ঐতিহাসিক ছোটগল্প
স্বগতোক্তি
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আজ নিদ্রাভঙ্গ হবার পর থেকেই একটা অলীক সুখভোগ হচ্ছে। যেদিন এই দেহ ছেড়ে আমি উড়ে পালালাম সেদিন থেকে ওরা আর কেউ আমায় বাঁধতেই পারবে না। মৃত্যু নামক নিষ্কৃতিটি যেন জাগতিক বাধা থেকে এতদিনে মুক্তি দিল। আমি কেবল সেদিন রবিকেই কিছু বলে আসতে পারলাম না। ওর কথাই মনে মনে একটা অক্ষমের কষ্ট দিচ্ছে। মরেও যেন সুখ নেই। এরকম অব্যক্ত কষ্ট কেন এখনো পেতে হবে?
বরং রবির জ্যোতিদাদাকে নিয়ে সে সমস্যা নেই। ওনার শোকটি বড়ই ব্যক্তিগত। বাইরে তা প্রকাশ পাবে না মনে করি। অথচ আমায় একদা ফুল, চাঁদ
আর পাখীর সাথে তিনিই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমায় একটু একটু করে গড়েও তুলেছিলেন কিন্তু প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে ভুলে গেছিলেন বলেই আমি নিজেই একদিন একাকী সব ছেড়ে চলে আসলাম। আমায় আর ওখানে মানাত না বলে ভিতরচাপা দুঃখটাকে বয়ে নিয়ে যাবার আর কোন কারণই ছিলনা।
জানতাম রবি একদিন নিশ্চিত বড়মানুষ হবে। কবি হিসাবে জগতে তার স্থান হবে ঠিকই কিন্তু তার বদলে এক একাকীত্বের অসীম বিচ্ছেদবোধ তাকে আমৃত্যু ঘিরেই থাকবে।
যেখানে সে যখন নিজের জন্যই সৃষ্টি করবে সেখানেই কেবল এক অন্য রবিকে পাব। আর যখন সে সবার হয়ে লিখবে তখন তাকে আসলে কেউ ঠিকমত চিনতেই পারবে না।
সেও তার নতুনদাদার মত নিজেকে লুকিয়ে রেখে প্রকাশ করতেই জানে। তার এই কৌশলেই সবাই ভুলবে। যে সে নিজেই আসলে কত অসহায় আর একা সেটাই তো আর কেউ বুঝবে না। তার কবিত্ব একদিন তাকে খ্যাতির শিখরে এনে বসাবে ঠিকই কিন্তু তাকেই ক্রমশ একাকী করে দেবে আর তার নিজেকে জানার পরেও সে ভিতরে ভিতরে একটা কষ্ট পাবে। বাইরের কেউ তার নাগাল পাবেই না।
আচ্ছা, আজ আর আমার বেশী কথা বলবার অধিকার নেই বলেই আমি কেবল কাঁদব কেন? বাবামশায়ের শাসনে যে আমায় কেউ ওখানে মনেও আনবেনা। ঠাকুরবাড়ির এক অযথা বিড়ম্বনার ইতিহাস হব না হয়, তাতেও দুঃখ পেলে কি চলবে?
আসলে আমি নিজে কখনোই এ বাড়ির নিয়ম মেনে ঠিক বেড়ে উঠিনি। এটা আমারই দোষ বুঝতেও পারি। কিন্তু তার বদলে সকলে আমায় যে ক্রমাণ্বয়ে ভুল বুঝল তার কি হবে? আমায় কেউই স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিল না।বাজারসরকারের মেয়ে বলেই হয়ত এতটা স্বপ্ন দেখবার অধিকার আমার যে ছিলনা তা আগেভাগে কেউ যদি একবার বলত..
স্বর্ণদিদির মেয়ে শিশু ঊর্মিলাই আসলে আমার অনেকটা জায়গা জুড়েই ছিল। ওরা বড়লোক বলে সেদিন দাম দিয়ে আমার স্নেহ কিনতে আসেনি বরং আমায় তাকে বিলিয়ে আনন্দ পেতে চেয়েছিল। সেই ঊর্মিলা হঠাৎ সেদিন হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেল সিঁড়ি থেকে আর আমি অসহায়ের মত তার মৃত্যুটাকে দেখলাম। সবাই একশ্বাসে বলল অপয়া আসলে আমিই, ওকে নাকি খেয়েছি….
আচ্ছা রবি…রবি…তুমি কেন বললে না সেদিন আমি কারুর মৃত্যুই চাই নি। আমি নিজেকেই শুধু শেষ করে দিতে জানি…নিজেকেই শুধু !
ফিরে ফিরেই খালি আজ রবিকে মনে পড়ছে। রবি আমাকে ভালবাসত একমাত্র। আমারও তার নবীন সঙ্গটি ভালো লাগত। কল্পনার অথৈ সাগরে ভেসে গিয়ে একদিন সেও মৃণালিনীর হয়ে গেল। তার বৌ টিকে এবাড়ির সবাই মেজে ঘষে মানুষ করতে লাগল। কিন্তু সে যে নিজেই আজন্ম মানবসন্তান হয়েই ছোটবউ এর পদটা পেয়েছে সেটা যেন কেউই মানল না। বেচারা রবিও তার বউ এর মধ্যে কিন্তু শেষমেশ নিজের বন্ধুটিকে পেল না, এটা কিন্তু আমাকেও কষ্ট দিত। মৃণালিনী যেন ও বাড়ির সফল গৃহিণী রূপেই চিরবিদায় নিল চির অভিমানে। কারণ সেও স্বামী পেয়েছিল ঠিকই অন্তরঙ্গ বন্ধু পায়নি। যদিও মেজবৌঠানের কড়া শাসনে তাকেও অযোগ্য প্রমাণ করতে সবাই মেতে উঠেছিল সেদিনও। সে রবির থেকে স্ত্রী সৌভাগ্য আর কয়েকটি সন্তান পেল ঠিকই কিন্তু তার সবগুলোই অকালে ঝরে গেল। মীরা অনেকদিন কেবল তার বাঁচল বটে কিন্তু তাকে আর সবার মতো সেও যেন কখনোই বুঝল না।
তার মৃত্যুর পর রবির সংসারটি ভেঙে গেল ঠিকই তবে ততোদিনে সে জগৎকে বিস্তৃত করতে শিখেছে বলেই নিজেকে এসব থেকে ঠিক লুকাবার পথটিও জানে।
সকলে এবাড়িতেও আমার সাথেও একদিন এটাই করেছিল। ওরা কিন্তু বুঝতে পারে নি যে অঙ্গারস্বরূপা আমি, কখনোই স্বর্ণে পরিণত হব না। তাই আমিও একদিন ছুটি পেলাম। মৃত্যু আর বিচ্ছেদ যেন ওবাড়ির বৌদের সতীন !
রবির নতুনদাদা এককালে আমাকে পুরোটাই বুঝত। গড়ের মাঠে সে আমাকেও ঘোড়ায় চড়ে নিয়ে যেত। তখন তার নামে লোকে অপবাদ দিত স্ত্রৈণ বলে অথচ আমি কখনোই তাকে অধিকার করে কূপিতা বা ভীষণা কিন্তু হতাম না। তবুও সেও ধীরে ধীরে একদিন আমার থেকে আস্তে আস্তে দূরের মানুষ হয়ে গেল। ওকে আমার ভীষণ অচেনা লাগত তখন।
তখন সেই বয়সেই রবিকেই বন্ধু মানলাম হয়তো অনুজ আর বেশীবয়সী নয় বলেই। তখন সেই কল্পনার বয়সে আমিও যে তাকে হয়তো প্রেম মিশ্রিত বাৎসল্যরস কখনো কখনো দিয়ে ফেলেছি হয়তো এটা আজকে এই সাঁঝবেলায় এসে আর অস্বীকার করি না। কিন্তু আমি নিজে হয়তো মোহগ্রস্ত হতাম অনেক বেশী। ওর সেই দেবদত্ত প্রতিভায় সম্মোহিত আমি নিজেই, তাই বলে তাকে আঁচলে বেঁধে কেনোই বা আমি রাখব? আমি তো নিজের স্বামীকেই যখন কখনো বাঁধি নি …।
তাকে হয়তো এক নিকটজনের প্রশ্রয়ে ভালবাসতাম আমি অথচ একদিন সেই তাকে ছেড়েই আমায় অনেক দূরে চলে যেতে হল।
এটাই এখন সত্যি। আমাকে আর কেউই বুঝলনা। সেও কষ্ট পেল ঠিকই নিভৃতিতেই কিন্তুু কবিতার বাইরে এসে আমায় কি বুঝতে পারল কখনো ?
রবিইইইই কতদিন দেখিনি তোমায়……!
আজ অবশ্য চলে গিয়ে অনেক বাধাই দূর হয়েছে। দেহবোধের অন্য পারে বসে এক নতুন অনুভূতি হচ্ছে। মরণ আমাকে সেই স্বাধীনতা অকৃপণ হাতে দিয়েছে বলেই একে আমিও আজ আর অস্বীকার করিনা।
আজ তো আমি অতীততম এক নারী হয়েও বলতেই পারি যে রবির নতুনদাদাকে আজও আমি স্বামী হিসাবেই স্বীকার করি। তাঁর সেদিন কোনও দোষ ছিলনা। আমিই ও বাড়ীর একজন সভ্য হয়ে উঠিতে পারি নি। এ যেন আমারই অক্ষমতা, তাও জানি। এখনো কেবল রবির কথা ভাবলেই যা কষ্ট হয়। ওর বিশ্বকবি হওয়ার সময়টিকেই আমি আর দেখতে পেলাম না বলে। বেচারা দুঃখশোকের ভেতরে শুধু অমৃতের স্পর্শকেই সন্ধান করে গেল আজীবন।
অবশ্য এটাই সান্ত্বনা রবি অন্তত আমাকে কখনো ভুলতে পারে নি। সে লেখার জগতে সবেতেই আমায় ভাবত এটা ঠিকই। আমি জানি সেই কথা।
এমনকি ওই রাণুর মধ্যেও আমাকে খুঁজত বোকার মত। ভাবত সেই বোধহয় আমি। সারাজীবনে ওর মানসপ্রতিমা হয়েই থেকে গেলাম হয়তো। এটাই যা আমার গর্বের একমাত্র কারণ বোধহয়।
কত কত শতাব্দী কেটে গেল। দেখতে দেখতে আমি আজহএকলা থাকতেই একদিন নিজেই শিখে গেলাম তো! তার জন্য দুঃখ করেই বা কি লাভ? মায়াবৃক্ষে নতুন করে তো কোন কিছুই এসে বসেনা এটাই বোধহয় পরম সত্যি। তাই সে বৃক্ষটিও বোধ হয় আমারই মতন একাকীই থেকে যায়।
সেই ভালো…সেই বড় আশ্চর্যময় বোধহয়। রবি এখানে হয়তো ঊপনিষদ থেকে আরো ভাল করে বলতে পারত সবাইকে।
আমার তবুও মনে হয় কিছু কথা আজ অব্যক্তই থাকুক এতদিন পরেও।
–~০০০XX০০০~–