এ প্লেটোনিক লাভ স্টোরি
সলিল চক্রবর্ত্তী
“তুই তো বসিরহাট B L R O তে আছিস , সময় সুযোগে হাসনাবাদে রতন মন্ডলের বাড়ি গিয়ে জমির টাকাটা নিয়ে আসতে পারিস তো?”
অপু, ওরফে অপরেশ লাহিড়ীকে ওর বাবা খানিকটা অনুরোধের সুরেই কথাগুলো বলেন। একসময় বসিরহাটে অপুদের পৈতৃক বাড়ি ছিল। সেসব এখন শরিকানা ভাগ বাটোয়ারায় কিছুই নেই। আবাদি জমি এদিক ওদিক অনেক ছিল, যদিও সেগুলো ভাগ চাষীদের হাতে। হাসনাবাদের বিঘা চারেক আবাদী জমি অপুদের ভাগে পড়েছিল। সেটা এখন ভাগ চাষে দেয়া আছে। বছরান্তে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যায় বটে, তবে কলকাতা থেকে যাওয়ার অভাবে টাকা নেয়া হয় না। বছর চৌত্রিশের অপু বসিরহাট B L R O তে সদ্য জয়েন্ট করেছে। অপু ছোট বেলায় ওদের গ্রামরে বাড়ি গরমের ছুটিতে বেড়াতে আসতো সে ওই তেরো চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত। উঁচু ক্লাসে উঠে পড়ার চাপে আর আসতে পারেনি। আজ আঠারো কুড়ি বছর পর চাকরি সূত্রে বসিরহাটে আসা। এতদিনে ইছামতি নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। যাইহোক অপু ঠিক করলো সামনের শনিবারে সে হাসনাবাদ গিয়ে রতন মন্ডলের সাথে দেখা করবে।
ভাঙাচোরা একটা খড়ের চালা, মাটির স্যাঁতসেঁতে মেঝে, উঠোনে কয়কেটি ইঁট পাতা যার উপর দিয়ে জল এড়িয়ে ঘরে ঢোকা যায়। গুটি কয়েক মুরগি উঠোন এবং ঘরের বারান্দায় ঘুর ঘুর করছে। উঠোনে একটা গরু বাঁধা, একটু দূরে তার বাছুরটি মাঝে মাঝে ডেকে চলেছ তার মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। অপু খোঁজ নিলো ওটাই রতন মন্ডলের কুড়ে ঘর। একপা দুপা করে অপু বাড়ির ভীতর ঢুকলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে অপু ডাকলো- “রতনদা বাড়ি আছেন নাকি?” কোনো উত্তর না পেয়ে আবার ডাকলো। এবার একটি বছর আটেকের ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, আলগা মলিন গায়ে। অপু একটু ভেবে বললো-” তোমার বাবা বাড়িতে আছেন?” ছেলেটি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলো। অপু আবার ডাকতে যাবে, এমন সময় বছর দশেকের একটি মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অপু মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। স্বাস্থ্যবতী, বড় বড় চুল গুলোকে লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে দুই ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেয়া। ডাগর ডাগর চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অপুর দিকে তাকিয়ে থাকলো। অপুর মেয়েটিকে ভীষণ চেনা মনে হলো। এই মুখ কোথায় যেন সে দেখেছে। মেয়েটি বলল-” আপনি কোথা থেকে আসছেন?” অপু আরো অবাক হলো , গলাটিও যেন খুব চেনা। মেয়েটি একই প্রশ্ন আবার করলো। অপু ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বললো-” হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি কলকাতা থেকে আসছি, তোমার বাবা বাড়িতে আছেন?” মেয়েটি কিছু বলবে বলে বাবা শব্দটি উচ্চারণ করতেই ভিতর থেকে একটি মহিলা কণ্ঠ মেয়েটিকে ঘরের ভেতর ডেকে নেয়। অপু মিনিট খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি আবার ঘর থেকে বেরিয়ে অপুর সামনে দাঁড়ালো। পিছনে চৌকাঠ অব্দি এসে দাঁড়ালো সম্ভবত সেই নারী কণ্ঠী ভদ্র মহিলা। পরনে সাদা থান, অবগুণ্ঠনাবৃত। অপু একটু মিষ্টি হেঁসে বললো-” তোমার নাম কি?” মেয়েটি বলল-” বিমলা” অপু আবার অবাক না হয়ে পারলো না।নামেতেও একটা চেনা আভাস পাচ্ছে। অপু ভাবনা গুলোকে মাথা থেকে তাড়িয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো-” কৈ তোমার বাবা কোথায় গেছেন বললে না তো!” বিমলা মায়ের দিকে একবার দেখে নিয়ে বললো-” বাবা এক বছর হলো মারা গেছে”। অপু সহমর্মিতা দেখিয়ে বিমলার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল -” সেকি কিভাবে “? বিমলা একটু কাঁদো কাঁদো সুরে বললো -” সাপের কামড়ে ” অপু খুব অস্বস্তিতে পড়লো , তারপর ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলো-“আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?” ভদ্রমহিলা বিমলাকে একটা বসার জায়গা দিতে বললো। বিমলা একটা পিঁড়ি এনে বসতে দিলো। অপু পিঁড়িতে বসে বললো-” দেখুন আমার বাবার অনেক বয়স হয়েছে, উনি জমি জমা দেখভাল করতে আসতে পারেন না, সেইজন্য আমার আসা। কিন্তু এসে যা শুনলাম তাতে আমি খুবই মর্মাহত। আমার আসার উদ্দেশ্য এখন মূল্যহীন, আপনাদের এই পরিণতি কি ভাবে হলো আমি কি তা শুনতে পারি?” ভদ্রমহিলা এই কথার উত্তর না দিয়ে, ধীর স্থির নম্র ভাবে পাল্টা প্রশ্ন করলো-“আপনি কি অপু?” অপু রীতিমতো বিশ্বিত, মনে মনে ভাবলো এনার তো আমার নাম জানার কথা নয়। তাহলে উনি কি আমাকে আগে থেকে চিনতেন! অবগুণ্ঠনাবৃত মহিলাকে অপু জিজ্ঞাসা করলো-” হ্যাঁ, আচ্ছা আপনি কিভাবে আমার নাম জানলেন?” অবগুণ্ঠনাবৃত ভদ্রমহিলা উত্তর না দিয়ে আবার প্রশ্ন করে-” কমলা বলে আপনার কাউকে মনে পড়ে?”অপু চমকে ওঠে, বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে-” কে আপনি?” ভদ্রমহিলা ঘোমটা সরিয়ে মুখটা উন্মুক্ত করে অপুর দিকে ঘুরে তাকায়। দুই চোখ ছল ছল করছে জল পূর্ণ হয়ে। অপু মুখের দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়-” ক-ম-লা “!!! অশ্রুপূর্ণ টলটলে চোখে অপু দেখতে পেল তার হারিয়ে যাওয়া আঠারো বছর আগের স্মৃতি।
বসিরহাটের হাটখোলা গ্রামে অপুদের শরিকানা বাড়ি। বছর চোদ্দ পনেরোর অপু এসেছে গরমের ছুটিতে এখানে বেড়াতে। এখানে প্রায় প্রতিটা বাড়িতে তাঁত আছে, কারণ ঘরে ঘরে কুটির শিল্পের মতো গজ কাপড়ের কারবার। অপুর কাকাদেরও ওই একই ব্যাবসা। বাড়িতে গোটা পনেরো তাঁত আছে। কাক ভোর হতেই ওই এলাকায় গজ কাপড় তৈরীর কাজ শুরু হয়ে যায়। অপুর কাকার বাড়িতেও তাঁতের খট খট আওয়াজে চারদিক মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। চারদিক মাতোয়ারা বলার কারণ মূলত মহিলারাই এই এলাকার তাঁত শ্রমিক। এরা তাঁত চালাতে চালাতে নিজেদের মতো করে লোকগীতি, ভাটিয়ালি,চটকদারি গান গাইতে অভ্যস্থ। ফলে তাঁতের খটা খট আওয়াজ আর অপরিণত বেসুরো গানের আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কিশোর অপুর ঘুম ভাঙল ঠিক এমনি এক নুতন শব্দের ভোরে। তাঁতের খটাস খটাস আওয়াজের সাথে একটা সুন্দর ভাটিয়ালি গান অপুর কানে ভেসে এলো–” পদ্মা নদীর মাঝি তুমি নাও বাইয়া যাও / যেথায় তোমার পরান চায় সেথায় লইয়া যাও।” অপুর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। রেডিওতে অনেক ভাটিয়ালি গান শুনেছে, সেগুলো অনেক সুন্দর, কিন্তু তাতে কোনো রিয়েলিটি নেই। যান্ত্রিকতা বর্তমান ,এখানে মেয়েলি গলায় তাঁতের শব্দ মিশে একাকার হয়ে যাওয়া গানটি অপুর মনকে আরো আকর্ষণ করলো।গাত্রোত্থান করে গানের উৎস সন্ধেনে এগিয়ে গেলো। তাঁত ঘরে ঢুকে দেখে, তাঁতটি চালাচ্ছে এক ষোড়শী,শ্যামবর্ণা, লাবণ্যময়ী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী। স্কার্ট জামা পরে, লাল ফিতের বেনি ঝুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে গান করে চলেছে। কোনো দিকে তার দৃষ্টি নেই, দৃষ্টি শুধু তাঁতের মাকুর দিকে, যদি সুতো ছিড়ে যায়। অপু কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বিভোর হয়ে গানটি উপভোগ করতে থাকলো।
তাঁতটি থেমে গেলো, মনে হয় সুতো ছিড়ে গেল। ঠিক তাই, মেয়েটি মাথা ঝুকিয়ে সুতো ঠিক করে পুনরায় তাঁত চালাতে গিয়েই অপুকে দেখতে পেলো। প্রায় তার বয়সী অপুকে তার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো-” তোমার নাম কি?”
–“অপরেশ লাহিড়ী,সবাই অপু বলেই ডাকে, তোমার নাম?”
-“কমলা” বলেই কমলা তাঁত চালাতে শুরু করে। কিন্তু গান ধরে না। মিনিট খানিক অপেক্ষা করে অপু কমলাকে জিজ্ঞাসা করে সে গান করবে কিনা। কমলা একটু মুচকি হেঁসে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে-“কেন আমার গানের গলা কি
খুব সুন্দর?” অপু একটু লজ্জা পেয়ে কিছু না বুঝে বললো-” এমনি” । কমলা আবার আগের মতো তাঁত চালিয়ে গান গাওয়া শুরু করলো। অপু উদাস হয়ে কমলার দিকে চেয়ে থাকলো।
ওখানেই তাঁত চালায় বাইশ চব্বিশ এর পূর্ণিমা ও শেফালী । তারা গল্প করতে করতে তাঁত ঘরে ঢুকেই অপুকে দেখতে পায়। অচেনা অপুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পূর্ণিমা কমলার কাছে ব্যাপারটা জানতে চায়। কমলাও অপু এসে দাঁড়ানোর কারণটা বলে। পূর্ণিমা মাকুতে নলি পরাতে পরাতে ব্যাঙ্গের সুরে বললো-“তোর গান মনে ধরেছে না তোকে মনে ধরেছে”। কথাটি বলেই পূর্ণিমা ও শেফালী হো-হো করে হেঁসে উঠলো। ঠিক সেই সময় অপুকে তার কাকিমা ডাকায় অপু ছুটে চলে যায়।
পরদিন কমলা কাজে আসার সময় জামরুল খেতে খেতে আসছিল। হঠাৎ ওর অপুর কথা মনে হলো। ভাবলো সেতো ভালো গান জানেনা ,অপু তাহলে তার মধ্যে কি পেলো! অপু কি পেলো কমলা তা ঠিক না বুঝলেও, এক দিন কিছুক্ষনের দেখায় ষোড়শী কমলা তার শরীর মন দিয়ে অনেক কিছু ভেবে নিলো। যা আগে কখনো সে ভাবেই নি। কমলা আর জামরুল না খেয়ে গোটা পাঁচেক রেখে দিল।
তাঁত চালাতে চালাতে ভাবলো অপু আসলে জামরুলগুলো দেবে। কিন্তু অপু তখনো না আসায় কমলা একটা ইচ্ছে না মেটার অসস্তি অনুভব করলো। পাশাপাশি এটাও ভাবলো পূর্ণিমাদি শেফালী দির সামনে দেয়া যাবেনা, ওরা আবার কি বলে বসবে। কিন্তু অপু তখনো না আসায় কমলা একটা ভাটিয়ালি সুর ধরে-” পরান বনধু রে ,মোর ললাটে তোর দেখা নাহি হয় / আনচান করা নয়ন যে মোর তোকে খুঁজে বেড়ায়।” এদিকে অপু ভাবছে তাঁত চলছে কিন্তু গান তো হচ্ছেনা। যখনই কমলা ভাটিয়ালি সুর ধরল অপুও গুটি গুটি পায়ে তাঁত ঘরে গিয়ে উপস্তিত হলো। কমলা যেন এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। গান থামিয়ে, তাঁত বন্ধ করে জামরুলগুলো নিয়ে এগিয়ে এসে বললো-” এগুলো খাও, খুব মিষ্টি”। অপু ফল খুব ভালোবাসে, কমলার হাতথেকে নি:সঙ্কোচে যেই জামরুল গুলো নিতে গেল, ঠিক সেই মুহূর্তেই পূর্ণিমা শেফালী এসে পড়ল। পূর্ণিমা বক্র হাসি হেসে বলল-” কিরে কমলা কি দেওয়া নেওয়া চলছে?” শেফালী বললো-” প্রথম প্রথম না হয় ফলই হোক”। কমলা গম্ভীরভাবে তাঁতে গিয়ে বসল। অপু কিছু বুঝুক না বুঝুক এটুকু বুঝলো, পূর্ণিমা, শেফালী ভালো মেয়ে নয়। সে ওখানে না দাঁড়িয়ে চলে আসল। সেদিন সন্ধে বেলা গজ কাপড়ের হিসাব দেওয়ার সময় অনিল বাবু কমলার উপর রেগে গিয়ে বললেন-” কমলা তোর কাপড়ের বুনন কিন্তু ভালো হচ্ছে না। নজর দিয়ে কাজ করিস না?” পূর্ণিমা কমলার দিকে আর চোখে তাকিয়ে ব্যাঙক্তি করে বলে-” নাগো কাকা কমলার নজর শুধু কাপড়ে থাকে না, তাই না শেফালী?” পূর্ণিমা, শেফালী এক সাথে হো হো করে হেঁসে উঠে।
পরদিন কমলা কাজে আসলনা, তার মা কাজে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে বলল তার নাকি প্রচন্ড মাথা ধরেছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। মাথার যন্ত্রনা তো নয়, মনের যন্ত্রনা তার প্রবল হয়ে চলেছে। কমলার কিছুই ভালো লাগছে না, ঘুমও যদি আসতো তা হলে একটু শান্তি পেতো। বালিশে মাথা গুঁজে সে মনে মনে ভাবল, তার জন্যে অপুকেও কটু কথা শুনতে হয়েছে।
সকাল থেকে তাঁতের খট খট আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু অপু ভাটিয়ালি সুর শুনতে পাচ্ছে না। যে গানের আওয়াজ পাচ্ছে সেটা যে কমলার নয় তা অপু ভালোই বুঝতে পারছে। অপুর যেন কিছুই ভালো লাগছে না। কি যেন একটা মিস করছে। বিরাট বাগান বাড়ি, ভাবলো আম বাগানে গিয়ে পাকা আম খেয়ে আসবে। আম বাগানে যাওয়ার রাস্তা তাঁত ঘরের পাশ দিয়ে গেছে। অপু যখন তাঁত ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন সে দেখার চেষ্টা করেছিল কমলা সেখানে আছে কিনা। কিন্তু তাঁত ঘরের পাশে যেতেই মহিলা কণ্ঠের হিন্দি গান থেমে গিয়ে শুনলো-” আজ কমলা নেই, তাই আমার মনও ভালো নেই”। এই বলে হো হো করে হেঁসে উঠলো। অপুর বুঝতে অসুবিধা হলো না, যে পূর্ণিমাদি, শেফালীদি তাকে দেখেই কথাটি বললো।
পর দিন ছিল হাট খোলার হাট, হাটে খুব তেলে ভাজা উঠে, অপু গরম গরম পিঁয়াজি খুব ভালো বাসে, এক ঠোঙা পিঁয়াজি কিনে খেতে গিয়েই ওর কমলার কথা মনে পড়লো। বাড়িতে এসেই অপু তাঁত ঘরে চলে যায়। ভাগ্যক্রমে সেখানে তখন পূর্ণিমারা ছিল না। অপুকে দেখে কমলা খুশিতে আত্মহারা। অপু জিজ্ঞাসা করলো যে, সে গতকাল আসেনি কেন? কমলা কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিলোনা। একটা অনাবিল আনন্দের ঢেউ এসে তার মন প্রাণ সব সিক্ত করে দিল। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল-” কাল আমার মনটা ভালো ছিলো না। কাল আমি আসিনি ঠিকই, কিন্তু তুমি জিজ্ঞাসা করছো কেন গো?” কমলা তার মনের মতো উত্তরের অপেক্ষায় অপুর মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। –“কাল আম গাছ তলায় আম কুড়িয়ে পেয়ে ছিলাম, তোমাকে দেব বলে এসে দেখি তুমি নেই।” অপুর থেকে কমলা বছর দুই এর বড়ো, তাছাড়া সমো বয়সী ছেলের থেকে মেয়েদের মানসিক উন্নতি সব সময়ই বেশি। কমলা খুশিতে গদ গদ হয়ে বলল-“তুমি যে আমার এখানে এসেছিলে এটা শুনেই আমার ভীষণ ভালো লাগছে”। অপু এবার পিছন থেকে পিঁয়াজি ভরা ঠোঙাটা কমলার সামনে আনলো। কমলা অবাক বিশ্বয়ে বললো-” কি আছে ঠোঙায়?”
–“হাটে গিয়েছিলাম, পিঁয়াজি কিনেছি”। কমলার জন্য অপু পিঁয়াজি কিনেছে, এটা কমলা ভাবতেই পারছে না। আনন্দে কমলার চোখে জল এসে গেল। পিঁয়াজির ঠোঙাটা অপুর হাত থেকে নিয়ে বললো-” বলো, তুমি আমার কাছে কি চাও?” অপু একটু ভেবে বললো-” কিছু না।” কমলা অপুর দিকে তাকিয়ে খুশিতে ডগোমগো হয়ে বলল-” কিছুতো বলো, আমারও তো ইচছা করে তোমাকে কিছু দিতে” অপু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ,কমলার দিকে তাকিয়ে সরল হাসি হেসে ‘গান’ বলেই দৌড়ে পালালো।
কমলার জীবনে এতো ভালো দিন আর আসেনি। পূর্ণিমা শেফালী আসছে দেখে ওর রাগ না হয়ে আনন্দ হলো বেশি। জোর করে ওদের পিঁয়াজি খাওয়ালো। পূর্ণিমা শেফালীতো অবাক মেয়েটির হলো কি। কমলা তাঁতে বসে ভাটিয়ালি সুরে গান ধরলো। পূর্ণিমা শেফালী আর গান ধরতে পারলনা। কারণ কমলা নদী মাত্রিক ভাটিয়ালি গান যেন আজ অন্য মাত্রায় গেয়ে চলেছে। যেমন তার সুর তেমন তার কথা। বিকালে গজ কাপড় জমা দেয়ার সময় অনিল বাবু খুব প্রশংসা করলেন। আজ গজ কাপড়ের বুনন তো ভালো হয়েছে,উপরন্তু একটি কাপড় বেশি বুনেছে।
পরদিন কমলা গাছের জাম কিছুটা পেড়ে ঠোঙায় ভোরে নিয়ে কাজে এলো। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তার মনকে উথাল পাথাল করে দিচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে, মনের না বলতে পারা কথাগুলো যদি মন উজাড় করে কাউকে বলতে পারত, তাহলে মনটা একটু হালকা হতো। পূর্ণিমা শেফালী এসে দেখে কমলা তাঁতে বসে পড়েছে, পাশে এক ঠোঙা কালো জাম। পূর্ণিমা মুচকি হেসে বলে-” কিরে কমলা, জাম আমাদের জন্যে এনেছিস না অন্য কারো জন্যে?” কমলা রাখঢাক না করে বলে দিল যে সে সত্যিই অপুর জন্য এনেছে। এই কথা শুনে পূর্ণিমা শেফালী ভীষণ সিরিয়াস হয়ে কমলাকে বোঝালো-” কমলা, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কোথায় তুই আর কোথায় অপু, তাছাড়া অপু তোর থেকে ছোট, এটা তুই বুঝতে পারিস না?
কলকাতার ছেলে বেড়াতে এসেছে দুদিনের জন্যে,দুদিন পরে ফিরে যাবে। মধ্যে পড়ে তোর মনটাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে লাভ কি!” কমলার চোখ জলে ছল ছল করে উঠলো। যুক্তি বুদ্ধি, জ্ঞান, বিবেচনা, উচিত, অনুচিত সব কিছুর বাইরের এক জগতে তার মন বিচরণ করছে। পাগলপারা মন যে বাঁধ মানতে চায় না। এরই মধ্যে অপু একটা বল নিয়ে খেলতে খেলতে তাঁত ঘরের কাছে এসে পড়ে। কমলা দেখতে পেলো,খুব কষ্ট হলেও কিছু বললো না। শেফালী অপুকে দেখতে পেয়েই ডাকলো। অপু আসতেই পূর্ণিমা বললো-” এইনে অপু জাম খা।” অপু পূর্ণিমা শেফালির এহেন আচরণে খুব অবাক হলো। মুখে কিছু না বলে কমলার দিকে তাকালো। কমলা কথা না বললেও চোখের ভাষা বুঝিয়ে দিলো সে যেন জাম নেয়।
অপু এক মুঠো জাম নিয়ে চলে গেল।
সেদিন সারা রাত কমলা দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। বিভিন্ন রকম অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনা তার বাস্তবতাকে তালগোল পাকিয়ে দিলো। পরদিন একটু বেলাতে কমলা কাজে আসছিল, অন্য সময় হলে হয়তো আসতো না। অপু গিয়েছিল মুদির দোকানে, ফেরার পথে দুজনের দেখা। অপু কমলাকে জানালো, গতকাল রাতে তার বাবা এসেছেন, আজ দুপুরের পর সে কলকাতায় ফিরে যাবে। কমলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এমন একটা কথা শুনবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, তারপর অপুর চোখে চোখ রেখে ছল ছল নয়নে বললো-” অপু আমাকে তোমার মনে থাকবে?” অপু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি জানাতেই, অপু দেখলো কমলার দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জলধারা নেমে এসে চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জামার নিচের অংশ দিয়ে চোখ মুছে কমলা বলো-” তুমি বাড়ি যাও।” অপু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো-” তুমি কাজে যাবে না?”
“না”বলে কমলা দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে চলে যায়।
বাড়িতে গিয়ে কমলা বালিশে মাথা গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। পূর্ণিমাদি ঠিকই বলেছে, দোষ তার নিজের , কিন্তু কিভাবে কি হয়ে গেল সে নিজেই বুঝতে পারলো না। কাঁদতে,কাঁদতে কমলা ঘুমিয়ে পড়লো। ঘন্টা দুই পরে কমলার ঘুম ভাঙলে ওর মনে হলো একবার কাজের ওখানে গেলে অন্তত শেষ বারের মতো অপুকে দেখতে পাবে।
কলকাতায় ফেরার জন্য অপু একদম রেডি। সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে নিচ্ছে। পূর্ণিমা, শেফালী ও এসে দাঁড়ালো। অপুর মনের ভিতর কেমন যেন একটা অসস্তি হতে লাগলো। কিছু যেন একটা বাকি থেকে যাচ্ছে। ওর চোখ দুটি যেন কিছু খুঁজছে। হঠাৎ অপুর চোখ পড়ল তাঁত ঘরের দরজা ধরে কমলা দাঁড়িয়ে। অপু বিষন্ন মুখে কমলার দিকে হাত নেড়ে বিদায় নিল।
অপু চলে যেতেই কমলা এক বুক মেঘ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। সপ্তাহ খানিক কমলার পৃথিবীতে সূর্য ওঠেনি। অঝোরে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি হয়ে চলেছে।
কমলার মেয়ে বিমলা এক গ্লাস লেবুর জল এনে অপুকে দিলো। অপু পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে জলের গ্লাস টা ধরে বলল-“বা: তোমার মেয়ে তো বেশ তোমার মতোই হয়েছে।” অপুর ও পিপাসা পেয়েছিল, এক লহমায় এক গ্লাস জল খেয়ে নিয়ে কমলাকে বললো-” বিশ্বাস করো, আমি আঠারো বছর আগের সেই অজানা ভাষা বুঝতে পারিনি। বোঝার জন্য যে মন লাগে সে মন তখনো আমার তৈরী হয়নি । বুঝেছি আরো বছর পাঁচেক পর। তখন আমি সেই স্মৃতি গুলো মোন প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছি। ছুটে এসেছি বসিরহাট। তোমাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি, পাইনি। তাঁত ঘরে ঢুকে দেখি পুরোনো একজনই আছে, কেষ্ট কাকা। তিনি বললেন-“ওদের সব বিয়ে থা হয়ে গেছে, পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছে হাট খোলার মোড়ে। সেখানে গেলে কমলার খবর পাবে।” কোনো লাভ নেই ভেবে ফিরে আসি। আজ যে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে সেটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। ঈশ্বরের অসীম কৃপা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।”
সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে এলো। অপু রতন মন্ডলের মৃত্যু থেকে বর্তমান পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে শুনলো।কমলার চোখের ভাষা বলছে, সে আরো খানিক্ষণ থাকলে কমলা খুশী হবে। কিন্তু তার আর উপায় নেই দেখে অপু বললো-“কলকাতায় ফিরতে হবে তো, আজ চলি, আমি আবার আসবো।” এই বলে অপু পকেট থেকে দুইশ টাকা বার করে বিমলার হাতে দিয়ে বললো-” আমি তো হঠাৎ এসে পড়েছি, এটা রাখো কিছু কিনে খেও”। বিমলা ইতস্তত করায় কমলা বিমলাকে টাকাটা নিতে বলে। তারপর অপুকে বলে-“তোমাকে তো কিছুই খেতে দিতে পারলাম না।” অপু কমলার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে-” আজ থাক অন্য দিন এসে তোমার হাতের তৈরী কিছু খেয়ে যাবো”।
অপু ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে, ড্রইং রুমে গিয়ে বাবার পাশে সোফাতে বসলো। অপুর মা হালকা টিফিন আর এক কাপ রেড টি এনে অপুকে দিলো। বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে অপু জানায় সে আজ হাসনাবাদে রতন মন্ডলের বাড়িতে গিয়েছিল। অপুর বাবা অপুর কাছে জানতে চাইলেন যে হাসনাবাদে এবার চাষ বাস কেমন হয়েছে? অপু ভাবলো শুধুমাত্র চাষের খবর না দিয়ে রতন মন্ডলের পরিবারে এক বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম বর্ণনা করবে। ধূমায়িত রেড টি তে ঠোঁট ঠেকিয়ে অপু বলতে শুরু করলো।
রতন ভিটে বাড়ির সব্জি খেতে মাটি কোপাচ্ছিলো। এরই মধ্যে এলাকার রুলিং পাটির হত্যা কত্তা বিধাতা জাকির ভাই এসে খবর দিলো যে কলকাতা থেকে খবর এসেছে আগামী পাঁচ দিনের মাথায় দুইশ কিলো মিটার গতিবেগে ঝড় আসছে। প্রশাসন থেকে নোটিশ জারী হয়েছে। ইছামতী, কাটাখালী রায়মঙ্গল এই সব নদী সংলগ্ন গ্রাম গুলোকে জনশূন্য করতে হবে। একই সাথে এটাও বলে যে রতনের বাবা পরান মন্ডল তাদের দলের সক্রিয় কর্মী ছিল,সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই সাহায্য করতে এসেছে। রতন যেন পার্টি অফিসে গিয়ে চার জনের কুপন নিয়ে আসে। শুক্র বার দুপুরের পর অত্যাবশ্যকীয় জিনিস পত্র নিয়ে হাসনাবাদ গার্লস হাই স্কুলে গিয়ে উঠতে হবে। শুক্র বার রাত থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পূর্ণ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত চার জনের থাকা খাওয়ার দায়িত্ব পার্টির। জাকির ভাই চলে যেতেই কমলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মুরুব্বিরা আসার কারণ জানতে চাইলো। রতন এক বুক হতাশা নিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো-“এই ভাবে যদি প্রতি বছর ঝড় বৃষ্টি হয় তাহলে আমরা গরীব মানুষ গুলো বাঁচি কি করে! তারপর দয়ার সাগররা আসলেন আমাদের ত্রাতা হয়ে। জানো কমলা, এর মধ্যেও রাজনীতি আছে। নদী বাঁধ পাকাপক্ত করলে ভাঙ্গন রোধ হয়। বাঁধ ভেঙে নদীর নোনা জলে ঢুকে আবাদি জমিগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে সে দিকে নজর নেই। কয়কে দিন খেতে দিলে থাকতে দিলে ক্ষতি পূরণ হয়? বাবা সক্রিয় কর্মী ছিল তাই নাকি ওরা এসেছে। মিথ্যা কথা, টাকা দেয় সরকার আর ওরা পার্টির বলে চালায়।” কমলা বললো-“তুমি আবার ওদের কিছু বলতে যেয়ো না।” -“কেউ তো সত্যি কথা মুখের উপর বলতে পারেনা, তাই ওরা ওদের সুবিধা মতো যা খুশি বলে যায়”।
রতন ও কমলা চার দিনের মাথায় মালপত্র গুছিয়ে চৌকির উপর যতটা সম্ভব রাখলো। তার পর টাকা পয়সা দলিল দস্তাবেজ গুছিয়ে নিয়ে,ছেলে মেয়ের হাত ধরে চলে আসলো সেভ সেন্টারে।
পর দিন ঘুম ভাঙল এমন এক সকালে ,যাকে সকাল না বলে সন্ধ্যা বললেও ভুল বলা হয় না। স্কুলে একটি ঘরে তিন চারটি পরিবার গাদাগাদি করে বাস করতে হচ্ছে। এও এক নরক যন্ত্রনা, যদি প্রাণটা বাঁচে সেই আশাতে আসা। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। একটা গুমোট পরিবেশ। সবই অপেক্ষমান সন্ধে সাড়ে সাতটার সাইক্লোনের জন্য। স্কুলে থেকেও স্বস্তি নেই, ছাত হয়তো ভেঙে পড়বে না, দরজা জানালার যা অবস্থা তাতে না ভেজার কোনো ভরসা নেই।
সন্ধ্যা থেকেই প্রকৃতি তার ভয়ঙ্কর করাল রূপ দেখাতে শুরু করলো। রাত নয়টা পর্যন্ত চললো প্রকৃতির তান্ডব লীলা। সারা রাত আতঙ্কে কেউ দুই চোখের পাতা এক করতে পারলো না।
সকালে বাইরের দিকে তাকালে মনে হলো স্কুল বাড়িটি যেন সমুদ্রের মাঝখানে। ইছামতী, কাটাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে চাষের জমি সহ সমস্ত এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে।
সেই জল শুকাতে সময় লেগে যায় সপ্তা খানিক। গ্রামের বাড়ি ঘর সব কঙ্কালসার চেহারা। রতনের কুটির ও সেই তালিকায় পরে। ঘরে যে উচ্চতা পর্যন্ত জল উঠেছিল, সেই পর্যন্ত মাটির দেয়ালের মাটি গোলে ভিতরের বাখারী, কঞ্চি বেরিয়ে গেছে। ঘরামী ডাকার টাকা নেই,সেই জন্য রতন নিজেই জমি থেকে মাটি কেটে ঘরের দেওয়াল ঠিক করলো। ঘরের চাল খড়ের তৈরী, সেও লন্ড ভন্ড অবস্থা। চালে অর্ধেক খড়ও নেই। এদিকে স্কুল ঘর ছাড়ার নোটিশ এসে গেছে। অগত্যা রতন নিজেই খড় কিনে ঘরের চাল ছাইতে গেল। তখনই ঘটলো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, যা রতনের পরিবারকে আর একটা সাইক্লোনের মতো লণ্ডভণ্ড করে দিলো। মাঠ ঘাট সব জলে ডুবে যাওয়ায় এক মেঠো কেউটে সাপ ঘরের চলার খড়ের ভিতর গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। রতন সেই জায়গার চাল সারাতে গেলে,ওকে ছোবল মারে। ঘটনাটা জানাজানি হতে আরো খানিকটা দেরি হয়ে যায়। টাকি স্বাস্থ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলো,সেখানে সাপের কামড়ের আন্টি ভেরাম ইনজেকশন না থাকায় বসিরহাট হসপিটালের দিকে ছুটলো এম্বুলেন্স,কিন্তু দুরভাগ্য বশত নিয়ে যাওয়ার পথেই রতনে মৃত্যু হয়।
অপুর মা একটা দীর্য নিঃস্বাস ফেলে বললেন-” আহারে, তারপর কমলা আর ওর বাচ্চা দুটোর কি হলো? –“কি আর হবে! অন্যের দয়া দাক্ষীণ্যে আধপেটা খেয়ে কোন রকমে দিন গুজরান করছে। বাচ্চা দুটোর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। মন্দের ভালো পার্টি থেকে ত্রাণের টাকায় ঘর দোর গুলো ঠিক করে দিয়ে গেছে। ও আর একটা কথা তো বলাই হয়নি, রতন মন্ডল ধানের ভাগ বাবদ পাঁচ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছিল, সেটা কমলা শত কষ্টেও খরচ করে নি”। এই বলে অপু ড্রয়ার থেকে পাঁচ হাজার টাকা এনে বাবার হাতে দিতে গেল। তিঁনি টাকাটা হাতে না নিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে এবং অপুর উপর মৃদু ভৎসনা করে বললেন-” তাদের এই অবস্থার মধ্যে টাকাটা দিলো আর তুমি নিয়ে এলে!” অপুর মায়ের কোমল হৃদয় কমলার করুন পরিস্থিতিতে বিগলিত হয়ে উঠলো। তিঁনি বললেন-” অপু টাকাটা ফেরত দিয়ে আয়, কমলা সংসারের কাজে টাকাটা লাগাতে পারলে কিছুটা তো সুরাহা হবে”। অপু মা বাবার কাছ থেকে এই অনুমতির অপেক্ষায় ছিল।
রতন মন্ডল মারা যাওয়ার পর কমলা অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঘাত প্রতিঘাতে দগ্ধ হতে হতে ববর্তমান পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। নিজের আকাঙ্খিত সমস্ত সত্তা বিসর্জন দিয়েছে। দুটি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মাতৃসত্তাকে আর বিসর্জন দিতে পারেনি। রক্ত মাংসের কলেবরে বিরহ যন্ত্রণা যে ছিলোনা তা নয়,তবে পরিস্থিতির কারণে ছাই চাপা আগুন হয়ে ছিল। অপুকে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখে ফেলার সাথে সাথে সেই আগুনে যেন দামাল বাতাস এসে আছড়ে পড়লো, এবং সেই উষ্ণতা সুপ্ত সত্তা গুলোকে জাগ্রত করে তুলল। তার পর অপু চলে যেতেই কমলার মনে হলো, কিছু যেন পেয়েও হাত ছাড়া করে ফেললো। মন বলছিল অপুকে আরো কিছু সময় তার কাছে থাকতে। কিন্তু সমাজ সংস্কার পুত্র, কন্যার কথা ভেবে মুখে কিছু বলতে পারেনি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিরহ ঢেউ তার মনের উপর আছড়ে পড়ে মনকে বাঁধ ভাঙা নদীর মতো করে তুলল। ন্যায়, নীতি, সমাজ, সংস্কার কিছুই আজ মন মানতে চাইছে না। তার অদম্য ইচ্ছে অনলের মতো সবকিছু গ্রাস করতে চাইছে।
দিন চারেক পরের কথা , কমলা নিজের মনকে অনেক বুঝিয়ে একটু শান্ত করেছে। সকালের দিকে গৃহস্থলীর কাজ কর্মে কমলা ব্যাস্ত, বিমলা মাকে সাহায্য করছে, আর ছেলেটি রাস্তার দিকে খেলছে। এরই মধ্যে বাচ্চাটি ছুটে বাড়ির ভিতরে ঢুকে মাকে হাত বাড়িয়ে একটা দামি ক্যাডবেরি দেখালো। সে ভীষণ খুশি, এমন একটা খাবার বস্তু এই প্রথম সে হাতে পেলো। কমলা অবাক হয়ে জানতে চায় সে দামি চকলেট কোথায় পেলো। ছেলেটি রাস্তার দিকে হাত বাড়ায়। কমলা সেই দিকে তাকিয়ে খুশির জোয়ারে কয়কে সেকেন্ড বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
অপু দুই তিনটি ভারী ব্যাগ নিয়ে কুথতে কুথতে বাড়ির ভিতরে ঢুকছে। বিমলা তাড়াতাড়ি গিয়ে ব্যাগ ধরলো। মেঘ না চাইতে একবারে জল পেয়ে যাবে সেটা কমলা কল্পনাও করতে পারেনি। সে আজ আর ততটা অবগুণ্ঠনাবৃত নয়, কথা বলায়ও লজ্জার বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে। মনের চঞ্চলতা আজ বড়ো দামাল হয়ে উঠেছে। অপু ব্যাগ রাখতে রাখতে বললো-” বড্ড ভারী, অভ্যাস নেই তো” কথা বলতে বলতে আর একটা ক্যাডবেরি ব্যাগ থেকে বার করে বিমলার হাতে দিলো। ” তুমি যে আসবে এটা আমি ভাবতেই পারিনি। কিন্তু এত কিছু কি এনেছ?” অপু একটা প্রাণ খোলা হাসি হেসে বললো-” আমি নিজে থেকে কিছু আনিনি, মা তোমাদের পরিস্তিতি কথা শুনে সামান্য কিছু পাঠিয়েছেন। আর বাবা এই টাকাটা তোমাকে দিতে বলেছেন” এই বলে অপু কমলার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিলো। কমলা ইতস্তত করে টাকাটা নিয়ে বললো-” বিমলার বাবার কাছে শুনেছি উনি ভীষণ ভালো মানুষ, কিন্তু উনি যে দেবতুল্য মানুষ এটা আমার জানা ছিল না।” ” যাক ওসব কথা, এবার একটু চা করতো ,শরীরটা যেন গরমে ম্যাজ ম্যাজ করছে। আর একটা কথা আমি কিন্তু দুপুরে তোমার এখানে খাওয়া দাওয়া করবো, আপত্তি নেই তো?” কমলা অপুর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। যে হাসির অর্থ যেমন গভীর তেমন সুদূর প্রসারিত।
বিমলারা বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম তৃপ্তি করে দুপুরবেলা একটু ভালো মন্দ খেলো। দুই ভাই বোনের খাওয়ার পর কমলা আর অপু মাটির মেঝেতে আসন পেতে খেতে বসলো। কমলা বললো-” তুমি কলকাতার মানুষ, মাটিতে বসে খেতে তোমার খুব অসুবিধা হচ্ছে, তাইনা?” অপু হেসে বললো-” একদম না, সত্যি কথা বলতে কি, আজকে এই মুহূর্তটাকে আমি আমৃত্যু স্মরণে রাখবো।” “এতো তোমার একটা উটকো ঝামেলা হলো সুখের স্মৃতিতো নয়।” বলে কমলা একটা উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো। অপু খেয়ে মুখ ধুতে ধুতে বললো ” ও তুমি বুঝবে না।” কমলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ” সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না। ছোট বেলার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বর্তমানের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করা!” অপু কমলার কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে- “এবার তো আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কি বলতে চাইছ বলতো?” অপু আলালের ঘরের দুলাল একটা হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে ইমশানাল হয়ে পড়েছে , কিন্তু কমলা পরিস্তিতির বাস্তবতা বোঝে, সমাজ এবং অপুর জীবনের কথা ভেবে তাকে অনেক শক্ত হতে হবে। সে অপুর দুই চোখে চোখ রেখে বললো ” তুমি কি সত্যিই মাতৃ পিতৃ আজ্ঞা পালন করতে এসেছ?” অপু বুঝতে পারলো সে ধরা পড়ে গেছে। তার মনের ইচ্ছেটা সে কমলার কাছে বলেই দেবে ঠিক করলো।কমলাকে অনুরোধের সুরে বললো “আমি তোমার দায়িত্ব নিতে চাই।” অপুর আবেগ প্রবন হয়ে না ভেবে বলা কথা শুনেই কমলা চমকে উঠলো। একটা অজানা ভয় তাকে আড়ষ্ট করে ফেললো। সাথে সাথে নিজেকে অপরাধীও মনে হলো। নিজের সুখের কথা ভেবে অপুর জীবনকে শেষ করে দেয়া যায় না। মা, বাবা , পরিবার নিয়ে তারও তো একটা জগৎ আছে। ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করবেন না। তাছাড়া এই গ্রাম্য সমাজও তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। কমলা অপুকে সমস্ত পরিস্থিতি বুজিয়ে বলার চেস্টা করলো। অপুও বুঝতে পারছিল কথাগুলো কমলার মনের কথা নয়, দূরদর্শিতার পরিচয়। অপুও নাছোড় বান্দা, কিছুতেই যখন বুঝতে চায় না,তখন কমলা কেঁদে ফেলে, এবং অপুর কাছে নিষ্কৃতি ভিক্ষা করে। অপুও কমলার সমাজ জীবনের কথা ভেবে বলে ” ঠিক আছে, তাহলে তোমার ছেলে বড়ো না হওয়া পর্যন্ত আমাকে তোমাদের পাশে থাকার সুযোগ দাও” অগত্যা কমলা রাজি হয়। “‘একটু হাসো” অপু অনুরোধ করে। কমলা হাসতেই পরিবেশটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। কমলা শাড়ীর অচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো-” তুমি যা করলে ,তা মনে হয় আমার সাত জন্মের তপস্যার ফল। তোমার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবোনা” অপু একগাল হেসে বললো -” শোধ করতে চাও ,তবে সেই ষোড়শী গলার ভাটিয়ালি গান একটি গাও” কমলা একটু লজ্জা পেয়ে বললো “আমি কি এখন ষোড়শী? আর সেই গলা আছে নাকি!” অপু ছাড়বার পাত্র নয়-” তুমি নিশ্চয়ই পারবে, আমি না হয় মনটাকে আঠারো বছর আগে নিয়ে যাবো” অগত্যা কমলা ইচ্ছা না থাকলেও অপুকে খুশি করার জন্য একটা ভাটিয়ালি গান ধরলো-
পরান পাখি উইড়া যায়
ওই দিকচক্রবালে,
মিলন হওয়ার আসায় থাকে
অপেক্ষারী কালে।——–
———-
বিমলা ভাইয়ের হাত ধরে পাড়ার দিকে গিয়েছিল, ফিরে এসে অনেক দিন পর মাকে গান গাইতে শুনে একটু অবাক হলো। ছোট বেলায় মায়ের গলায় অনেক গান শুনেছে। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর মা আর কখনো গান গাইনি।বিমলা ঘরে না ঢুকে উকি মেরে দেখলো, মা মুখে একটা প্রসস্তি এনে প্রাণ খুলে গেয়ে চলেছে, আর ওই ভদ্রলোক মায়ের মুখ পনে উদাস হয়ে চেয়ে রয়েছে। বিমলাকে দেখতে পেয়ে কমলা গান থামিয়ে দিলো। অপু বললো -” কমলা আজ উঠি।” কমলার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল ” আবার কবে আসবে?” “দেখি” বলে অপু যখন ঘর থেকে বেরুচ্ছে ঠিক তখন কমলার ছেলে সামনে এসে দাড়ালো। অপু গালটা একটু টিপে বললো-” স্কুলে যাবে,ভালো করে পড়াশুনা করবে, জীবনে অনেক বড় হতে হবে।” ছোট শিশু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে-” তুমি কে হও?” অপু একটু মুচকি হেসে বলে ” একটা মামা।”
–~০০০XX০০০~–