ভুল সংশোধন
—— মৃনাল কান্তি বাগচী
হঠাৎ মলয় সেনগুপ্তের -এন্ড্রয়েড ফোন-এর স্ক্রীনে একটা অজানা নম্বর থেকে কল আসলো । তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোনের কলটা রিসিভ করলেন । কিন্তু কয়েকবার হ্যালো, হ্যালো করার পর ফোন এর অন্যপ্রান্ত থেকে কোন রেসপন্স পেলেন না । এতে মলয়বাবু যারপর নয় বিরক্ত হলেন । ডিউটিতে যাওয়ার আগে এ ধরণের ঘটনায় যিনি অপর প্রান্ত হতে ফোন করেছিলেন তার প্রতি যথেষ্ট বিরূপ হলেন । এ ধরণের আচরন কেন যে তার সঙ্গে করা হলো তা খোঁজার চেষ্টা করলেন ।
মলয়বাবু উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অঙ্কের শিক্ষক । বর্তমানে তার বয়স ২৮ বছর । তিনি শান্ত স্বভাবের লোক । কোনো ঝঞ্ঝাট তিনি পছন্দ করেন না । নিজের আদর্শ নিয়ে চলতে পছন্দ করেন । তার বিদ্যালয়টি বাড়ী থেকে বেশী দূরে নয় । এম.এসসি, বি.এড পাশ করে এস.এস.সি দিয়ে রাজ্য সরকারের অনুমোদিত একটি বিদ্যালয়ে বছর চারেক আগে শিক্ষকতার চাকুরী পেয়েছেন । তার পরিবারটি ও খুব ছোট । বাবা, মা এবং তাকে নিয়ে তাদের সংসার । তার বাবা বিনয় সেনগুপ্ত কেন্দ্র সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ছিলেন ।
সাম্প্রতিক তিনি চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন । তিনিও ভীষণ রাশভারী লোক । শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা তার জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ন । জীবনে ছল চাতুরী মোটেই পছন্দ করেন না । তার ছেলে মলয়বাবু ও অনেকটা বাবার মত । মলয়বাবু বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো ছাড়া বাড়ীতে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে সময় কাটান । তাছাড়া তিনি খুবই মিতভাষী ।মলয় বাবু তার বাবা ও মাকে খুবই শ্রদ্ধা ও মান্য করেন ।
মলয় বাবুকে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা খুবই পছন্দ করেন । অঙ্ক বিষয়টি মলয় বাবুর কাছে জীবনের ধ্যান ও জ্ঞান । তার অঙ্ক লেখানোর পদ্ধতি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুবই গ্রহনযোগ্য । ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক । ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে খুব ভালোবাসে ।
কথা প্রসঙ্গে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে আসার পূর্বে – এন্ড্রয়েড ফোন এ যে কলটা পেয়েছিলেন তার বিষয়টি জানালেন এবং ইদানিং ফোন এ যে সব ঘটনা ঘটছে তাতে তার প্রতিক্রিয়া তাদের জানালেন ।
ছাত্রদের মধ্যে প্রকাশ নামে একটি ছেলে মলয় বাবুকে জানালেন , ” স্যার , আজকাল এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই হয় । এটা নিয়ে অত কিছু ভাবার নেই “।
যা হোক, মলয়বাবু আপাতত বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন ।
কিন্তু সকালের ফোন এর ঘটনাটি তার মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারলেন না । তার মাথায় হাজারো রকমের সম্ভাবনা কিলবিল করতে লাগলো । তিনি বাড়ি ফিরে এসে যে নম্বর থেকে ফোন টি এসেছিলো সেই নম্বর এ ফোন করলেন । কিন্তু সুইচ বন্ধ । মলয় বাবুর মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো । তার বারবার মনে হচ্ছিলো যিনি ফোন করেছিলেন তিনি তার বিশেষ পরিচিত ।
কেন তার এ ধরনের মনে হচ্ছিলো তার কারন হলো –
মলয় বাবুদের বাড়ীর পাশে একটি পরিবার ভাড়া থাকতো । পরিবারের কর্তা বদলীর চাকুরী করেন । তার একটি মেয়ে আছে, তার নাম তপতী অর্থাৎ তপতী রায় । মলয় বাবুর থেকে তিন বছরের মত ছোটো । তারা যখন মলয় বাবুদের পাশে ভাড়া থাকতো তপতী তখন বি.এস-সি অঙ্কের অনার্সের ছাত্রী ছিলো । সে মাঝে মাঝে মলয় বাবুর কাছে তার পড়াশুনার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে আসতো । সেই সূত্রে বার বার মলয় বাবুদের বাড়ী অবাধ যাতায়াত ছিলো । এই যাতায়াত থেকে মলয় বাবু ও তপতীর মধ্যে একটি প্রণয় গঠিত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।
ভালোবাসা কখনো কখনো মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে । মলয় বাবুর অবস্থা তাই হলো । তিনি সব সংকোচ ত্যাগ করে বাবার কাছে তপতীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন ।
মলয় বাবুর এই আচরনে বিনয় বাবু তার মেজাজ হারিয়ে ফেললেন । তিনি মলয়কে অনেকগুলি অপ্রিয় কথা বলে ফেললেন । মলয় বাবু তার বাবার এ ধরনের আচরনে খুবই দুঃখ পেলেন । তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন জীবনে বিয়ে করবেন না । যদি বিয়ে করেন তবে তপতীকেই করবেন ।
অন্যদিকে তপতীর বাবা প্রলয় বাবুর হঠাৎ বদলীর আদেশ পেয়ে গেলেন । তিনি বিনয় বাবুর মলয়ের প্রতি আচরনে খুবই মনোক্ষুন্ন হয়েছিলেন । তিনি মেয়েকে এবং বিধাতাকে তার বদলীর আদেশনামাকে ঈশ্বরের অনুগ্রহ বলে মনে করলেন । প্রলয় বাবু তার পরিবার নিয়ে অনেকটা দূরে কর্মস্থলে চলে গেলেন । এর ফলে মলয় বাবু ও তপতীর ভালোবাসার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেলো ।
মলয় বাবু ও তপতী কেহ ই আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন নি ।
মলয় বাবু বই পড়ে ও বিদ্যালয়ের ডিউটি করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলেন ।
মাঝে মাঝে মলয় বাবুর পিতা ও মাতা মলয় বাবুকে বিয়ে করার জন্য বলতেন । কিন্তূ মলয় বাবু ইনিয়ে বিনিয়ে তা এড়িয়ে যেতেন । মলয় বাবু জানতেন তপতীর কথা তার মা-বাবাকে বলে কোনো লাভ নেই কাজেই নিরুত্তর থাকাই তার কাছে শ্রেয় মনে করতেন ।
কিছুদিন এই ভাবে যাওয়ার পর একদিন রাতের খাবার খাওয়ার পর মলয় বাবু বিছানায় ঘুমোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । হঠাৎ তার মোবাইল-এ কিছুদিন আগে যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো সেই নাম্বারে একটি মেসেজ দেখতে পেলেন । মেসেজ এ আছে –
“আমি তপতী, কয়েকদিন আগে তোমাকে ফোন করেছিলাম, কিন্তূ আমি তোমাকে কোনো উত্তর দেই নি । কথা বলতে সাহস পাই নি । তুমিতো আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখো নি । তাই আমিই ফোন করেছিলাম । জানি, আমার প্রতি তোমার তো কোনো টানই নাই । যাহা হোক আমারই দায় ।তাই দয়া করে যে মেসেজ গুলো পাঠাচ্ছি তার উত্তর দাও । যদি আমাকে আজও ভালোবাসো উত্তর দাও ।” মলয় বাবু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবার মনো স্থির করে ম্যাসেজ এর উত্তর পাঠানো শুরু করলেন ।
মলয় বাবু : – ‘ ইচ্ছা করলে কি সব ভোলা যায় । তোমাকে খুবই মিসকরি ‘।
তপতী : – “আমাকে যদি মিসই করো তবে কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখো নি ?”
মলয় বাবু : – তুমিতো বাবাকে ভালোভাবে চেনো । কি হবে তোমার সংগে বৃথা যোগাযোগ করে ?
তপতী : – তবে কেন মেসেজ-এর জবাব দিচ্ছো ?
মলয় বাবু : – মন তো মানে না । এতদিন পরে তুমি যে আমাকে ভোলো নি সে কথা ভেবে তোমাকে
ভালোবাসার লোভ সামলাতে পারলাম না । তোমাকে আমি বড় ই ভালোবাসি তপতী ।
তপতী : – তুমি কি পারো না তোমার বাবাকে রাজি করিয়ে আমাকে বিয়ে করতে ?
মলয় বাবু : – আমি খুবই অসহায়, তবুও চেষ্টা করবো । তুমি যোগাযোগ রেখো । আচ্ছা, একটা কথাতো
জানাই হয়নি । তুমি এখন কি করছো ?
তপতী :- আমি এম. এস-সি, বি.এড. পাশ করে একটি বালিকা বিদ্যালয়ে অঙ্কের দিদিমনি হয়েছি । তুমিতো
আর কোনো খোঁজই রাখো না । তোমাকে বলেই বা কি লাভ ?
মলয় বাবু:- ভুল স্বীকার করছি তোমার সংগে যোগাযোগ না রাখার জন্য । এবার থেকে যোগাযোগ রাখবো
। ঠিক আছে । শুভরাত্রি ।
তপতী :- ঠিক আছে, শুভরাত্রি ।
এভাবে মলয় বাবু ও তপতীর মধ্যে এন্ড্রয়েড ফোন এর হোয়াটস্যাপ এ মনের ভালোবাসার আদান প্রদান চলছিল । দিনের পর দিন বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিলো ।
কিন্তু গোল বাধলো একদিন রাতে । মলয় বাবু কোনো ভুল করে ফোন রেখে কিছুক্ষনের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন । ঐ সময় কি একটা কাজে মলয় বাবুর পিতা বিনয় বাবু মলয় বাবুর বিছানার কাছে গিয়েছিলেন । হঠাৎ মোবাইল এ ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলতে দেখলেন । কৌতুহল বশত: ছেলের ফোন টি হাতে তুলে হোয়াটস্যাপ মেসেজ এ গেলেন, দেখেন তপতী নামে একটা মেয়ের থেকে একটা মেসেজ এসেছে । তাতে লেখা আছে “তুমি মেসেজ এর উত্তর দিচ্ছ না কেন ? ” প্লিজ রিপ্লাই ।
বিনয় বাবু এটা ওটা ভেবে মেসেজ টির উত্তর দিলেন, “বলো তোমার খবর কি ?”
তপতী : – আমার খবর আর কি ? তুমি তোমার খবর বলো । সাহস করে তোমার বাবাকে আমাদের
বিয়ের কথা বলেছো কি ?
বিনয় বাবু :-দেখি চেষ্টা করছি, আজ রাখো । একটু অন্য কাজে ব্যস্ত আছি , ভালো থেকো, শুভরাত্রি ।
তপতী : -শুভরাত্রি । ।
এই ঘটনার পর বিনয় বাবু বুঝতে পারলেন, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে । তার ভুলের সংশোধন করতে হবে । পরের দিন বিনয় বাবু তার গিন্নিকে নিয়ে তপতীদের বাড়ী রওনা দিলেন । সেখানে পৌঁছে তপতীর বাবা মাকে পূর্বের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং তপতীকে তাদের পুত্রবধু করার প্রস্তাব রাখলেন । তপতীর পিতা ও মাতা রাজী হয়ে গেলেন । তার সঙ্গে তাদের এই বিয়ের পরিকল্পনাটি গোপন রাখার জন্য অনুরোধ রাখলেন । তারা ও সহমত পোষন করলেন ।
বিনয়বাবু ও তার স্ত্রী বাড়ী ফিরে এলেন । রাতের দিকে মলয় বাবুকে জানালেন আগামী মঙ্গলবার তাঁর এক বন্ধুর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ আছে, সেখানে সবাইকে যেতে হবে ।
মলয় বাবু কিছুতেই যেতে চাচ্ছিল না । কিন্তু বিনয় বাবুর কথা কিছুতেই ফেলতে পারলেন না ।
বিনয় বাবু, মলয় এবং তাঁর গিন্নিকে নিয়ে তপতীর বাড়ীতে হাজির হলেন । মলয় বাবু তপতীদের বাড়ীর লোকজন এবং তপতিকে দেখে হতবাক । ওদিকে তপতীও মলয় ও ওদের বাড়ীর লোকজনদের দেখে বিস্মিত ।
বিস্ময়ের মাঝে মলয় ও তপতী ডেকে নিয়ে বিনয় বাবু আসল ঘটনাটা জানালেন । এবং সেদিন রাতে ছেলের মোবাইলে তিনি মেসেজের উত্তর দিয়েছিলেন । এটা ঠিক হয় নি । এই জন্য তিনি দুঃখিত । কিন্তু ঐ ভুল জন্য তিনি তপতী ও মলয়ের মন দেওয়া নেওয়া উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । তার সেই আগের ভুল সংশোধন করে তাদের বিয়ে দিয়ে ভুলের সংশোধন করতে চান । সেকথা শুনে মলয় ও তপতী লজ্জায় লাল হয়ে গেল ।
বিনয় বাবু ও তার ভুল বুঝতে পেরে ভুল সংশোধন করে নিলেন ।
–~০০০XX০০০~–