পুনর্জন্ম
✍️ শিব প্রসাদ হালদার
সূর্যাস্ত হতে চলেছে। ঠিক এমনই সময়ে ছোট্ট প্রতীক পথেই পথ হারিয়ে ফেলল। হাঁটতে হাঁটতে হেঁটে গেল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। চোখে পড়ল বিশাল ঝলমলে ঝিল। সূর্যাস্তের পড়ন্ত লাল আভায় ঝিলের জল ঝিলমিল করছে। এই ঝিলে মাছের চাষ হয়। সম্প্রতি ঝিলের লিজ শেষ হয়ে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তা আবার হস্তান্তর হবে। এই সুযোগে অসৎ কিছু লোক দিনের আলো নিভতেই ঝিলে অবৈধ ভাবে মাছ ধরার হিড়িকে মেতে উঠেছে। প্রতীক ঝিলের পাড়ে প্রচুর লোক দেখে কাছে এগিয়ে যায়। ঘুরে ঘুরে মাছ ধরা দেখছে। আনন্দও পাচ্ছে খুব। ছোট্ট ছেলে। চারিদিকে জলকাদায় পিচ্ছিল তাই কেউ কেউ ওকে সরিয়ে দিয়ে বলছে -সন্ধ্যা হয়েছে বাড়ি যা। কে শোনে কার কথা। স্থান পরিবর্তন করে যায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। যেতে যেতে একদম পেছনের দিকে চলে গেল। তীরে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে মাছধরা দেখার আনন্দ উপভোগ করছে। জালে ধরা জ্যান্ত মাছের ছটফটানি দেখে সেও যেন অশান্ত হয়ে উঠলো। শুধু উসখুস করছে। হঠাৎ তারই এক ফাঁকে কোন্ কুক্ষণে গড়িয়ে পড়ে গেল গভীর খাদে।সবাই মাছ ধরার হুড়োহুড়িতে সেদিকে কারও নজর পড়লো না।
এদিকে প্রতীকের বাড়িতে তার খোঁজে সবাইর ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার যত গভীর হচ্ছে সকলের দুশ্চিন্তা তত বাড়ছে। ঘর দুয়ার খোলা ফেলে রেখে এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়ল সবাই। ঘন্টা দেড়েক খোঁজার পরেও যখন কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না তখন আর বিলম্ব না করে একটা অটো ভাড়া করে মাইক নিয়ে নিকটবর্তী এলাকায় ঘোষিত হলো- ছোট্ট প্রতীক হারিয়ে গেছে। পরনে লাল গেঞ্জি কালো প্যান্ট। সন্ধান পেলে অনুগ্রহ করে খোঁজ দিন—। ঘণ্টা দেড়েক ধরে অনবরত ঘোষণায় এলাকায় তোলপাড় করে ফেলল কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। তখন রাত সাড়ে আটটা।সবার মনে দুশ্চিন্তার কালোমেঘ আরও গভীর হচ্ছে। দাদু ঠাকুমা বাড়ির সামনে রাস্তায় ঘনঘন পায়চারি করছেন। প্রতীকের মাকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। উন্মাদের মত মাথা ঠোকাঠুকি করছে। সারা বাড়িতে একটা কান্নার রোল উঠে গেলো। কে জানে প্রতীক এখন কোথায়! কি অবস্থায় আছে–!!
কেউ না জানলেও জানতে পারলো সমাজে অবহেলিত তিনটি প্রাণী- জহর ,পটলা আর পেটকো। ওদের মনটা বড্ড ভালো কিন্তু একটু বাংলা মদ খায় তাই ওদের সবাই ঠিক ভাল চোখে দ্যাখেনা। মানুষের যে ওরা উপকার করে না তা নয়। এই তো সেদিন ধাপার পাশে একটা অচৈতন্য প্রাণী ভেবে প্রান বাঁচাতে গিয়ে আজ পুলিশের জেরায় জর্জরিত। সেদিনকার ওই চৈতন্য প্রাণী আসলে ছিল ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত একটা মৃতদেহ। আর না বুঝে তার প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসায় আজ পুলিশের ঘনঘন জেরার ভয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে। তাই তো আজ এ ধরনের কোনো বিপদে পেটকো আর চায়না এগিয়ে আসতে।
মদ খেতে খেতে হঠাৎ জহরের কানে এল অস্পষ্ট নড়াচড়ার শব্দ। কিছুক্ষণ পরে আবার–। সে উঠে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল গলা অবধি ডুবে থাকা একটা মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে বাকী দুজনকেই দাঁড় করালো। মদের নেশায় ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছেনা। হাঁটু কাঁপছে। পেটকো বলল না ভাই আমি আর ওসব সেবা টেবার মধ্যে নেই। আমার ভালো শিক্ষা হয়ে গেছে। পারলে তোরা ওসব কর গিয়ে। আমাকে ভাই মাফ কর। পটলা বলে উঠল নারে পেটকো- ওই দ্যাখ না একটা বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে! ওরা তাকিয়ে থেকে দেখলো সত্যিই তো তাই। কিছুক্ষণ বাদে বাদে উপরের দিকে হাত তুলে বাঁচার চেষ্টা করছে। গলা অবদি পাঁকের মধ্যে আটকে আছে। কিছুতেই উঠতে পারছেনা।
প্রায় আড়াই ঘন্টা প্রতীক ঐ খাদে পড়ে আটকে থাকলো। বাঁচার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় গলা সমান পাঁকে নাক মুখ উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। শরীর নিস্তেজ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে একটু হাত উঁচু করে উঠার চেষ্টা করলেও চিৎকার করার মত শক্তি আর নেই। এমন পরিস্থিতি দেখেই ওরা তিনজনে খাদে নেমে উদ্ধার করে উপরে তুলে আনতেই দেখতে পেল পরনে লাল গেঞ্জি কালো প্যান্ট। ওকে জিজ্ঞাসা করতেই অস্পষ্ট স্বরে নামধাম বলল। কিন্তু ততক্ষণে তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় তাই এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাইকে চাপিয়ে নিয়ে ছুটল। একজন চালিয়ে চলেছে। অন্যজনে কাঁধে মাথা রেখে প্রতীককে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে ছুটেছে নিকটস্থ বরাহনগর জেনারেল হসপিটালে। সেখানে ইমারজেন্সিতে ভর্তি করিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। লোক মারফৎ প্রতীকের বাবার মোবাইল নম্বর পেয়ে এক জনৈক ব্যক্তি ফোন করে প্রতীকের প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে দেয়। তার আগে তাকে পেয়ে হসপিটালে নিয়ে গেছে এই উড়ো খবর বাড়িতে আসায় অনেকেই ছুটে এসেছে গোরাবাজার দমদম স্পেশালিস্ট হসপিটালে। প্রতীকের কাকা তখন আউটডোরে ছোটাছুটি করে খোঁজখবর নিচ্ছে। চোখেমুখে এক ভয়াল আতঙ্কের ছাপ! যদি সন্ধান পাওয়া যায়। এমন সময়ে তার কাছে ফোন আসায় জানতে পারল বরাহনগর হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কথা। সঙ্গে সঙ্গেই বাইকে চেপে ছুটলো সেখানে। আউটডোরে ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেল। কাকাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ফোন করে তার কাকা প্রতীকের সাথে কথা বলিয়ে বাড়ির সবাইকে শান্ত করলো। প্রতীককে কাছে পেয়ে কাকার চোখ ফেটে তখন টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। ব্যথীত হৃদয়ের এই মুহূর্তের দৃশ্য সত্যই ভুলবার নয়!
ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলে তাঁর নির্দেশ মত আর জি কর হসপিটালে স্থানান্তারিত করা হলো। সেখানে নিয়ে ভর্তি করিয়ে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টা চিকিৎসার পর ঘরের ছোট ছেলে ঘরে ফিরে এলো। খবর পেয়ে অনেকেই দেখতে আসছে। ঘটনার বিবরণ শুনে অনেকেই আৎকে উঠলো। তখন প্রত্যেকের মুখে একটাই কথা- ভাগ্যের জোরে ছেলেটা পুনর্জন্ম পেল।
সমাজের নিন্দিত অবহেলিত মানুষের মাঝেও আছে মায়া-মমতা মহত্ত্ব। ঘটনাচক্রে তা প্রকাশিত হয়ে মহৎ ব্যক্তিদের মহত্বকেও কখনও মলিন করে দেয়। আর ঠিক তখনই সমাজের অধিকাংশ লোক সেই সময়টার জন্যই শুধু এই মহত্ত্বের মূল্যায়ন করে। কিন্তু দুদিন যেতেই তারা আবার সমাজের চলমান স্রোতে হয়ে ওঠে নিন্দিত অবহেলিত।তবে যারা যেভাবেই দেখুক- যেভাবেই ভাবুক প্রতীকের পরিবারে এদের মহত্ত্বের মর্যাদা কোনদিনও মলিন হবার নয়—–!
–~০০০XX০০০~–