কাচের ঘর
কাকলি ঘোষ
:কী রে কাল রাতে মোবাইল বন্ধ ছিল কেন ?
:কই না তো ! খুলেছিলাম তো !
:সে তো একবার আটটার সময়। তারপর ?
:আসলে ও দেখছিল তো____
: কে ? তোর বর ? তোর ফোন দেখছিল? কি দেখছিল ?
: না না সেরকম কিছু নয় । আমি ই বলেছি কত টপিক থাকে ফেসবুকে —
: তো? ওর নিজেরও তো আছে। তোরটা কেন ?
তাতে কি হয়েছে?
: হয়েছে। তুই দীপকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিস? কেন?
: আসলে ও বলছিল —
: কী বলছিল?
: কিছু না। তোমাকে কে বলল?
: দীপ
: হুঁ। একটু অসুবিধে হয়েছে। করে নেব আবার ফ্রেন্ড।
:মানে? তোর সুবিধামত নাকি? এই তোর কী হয়েছে ?
:কি –কি হবে ? কিছু না তো!
তোর চোখগুলো এমন লাল! সারারাত কেঁদেছিস নাকি! মুখ তো শুকিয়ে আমসি! হাতে , কপালে ওগুলো কিসের দাগ ?
: কিছু না। শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে……রাতে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম
: মিথ্যে বলিস না স্বাতী। ওটা তুই পারিস না।
: পারমিতা দি
: স্বাতী! তোর বর তোর ফোন চেক করে ? ওর ভয়েই তুই দীপকে আনফ্রেন্ড করলি? তুই কী রে?
: ও আমাকে খুব ভালবাসে পারমিতা দি। আমাকে কারুর সাথে শেয়ার করতে পারে না।
: বোকা বোকা কথা বলিস না। বউকে কে আবার শেয়ার করে অন্যের সাথে? তা বলে তোর কোন বন্ধু থাকতে পারবে না।
:আসলে কী জানো? ও একটু ব্যাকডেটেড। ঠিক চায়না এসব।
:তো আপডেটেড কর! তুই কী করে পারবি এভাবে!
:পারছি তো।
:না পারছিস না।
:মানে?
:মানেটা তুই ই ভালো জানিস? সেদিন স্কুলের মিটিং অ্যাটেন্ড করলি না। কী? না বাড়ি যেতে দেরী হয়ে যাবে। লাস্ট উইকে স্কুল পিকনিকে গেলি না। কারন কি দেখালি? ভাল লাগছে না। আজ দীপকে আনফ্রেন্ড করলি—— তুই কি ভাবিস কেউ কিছু বোঝে না?
:পারমিতা দি একটু প্রব্লেমে আছি গো—
:জানি। কিন্তু মুশকিল টা কী জানিস?
:কী?
:তোর প্রবলেমটাকে তুই আসলে চিনতেই পারছিস না। মন্দিরার বিয়েতে আমরা স্কুলশুদ্ধু সবাই গেলাম। শুধু তুই বাদ। কেন? বিয়েবাড়ীতে সেজেগুজে গেলে সবাই দেখবে তোকে। তোর বরের তাতেও বুকে ব্যাথা!
:না মানে –দেখ– ওর কথাগুলো মেনে নিলে যদি একটু শান্তি থাকে —-
:হা হা হা। মেনে নিলে ? কত মেনে নিবি ? মানতে মানতে তোর তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে রে!
না না ও অতটাও ওরকম নয়। ভালবাসে আমাকে।
: হ্যাঁ। সম্পত্তির মত। দামী গয়নার মত। পোষা জন্তুর মত।
: পারমিতাদি—!
ব্যাস! চোখে জল এসে গেল তো! এই করেই মরেছিস তুই! কথায় কথায় চোখে জল। ঠোঁট কামড়ানো—সেন্টিমেন্টাল ফুল একটা—!
:কী করব? না মানলে অশান্তি— সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে পারি কী? আমার একটা ছেলে আছে।
:বেরিয়ে আসতে কে বলেছে? সংসারটা তোর নয়? ছেলেটা ওর নয় ? ওখানে থেকেই প্রতিবাদ কর। একবার তো রুখে দাঁড়া স্বাতী। সারাজীবনে একবার অন্তত—–
:দেখি! বুঝিয়ে বলছি তো। ক্লাশ আছে গো । যাই—
:জানি। উচিত কথা বললেই তুই পালাবি। দাঁড়া। শোন। আজ হাফ ডে। জানিস তো?
:না তো। কেন গো?
(ভেঙিয়ে) কেন গো? ছুটি হলেই বাড়ীর দিকে দৌড়! জানবি কোত্থেকে?
:উফ! বলবে কি?
:স্কুলের এক্স প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন। তার অনারে।কাল ছুটির পর অ্যানাউন্স করল। তুই তো তখন ভাগলবা—
:হ্যাঁ গো। কাল ওর সংগে এক জায়গায় যাবার কথা ছিল। আমি বড়দিকে বলে রেখেছিলাম।
:যাক গে। শোন। আজ আমরা সবাই মিলে মন্দিরার বাড়িতে আড্ডা দিতে যাচ্ছি। তুই ও যাবি
:আমি! এই না না।পারব না গো!
:কেন? যাবি না কেন?
:বাড়ীতে বলা নেই যে—
:বাড়ীতে? না বর কে?
:ওই একই হোল—
:বলা নেই তো বলে দে। ফোনটা করে বলে দে আজ আমাদের সাথে যাচ্ছিস সিম্পল—
:অতটাও সিম্পল নয় গো। খুব অশান্তি করবে। তাছাড়া শুধু মেয়েরা তো যাচ্ছ না তোমরা—
:না। সুবিমল, তাপস, দীপায়নও আছে। তো?
:না গো আমি পারব না।
:স্বাতী। এই যুগে দাঁড়িয়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েও কোন মেয়ে এমন হতে পারে তোকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না !
:মেয়েদের আবার এ যুগ সে যুগ কী ?মেয়েদের একটাই যুগ। তবু তাদের মধ্যে তোমাদের মত কেউ কেউ স্বাধীন ভাবে বাঁচছে দেখলে ভালই লাগে। না গো। আমার হবে না। তুমি জানোনা—-
:না জানিনা। জানতেও চাই না। শুধু এটাই চাই যে তুই একবার প্রতিবাদ কর। চল আজ আমাদের সাথে।দ্যাখ কী হয় ? কী করে ও ?
:আমি পারব না।
:তুই মরে যাচ্ছিস স্বাতী! একে একে সব দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিস! বাঁচবি কী করে?
:পারব। পারব। এভাবেই বাঁচব।
:মার খেয়ে খেয়ে! মনের সব ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে মেরে! একে বাঁচা বলে!
:পারমিতাদি—-
তোর ইচ্ছে হলে কোথাও যেতে পারবি না—ইচ্ছে হলে কারুর সাথে কথা বলতে পারবি না—এভাবে বাঁচবি? তবু কিছু বলবি না?
:পারমিতাদি —ধরে নাও এটাও এক ধরনের লড়াই! নীরব প্রতিবাদ! সব মেনে নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা—
:বোগাস! ওসব বোঝার লোক তোর বর নয়। দেখেছি তো স্যাম্পলটাকে দু একবার। বরং এটাই ভাবে যে তোকে দমিয়ে রেখেছে। পায়ের তলায় পিষে রেখেছে। —–একটা কথা বলবি?
:কী?
:তোর এত ভয় কীসের ?
:জানিনা। ছোট থেকেই শান্ত প্রকৃতির। বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে। সবার সব কথা শোনা আর মেনে নেওয়া একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আর এখন তো লোকলজ্জা ।হয়ত বা সংসার ভেঙ্গে যাবার — হয়ত বা —
:হয়ত বা—
:খাঁচাটাকেই ভালবাসি। তাই ভেঙ্গে বেরোতে পারিনা।
:হুম। এক কাজ কর তাহলে—
:কী—!
:এবার থেকে একটা বোরখা পরে আসিস। বলা যায় ! তোর সুন্দর মুখ—এত সুন্দর শরীর –কতজন দেখছে রাস্তায় —রাতে মনে মনে তোকে কামনা করছে — আর তাছাড়া হাতের দাগ, পিঠের কালশিটে __সব কিছু থেকে রেহাই পেয়ে যাবি—
:পারমিতা দি–!
:হ্যাঁ। সিঁদুরের টিপ টাও বড় করে পরিস। কপাল টা ঢাকা থাকবে।
: ঠাট্টা করছ ?
: নাহ ! তুই তারও যোগ্য নোস। আর শোন এবারে সত্যি সত্যি একটা শেকল পরে আসিস কোমরে। যার চেনটা তোর বরের হাতে থাকবে—! দরকার মত টানবে—-নাড়বে —চাড়বে—। তুই ও সেই মত ——
হা ।হা। হা। কী বলিস! চলি রে— ক্লাশ আছে—-
–~০০০XX০০০~–