শেষ নমস্কার
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
সাতদিন হয়ে গেল পল্টুর জ্বর কিছুতেই সারছেনা। হরিশবাবু প্রায় রোজই অফিস কামাই করেছেন এই কদিন। আসলে পল্টুর মা নেই। সংসারে থাকার মধ্যে আছে হরিশবাবুর বুড়ি মা আর পল্টু। এরই মধ্যে চালাতে হয় ট্রাম কোম্পানির অফিসে হিসেব রাখার চাকরিটাকে। নেহাত ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার অবধি সোজা ট্রাম চলে বলে অফিস করতে অসুবিধা হয়না। আর ট্রামকোম্পানির লোক বলে তাঁকে ভাড়াও দিতে হয়না। এটুকুই যা স্বস্তির।
যুদ্ধের বাজারে জিনিষপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। এভাবে চললে খুব বেশী দিন চালানো কঠিন। সঞ্চয়টুকু নিভা মানে পল্টুর মা’এর বুকের অসুখের সময় সবটা ফাঁকা হয়ে গেছে। নিভার শেষদিকে কাশির সাথে রক্ত উঠত।
তখন থেকেই পল্টু ঠাকুমার কাছে রাতে ঘুমোয়।
************
জ্বরের দিনগুলোয় আজকাল রাত জাগতেই হচ্ছে। পল্টুর মাথার কাছে বসে বসে হয় ‘শিশু’ না হয় ‘কথা ও কাহিনী’ পড়ে শোনাতে হয়। নিভাও তাই করত। সেই অভ্যেসটুকু তার চলে যাওয়ার পরেও রয়ে গেছে। সারাদিন খাটুনির পর ইচ্ছে করেনা হরিশবাবুর। তবুও জ্বরতপ্ত ছলছল চোখে পল্টুকে দেখলে না বলতে পারেন না। একটু পদ্য শুনতে শুনতে যদি ছেলেটা একটু জলদি ঘুমায়। নিভার চোখদুটো পল্টুর চোখে একদম বসানো। বড় মায়ামাখা। বেশীক্ষণ তাকালে বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে।
**********
গত তিনদিন টানা বৃষ্টি হয়ে আজ একটু রোদ্দুর বেরিয়েছে। অফিসে টিফিনটাইমে নানারকম খবরের গুলতানি হয়। তারমধ্যেই কে যেন বলল বিধান রায় নাকি অপারেশান করবেন বলে ঠিক করেছে…হ্যাঁ হ্যাঁ ওই জোড়াসাঁকোতেই! হরিশবাবু খবরের কাগজে দেখেছিলেন বটে কবির অসুস্থতার খবরটা। শান্তিনিকেতন থেকে একটা স্পেশাল ট্রেনে করে কলকাতায় আনা হয়েছে। উনি নাকি খুব অসুস্থ।
সে যাই হোক, ভাসাভাসা খবর শুনতে শুনতেই খটাংখটাং করে টাইপরাইটারে আঙুল চলে হরিশের।
************
“…যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল/সে পথ দিয়ে ফিরলো না তো তারা!”
পল্টুর ঘুমন্ত চোখের পাতায় একটা চুমু খায় হরিশ। পল্টুর আজ সারাদিন জ্বর আসেনি। একটু ভালোর দিকে। রবিদাদুর কথার যাদুতে ও ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে। দেখে ভালো লাগে। হঠাৎ কি মনে হতে একবার বাইরের ঘরে এসে একটা কাঁচি সিগারেট ধরালো। মা’ও এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে পাশের ঘরে। জানলা দিয়ে মধ্যরাতের মেঘলা আকাশ লালচে হয়ে আছে।একটু গুরুগম্ভীর যেন। আজ বোধহয় তাঁর অপারেশনটা হয়ে গেছে। পল্টুর মত তাঁরও রোগশয্যার পাশে থাকতে পারলে বেশ হত। অন্তর দিয়ে অনুভব করলে তিনি যে সব অনুভূতির পথের বাঁকেই দাঁড়িয়ে আছেন হরিশ টের পান সে কথা। নিভা চলে যাওয়ার পর এই একটা বছর পল্টুর দৌলতে তিনিও তো তাঁকে আশ্রয় করেই……
************
আজ শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখ। আকাশের মুখটা বেশ ভার। অফিস ছুটি হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। রাস্তায় বেশ ভীড়। বাস-ট্রাম সব বন্ধ। সবাই হন্যে হয়ে জোড়াসাঁকোর দিকে ছুটছে। কারণটা অবশ্য হরিশ এখন জানেন।
কবিগুরু আর নেই। দুপুর বারোটার কিছু পরে অনন্তলোকের পথে যাত্রা করেছেন পল্টুর রবিদাদু। প্রাথমিকভাবে অপারেশনটা সফল হয়েছে বলে ভাবা গেলেও শেষ অবধি তাঁর আশীবছরের জীর্ণ দেহটি এর ধকল সামলাতে পারেনি।
মনটা খুব উথালপাথাল করছে। অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালেন হরিশ।
**********
সাদা জামা প্যান্ট পড়িয়ে পল্টুর হাত ধরে হরিশ বটকৃষ্ণ পাল এভিন্যু ধরে নিমতলার পথ ধরলেন। কলেজস্ট্রীট হয়ে এই পথেই আসবে তাঁর মরদেহবাহী শকটটি। পল্টুকে শেষবারের মত তার প্রিয়তম সঙ্গীর সাথে দেখা করিয়ে দেবেন অন্তত, এটাই একান্ত ইচ্ছা তাঁর।
রাস্তাঘাটে তুমুলভীড়। উর্দিগায়ে পুলিশের লোকেরা ব্যারিকেড করছে রাস্তার দুধারে তবুও বন্যার মত লোকে ধেয়ে আসছে তাঁকে শেষ নমস্কার জানাতে। হঠাৎ চোখে পড়ল চারিদিকে শুধু কালো কালো মাথা আর তার মধ্যে ফুলের ভেলায় ভাসতে ভাসতে আসছেন রবিঠাকুর। চোখদুটি বোজা। হাতদুটি বুকের উপর আর তার ওপর রাখা একটি প্রস্ফূটিত শ্বেতকমল।
দেখেই হঠাৎ মনে হল, এই যাহ্! একটা মালা কেনা হল না তো বা সামান্য ফুল। তাঁকে কোন অর্ঘ্যে করবেন শেষ নমস্কার? মনে মনে আফশোষ করেন হরিশ।
ইতিমধ্যে ভীড়ের মধ্যে প্রবল চাঞ্চল্য ওঠে। নিমতলার লোহার দরজা জনতার চাপে ভেঙে পড়ে। সবাই যে যার মত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে। সবার জীবনে আজ ইন্দ্রপতন!
হরিশ টের পাননি কখন যেন পল্টুর হাতটা আলগা হয়ে গেছে মুঠির ভিতর থেকে। বেচারা ভীড়ের মধ্যে কোথায় গেল!চতুর্দিকে বিপুল জনস্রোত থেকে ভেসে কলকন্ঠে ভেসে আসছে –
“জয় রবীন্দ্রনাথের জয়! জয় বিশ্বকবির জয়! বন্দেমাতরম্ “…কিন্তু পল্টু? পল্টু কোথায় গেল? ভয় আর দুশ্চিন্তা গ্রাস করে হরিশবাবুকে।
প–ল্——টু—উ—উ! কিন্তু উন্মত্ত জনতার অশ্রু- আবেগ কোলাহলে সে ডাক হারিয়ে যায়।
**************
অবশেষে খুঁজে পেলেন পল্টুকে। ভীড়টা একটু সরে শ্মশানের দিকে যেতেই দেখতে পেলেন। ধূলোর মধ্যে কুঁকড়ে শুয়ে মাটিতে পড়ে আছে সে। নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দ। ভীড়ে বাবার হাত ছেড়ে যেতেই উন্মত্ত জনতা যখন ওদিকে ধেয়ে গেছে তখন বেচারা দিশাহারা হয়ে একটু এগোতেই পিছন থেকে আসা তুমুল ভীড় তার ছোট্ট দেহটাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে চলে গেছে কখন। পরণের শতচ্ছিন্ন জামায় আর স্পন্দনহীন পল্টুর হাতের ক্ষুদ্রমুষ্ঠিতে লেগে আছে অসহায়তার গ্লানি।
*************
হরিশ মুহূর্তে সন্তানকে বুকে তুলে নেন অশ্রুসজল চোখে।
অদূরে ধিকিধিকি জ্বলে উঠেছে কবির চিতাগ্নি। আর তাঁর হাতে ধরা প্রিয় মহামানবের চরণে শেষ নমস্কারের জন্য আনা ধুলোমাখা পবিত্রতম শ্বেতকমলের অর্ঘ্যটি।
ততোক্ষণে শ্রাবণের মেঘছেঁড়া আলো এসে পড়েছে পল্টুর গালে, দূরের সেই চিকন বৈশ্বানরের হোমশিখাটির মতন।
–~০০০XX০০০~–
এমন লেখায় কিছু বলি সে সাধ্য আমার নেই, মন্তব্য তো অনেক দূরের কথা। শুধু ভিজে গেলাম অবিরত ধারায়। আরও আরও আরও এগিয়ে চলুক কলম 🙏