গৃহস্থ
*******
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
রোজকার অফিস বেরনোর সময় এই নিয়েই অশান্তি। আরে বাবা ! ভাতটা যখন বেড়ে দিবিই..তখন মিনিট পনেরো আগে দিলে কি ক্ষতি। দু মুঠো ভাত, ডাল আর আলু-কুমড়োর ঘ্যাঁট এই তো পিন্ডি! তাও কি করে জ্বলন্ত গেলা যায়? এবারে ওদিকে আটটা কুড়ির লোকালটা ধরতে না পারলে লাল কালির দাগ পড়বে। জুটমিলের সামান্য অ্যাসিসটেন্ট এক্যাউন্টেন্ট তার আবার আর মাথার দাম !
*********
সর্বময়ীও কম যায়না। মুখঝামটা দিতে দিতে সেও চোপা দেয়- ” আমার বাপের বাড়ির চালের ভাত কিনা তাই তোমার গাল জ্বলছে! একা হাতে কোন ভোর থেকে উনুন ধরিয়ে এসব করছি সেটা কখনো দেখেছ?”
এরপর মিতবাক হওয়ায়ই দস্তুর। সর্বময়ীর বাপের বাড়িতে জনতা স্টোভ আছে। মিলের চাকরিতে আড়াই হাজার সাকূল্যে হাতে এলে কি আর ওসব বিলাসিতা মানায়?তোলা উনুন আর গুলকয়লার আঁচে ভোর হয় এবাড়িতে। সর্বময়ী তার মধ্যেই খাবারদাবার তৈরী করে দেয়। তার কর্তব্যে সে নিষ্ঠ কিন্তু জিভটি বড় ধারালো। তার সর্বদাই মনে হয় এই জাতবাউন্ডুলের হাতে সঁপে দিয়ে তার বাবাটিও বেড়াল পার করে বেঁচে গেছে।
*********
এই যে এখন ঘর থেকে বেরিয়ে স্টেশনে লাল্টুর পান দোকানে গিয়ে যে সাইকেলটা রেখে ট্রেনে উঠবে মনোময় সেটাও ওর বিয়ের যৌতুক। সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও বেশ পোক্ত। শ্বশুরমশায়ের নিজের র্যালে কোম্পানির সাইকেল। মনোময় চাকরি করলেও এদ্দিনে নিজের কিছুই জোটাতে পারেনি। মিলের কিপারবাবু তার মা মরা একমাত্র মেয়ে সর্বময়ীকে ওর হাতে গছিয়ে না দিলে বউটাও জুটতনা হয়তো। সে নিখাদ নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের বাপমরা ছেলে তাও যে আই এ পাশ করেছে সেই অনেক! তার মা’ ও মৃত্যুশয্যায় এই অস্বস্তি নিয়েই চোখ বুজেছে যে খোকাটাকে কে দেখবে এখন! মায়ের খোকাটিও তেমন! কোনও কিছুতেই তার কিছু এসে যায়না। সে যেন সমস্ত সাংসারিক বোধবুদ্ধি থেকে পালিয়ে বাঁচে।
সেদিন গন্ডগোলটা বাড়ল। ডালের বাটিটা হাত ফস্কে গরম ডাল এসে পড়ল মনোময়ের পায়ে। রাগ দেখিয়ে ভাতের থালায় সটান লাথি কষিয়ে সে উঠে গেল। সর্বময়ী তার মধ্যেই প্রবল মুখরতায় মনোময়ের আনাড়িপনা আর অন্যমনস্কতার জন্য দুষতে লাগল তাকে।
*********
এদিন মনোময় হেঁটেই স্টেশনে গেল। অফিস পৌঁছতে সামান্য দেরী হলেও লাল দাগটা বাঁচল। তাড়াহুড়োতে মানিব্যাগ নিয়ে বেরোলেও তাতে রেলের মান্থলিটা ছাড়া দশটা টাকা পড়ে ছিল। তা দিয়ে দুপুরের পেটভরা খাবার হয়না। তাই দু কাপ চা আর জল খেয়ে দুপুরটা চালিয়ে নিল সে।
*********
মনোময়ের এমন রাগ সর্বময়ী আগে দেখেনি। বরং তার ক্ষুরধারা বাক্যবাণের সামনে মাথা গুঁজে চুপচাপই তো এতকাল থেকে এসেছে। আজ হঠাৎ এত রাগ দেখাতে পারে এটা যেন মনে মনে ওকে বেশ চাপা আনন্দ দিচ্ছিল। পুরুষমানুষ আবার মিনমিনে হলে হয় নাকি! আবার পরক্ষণে ভাবল সারাদিন মানুষটা না খেয়েই রইবে। মনোময়ের কাছে কখনো বেশী টাকা থাকেনা। অগত্যা হেঁসেলে শেকল তুলে সেও অভুক্ত থেকে গেল ইচ্ছে করে। মনের মধ্যে গজগজানিটা কমে আসলেও একেবারে তা থামেনি।
*********
অফিস ছুটি হলে স্টেশনের একপাশে ছেলেবেলার বন্ধু পেকা মানে লাইনের ওভারসিয়ার প্রকাশের সাথে মাসি’র চোলাইএর ঠেকে মনোময় গেল। আজ সকাল থেকে বুকে একটা বাড়তি সাহস এসেছে কেমন করে যেন! আদার শুঁট আর পাঁপড় দিয়ে দু ভাঁড় খেয়েই মাথাটা বেশ দুলছে। পেকা নিজেই সব পয়সা টয়সা মিটিয়ে দিল। “শাআআআআলাআআআ!” বেশ একটা বীরদর্পে পদক্ষেপ ফেলে সে ঘরমুখী হয়।
*********
রাত তখন এগারোটা। ছোট মফস্বল শহর প্রায় নিঝুম। রাতের গুমোট নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে দু একটা মালগাড়ি ঝনঝন করে শব্দ উঠিয়ে চলে গেল।
সর্বময়ীর রাগ ততোক্ষণে একেবারে নেমে গেছে। মানুষটা এখনো ফিরলনা কেন? তার বুক দুরুদুরু করে ওঠে।
বাইরের দরজার শিকলটা ঝনাৎ করে ফেলে একসময় মনোময় টলতে টলতে উঠোনে পা রাখে। তাকে দেখতে পেয়েই ঝড়ের মুখে একটুকরো বাঁশপাতার মত উড়ে এসে ঘর্মাক্ত পরাজিত মনোময়কে জড়িয়ে ধরে সর্বময়ী হু হু করে কেঁদে ওঠে। মনোময়ের কাছে এই সর্বময়ী অচেনা। চারবছরে অবশেষে এই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ তার কাছেও তো কল্পনার অতীত।
খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা শুতে গেল। মাথার কাছে জানলার পাল্লাটা খোলাই। সেখান থেকে রূপোলী চাঁদের মলমলে আলো এসে পড়েছে দুজনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায়। মনোময় সর্বময়ীকে এবারে খুব যত্নে বুকে টেনে আনে। বিছানার ওই ফাঁকটার বদলে একটা গোটা চাঁদকে পূর্ণিমার সম্পূর্ণ আবহে এবার থেকে ওখানে খেলা করতে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
–~০০০XX০০০~–