রেস। পনের মিনিট অন্তর পুলিশ টহল দিচ্ছে। ওরা অনেকক্ষণ ধরে এটা লক্ষ্য করেছে কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না কেন সিকিউরিটি গার্ডের এত আনাগোনা। সহসা সাহস করে ওরা এগিয়ে গেল রাস্তার পাশে একটা মিলিটারি ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছোট। সেখানে তারা কথা বলল। বাইরে এসে জানতে পারলো এই দেশে ট্যুরিষ্টদের পক্ষে মোটেও নিরাপদ নয়। এখানে আছে ভিন্ন ধরনের ক্রিমিনাল। সবসময় মারামারি গুলিগালা নানা রকমের অপরাধমূলক কাজ হয়ে চলেছে। সব শুনে মনে হলো এ যেন এক অরাজকতার রাজ্য। এইসব সিকুউরিটি বেসরকারি তবে সরকার অনুমোদিত।
ওরা রাস্তা ধরে হাটতে লাগল। দেখতে পেল রাস্তার পরে দলে দলে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। কোথাও বা রাস্তার পাশে অনেকে টানছে গাজা। জায়গায় জায়গায় কুড়ি-পঁচিশ জনের মত একটা দল। প্রত্যেকটা জায়গায় ছেলেমেয়েরা ছন্নছাড়া বাউন্ডুলের মত ঘোরাফেরা করছে। ওরা হেঁটে চলেছে আর সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। স্থানীয়দের এমনভাবে তাকানো দেখে ওদের মনে ভয়ের সঞ্চার হল। একেতো অপরিচিত দেশের না চেনা জায়গা। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সি বিচ থেকে অনেকটা ভেতরে চলে এলো। হঠাৎ থমকে গেল। আর সামনে এগোনোর সাহস পেলো না। শুরু করলো পিছাতে। রাস্তায় মেয়েরা ওদের ডাকাডাকি করতে লাগল। ভয় পেয়ে গেল আরও। কোনো দিকে না তাকিয়ে হাঁটার গতি দিল বাড়িয়ে।আর ঠিক তখনই ওরা কোম্পানির নির্দেশের কথা বারবার স্মরণ করতে লাগল। ওরা তখন উপলব্ধি করলো সেই নির্দেশ অমান্য করে তারা যে কতটা ভুল করেছে! বেগতিক বুঝে ওদের মাথার উপস্থিত বুদ্ধি এল। ওরা সোজা চলে গেল রাস্তার পাশে আর একটা মিলিটারি ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে ওরা সব বিস্তারিত জানালো। তখন ওদের পরিচিতি পত্র দেখতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই তারা তাদের নিজ নিজ নেভির আইডেন্টি কার্ড ও পাসপোর্ট শো করল। তারা বুঝতে পারলো এরা সম্পূর্ণ নূতন তাই না বুঝে এমন পরিস্থিতিতে এসে পড়েছে। এই মুহূর্তে তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সাহায্যের অনুরোধ জানালো। নেভির স্টাফ ভেবে কালবিলম্ব না করে ওয়াকিতে ফোন করল। মুহূর্তে জিপ এসে হাজির। দুজন সিকিউরিটি গাড়ী থেকে নেমে এলো। ওরা তাদের সাথে নিয়ে একটু স্বস্তিতে হাঁটতে শুরু করল।
মিঃ হালদার চিরকাল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। প্রচন্ড পরোপকারী এবং একটু দয়ালু তাই কেউ কখনো তার কোনো রকম উপকার করলে প্রতিদানে তাকে কিছু না দিতে পারলে নিজেকে যেন ঋনী মনে ভাবতো। ভিন্ন দেশে এহেন বিপদকালীন মুহূর্তে এমন সহানুভূতি পেয়ে প্রতিদানে কি দেওয়া যায় শুধু ভাবছে। সিকিউরিটি নিয়ে ওরা হেঁটে চলেছে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে ওদের। যেন মনে মনে আনন্দ লাগছে। লোকে ভাবছে – এঁরা নিশ্চয়ই কোন ভিআইপি। নতুবা কোন গেষ্ট। দলে দলে ছেলেমেয়েরা তাদের দেখে ডাকতে লাগলো।কেউ কেউ ওদের কাছে চলে এল। তখন রাতও হয়ে গেছে প্রায় পৌনে নটা। ওদের ডাকাডাকির অসংযত আচরণে সিকুউরিটি কাঁধের বন্দুক নামিয়ে হাতে নিয়ে বলল- “ডোন্ট টাস হিম ,দে আর আওয়ার গেস্ট—” ওরা তখন পিছিয়ে গেল। শুরু করল আবার হাঁটা। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ওদের টাকা চেঞ্জ এর জন্য ঢুকলো একটা দোকানে। আশেপাশের সমস্ত দোকান পাট অনেক আগেই সব বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানে ঢুকে দেখল চারটি ছেলে দাঁড়িয়ে। তারাও কাস্টমার। দোকানদার একটা অল্প বয়সী মেয়ে। প্রচন্ড কালো হলেও দেখতে ভাল।রিষ্টপুষ্ট ডাগর ডাগর চোখে ওদের দিকে বারবার তাকাতে লাগলো কিন্তু কিছু বলছে না। যেন পাত্তা দিচ্ছে না অথচ বারবার ঘনঘন ওদের দিকে তাকিয়ে চলেছে। আর ব্যস্ততায় সাথে ছেলেগুলির সাথে আদান-প্রদান সারছে। ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের ছেড়ে দিয়ে ওদের কাছে জানতে চাইলো তারা কোন কারেন্সি চেঞ্জ করবে? ডলারের কথা শুনে মেয়েটি তখন ওদের বলল- আপনাদের এতক্ষণ দেরি করিয়েছি কেন বুঝতে পারলেন? ওরা জানাল দেখুন এখানে আমরা সম্পূর্ণ নতুন। কিছুই জানিনা- চিনিনা তাই বুঝতে পারছি না। শুনেই মেয়েটা বলল সে তো প্রথম দর্শনেই বুঝতে পেরেছি। দেখুন প্রতিদিন আমাকে নানা ধরনের কাস্টমারের সাথে আদান-প্রদানের অভিজ্ঞতায় অতি সহজে লোক চিনতে পারি। এখানে এত রাতে আপনারা এসে মারাত্মক ভুল করেছেন। তখন মেয়েটি বলল এই ছেলেগুলির সব ক্রিমিনাল। এদের মত অনেকেই অহরহ আসছে যাচ্ছে। আপনাদের ডলার চেঞ্জ করা দেখলে রাস্তা থেকে সব কেড়ে নিতো। এত রাত অব্দি দোকান খোলা থাকেনা। আপনাদের দেখে দোকানও বন্ধ করতে পারছি না। তখন ওদের কাছে জানতে চাইলো- ওরা ঐ সিকিউরিটি কিভাবে পেল? সব শুনে মেয়েটি বলে উঠলো- “ইউ আর ভেরি লাকি ম্যান” তাই এত রাতে এমন মুহূর্তে ওদের এমন সহানুভূতি পেয়েছেন———-।
ওরা একথা শুনে আরো আতঙ্কিত হলো। এমতাবস্থায় কি করবে ভেবে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। উপায়ন্তর না দেখে তখন ওই সিকুরিটি গার্ডদের বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানালো তাদের পোর্টে পৌঁছে দেবার জন্য। তখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে। তাদের অনুরোধে মেয়েটিও সায় দিল। সেও তাদের হোয়ে সিকিউরিটি গার্ডদের বিশেষভাবে রিকোয়েস্ট করল। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে মেয়েটির এই বিশেষ অনুরোধ ওদের কাছে খুব ভালো লাগলো। এমন দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোতে তারা খুশিও হলো বটে! ঠিক ওই মুহূর্তের অবস্থাটা ওরা ভূলতে পারছিল না। ওরা রাজি হল। ইশারায় ওদের গাড়িতে উঠার নির্দেশ দিল। গাড়িতে উঠার আগে ওরা মেয়েটিকে জানাতে ভুললো না – “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ—”
দোকান থেকে বেরিয়েই ওরা এলো রাস্তায়। চলতে গিয়ে চিন্তা করল সাথে যখন সিকুরিটি গার্ড আছে তখন ভয় কিসের? এখানকার একটু চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নিয়ে যাই কিন্তু ওদের তা বলা যাবেনা। তাই ঘুরিয়ে বললো- দেখুন আপনারা আমাদের এই অসময়ে এমন উপকার করেছেন তাই এখানকার এই মুহূর্তের স্মৃতি কোনদিন ভুলতে পারবো না। আমরা আপনাদের কিছু দিতে চাই। শুনে ওরা খুশি হলো। ওদের সাথে নিয়ে ঢুকল একটা ক্লাবের মধ্যে। ঢুকতেই সিঁড়িতে দেখতে পেল -অনেক মেয়েরা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। কারো কারো মুখে সিগারেট। কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা উপরে উঠে যেতে লাগল। ভিতরে ধোঁয়ায় ভর্তি ।যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে।আড় চোখে তাকিয়ে দেখতে পেল বেশির ভাগ কালো কালো মেয়ে। দুই-একজন সাদা। ভিতরে ঢুকতেই সিকুরিটি গার্ড দেখে ওরা ভাবল- এরা আবার কারা? সঙ্গে সিকিউরিটি নিয়ে এসেছে?? সবাই ঘনঘন তাকাতে লাগল। ওরা ব্যস্ত ভাবে চলে গেল কাউন্টারে। চট করে পাঁচটি বিয়ারের বোতল নিল। ফেরার পথে দেখল এক বিশ্রী পরিবেশ। ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ টানছে গাজা চুরুট কেউ খাচ্ছে কিস কেউবা——-! সেই অশালীন বেশে ওদের যেন দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। ওরা ওদের বারবার ডাকতে লাগল । তখন কোন দিকে আর না তাকিয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি নিচে এসে একটা দোকান থেকে নিল এক প্যাকেট সিগারেট। ওরা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলতে শুরু করল সব ঘটনা। আর সবার হাতে তুলে দিলো একটি করে বিয়ারের বোতল। সাথে সাথে গাড়িতে বসেই তার সৎ ব্যবহার করল। ওরা সবাই খুশি। গাড়ি চলতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌছালো ওদের কন্ট্রোল রুমের সামনে ।গাড়ি থেকে নেমে সিকিউরিটি বললো এখান থেকে সোজা রোড ধরে আপনারা চলে যান। আর কোন ভয় নেই। তবে একটু হাঁটতে হবে বেশি। সামনে গিয়ে একটা গলি পড়বে। সেখান দিয়ে ক্রস করলে রাস্তা অনেকটা কম হবে কিন্তু ওটা একটু রিক্স হয়ে যাবে। কারণ ওখানে কিছু ক্রিমিনাল আছে। আপনারা বরং একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যান। এ কথা শুনে ওরা ভাবল ট্যাক্সি করলেই তো ভাড়া গুনতেই হবে। ওরা নিঃস্বার্থে এতটা উপকার করল তাই ওই ভাড়ার টাকাটা যদি ওদের দেয়া যায় তাহলে নিরাপত্তার সাথে পৌঁছাতে পারবে। প্রস্তাবটা দেওয়ায় ওরা রাজি হয়ে গেল।মূহূর্তেই ওরা পৌঁছে গেল পোর্টে। জিপ গাড়ি থেকে নেমে ওরা হাতে হাত মিলিয়ে জানালো কৃতজ্ঞতা। নির্ভয়ে তখন ওখানে ওরা তুলে নিল ওদের সাথে ছবি। তখন রাত দশটা। শীপে পৌঁছাতেই অন্যান্য নাবিকেরা ওদের ঘিরে ধরল সব জানার জন্য। সমস্ত বিবরণ শুনে সবাই চমকে উঠলো। ওরা তখনও ওই দোকানদার মেয়েটির আন্তরিক সহানুভূতির কথা বারবার স্মরণ করে চলেছে -“আপনারা অত্যন্ত লাকি ম্যান এই সিকিউরিটি না পেলে আজ আপনাদের কাছে কিছুই থাকত না। সমস্ত কিছু কেড়ে নিতো—-“ডারবান পোর্টৈ মাত্র তিন দিন তাদের অবস্থান করার সুযোগ হয়েছিল। আর সেই সুযোগেই স্মৃতি হয়ে রইল ডারবানে রাতের রাস্তার না জানা এই অভিজ্ঞতা———!
–~০০০XX০০০~–