প্রলেতারিয়েত
………………….
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
মধুরা কাঁধের ঝোলাটা বিরক্তির সাথে খাটে ছুঁড়ে ফেলল। মিটিং শেষে আজ ওরা যেভাবে এতদিনকার সঞ্চিত রাজনৈতিক আদর্শটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল সেটা বাবা’দের দেখে শেখা রাজনীতির চলনে শিক্ষিত মধুরা’দের মতো কর্মীদের পক্ষে এখন কোনওমতে মেনে নেওয়া যায়না।
প্রবীণ নেতা সমীর সেনগুপ্ত এখন ওদের জেলা কমিটির সভাপতি। একসময় এই সমীরদা’ই মধুরার বাবা কমরেড দীনেন মিত্তিরের ডানহাত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় পোস্টার মারত আর ইলেকশনের আগে জমাটি গলায় বক্তৃতা দিত।
সেটা কি আর মধুরা’র মনে নেই?
বাবা অবশ্য শেষের দিকে মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। মধুরা তখন কলেজে পড়ছে। একানব্বইয়ে রাশিয়ার ভাঙ্গনটা বাবা মেনে নিতে পারেননি। এক বুক জমানো বিশ্বাসভঙ্গের আঘাতটা বাবা’র মত অনেক নিষ্ঠাবান পার্টীকর্মীর বুকে সেদিন যেন শেল হেনেছিল।
………..
সমীর’দা আজকে প্রকাশ্যে বললেন যে সামনের ইলেকশনে পার্টি সেক্যূলারিটির হয়েই লড়বে। আর সেজন্য কয়েকটা তথাকথিত দক্ষিণপন্থী দলের সাথে একটুআধটু সৌজন্য বা মিত্রতা দেখানোটাই এখন পলিটব্যুরোর নির্দেশ। এবারে কয়েকটা সিটে ওদের পার্টী নাকি লড়বেই না। এগুলো আসলে ধর্মোন্মাদী বিপক্ষদলের গা-জোয়ারি লড়াইতে এখন অস্তিত্বরক্ষার্থে দক্ষিণপন্থী ভায়েদের যে একটু ওয়াকওভার দিতেই হবে। ভোট ভাগ হলে সবার মুশকিল।
আসলে মধুরার সমস্যাটা সেটা নয়।
যে সমস্ত জঙ্গীপন্থী বামদল থেকে কিছু নেতানেত্রী আজকাল নিজেদের অতীত বা ভোলবদলে দক্ষিণপন্থী সংস্রবে ঢুকে পড়েছে মন্ত্রী বা এম এল এ হওয়ার লোভে তাদের মার্জিত পোশাকে একসময়কার তাদের সহকারী কমরেডদের খুন হওয়া সেই তাজা রক্তের গন্ধটা মধুরা পায় বলে ওদের সাথে একাসনে বসে গণতন্ত্রের নাটক দেখতে ও রাজী হবার কথাটা ভাবতেই পারবেনা।
………..
মধুরা মুখ হাত ধুয়ে গ্যাসে রান্না বসাতে যায়। কাল ওর মেয়ে সংবৃতা কলেজ হোস্টেল থেকে ক’দিনের ছুটিতে বাড়ি আসছে। খুকু ভালবাসে বলে ওর জন্যে তাই গোবিন্দভোগ চালের পায়েস বানিয়ে রাখতে হবে। মেয়েটা যত বড় হচ্ছে মধুরা’র মনে হচ্ছে ও বোধহয় আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। না মধুরা’র বয়স তেমন হয়নি বটে,তবে সব উজাড় করে পার্টীর কাজ করার উন্মাদনাটাই যেন আর আগের মত নেই। যদিও জেলা কমিটি নিপীড়িত মেয়েদের পুনর্বাসনের কিছু কাজ মধুরা’কে কিছুদিন হল দিয়েছে, তাও আজকাল মনে হয় এসব যেন কেবল সময় নষ্ট করছে। কারণ মুখে লড়াইএর অভিনয় করে গেলেও পার্টী একটু একটু করে ক্ষমতার দাস হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
…………
সন্দীপনকে যখন মধুরা বিয়ে করে তখন সঞ্চয় বলতে কিছুই ছিলনা। সন্দীপন জনযুদ্ধ লিবারেশান করত ছাত্রবয়স থেকেই তাই ততোদিনে পাকা সরকারী চাকরির কাজে এন্তার ফাঁকি দিয়ে কনভেনশনে আজ ঝাড়খন্ড কাল তেলেঙ্গানা করে যাচ্ছে সেটা মধুরা জানত বলে যাদবপুরের প্রাক্তনী সহযোদ্ধার সাথে সেও তখন দিনবদলের স্বপ্ন দেখত। ওদের পার্টী ততোদিনে সরকারে থেকে দশটা বছর পার করে দিয়েছে বলে ও বুঝতে পারছিল যে এবারে সন্দীপনদের আসল লড়াই সরকারী পল্টনদের বদলে প্রাইভেট পূঁজিপতিদের লাভের বিশালকায় স্তুপের সাথে না খেতে পাওয়া দিনমজুরদের নিত্যদিনের বঞ্চনার লড়াইতেই পরিণত হতে চলেছে। সেখানে চীন বা সোভিয়েতের আসল পরিচয় পিঁপড়ের ডিমের মন্ডের বদলে একথালা গরম ভাতের।
খুকু তখন সাতে পড়েছে, ওদের কমরেড সুরেন হাঁসদা একদিন রাতে এসে খবর দিল বিরোধী “দ্যিকু”রা মহিষবাথান ক্যানেলের পাশে নাবাল জমিতে ফেলে শাবল দিয়ে পরপর আঘাত করে সন্দীপনের মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে গত পরশু। ওদের মোর্চার নেতা কমরেড কেশবরাম রাও তাই ওকে পাঠিয়েছে সন্দীপনের কাছে থাকা সাতশো টাকা আর ওর ব্যবহার করা শেফার্স কলমটা ফেরৎ দিতে।
………..
অনেকক্ষণ মুখে কথা যোগায়নি মধুরা’র। সন্তোষপুরের দেড়কামরা ফ্ল্যাটে সে আর খুকু। বাইরে কিছুদিনের মধ্যে নখ-দাঁত বের করে ঘনিষ্ঠজনেরা ওদের সংশ্রব রাখা বন্ধ করে দিয়েছে আর পরিবর্তে বেয়াড়া আহ্লাদের আমন্ত্রণ লুকিয়ে চুরিয়ে এসে জানিয়ে দিচ্ছে নির্লজ্জদের মত। ততোদিনে বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রতিটা স্তর কেতাবী থিয়োরীর চেয়ে অনেক বেশী বাস্তবের আগুনে ধরা দিচ্ছে মধুরা’র সামনে। ও টের পাচ্ছিল প্রলেতারিয়েত বলে যে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে ওরা দাগিয়ে দিতে শিখেছিল আসলে তাদের মধ্যে থেকেই সুবিধামত বিপ্লবী তৈরী করে নেওয়াটা এখনকার রীতি, সেখানে পিছনের দরজা দিয়ে আদর্শকেই কালো চাদরে মুড়ে বের করে দিচ্ছে বিপ্লবী আদর্শের সব ধ্বজাধারীরা।
………..
সে সময় স্কুলের চাকরিটা না থাকলে আজকের সংবৃতি বা মধুরা’র জীবনধারণটাই অসম লড়াইএ শেষমেশ হারতে বসতো।
সন্দীপন যদিও স্মৃতিভারে প্রতীকি হয়ে যাওয়াকে ঘৃণা করত। ও চাইত একটা নতুন সকাল যেখানে গতরাত্রের মেহনতী তারকার দল নতুন দিনের আলোয় নিশ্চুপে গোপনে থাকবে নিজেদের জাহির করার বদলে। লোকে কাজ পাবে, জামাকাপড় পাবে, শিক্ষা পাবে আর দিনান্তে গরম ভাতের গন্ধে বেঁচে থাকার স্বপ্নটা ভাঙতে দেবে না। কিন্তু সেসব আর হল কই।
………..
পার্টীর এই সস্তার নীতি বিনিময়ের ফলে একটা অন্যরকম রাজনৈতিক প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যাদের কাছে পদপ্রত্যাশা আর কাটমানি নেওয়াটাই আসল ও প্রধান হয়ে উঠবে। সেখানে উন্নয়নের প্রসাদ পাবে বশংবদ পার্টীকর্মীরা আর
তাদের হয়ে ছাপ্পামারা কিছু শ্রেণীর তোষণকারী নাগরিকেরা। সেখানে বিপ্লবের আদর্শ কেবল একটা তামাশা।
মধুরা এমনকি সন্দীপন’রা এসব ক্ষেত্রে বেজায় রকম বেমানান। ওরা সব কিছু শিখলেও টাকা নিয়ে মিথ্যাস্বপ্নের ব্যবসা করতে আজও শিখে উঠতে পারলনা।
………..
রাতের তিনটে রুটি আর একটা অমলেট বানিয়ে
মধুরা’র আজকের মিটিং আর সিদ্ধান্তের কথাগুলো ভেবে কষ্ট পাচ্ছিল। এইসব লোকদেখানো পার্টী করার মানে খুঁজতে চাইছিল নিজের কাছে।
ওদের বিয়ের পরে পরে সন্দীপন তখন পার্টীর মুখপত্র “গণবার্তা”য় ” অযান্ত্রিকের খাতা” এই ছদ্মনামে কলাম লিখত। সেসময় লেখা প্রতি যে সাড়ে পাঁচশো করে পেত তার থেকে তিনশ টাকা ও সোজা মুক্তিমোর্চার গোপন ফান্ডে জমা দিয়ে আসত।
সেখানে এক জায়গায় লিখেছিল,
” সব সম্পর্কেরই একটা শেষতম দিন আছে, একটা মাহেন্দ্রক্ষণ আছে, একটা বিশেষ মূহুর্ত আছে, যার পরে এককালের উজাড় করে দেওয়া সম্পর্কটার পরতে পরতে ধূলোর স্তর জমে। অবশ্য তারপরেও বহুদিন গড়িয়ে গড়িয়ে চলা যায়- মায়া অথবা বলতে না পারার বোঝা সমেতই গড়াতে হয়, তারপর আরো একদিন একেবারেই নেই হয়ে যায় সবটা, আবছা আবছা স্মৃতি কিছু ব্যঘাত ঘটায় কখনো, কখনো ঝাপসা করে চরাচর। বাকি চরৈবেতি!
কেউ অবিনশ্বর নয়, কিছু চিরন্তন নয়, “জন্মিলে মরিতে হবে!” ….কবির এই অমোঘ বাণীটি মনে রাখলে বাঁচা অনেক সহজ হয়।”
আজ পালাবদলের সহজগম্য ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা প্রমিসিং পার্টীকর্মীদের কাছে একসময়ের বাতিল হয়ে যাওয়া গহ্বরে প্রাগৈতিহাসিক সব আদর্শবোধের পুরনোদিনের কথা গুলোই মধুরা এখন নিজের মনে মনে একবার স্বগতোক্তির মত উচ্চারণ করতে চাইছিল আর তার পরক্ষণে অপ্রাপ্তির এক গভীর বিষাদে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল।
(কৃতজ্ঞতা – বৈশাখী রায়)
–~০০০XX০০০~–