অসামাজিক ভালোবাসা
*********************
নভশ্রী সান্যাল (মনীষা)
“মার মার , মেরে হাত পা ভেঙে দে…..” বেশ কিছু উত্তেজিত আগুনে গলা আর একই সাথে প্রায় চাপা পড়ে যাওয়া নারীকণ্ঠের “আর মেরো না আমায়, আমি কিছু করিনি” …..গোছের আর্তনাদ কানে আসতেই অন্ধকারে থমকে সাইকেল সহ দাঁড়িয়ে গেল আশরাফ।
হ্যাঁ, ওই তো….ওই বাঁশঝাড়ের দিক থেকেই তো আসছে আওয়াজটা….তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেই কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলো সে। একপাশে কাত হয়ে পড়ে থাকা একটা কেরোসিন কুপি থেকে কেরোসিন আর আগুন দুইই সংক্রমিত হয়েছে শুকনো পাতায়…..ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশঃ। আর তারই আলোয় দেখতে পেলো একটি মেয়েকে মাটিতে ফেলে কয়েকজন পুরুষ নৃশংসভাবে মেরে চলেছে কিল,চর, লাথি….একজনের উদ্যত হাতে আধখানা ইটও, সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজেরও অবিশ্রান্ত বর্ষণ চলছে।
মহিলাটি মাটিতে কাত হয়ে পড়ে দুহাতে নিজের মুখ আর মাথা আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে আর গোঙাচ্ছে।
শয়তানগুলো হিংস্র উন্মত্ততায় খেয়াল করেনি আশরাফকে। মেয়েটির মাথা লক্ষ্য করে মারার জন্য তুলতেই আশরাফ চেঁচিয়ে উঠল …..”কী করছেন কী আপনারা??? মরে যাবে তো মানুষটা!
কেন মারছেন ওনাকে এইভাবে?!”
আকস্মিক এমন চিৎকার আর এক আগন্তুকের আগমনে লোকগুলো যেন একটু থতমত খেয়ে গেল। ততক্ষণে আশরাফ পৌঁছে গেছে মেয়েটির কাছে।
মেয়েটির কপাল,মাথা এবং শরীরের নানান জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে, মুখ দিয়ে
মাঝেমাঝে একটু গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছে।
ততক্ষণে প্রহারকারীর দল একটু ধাতস্থ হয়ে আবার স্বমহিমায় ফিরেছে।
আশরাফকে বলে, “আপনি কে আমাদের কাজে বাঁধা দেওয়ার?
আপনি জানেন, ও একটা ডাইনি!!
আমাদের গাঁয়ে থাকতো, ওর ছায়া পড়ে কতজনের কত ক্ষতি হয়েছে!!
পঞ্চায়েতের বিচারে ওকে গাঁ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
ওর বাড়ির লোকও ওকে ঘরে তোলে নি….তাও ও মাঝেমধ্যেই গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে …….এর ওর রক্ত চুষে খাওয়ার জন্য।
ওকে না করলে যখন শুনছে না, তখন ওকে মেরে হাড়গোড় ভেঙে ফেলে রেখে যাবো গাঁয়ের বাইরে এই বাঁশঝাড়ের মধ্যে,
এখানে পড়ে থাকতে থাকতে এমনিই বা সাপের কামড়ে মরে যাবে।
আমরা বাঁচবো এই রাক্ষসী ডাইনির হাত থেকে। আপনি সরে যান, এসবের মধ্যে ঢুকবেন না ভালো চান তো।”
বলে একজন পা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারলো অচৈতন্য আধমরা মেয়েটির পেটে।
আসরাফ আর সহ্য করতে পারলো না…..
মেয়েটির শরীরের উপর বিছিয়ে দিলো নিজেকে, বলে উঠলো, আমি আপনাদের হাত জোড় করে অনুরোধ করছি ,আপনারা ওকে ছেড়ে দিন।
কথা দিচ্ছি, আর ওকে এই গাঁয়ের ত্রিসীমানায় দেখা যাবে না।”
কোন কারণে, লোকগুলো নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে চলে গেলো। হয়তো মারতে মারতে ওরাও ক্লান্ত হয়ে গেছিলো।
আসরাফ দ্রুত উঠে পড়লো মেয়েটির উপর থেকে। সাইকেলে ঝোলানো ব্যাগ থেকে জলের বোতল এনে মেয়েটির মাথার কাছে বসে মুখের উপর থেকে অবিন্যস্ত চুলের রাশি আর শীর্ণ হাতখানি সরাতেই শুকনো পাতায় ছড়িয়ে জ্বলা আগুনের আলোয় মেয়েটির মুখখানি দেখে চমকে উঠলো।
বেশ কয়েকবার জলের ঝাপটা দেওয়ার পর ধীরে চোখ মেলে মেয়েটি।
আসরাফ আস্তে বলে, আমি তোমায় ধরলে উঠে আমার সাইকেলে বসতে পারবে?
সে বেচারি নিজেই উঠতে যায়, কিন্তু পারে না,তার মাথা,কপাল এবং সারা শরীর বিক্ষত।
আশরাফ পরম যত্নে তাকে তুলে দাঁড় করায়,
তবে ছাড়ে না, ধরে থাকে শক্ত করে।
একটু জল খায় মেয়েটি। একটু যেন বল পায়। এতক্ষণে সে ভালো করে তাকায় তার রক্ষাকর্তার দিকে…….”এ কি তুমি!!! চিত্রার্পিতের মতো চেয়ে থাকে আশরাফের দিকে।” আশরাফ ম্লান হেসে বলে,
“হ্যা, কুসুম, আমি। সেই আশরাফী বা আশরাফ যে নামে তুমি আমায় ভাবতে চাও।তবে মনে প্রাণে আমি জানি, আমি আশরাফ।”
ক্লান্ত আর্ত মায়ামাখানো চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে কুসুমের। অস্ফুটে যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করে আমি এখন কী করবো? কোথায় যাবো? চোখের জলের প্লাবন লুকোনোর বৃথা চেষ্টায় মুখ নামিয়ে নেয় সে।
আশরাফ খুব শান্ত অথচ ব্যাকুল হয়ে বলে, “আমার সাথে যাবে কুসুম?
শহরে?
আমার ঘরে?”
কুসুম এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে……
কান্না জড়ানো গলায় বলে, আমার যে কোত্থাও যাওয়া চলে না, কোনওখানে যে আমার ঠাঁই হবে না, আমি যে ডাইনি….যেখানেই আমার পা পড়বে, সেখানেই অমঙ্গলের ছায়া ঘনিয়ে আসবে, আমার দৃষ্টিতে যে বিষ আছে…..
আমি যে রক্ত চুষে ……. আর বলতে পারে না সে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে সে।
আশরাফ আবারও শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলে, আমার কাছে তুমি ডাইনি নও কুসুম, আমার কাছে তুমি আমার স্বপ্নের ভালোবাসা।
হ্যাঁ, প্রকৃতির অভিশাপে আমি আকৃতিগত ভাবে মেয়েদের মতো হলেও , তুমি জানো মনেপ্রাণে আমি নিজেকে পুরুষ বলেই মানি।
আর তাইই হয়তো বেড়ে ওঠার দিনগুলো থেকেই একজন পুরুষের মতোই আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।
তোমায় যেদিন জানিয়েছিলাম প্রথম, সেদিন ঘেন্নায়, প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপে আমায় চুড়ান্ত অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে, বলেছিলে,
“তুমি তো হিজরে,
হিজরের আবার ভা লো বা সা!!!”
বলে তোমার বন্ধুদের ডেকে তোমায় জানানো আমার নিভৃত ভালোবাসাকে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপে,অপমানে বারোয়ারি করে পায়ে পিষে চলে গেছিলে সদর্পে।
আমিও তারপর দিনই গ্রাম ছেড়েছিলাম রাত থাকতে সবার অগোচরে।
আম্মিকে তো জন্মেই হারিয়েছিলাম, আব্বাও আমার জন্য প্রায় মুখ লুকিয়ে বাঁচতো, বাবাকেও স্বস্তি দিলাম।
শহরে কেউ কারুর অত খেয়াল করে না।
অতি কষ্টে একটা ছোটখাটো কারখানায় কাজ জুটিয়ে দিলো আল্লা।
অনেক দিন পর পর আব্বাকে একবার চোখের দেখা দেখতে আসি, সেদিনই ফিরে যাই আবার। সাধ্যমতো টাকা দিয়ে যাই আব্বার হাতে।
কিন্তু তোমার জন্য ভালোবাসাকে তুমি সেদিন মেরে ফেলতে পারোনি কুসুম।
আজও সে অমলিন আমার বুকে বেঁচে আছে।
আমি তোমার উপর তোমার সৎ মায়ের এই ডাইনি অপবাদ চাপিয়ে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, গ্রামের লোকের তোমার উপর অত্যাচারের খবর শুনেছিলাম কিছু কিছু ….আজও এসেছিলাম, ফেরার সময় দেখতে পেলাম স্বচক্ষে সবটাই।
কুসুম, আমাদের দুজনেরই তো আর হারানোর কিছু নেই নতুন করে, আমি যে আজও তোমায় ভালোবাসি।
আসবে আমার কাছে?
চলো না দুজনে শুধু ভালোবাসায় নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করি।
তবে, আমার হৃদয় নিংড়ানো প্রেমে, ভালোবাসার আদরে তোমায় ভরিয়ে দিতে পারলেও কোনওদিন জৈবিক বা সন্তানসুখ দিতে পারবো না তোমায় একথা তো তুমি জানোই কুসুম।
আমাদের তথাকথিত অসামাজিক সংসারে লক্ষ্মী হয়ে আসবে তুমি…..আর কেউ কখনো তোমায় ‘ডাইনি’ অপবাদে অস্পৃশ্য করে রাখবে না….কথা দিলাম তোমায় ।
অবশ্য আজও যদি তুমি আগের মতোই আমায় হিজরে বলেই ঘেন্না করো, তাহলে …
কথা শেষ হবার আগেই কুসুম তার হাতের পাতা আশরাফের ঠোঁটে চেপে ধরলো।
অস্ফুটে বলে উঠলো, আর বোলো না…. সেদিন মহাপাপ করেছি আমি।
জানি, ক্ষমার অযোগ্য, তবু পারবে….পারবে আমায় একটু ক্ষমা করতে???
বলে অঝোড় কান্নায় ভেঙে পড়ে আসরাফ বুকে।
আসরাফ পরম মমতায় দুহাতে জড়িয়ে রেখে কাঁদতে দেয় তার ভালোবাসাকে।
বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে আধখানা চাঁদটা এমন অসম অসামাজিক ভালোবাসার পূর্ণতায় পরম তৃপ্তিতে জ্যোৎস্নায় ধুইয়ে দিতে লাগলো ভালোবাসায় বিভোর হয়ে থাকা দুটি মানুষকে ঘিরে থাকা অন্ধকার।
–~০০০XX০০০~–