আসল ও নকল
————————–
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
শ্রাবণের আকাশ পক্ষকাল মেঘাচ্ছন্ন। এই মেঘমেদূরতায় মন বিষণ্ণ হয় যেমন, তেমনই আরও এক মহাবিষণ্ণতার আবহে কাশীপুরের বাগানবাড়িটি স্তিমিতপ্রায়।
যে আনন্দরসের সুধাভান্ড রাসমণির কালিবাড়ীতে একদা নববৈকুন্ঠের হাট বসিয়েছিল, তা প্রায় নির্বাপণের পথে। কবিরাজী মতে রোগটির নাম রোহিণী। যাঁর গলদেশে এটির প্রাদূর্ভাব, তিনি নিজেও একজন মহাভিষগ,অবশ্য ভবরোগের। তাঁর অমৃতময় প্রেমাভক্তি শ্রীচৈতন্যের পর বঙ্গদেশে বিরল। সপার্ষদ তাঁর ঐ দক্ষিণেশ্বরে লীলার বিবরণ লিপিবদ্ধ করলে নবমহাভারততূল্য এক কথামৃতের আগার হবার সম্ভাবনা। মাস্টারমশাই মহেন্দ্রলাল এ ভাবনার বীজ মস্তিষ্কে বপন করেছেন সবেমাত্র। আনন্দের হাট সমাপনের পথে।
……..
বিস্ময়ের ঘটনা এই যে গলদেশের কালান্তক পীড়া এই প্রেম-অমৃতময় দেবসন্তানটিকে যন্ত্রণা দিলেও সহাস্য অন্তরঙ্গতায় ছেদ ঘটাতে অক্ষম। কোন এক অপার আনন্দধারার অবিচ্ছিন্ন স্রোত রক্ত -পুঁজ সমণ্বিত ব্যাধি বিড়ম্বিত সুধাকরটিকে রোগ ও রোগী এই দুই বিপরীত অবস্হা থেকে পৃথক রেখেছে। দ্বিতলের পূর্বমুখী একটি ঘরে তাঁর রোগশয্যা, পার্শ্ববর্তী আর একটি ঘরে তাঁর সহধর্মিণী সাক্ষাৎ জগন্মাতা পথ্য প্রস্তুতিতে মনোনিবেশিত। ইদানীং সহজপাচ্য অর্ধতরল খাদ্য ব্যাতিরেকে গলাঃধকরণ সম্ভবপর নয় তাঁর। রোগের প্রকোপ প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান।
নিচের দুইটি ঘরে তাঁর পার্ষদবর্গের বাস। তারা সকলেই যুবক, শিক্ষিত ও পূর্ণযোগী। ধর্মপিতাকেই আকর্ষণ করে তারা জাগতিক বিষয়বাসনা মুক্ত হবার পথে প্রায় সফল। খাদ্যাখাদ্যের বিচার এরা করেনা, মাধুকরীতেই দিন অতিক্রান্ত এমনকি অনাহারকেও এরা মাথার ভূষণ করেছে। নরেন্দ্র ও কালী কেবল তাম্রকূটের আসক্তি পরিত্যাগ করেনি সাধারণ্যের মতোই।
……..
একটি ফিটন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। তিনজন সেবক এখন অনুপস্হিত। বাকীরা রাত্রিজাগরণে পরমপদসেবার কারণে কিঞ্চিৎ বিশ্রামে রত। একটি সাহেবীপোশাক পরিহিত যুবা প্রায় বিনাবাধায় দ্বিতলের দিকে অগ্রসর হল।
তিনি শয্যায় পাশ ফিরে শুয়ে মাতৃনাম উচ্চারণ করছিলেন মৃদুভাবে। ওষ্ঠদুটি মৃদু কম্পিত হচ্ছিল কেবল। যুবাটি নগ্নপদে প্রবেশ অগ্রসর হয় রোগশয্যার সামনে।
হঠাৎই মাথার টুপিটি খুলে সে লুটিয়ে পড়ে শ্রীচরণকমলে। মাথার বাঁধনমুক্ত কেশরাজির কোমল স্পর্শে প্রণম্যের অনবগত থাকে না ভক্তের পরিচয়। মৃদুহাসিতে ‘চৈতন্য’ সম্বোধনে কাছে ডেকে নেন ছদ্মবেশী বিনোদিনী দাসীকে।
বালকের হাসি জেগে থাকে তাঁর স্মিত রোগজর্জর মুখমন্ডলে। খুব আনন্দলাভ করেন এই পুরুষ ছদ্মবেশী নারীটির রহস্য উন্মোচনে। মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখেন পরম কারুণিক। গত ইংরাজি নববর্ষের দিনে তিনি কল্পতরুরূপে পূর্ণ করেছেন বহুভক্তের মনোকামনা। তিনি জানেন যে এই নারীটি সেই তরুমূলে অনুপস্হিত ছিল না।
এক সামান্য বারাঙ্গনার জীবন থেকে মহানটী হয়েছেন বিনোদিনী আত্মপ্রতিষ্ঠার গুরুতর মূল্যে।’চৈতন্যলীলা’ নাটকের শেষে সাজঘরে এই মহামানব তার সমগ্র জীবনের ক্লেদমুক্তি ঘটিয়ে দান করেছেন অপার চৈতন্যের আনন্দ। যিনি অপার অনন্তের আলো নিয়ে নিকটে এসেছেন, সেই পরমানন্দ মহাকারুণিকের কাছে জাগতিক বিষয়বাসনা তুচ্ছ হয়ে যায়, এই বোধের নবজন্ম হয়েছে তার। কিছুদিনের মধ্যেই সে স্হির করেছে রঙ্গমঞ্চ থেকে অবসৃত হওয়ার।
……..
তাঁর সাথে হয়তো তার এই শেষ দেখা। চোখের জলে ধুইয়ে দেন তাঁর চরণদ্বয়।
দেবসন্তানটিও অশ্রুমুগ্ধ হন। কম্পিত কন্ঠে রামকৃষ্ণ আবদার করে বলেন যে যাবার কালে চৈতন্যকে না চিনলে হবে কি করে…।
সেদিনের গীত একটি গানের যাচনা তাঁর কন্ঠে।
‘আমি ভবে একা দাও যে দেখা/প্রাণসখা রাখ পায়ে/ হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায়….’
ভক্ত ও ভগবান একই সঙ্গে অশ্রুস্নান করেন। বাতায়ন থেকে এই অনাবিল সুরধারা প্লাবিত করে আবিশ্ব চরাচর।দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় এখন ভাঁটার টান,লীলাসংবরণ যে সন্নিকটেই।
–~০০০XX০০০~–