হাওয়ায় গড়িয়ে যাওয়া চিঠি
পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়
আজ শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের অনুভব আমার সামনে জেগে উঠছে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা যারা একটা প্রজন্মকে জীবনের উজ্জ্বল স্পন্দনে – এই সাফল্য, এই উত্তরণের পথে এগিয়ে দিতে চেয়েছ, তোমাদের ছেলেবেলার স্বপ্ন, কিশোর জীবনের প্রতিশ্রুতি, প্রকৃত শিক্ষায় নতুন সমাজকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার অদম্য ইচ্ছার বলে, আমি বিশ্বাস রাখি তারা আগামী দিনেও আরো বৃহত্তর ক্ষেত্রে, জীবনের কঠিন সংগ্রামে সাফল্য লাভ করবেই। ক্রমে একদিন স্কুল ও কলেজ-জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে আরও বড় শিক্ষাঙ্গনে উত্তীর্ণ হবে তোমরা, সে পাঠ প্রথাগত শিক্ষার নয়, তা সমাজ -প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে সাড়া জাগানো দায়বদ্ধতার কথা, পৃথিবীতে নিজের কর্মের দ্বারা একটা দাগ রেখে যাওয়া, যে উদাহরণে বারেবার ঘুরে ফিরে আসবে সমাজের অস্বচ্ছ, ভ্রান্ত এবং অলস দৃষ্টিকোণ বদলাতে সক্ষম এক প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। যেভাবে শিক্ষক বেনীমাধব দাস, এবং পরবর্তীকালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জীবনে বিস্তৃত প্রভাব ফেলেছিলেন। সেই কারণেই নেতাজী ভারতীয় আদর্শের যোগ্য উত্তরসূরি হতে পেরেছিলেন। দেশ এবং জাতির আদর্শকে না বুঝলে, মানুষের মধ্যে সফল আশা ও উদ্যমের সঞ্চার না ঘটাতে পারলে,
মাতৃভাষার শিকড়ে ভিতের মাটিকে গেঁথে রাখতে না পারলে – সমগ্র সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আজ এই অস্থির সময়েও মানুষ অবিরত কাজ করে চলেছে বোবা সভ্যতার বুকে ভাষার উন্মেষ ঘটাতে। যে ভাষা মূল্যবোধের পথ দেখায়, নিষ্ঠায় গড়ে তোলে এক মহৎ আদর্শের সম্ভাবনা,মূল্যবোধে রাখে দৃঢ়সংকল্প, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে শিরদাঁড়াকে ঋজু তৈরি করে। তোমরাই পারো সেই বাধার দুর্লঙ্ঘ্য হিমালয়, বিঘ্নের অসীম পারাবার পার করে এক চিরহরিৎ পৃথিবী তৈরি করতে। একসময় বেদ লিখিত ছিল না, বৈদিক শিক্ষার্থীরা পরম্পরাগত আবৃত্তির মধ্যে আত্মস্থ করে নিত সেই প্রাচীন সংস্কৃতিকে, আজ সেই সময় চলে গেছে কিন্তু সেই আত্মস্থ করার অভ্যাস মানুষকে এখনো গভীরভাবে জাগিয়ে তোলে, তারা স্মৃতির ভিতর মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করে নিজেকে বলুক : আমি পেরেছি, আমি পারি এবং আমি অবশ্যই পারবো। এই পারার মধ্যেই জীবনের রহস্যটুকু, তাকে আবিষ্কার করার মধ্যেই আত্ম অনুসন্ধান। আমার বিশ্বাস একদিন তোমরা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারবে, একটু একটু করে আবিষ্কার করতে পারবে নিজেদের সত্তার ভিতরে রাখা মূল্যবোধের উজ্জ্বল চাবিকাঠি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: “আমাদের শিক্ষার ভিতরে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই, যা আমাদের কেবল তথ্য দেয় না সত্য দেয়, কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।” এই সত্য সবার ভিতরে প্রতিষ্ঠিত হোক, “ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে”, এই অগ্নি জীবনের সকল নিরাশা দূর করে ছড়িয়ে দিক সময়ের পূণ্য আলোকদীপ্তি। “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পুণ্য করো দহনদানে।” (৫ই সেপ্টেম্বর,২১)
–~০০০XX০০০~–