বিবেকের যন্ত্রণা
✍️ শিব প্রসাদ হালদার
প্রদ্যুতের প্রবল প্রতিবাদে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ওরা। মুহূর্তেই ঘটে গেল প্রকাশ্যে প্রতিবাদের এক বিরক্তিকর বিরূপ পরিণতি!
অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে ওরা উত্যক্ত করে চলেছে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটি নিঃশব্দে সহ্য করলেও আস্তে আস্তে তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ। কলকাতার রাস্তায় রাত তখন খুব একটা বেশি নয়- সবে সাড়ে নটা। জনসমাগমের যাত্রা শেষে অনেকেই যাচ্ছে ঘরে ফিরে। কেউবা বিনোদনে। কার গতি কোন দিকে কি করেই বা একে অন্যেরটা বুঝবে? তবুও কর্ম দেখে তো কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। ক্রমাগত বিরক্তির মাঝে যখন ওদের মাঝে একটি ছেলে মেয়েটির ওড়না ধরে মাঝে মাঝে টানতে লাগল তখন প্রদ্যুৎ সোজা উঠে দাঁড়াল। বাসের পেছনের সিটে বসে এতক্ষণ সবটাই প্রত্যক্ষ করছিল। সবশেষে সেও সহ্য করতে না পেরে এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদটা সামাজিক কর্তব্য মনে করে সোজা উঠে গিয়ে ছেলেটির হাত ধরে বসলো। মুহূর্তেই হিন্দি সিনেমার হিরো সেজে প্রদ্যুৎ এর হাত মুচড়ে ধরলো। ওরা সংখ্যায় ছিল পাঁচ। সকলেই উঠলো ক্ষিপ্ত হয়ে। বাসটিতে তখন জনা কুড়ি যাত্রী বসে। দুই-একজন প্রথমে প্রতিবাদ করে উঠলেই ওরা হলো আরো ক্ষিপ্ত। মুহূর্তেই ধারণ করলো রনমূর্তি! গোটা বাসটি যেন তখন ওদের দখলে। যাত্রীরা তখন শঙ্কিত। অপরের মঙ্গল করতে গিয়ে নিজের অমঙ্গল ডেকে আনতে কেউ আর চাইলোনা। পাষণ্ড পঞ্চপান্ডবের আক্রমণের ভয়ে সকলেই এড়িয়ে গিয়ে নিরব রইল। ভদ্রবেশী সুবেশ সুপুরুষ যাত্রীরা বসে যেন কোন সিনেমার দৃশ্য দেখে চলেছে। তবুও সমষ্টিগত সকলে সমান হয় না। দুই একজন একটু আধটু উসখুস করলেও তার বাহ্যিক রূপ কেউ দেখতে পেল না। এই মুহূর্তে কে বাঁধবে বিড়ালের গলায় ঘন্টা? বাস ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। উটকো ঝামেলা এড়িয়ে যাবার উদ্দেশ্যে কন্টাকটার করুণাময়ী স্টপেজ আসতেই প্রদ্যুৎকে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে পড়ল ওরা পাঁচজন। সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটির উপর। কিল, চড় ,লাথি, ঘুঁষি কোনোটাই আর বাকি রইল না। তবুও প্রদ্যুৎ এর প্রতিবাদ বন্ধ হল না। তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে- “তোরা এই সভ্য সমাজের কলঙ্ক। মা-বোনেরা কি তাদের সম্মানটুকু নিয়ে পথে চলতেও পারবে না? তোদের ঘরে কি মা বোন নেই? ওই মেয়েটা যদি তোদের আপন বোন হোত – পারতিস তার সাথে এমন অশালীন আচরণ করতে? কি ভেবেছিস তোরা?” প্রচন্ড প্রতিবাদের ক্ষোভ প্রদ্যুৎ এর কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল।ছেলেগুলি প্রচন্ড ফুসছে। হিতাহিত ভুলে ওরা এলোপাথাড়ি মারতে লাগল। আঘাতের ঘায়ে প্রদ্যুতের মুখ ফেটে রক্ত ঝরছে—! এতক্ষণ সহ্য করে চললেও আর পারলেন না। এক ভদ্রলোক প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন কিন্তু তিনিও তাদের আক্রমণে হলেন আহত। ঠিক তখনই টহলরত পুলিশ জীপ এসে হাজির। পুলিশের গাড়ি আসতেই হিরো বেশ ধারী পঞ্চপান্ডব দৌড়ে পালিয়ে গেল। কর্তব্যরত পুলিশ ইন্সপেক্টর মিস্টার অমল দত্ত প্রদ্যুৎ এর প্রতিবাদের প্রশংসা করলেন। পুলিশ দেখে চলমান পথচারী কেউবা একটু আধটু উঁকি মেরে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে গেল। আবার কেউবা দুই-একজন করে জড় হলো। অনেকে অনেক রকমের মন্তব্য করল কিন্তু প্রতিবাদে প্রত্যক্ষভাবে কেউ তেমন করে এগিয়ে এলো না। ধীরে ধীরে পথ হয়ে গেল ফাঁকা। যে যার মতো তখন ঘরে ফেরায় ব্যস্ত।
এমনই কত ঘটনা প্রতিনিয়ত পথে-ঘাটে ঘটে চলেছে কিন্তু সামাজিক এই চরম অবক্ষয়ের অবসানে কজন আসেন এগিয়ে? এহেন পরিস্থিতিতে কিসের প্রতিবন্ধকতায় সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে না সবাই? এলেও কেন হয় দ্বিধাবিভক্ত? আজও কান পাতলে শোনা যায় দুই হাজার দুই সালের একত্রিশে ডিসেম্বর বর্ষবিদায় রাতের আক্রান্তের আত্মরব–! সেদিন এক বোনের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন পুলিশ সার্জেন্ট বাপি সেন। তিনিও সেদিন করেছিলেন বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। আদর্শবাদী সেই পুলিশ সার্জেন্ট আজ আমাদের সমাজের গর্ব। তবুও সেই উজ্জ্বল গর্বের স্মৃতিকে অনুজ্জ্বল করে তোলে কতনা লজ্জাজনক কলঙ্ক যা জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের কাছে পশুর থেকেও জঘন্য।এমনই কিছু জঘন্য ব্যক্তির পাশবিক পরিচয়ে আমাদের উঁচু মাথা হয়ে যায় নিচু। বলতেও লজ্জা লাগে- সেই কলঙ্কিত প্রাণীরা আমাদেরই কারো না কারো ভাই। আদর্শবাদী বাপি সেনের আত্মত্যাগের পরেও শোনা যায় কত আক্রান্ত অসহায় বোনের আত্মার আত্মরব! ধর্ষিতা হেতাল পারেখের হত্যার মামলায় অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের চরম শাস্তি ফাঁসির সাজাতেও রক্ষা পেল না আমাদের সুস্থ সমাজের মা-বোনেরা। সেদিন দিল্লীর দামিনীর (জ্যোতি) আত্মবলি গোটা বিশ্বকে করেছে আলোড়িত। উত্তাল হয়েছে সমগ্র দেশ। সংসদে তর্কবিতর্কের মাঝে রচিত হয়ে এসেছে সম্ভ্রম রক্ষার কঠোরতম আইন। তবুও জাগল না চেতনা। আজও খুঁজে পাওয়া গেল না সেই বোনকে যার সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে অকাল মৃত্যু হল পুলিশ সার্জেন্ট বাপি সেনের মত এক নিরপরাধী ভাইয়ের। কোন্ অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতায় সেই বোন আজও প্রকাশ্যে মুখ খুলে প্রকাশ করতে পারেনি তার অন্তরে জমে থাকা অন্তজ্বালা!
তার পরেও ঘটে চলেছে কতনা বর্বোরোচিত জঘন্য ঘটনা। আজও সুস্থ বিবেককে ক্ষত-বিক্ষত করে- যখন মনে পড়ে বোনের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে মদ্যপ উশৃঙ্খল কটা ঘৃণ্য যুবকের বেলেল্লাপনার প্রতিবাদে ঝরে গেল তরতাজা প্রাণ! বারাসাতের রিঙ্কু দাস সে তার ভাই রাজীবকে আর কোনদিন খুঁজে পাবেনা স্টেশন থেকে নিরাপদে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য! বুকফাটা বেদনায় আজও রিঙ্কু চোখের জল ফেলে চলেছে—-! এমনই কত বোন কতভাবে নিঃশব্দে ঝরিয়ে চলেছে চোখের জল! তবুও জাগলো না সুস্থ সমাজের এই ঘৃণ্য ব্যক্তিদের বিবেক।
দিনের-পর-দিন কঠোর থেকে কঠোরতম আইন প্রণয়ন করেও যখন নারী জাতিকে সমাজের এই রিপু আক্রান্ত ঘৃণ্য নরপশুদের নারকীয় লালসার শিকার থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন কি আমরা পারিনা এমন একটা স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় সবাই মিলে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে আসতে?
ঘৃণ্য রত্নাকর দস্যু যদি একদিন পরিবর্তিত হয়ে হতে পারে রামায়ণের মহান বাল্মিকী তাহলে কেন হবেনা সমাজের এইসব রিপু আক্রান্ত নরপশুদের মধ্যেও পরিবর্তন? সেইসব উপেক্ষিত ভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে যদি সঠিকভাবে বোধোদয় জন্মানো যায় তাহলে হয়তো হবে পরিবর্তন। আজ না হয়- পরবর্তী প্রজন্মে ফলবে এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল———-! আজ জাগিয়ে তুলতে হবে সেই সঠিক বোধ যার অনুভূতিতে নারী জাতির স্বীয় সম্ভ্রম হবে রক্ষা। বিবেকের দংশনে জেগে উঠবে শুধু সঠিক চেতনা। সকলে জানবে- মাকে শুধু মাতৃ রূপে, বোনকে ভগ্নী রূপে, আর একমাত্র স্ত্রীকেই দেখতে শিখবে শয্যা সঙ্গিনী রূপে—!!
–~০০০XX০০০~–
“সবুজ স্বপ্ন” ওয়েব ম্যাগাজিনে আমার লেখা “বিবেকের যন্ত্রণা” গল্পটি প্রকাশ করার জন্য সম্পাদক মহাশয়কে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। সুধী পাঠক মন্ডলীর সুচিন্তিত মন্তব্য পেলে অত্যান্ত খুশি হব। “সবুজ স্বপ্ন” ওয়েব ম্যাগাজিনের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি
ধন্যবাদ 💐💐💐