শৈশব (পর্ব – 2)
পাতাল পুরী
সলিল চক্রবর্ত্তী
“ফটিক জল কুমির খেলবি নে–”
“আজ তিন চার দিন হল ফটিক বাড়ি থেকে বার হয় না। বন্ধু বান্ধব সব চিন্তায় পড়ে গেছে। পেঁচো, স্বপন দীপক, সেকেনালি, খোকা রোজ বড়ো পুকুরে আসে জল কুমির খেলতে। ফটিকের দেখা নেই, সবাই মিলে ঠিক করলো সোমবার সকালে ফটিকের বাবা কলকাতায় চলে গেলে ফটিকদের বাড়ি যাবে।
ফটিকের দিদিমা এসেছেন, উনি যখনই আসেন মাস তিনেক থেকে যান। তাতে এমনিতে কারোর কোনো সমস্যা নেই। অসুবিধা হয় শুধু ফটিকের। উনি যখনই আসেন অনেক নুতনত্ব শহুরে খাবার দাবার নিয়ে আসেন, ফলে প্রথমটা ভালোই কাটে, তারপর শুরু হয় শাসন পর্ব। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সমস্ত কাজ কর্ম নির্ধারিত সময় মেনে করতে হয়। সব থেকে অসুবিধা জনক নির্দেশ হলো চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র দুই ঘন্টা খেলতে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার দিদিমা আসায় ফটিকের রুটিনটা কেমন যেন উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো। দিদিমাকে শাসন সংক্রান্ত কোনো বিধি নিষেধ জারি করতে হয়নি। কারণ স্রেফ একটা ঠাকুরমার ঝুলির স্বচিত্র বই। যখন থেকে ফটিক বইটি হাতে পেয়েছে, তখন থেকে ফটিকের ধ্যান জ্ঞান ওই ঠাকুরমার ঝুলি। বিকালে খেলতে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। স্বচিত্র বইটি খুলে রঙিন রূপকথার চরিত্র গুলো দেখে ফটিক পড়ার থেকে বেশি কল্পনার জগতে চলে যায়। রাজপুত্র, কোটাল পুত্র, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, পক্ষীরাজ ঘোড়া, রাজ কন্যা, জিওন কাঠি, মরণ কাঠি, এই সব চরিত্র গুলো পড়ে ফটিক যেন তাদের মধ্যে একজন হয়ে পড়ে।
সোমবার স্কুলে গিয়ে ফটিকের সাথে সবার দেখা হলো।সবাই জানতে চাইলো সে কেন কদিন খেলতে আসছে না? ফটিক পরিষ্কার করে কিছু বললো না, একটা “সব জান্তা মধুসূদনের মতো ভাব দেখিয়ে পাশ কাটলো। বন্ধুরা একটু অবাক হলো। ভূগোল মাস্টার ক্লাসে এসে যানবাহন চ্যাপ্টার পড়াতে গিয়ে প্রসঙ্গ ক্রমে প্রশ্ন করলেন- “বলতো উড়োজাহাজ আবিষ্কার হয়েছিল রূপকথার কোন বাহনের কথা ভেবে ?” সবাই চুপ, প্রত্যেকে মুখ চাওয়া চায়ি করছে। এরই মধ্যে ফটিক উঠে দাঁড়িয়ে বললো – “পক্ষীরাজ ঘোড়া মাস্টার মশাই।” ভূগোল মাস্টার চোখটি বড়ো বড়ো করে আধা খুশি হয়ে ফটিককে পাল্টা প্রশ্ন করলেন – “কেন তোমার এমন মনে হলো ?” ফটিক বিজ্ঞের মতো ব্যাখ্যা করলো-” মাস্টার মশাই, পক্ষীরাজের দুটো ডানা, উড়োজাহাজেরও দুটো ডানা, পক্ষীরাজের পা উড়োজাহাজের চাকা, পক্ষীরাজ ওড়ার সময় একটু ছুটে তারপর ডানা ঝাপটে উপরে উঠে,আবার নামার সময় মাটিতে পা ফেলে একটু ছুটে তারপর দাঁড়ায়, উড়োজাহাজও প্রথমে কিছুটা ছুটে তারপর সামনের চাকা তুলে উড়ে যায়, আবার নাম্বার সময় পেছনের চাকা আগে ফেলে কিছুটা ছুটে তারপর দাঁড়ায়।” ফটিক যখন তার কল্পনা শক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করছে, তখন ভূগোল মাস্টার পায়ে পায়ে ফটিকের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অন্য ছাত্ররা ভয় পেয়ে গেল,ফিস ফিস করে পরস্পরকে বললো-” পাকামো বেরিয়ে যাবে, এবার উত্তম মধ্যম খাবে”। ভূগোল মাস্টার ফটিকের কাছে গিয়ে দুই চোখ ভরা বিশ্বয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-” এ ব্যাখ্যা তুমি কার কাছে শুনেছ”? “কারুর কাছে না, আমার মনে হলো মাস্টার মশাই”। ভূগোল মাস্টার ফটিককে জড়িয়ে ধরে বললেন -“মন দিয়ে পড়াশুনা করো বাবা, ইচ্ছে থাকলে জীবনে অনেক বড়ো হতে পারবে”। অন্য ছাত্ররা তো অবাক, বিচ্ছু ফটিকের পেটে এত বিদ্দ্যে! ছুটির পর বন্ধুরা ফটিককে একটু বেশি গুরুত্ব দিতে থাকলো, বাড়ি আসার সময় সবাই চাইছিল ওর পাশে দাঁড়িয়ে হাঁটতে।
নাম বড়ো পুকুর, অনেকটা সেই নামে তাল পুকুর ঘটি ডোবে না অবস্থা। ফ্লাট কড়াই এর মত আকৃতি, বিরাট পুকুর , মাঝখানে জল বড়জোর এক মানুষ। শীতের পর থেকে জল শুকাতে থাকে। বৈশাখ মাসের দিকে জল একদম কমে যায়, এবং প্রচন্ড রৌদ্র তাপে জল গরম হয়ে যায়। সমস্যা হয় মাছের, সেই জন্য জেলেরা পুকুরের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা বাঁশ পুঁতে তাকে কেন্দ্র করে একটা বিরাট বৃত্তাকারে ফুট খানিক লম্বা কচুরি পানার দাম বেঁধে রেখেছে। যাতে মাছ গুলো কচুরিপানার তলায় গিয়ে তুলনামূলক ঠান্ডা জল পায়। যদিও সেখানে মাছ ছাড়া অন্য প্রাণীও থাকে। পুকুরে একটা বিরাট শান বাঁধানো ঘাট আছে, যার সিঁড়ি পুকুরের প্রায় মাঝখান অব্দি বিস্তৃত। এই পুকুরে চলে ফটিকদের জল কুমির খেলা।
আজ সব বন্ধুরা বড়ো পুকুরে হাজির। ফটিক, স্বপন, দীপক, সেকেনালি, পচা , আক্তার, পেঁচো সবাই। জল কুমির খেলা আজ জমবে ভালই। এই খেলায় ফটিকের একটু সমস্যা হয়, কারণ ফটিকের গাঁট্টা গোট্টা চেহারা হওয়ায় ও অল্প সাঁতারে হাঁপিয়ে উঠে ধরা পড়ে, এবং ওকেই কুমির সাজতে হয়। যাইহোক টস করে দীপক কুমির হলো। শানের ঘাটে টপাটপ সবাই প্যান্ট খুলেই জলে ঝাঁপ দিলো। শেষে দীপক যখন ঝাঁপ দিলো, একেবারে ফটিকের কাছাকাছি গিয়ে পড়লো। ফটিক ধরা পড়ার ভয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে অনেকটা দূরে সরে যেতে চাইলো। কিছুটা সাঁতার কাটতেই ওর মাথায় ঠক করে কোনো শক্ত বস্তুতে ধাক্কা লাগলো। দমও শেষ, মাথা তুলতেই সে বুঝতে পারলো, পুকুরের মাঝখানে পোতা বাঁশে ধাক্কা খেয়েছে, এবং কচুরি পানার দামের ঠিক মাঝ তলায় এসে পড়ছে। কচ্ছপ যেমন তার শক্ত কাঠামো থেকে মাথা বের করে নিঃশাস প্রশ্বাস নেয়, ঠিক তেমনি ফটিক বাঁশটি ধরে এক দেড় ফুট লম্বা কচুরি পানার ভিতর দিয়ে মাথাটা এমন ভাবে বার করলো যাতে ওর নিঃস্বাস প্রশ্বাসের কোনো অসুবিধা না হয়, আর বাইরে কি ঘটছে সব কিছু বুঝতে পারে। এদিকে স্বপন, দীপক, পচা, ওরা সবাই জল কুমির খেলায় ব্যাস্ত, ফটিক যে নেই প্রথম দিকে কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ফটিকও ঘাপটি মেরে কুচরি পানার ভিতর লুকিয়ে আছে। উলঙ্গ শরীররে একটা স্থলজীব দামের তলায় আসতেই, দামের তলার জলজীবেরা একটু ঘাবড়ে গেল। তারা সব ভয়ে স্থান ত্যাগ করার জন্য হুটপাটি শুরু করে দিলো,যেটা ফটিক বুঝতে পারছিল। ওর গা ঘেঁষে কত মাছ পালালো। আবার একটা নরম লম্বা দড়ির মতো প্রাণী ওর বুক,কোমর, পা জড়িয়ে হাটু হয়ে নেমে গেল। ফটিক বুঝতে পারলো বস্তুটি কি, কিন্তু ভয় পেলো না, কারণ প্রাণী গুলোই তখন জিজেদের প্রানের ভয়ে পালাচ্ছে। সব থেকে বড় কথা ও জানে জলে বাস করা প্রাণী গুলো নির্বিষ হয়। এদিকে ফটিকের বন্ধুরা সব ফটিকের অনুপস্থিতি ততক্ষনে টের পেয়ে গেল। এবার খোঁজ শুরু হলো। প্রথমে চিৎকার করে ডাকাডাকি,তারপর এদিক ওদিক খোঁজ। ফটিক ব্যাপারটাতে বেশ মজা পেলো, ভাবখানা ” দেখি না কি হয়”। ওরা তাড়াতাড়ি প্যান্ট পরে নিল। প্যান্ট পরতে গিয়ে দেখল ফটিকের প্যান্ট পড়ে আছে। বন্ধুরা নিশ্চিত হলো যে ফটিক জলেই আছে। কিন্তু জলে তো এতক্ষন ডুবে থাকতে পারবে না। সবাই মিলে পুকুরের চার দিকে খোঁজা খুঁজি করতে লাগলো। শিশু মনের অপোক্ত বুদ্ধিতে নানা রকম মন্তব্য করতে থাকলো। কেউ বললো ” জলে ডুবে গেছে”, আর একজন বললো “নিশ্চই জলপরী হয়ে গেছে”। ফটিক কচুরি পানার দামের ভিতর থেকে সব শুনতে পাচ্ছে। জলপরী হয়ে গেছে, এই কথাটি শুনে ফটিকের মাথায় একটা দুষ্টু ভাবনা এসে গেল। জল থেকে উঠে সে কি বলবে , জলে দাঁড়িয়ে তা ঠিক করে নিলো। এদিকে ফটিককে যখন কোনোভাবেই বন্ধুরা খুঁজে পেলোনা, তখন তারা ঠিক করলো বড়দের জানাবে, যদি পুকুরে জাল ফেলে খোঁজ পাওয়া যায়। ফটিক বুঝলো আত্ম গোপন করে থাকা আর সমীচীন হবে না। এবার আত্ম প্রকাশ করতেই হবে। সেকেনালি বললো ” বাপ-রে বলি, আমাদের বড়ো জাল আছে,জাল ফেললিই ফটিক তাতে ধরা পড়বে “। স্বপন, দীপক ,অন্য সকলে তাতে সম্মতি জানালো। এরই মধ্যে পচা চিৎকার করে বলে উঠলো ” ওই তো ফটিক “! সকলে বিস্ময়ে হতভাক, ফটিক জলের নীচে থেকে মাথা তুলে আস্তে আস্তে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে , ও এতক্ষন জলের তলায় ছিল কি করে? বন্ধুরা চরম উৎকন্ঠায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফটিকের পুকুর থেকে ওঠার অপেক্ষায় থাকলো।
ফটিক পুকুর থেকে উঠে এমন ভাব দেখিয়ে বাংলা প্যান্টের দড়ি বাঁধতে লাগলো যেন আলেকজান্ডার বিশ্ব জয় করে এলো। পচা একটু তোতলা আছে, তুতলে বললো ” তু-ই এত-ক্ষন জ-লের ত-লায় কি কর-ছিলি? ফটিক কচুরি পানার দামের ভিতর দাঁড়িয়ে যে মহাকাব্যটি রচনা করেছিল,সেটি এবার পাঠ করতে লাগলো। ওকে ঘিরে রইলো কচি কাঁচা বন্ধুরা।
“দীপক যেই আমার সামনে ঝাঁপ দিলো, আমি ধরা পড়ার ভয়ে ডুব সাঁতারে দূরে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার মাথায় শক্ত মতো কি যেন ঠেকল, তাকিয়ে দেখি একটা দরজা। বাইরে থেকে শিকল তোলা। আমি একটু অবাক হলাম। ভাবলাম দেখি তো শিকলটা খুলে, শিকল খুলে আমি তো আরো অবাক! দেখলাম দরজা থেকে একটা শিড়ী নেমে গেছে পাতালে।” ঠিক সেই সময় পড়ন্ত বেলার একটা হালকা বাতাস বইছিল। ফটিকের ভিজে শরীরে সেই বাতাস লেগে রোমকূপ থেকে ছোট ছোট লোমগুলো খাঁড়া হয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ফটিক এই শারীরিক অনুভুতিটা কাজে লাগিয়ে দিল। “এখন গল্পটা করতেই দেখ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে”। ঘটনা প্রবাহ দেখে বন্ধুদের মনে অল্প অল্প বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করলো। ওরা অবাক বিশ্বয়ে বললো ” তারপর”? ফটিক দেখলো বন্ধুরা বিশ্বাস করে ফেলেছে ও অতি উৎসায়ে বলা শুরু করলো- ” আমারও জেদ চেপে গেল,ঠিক করলাম দেখবো এই সিঁড়ি কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। তারপর এক ধাপ দুই ধাপ করে শেষ ধাপে এসে দেখি আমি বিরাট এক পাতালপুরীতে চলে এসেছি। ওখানে সাজানো গোছানো বড়ো বড়ো সব ঘর। একটা ঘরে শুধু দামি পোশাকে ভর্তি।আর একটা ঘরে ঢুকলাম অস্ত্র সস্ত্র বাসন কোষণ ইত্যাদি।আর একটা দরজা খুলতেই হিস হিস শব্দ পেলাম, ভালো করে তাকিয়ে দেখি ঘর ভর্তি পাথরের বড়ো বড়ো ঝুড়ি, তাতে হিরে, মানিক,সোনার অলংকার আরো কতকিছু ভরা রয়েছে। আর মেঝেতে অনেক গোখরো, কেউটে হিস হিস করে পাহারা দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। সব দেখছি ,কিন্তু কোনো লোকজন দেখতে পাচ্ছি না। একটু অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি, এমন সময় চোখে পড়লো একটা ছোট্ট কুঠুরি। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতে আমি ভয়ে চমকে উঠলাম। দেখলাম কুঠুরির মধ্যে একটা সুসজ্জিত পালঙ্ক আছে, তার উপর ঘুমিয়ে আছে এক রাজকন্যা। গুটি গুটি পায়ে পালংকের পাশে গিয়ে দেখি, হ্যাঁ যা ধরেছি তাই, রাজকন্যাই বটে, মাথার পাশে সোনা, রুপার জিওন কাঠি মরণ কাঠি আছে। সোনার কাঠিটা নিয়ে যেই রাজকন্যার চোখে ঠেকালাম দেখি রাজকন্যা নড়ছে। ঠিক সেই সময় আমার মনে পড়লো প্যান্ট তো আমি শানের ঘাটে খুলে এসেছি। এখন উপায় রাজকন্যা তো জেগে উঠবে। রাজকন্যার মাথার কাছে একটা আলনা ছিল, এবং তাতে একটা গামছা ঝুলছে, ব্যাস সেটাই পরে নিলাম’। সেকেনালি বললো ‘ তুই তো পুকুর থেকে ল্যাংটো হয়ে উঠলি”। সবাই যুক্তির জলাঞ্জলি দিয়ে মন্ত্র মুগ্ধের মতো ফটিকের পাতাল পাঠ শুনছিল। সেকেনালি দিল তাল কেটে। সহায় হলো ফটিকের উপস্থিত বুদ্ধি। সে না ঘাবড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো-” রাজকন্যাকে রুপোর মরণ কাঠি ছুঁইয়ে ঘুম পড়িয়ে আলনাতে গামছা খুলে রেখে এসেছি”। স্বপন সেকনালিকে এক তাড়া দিলো। ফটিকের পাতাল পুরীর বর্ণনা শুনতে শুনতে সবারই মনে হচ্ছিল, তারা প্রত্যেকে যেন পাতাল পুরীতে অবস্থান করছে। ফটিক আবার অঙ্গ ভঙ্গি করে পাতাল পুরীর কাহিনী শুরু করলো। ” রাজকন্যা চোখ খুলে আস্তে আস্তে উঠে বসলো, তারপর আমাকে দেখে চমকে উঠল। অবাক হয়ে বলল-” তুমি কে? রাজ পুত্তুর তো নও।” আমি বললাম-” আমি ফটিক,পৃথিবী থেকে এসেছি।” রাজকন্যা আরো অবাক হয়ে গেল। সেকেনালি ফটিকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো-“কেন তুই রাজকন্যার গামছা পরে দাঁড়িয়ে ছিলি তাই? ফটিক একটু ক্ষেপে যায় অনেক কষ্টে একটা গল্প খাঁড়া করছে ব্যাটা সেকেনালি মধ্যে পড়ে বাগড়া দিচ্ছে। স্বপন আবার সেকনালিকে তাড়া দিয়ে চুপ করতে বললো। ফটিক আবার শুরু করলো। ” আ হা হা হা একেই বলে রাজকন্যা, কি তার রূপ!! আবার সেকেনালি তাল কেটে বলে উঠলো- “কিরকম সুন্দর? আমাদের খেঁদি, পেঁচি, টেপি ওদের মতো”? ফটিক এবার সেকনালিকে মুখ ভেংচি কেটে বললো-” খেঁদি, পেঁচি টেপি এরা কি রাজকন্যা? দুগ্গা, লক্ষী, স্বরসতী যেমন দেখতে ওই রকম”। বিশ্বাসের আকাশে ফটিক সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেলো। ভাবলো আর বাড়ালে ধরা পড়ার ভয় আছে। দীপক সেকেনালিকে তাড়া দিয়ে চুপ করে শুনতে বললো। ফটিক এবার সতর্ক হয়ে কল্পগল্পের যবনিকা টানতে বলা শুরু করলো – “রাজকন্যা আমার কাহিনী শুনে খুব আফসোসের সুরে বললো আমি যদি আরো আগে যেতাম তো আরো কিছুক্ষন গল্প গুগব করা যেত। কিন্তু তার আর উপায় নেই, কারণ রাক্ষুসী ডাইনি এসে পড়বে, এবং তাকে জাগা অবস্তায় দেখলে বুঝতে পারবে পৃথিবীর উপর থেকে কেউ পাতালে এসেছে।আমি আর সময় নষ্ট না করে মরণ কাঠি ছুঁইয়ে রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। অবশ্য ঘুম পাড়াবার আগে তাকে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি আবার যাবো, এবং তাকে ডাইনি রাক্ষুসীর হাত থেকে উদ্ধার করে পাতাল থেকে পৃথিবীর উপর নিয়ে আসবো”।
সন্ধে হয়ে যাওয়ায় সেদিনের মতো সবাই বাড়ি ফিরে গেল।ফটিক ভাবলো যাক বাবা একটা গল্প তো চালিয়ে দেওয়া গেল। ভাগ্যিস দিদিমার আনা ঠাকুরমার ঝুলি থেকে পাতাল পুরীর রাজকন্যা গল্পটা পড়ে নিয়েছিলাম। এদিকে স্বপন, দীপক, পচা, আক্তাররা গল্পটাকে একেবারে সত্যিই ভেবে নিলো, এবং এরা আলাদা ভাবে মনে মনে ঠিক করলো কাল সকালেই পুকুরে নেমে পাতাল পুরীতে যাবে , এবং ফটিকের আগেই রাজকন্যাকে উদ্ধার করবে। সন্ধ্যা থেকেই ফটিকের হাঁচি শুরু হয়ে গেল। দিদিমা বললেন গাটা গরম গরম লাগছে খেয়ে শুয়ে পড়, জ্বর বেশি এসে গেলে খেতে পারবিনা।
পরদিন সকালে দীপক,স্বপন, পচা, আক্তার পুকুরে গেল, এবং জলে নামলো রাজকন্যার খোঁজে। পাতাল পুরীরই খোঁজে নেই তার রাজকন্যা ! শুধু শুধু মাথায় শানের ঘাটের ঠোকর খেয়ে রণে ভঙ্গ দিলো। মনে মনে ভাবল পাক ফটিককে মিথ্যে বলার মজা দেখিয়ে দেবে। কিন্তু পরদিন ফটিকের দেখা নেই। শোনা গেল সর্দি হওয়ার জন্য দিদিমা বাড়ি থেকে সারাদিন বার হতে দেয়নি। দিপকরাও ছাড়বার পাত্র নয়। পরদিনই চড়াও হয় ফটিকদের বাড়িতে। ফটিক ওদের সমস্ত কথা শুনে বিজ্ঞের মতো মুচকি হেসে বললো ” সবার দ্বারা যদি সব কিছু হতো তবে পৃথিবীটা এমন হতো না রে পাগলা”। স্বপন ক্ষেপে গিয়ে বলল ” তার মানে”? ফটিক বললো” স্কুলে হেড মাস্টার কজন হয় -একজন, দেশে কজন রাজা হয়-একজন। ঠিক তেমনি পাতাল পুরীর অবিষ্কর্তা কজন হবে- একজন, এবং সে হলো এই শর্মা”। দীপক ক্ষেপে গিয়ে বলল “মিথ্যা বলার জায়গা পাসনে না, ভেবেছিস আমরা কিছু বুঝি না, তুই যে সত্যি বলছিস তার প্রমান দিতে পারবি”? ফটিক শান্ত মাথায় বিজ্ঞের মতো আবার বললো ” জলের নীচে অতোসময় ছিলাম এটাই একটা প্রমান। বেট লড় আর কি প্রমান চাস”। সকলে মিলে ফটিককে চেপে ধরলো। আক্তার বললো “ঠিক আছে,আমি এক ছড়া ডয়রা কলা বেট লড়লাম”। দীপক বললো পাঁচটা আম, স্বপন বললো লিচু, সেকেনালি বললো আনারস। বেটের উপাদান তো ঠিক হলো, কিন্তু পাতাল পুরী থেকে আনবে কি তা কেউ ঠিক করতে পারছে না। পচা তুতলিয়ে বলে- “রাজকন্যা”। রাজকন্যা বলতে পারে ,এটা ভেবে ফটিক কি বলবে ভেবে ফেলেছিল এবার বন্ধুদের বললো- “দেখ রাজকন্যাকে আনা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু একটা সমস্যা আছে, আমি পাতালপুরী থেকে রাজকন্যাকে নিয়ে আসলাম, তোরা দেখলি, তারপর আমাকে আম, জাম লিচু, আনারস দিলি এই পর্যন্ত ঠিক আছে। এবার বল তাকে রাখবি কোথায়”? সবাই মুখ চাওয়া চায়ি করতে লাগলো। ভাবলো ঠিকই তো এই বিষয় টাতো কেউ ভাবেনি। ফটিক এই সুযোগে বললো-” শোন সবথেকে ভালো হবে আমি গিয়ে রত্ন ভান্ডার থেকে কয়েকটি রত্ন নিয়ে আসবো”। সবাই রাজি হলো, বিকালে পুকুর ঘটে দেখা হবে।
ফটিকদের ঠাকুর ঘরে একটা লক্ষীর ঝাঁপি আছে, তাতে ফটিকের মা বস্তু মতে কিছু পুরোনো আমলের পয়সা, কড়ি, পাথর ইত্যাদি দিয়ে ভর্তি করে রেখেছেন। ফটিক এক ফাঁকে ঠাকুর ঘরে ঢুকে ঝাঁপি থেকে পয়সা, পাথর, কড়ি মিলিয়ে এক মুঠো নিয়ে পকেটে ভরলো। তারপর চুপি চুপি দোতলা থেকে নেমে এসে খিড়কির দরজা খুলে পালাতে গিয়ে দেখল বন্ধু মহোদয়রা সব ভেট নিয়ে হাজির। ফটিক ফলগুলো নিয়ে নিচের একটা ঘরে লুকিয়ে রেখে সকলে মিলে পুকুরের দিকে চললো। যেতে যেতে ফটিক সবাইকে জানিয়ে দিল যে সে আজ প্যান্ট পরেই জলে নামবে, কারণ পকেটে ভোরে মনি, মানিক্য, হিরে, জোহরত আনতে হবে তো। ওরা প্রায় পুকুরের কাছে এসে পড়েছে। ফটিক যেন আবার যুদ্ধ জয়ে যাচ্ছে, এমন ভাব করতে থাকলো। বিরাট যোদ্ধার মতো বুক ফুলিয়ে বললো- ” তবে রাজকন্যকে আমি উদ্ধার কোর—–“। ফটিক শানের ঘাটে এসে পুকুরের মাঝখানে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল। ওর মুখ থেকে কোনো কথা বার হচ্ছে না। অস্ফুটে শুধু বললো- ” কচুরি পানার দামটা????”
পচা তুতলিয়ে বললো – “আজ সকালে জেলেরা এসে কচুরি পানার দাম পরিষ্কার করে সব মাছ ধরে নিয়ে গেছে”।
–~০০০XX০০০~–
খুবই ভালো লাগলো, শেষটা খুবই মজার ছিল।
ধন্যবাদ 💐