শ্রদ্ধা জ্ঞাপন
✍️ শিব প্রসাদ হালদার
৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। দুপুর গড়িয়ে যেতে চলেছে। একটা ফোন এলো। মাস্টারমশাই প্রশান্ত বাবুর প্রশ্ন- কে কোত্থেকে বলছো? উত্তর পাবার পর প্রায় আধা মিনিট একদম থমকে রইলেন। প্রাণখুলে আশীর্বাদ করলেন—-! সার্থকতার আনন্দে চোখের কোনে চিকচিক করে উঠলো আনন্দাশ্রুতে!
ফোনটা এসেছে সুদূর কাতার থেকে। মাঝ সমুদ্রে কর্মরত প্রশান্ত বাবুর একসময়ের ছাত্র প্রদীপ শিক্ষক দিবসে সে তার মাস্টার মশাইকে ফোন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। এমনিতে কাতার ও ভারতের মধ্যে সময়ে আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে। ভারতে যখন ভোর ছয়টা কাতারে তখন রাত্রি সাড়ে তিনটা। সকালেই ফোন করবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু স্যাটেলাইট লিংক না পাওয়ায় করতে পারেনি। সমুদ্রের মাঝখানে যেখানে যে অবস্থায় কর্মরত আছে সেখান থেকে মোবাইলে টাওয়ার পাওয়া যায়না। চেষ্টা ও ইচ্ছা থাকলে সবই করা যায়। প্রদীপও তাই করেছে। প্রশান্ত বাবু আজ পর্যন্ত এত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু কর্তব্যজ্ঞান ও সচেষ্টতায় প্রদীপের মতো ছাত্র খুব কমই পেয়েছেন। প্রতি বছর এই দিনে সে যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন মাষ্টারমশাইকে এই শ্রদ্ধাটুকু জানাতে ভুল করে না। এত দূরে এত কাজের চাপেও এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে তিনি অভিভূত। শিক্ষক জীবনে তিনি অনেক ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা দিয়েছেন। অনেক ছাত্র-ছাত্রী ক্যারিয়ার গড়ে জীবনে এখন প্রতিষ্ঠিত। জীবন প্রবাহের স্রোতে এই কর্তব্যজ্ঞান এখন বিলুপ্তির পথে। কিন্তু প্রদীপ ব্যতিক্রম। ক্যারিয়ার জীবনে প্রবেশ করে বিদেশের মাটিতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে থেকেও এই আদর্শ কর্তব্য জ্ঞানের বিচ্যুতি কখনো ঘটেনি। আজও নয়। সকাল থেকেই এই পর্যন্ত এইভাবে অন্য কেউ তাকে শ্রদ্ধা জানায়নি। তাই তাকে নিয়ে মাষ্টার মশাইয়ের একটু গর্বও হয়!
কোচিং ক্লাসে পড়ার সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন প্রদীপের চরিত্র। সব রকম সামাজিক কাজ, অপরের সাহায্যে সবসময় আগেভাগে থাকতো। সরস্বতী পুজোর সময়ে তার উদ্যোগে হত সমগ্র অনুষ্ঠান। সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন করার জন্য সব দিকে লক্ষ্য থাকত তার। সদাহাস্য ছেলে প্রদীপ সহজেই সকলের মন জয় করতে পারত। শুধু মাস্টারমশাই কেন- প্রত্যেকের কাছে সে সচ্চরিত্র হিসাবে পরিচিত ছিল। কাউকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে? কারো বিপদে সাহায্যের প্রয়োজন? কোন মুমূর্ষ রোগীকে রক্ত দিতে হবে? গরীব ছাত্র-ছাত্রী অর্থের অভাবে বই কিনতে পারছে না? রাস্তায় কোন ভিখারি অভুক্তাবস্থায় পড়ে রয়েছে? প্রয়োজনে খাবার মুখে তুলে দেওয়া— যে কোনো সাহায্যের বেলায় এগিয়ে আসতো সবার আগে।
পড়াশুনায় সে খুব একটা ভালো ছিল না। তবে কখনও কোন ক্লাসে ফেল করেনি। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে পছন্দমাফিক নির্দিষ্ট কলেজে ভর্তি হবার সময় উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বরে সহজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। পাঁচ বন্ধুর মধ্যে দুই বন্ধু “নিজে বাঁচলে বাপের নাম” এমনটা ভেবে চেষ্টাচরিত্র করে নিজেরটা হাসিল করে নিল। বাকি রইল প্রদীপ সহ অন্য দুইজন। প্রদীপ সোর্স অ্যাপ্লাই করে তিনজনের জন্য অনুরোধ জানায় কিন্তু সেখানে নাম উল্লেখ না করে দুই জনের নাম অনুমোদন পায়। প্রদীপের কাছে তখন আর এক ভাগ্য পরীক্ষা। তখন সে নিজে ভর্তি না হয়ে সেখানে অন্য দুই বন্ধুকে ভর্তি হবার সুযোগ করে দেয়। পরে ওই কলেজে তার ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়লে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সহযোগিতায় তার ভর্তির ব্যবস্থা হয়। স্বার্থন্বেষী বন্ধুদের মাঝেও সে ছিল এমন উদার অন্তরের অধিকারী। কালের স্রোতে সেই স্বার্থান্বেষী বন্ধুরা হারিয়ে গেলেও তাদের স্মৃতির দুয়ারে এখন আর সেই দিনের দৃশ্য উঁকি মারে না।
কলেজে প্রথম বর্ষ ভালোয় ভালোয় কাটলেও দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেই ঘটল পরিবর্তন। প্রদীপ চিরকাল সমুদ্রের প্রতি আকৃষ্ট ছিল খুব। ডিসকভারি চ্যানেলের সমুদ্রের ছবি দেখতে খুব ভালোবাসতো। সমুদ্রের চলমান জাহাজ গুলো যেন তাকে ইশারায় ডাকতো। একদিন তো বলেই ফেলল -“সমুদ্রের এমন জাহাজে যদি কোনদিন চাকরি হয় তবে ভাববো আমার জীবন সার্থক—” হলও তাই। হঠাৎ এক বন্ধুর প্রভাবে মাথায় এলো ক্যাটারিং কোর্স করবার। করলোও তাই। সঙ্গে করল সেফটি ট্রেনিং কোর্স। ভর্তি হল তারাতলা মার্কেনটাইল মেরিন একাডেমিতে।ট্রেনিং শেষে হাতে পেল সাফল্যের পাঁচখানি সার্টিফিকেট।
মেরিন কোর্স কমপ্লিট করার পনের দিনের মধ্যেই প্রশিক্ষণ প্রদত্ত ক্যাটারিং কলেজের অধ্যক্ষের তত্ত্বাবধানে মুম্বাইয়ের এক নামী শিপিং কোম্পানির ইন্টারভিউ হল বারাসত। প্রদীপ অ্যাসিস্ট্যান্ট কুকের জন্য অ্যাপ্লাই করলো। ইন্টারভিউ টেবিলে তার আদব-কায়দা অ্যাপ্রচিং দেখে শিপিং কম্পানির ম্যানেজার মিঃ কে সতীশ হয়তো ছেলেটাকে একটু ভালো করে বাজিয়ে দেখার জন্য প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা প্রদীপ! তুমি কোন্ পোস্টের জন্য অ্যাপ্লাই করেছো? সবিনয়ে প্রত্যুত্তরে জানালো- স্যার! অ্যাসিস্ট্যান্ট কুকের জন্য। তিনি বললেন- আচ্ছা, আমি যদি তোমাকে কুক হিসাবে রিক্রুট করি- তুমি করবে? প্রদীপের চটজলদি উত্তর- না স্যার! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন -কেন? কে না চায় আর্থিক স্বচ্ছলতায় সুন্দরভাবে দিন কাটাতে? অ্যাসিস্ট্যান্ট কুকের জন্য তুমি ক’ টাকা স্যালারি পাবে? আর কুকের পোস্টে পাবে ডবলের থেকেও বেশি। আমি তোমাকে কুকের পোস্টেই রিক্রুট করে নিচ্ছি। তবুও প্রদীপের একই কথা- না স্যার! কোম্পানি আমার দ্বারা প্রতারিত হোক আমি তা কখনো চাইনা। এই মুহূর্তে আমার যা অভিজ্ঞতা আছে তাতে অ্যাসিস্টান্ট কুকের দায়িত্ব পালন করতে পারব। বেশি স্যালারি পাইয়ে দেওয়ার জন্য যে দায়িত্ব আমায় দিতে চাইছেন সেই অভিজ্ঞতা এই মুহূর্তে আমার নেই। তবে আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমি অল্প দিনেই এই দায়িত্ব পালনে নিশ্চয়ই সমর্থ হব। ম্যানেজার বাবু অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি বুঝলেন এই ছেলেটাই একদিন কর্মগুণে সততার জন্য ক্যারিয়ার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবেই। তিনি বলে উঠলেন – গুড! ভেরি গুড——!! সাথে সাথেই তাকে সিলেক্ট করে নিলেন। এবার সে নবউদ্যমে বেরিয়ে পড়ল অজানাকে জানার আগ্রহে। মুম্বাইয়ে ওই কোম্পানিতে গিয়ে যোগাযোগ করলে সেখানে কোম্পানির নিজস্ব বিশেষ ট্রেনিং সহ হেলিকপ্টার ট্রেনিংও করিয়ে পাঠানো হলো বোম্বে হাইয়ে কর্মরত তৈল উত্তোলনে নিযুক্ত বিশেষ জাহাজে।
সেখানে কাজ করতে থাকে নিষ্ঠার সাথে। সুনামও হয় তার। সুষ্ঠু ও সুন্দর কাজের জন্য স্বয়ং ক্যাপ্টেনের রিপোর্টে তার প্রশংসা কোম্পানিতে যেতে লাগল ।ঐ জাহাজে কর্মরত উচ্চপদস্থ সজ্জন কর্মী মিঃ লুইস আঙ্কেলের সহযোগিতায় সুযোগ এলো বিদেশ যাবার। সে চলে গেল দুবাই। সেখানে যে জাহাজে কর্মে নিযুক্ত হলো সেখানে ভাগ্যচক্রে পরিচয় হয় তার কাছে দেবতাতুল্য মিঃটি কে উন্নির।যার নির্দেশে কর্মরত ডুবুরিরা নেমে যায় সমুদ্রের গভীর তলদেশে। সেখানে জরুরি মেরামতিতে জলের মধ্যে করে ওয়েল্ডিং এর কাজ। কথা বলে- সাঁতার কাটে। আবার উঠে আসে উপরে। ডাইভারদের জলে নামার আগে ও পরে বিশেষ বিশেষ প্রস্তুতি তাকে সর্বদাই নাড়া দেয়। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন দুঃসাধ্য কাজ সাধন করে। বিশেষ করে যখন সমুদ্রের তলদেশ থেকে নির্দিষ্ট কাজ সেরে উপরে উঠে আসবার সাথে সাথেই “ডাইভার্স চেম্বারে” ঢুকিয়ে প্রায় দেড় দু’ঘণ্টা শরীরের টেম্পারেচার অ্যাডজাস্ট করার জন্য আটকে রাখা হয় তখন দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। কারণ ওই সময়ে জরুরি টেম্পারেচার অ্যাডজাস্টমেন্টে সামান্য ত্রুটি হলে ওই ড্রাইভার এর জীবনের নেমে আসতে পারে পঙ্গুত্ব। এইসব দেখার অভিজ্ঞতা প্রদীপের কাছে এক স্মরণীয় স্মৃতি!
বিদেশের সমুদ্রে কাজ করছে ষোল বছর ধরে। কখনো কাজ করেছে শারজা, দুবাই কখনো ইরান, মাস্কট, কাতার, নেদারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, থাইল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য সহ বিশ্বের পঁয়তাল্লিশটি দেশের গভীর সমুদ্রে বিভিন্ন সময় করেছে কাজ কিন্তু ৫ই সেপ্টেম্বর দিনটি সে কোনদিন ভোলেনি। গত দু’বছর আগেও মাস্কট থাকাকালীন এই দিনে প্রচন্ড সি রাফ থাকায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রাত্রি সাড়ে নটাতে এই শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেনি। ছাত্রজীবনে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন ছিল তার আদর্শ।তার একমাত্র ধারণা- একজন শিক্ষক ঠিক পিতৃ সমতুল্য! তাই এই শিক্ষক দিবসে অবনত মস্তকে শতবার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেও তাঁদের ঋণ কোনদিন শোধ করা যাবে না—–!!
–~০০০XX০০০~–