“অধিকার”
✍ সলিল চক্রবর্ত্তী
“প্রয়োজন পড়লে আমি সুপ্রিম কোর্ট পযর্ন্ত যাব। দেখি সরকার কি করে আমার বাগান অধিগ্রহণ করে। আর ক্ষতিপূরণ ? ক্ষতিপূরণ দিলেই কি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে!” কথাগুলি ফাইল ঘাটতে ঘাটতে উচ্চস্বরে সামনে বসা পরিবেশবিদ সুভাষ পাল, অ্যাডভোকেট সোমনাথ দে, সমাজ কর্মী নিশীথ অধিকারীদের সাথে বলে চলেন রঞ্জিত চক্রবর্ত্তী।যাকে নিন্দুকরা ব্যাঙ্গ করে বলে চলেন ‘উদ্ভিদ চক্রবর্ত্তী’।
যে বাগানটি নিয়ে এত কোর্ট কাছারি আমরা সেই বাগানের ইতিহাস একটু জেনে নেই —
রঞ্জিত চক্রবর্ত্তীর দাদুর বাবা স্বর্গীয় শরৎচন্দ্র চক্রবর্ত্তী ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের আমিন। প্রখর বুদ্ধি ও দূরদর্শী সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ১৯৩০ সাল নাগাদ একবার ওনাকে কোলকাতার উপকণ্ঠে এক মামলাকৃত বাগান জরিপের কাজে যেতে হয়। উনি বাগানে গিয়ে দেখেন – বিঘা কুড়ি জমির উপর বাগান
আম, জাম,কাঁঠাল, বাতাবী লেবু, পেয়ারা, জামরুল, এছাড়াও শাল, সেগুন, মেহগিনি ইত্যাদি সমস্ত গাছ-ই বতর্মান। বিরাট বিরাট ‘সারি’ পূরনো গাছের জঙ্গল। এন্তাজ আলি নামে এক মুসলিম বৃদ্ধির শখের বাগান। তিনি বাগানটিকে আর অখণ্ড রাখতে পারছেন না কারন তার শরিকদের সাথে মামলা মোকদ্দমার কারনে বাগানটা টুকরো টুকরো হবার জোগাড় হয়েছে। বৃদ্ধ শরৎ বাবুকে বলেন – “বাবু ওরা টাকার পিশাচ, টাকা পেলে ভাগ ছেড়ে দেবে। কিন্তু আমি গরিব মানুষ অত টাকা কোথায় পাব বলুন যে ওদের ভাগের টাকা দেব। বিক্রি যে করব, এত বড় বাগান কে নেবে ? তবে বাবু কেউ যদি নিতে পারত আর বাগানটাকে রক্ষা করত তাতে তার লোকসান হত না। সারাবছর ফল ফলাদি থেকে একটা ভাল রোজগার হয়। সারি পুরনো গাছ আছে প্রচুর আর কাঠের যা দাম কিন্তু কে নেবে জঙ্গলের মধ্যে এত বড় জমি ?
শরৎবাবু অনেক হিসেব বিবেচনা করে কিছু ধারদেনা করে বৃদ্ধের পৈতৃক বাগানটি পনেরো হাজার টাকায় কিনে নিলেন। জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার পর রেজিস্ট্রি অফিসে এন্তাজ আলি শরৎবাবুর হাত ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন “বাবু, এ আমার বড় শখের বাগান। কিনেছি না ভেবে ভাববেন দেখাশুনো করার জন্য নিয়েছেন। কত পাখি এই বাগানের গাছে আশ্রয় নেয়। এই বাগানের গাছে ফল খেয়ে বেচে থাকে। কত ছোট ছোট জন্তু জানোয়ার এই বাগানে চরে বেড়ায় তাদের কথা না হয় একটু ভাববেন।” শরৎবাবুও তাকে বাগান রক্ষা করার মৃদু প্রতিশ্রুতি দেন। তখন বৃদ্ধ আশ্বস্থ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বাড়ির পথে পা বাড়ান।
শরৎবাবু অর্থশালী মানুষ হলেও পনেরো হাজার টাকায় জমিটা কিনে তিনি বেশ কিছুটা ঋণগ্রস্থ হলেন তো বটেই তিনি সমস্যায়ও পড়লেন। আলগা জমি, মাপ ঝোপ করে অন্তত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা ভাবলেন। তিনি ঠিক করলেন কিছু পুরনো সারি গাছ বেচে দেবেন তাতে অনেকটাই সুরাহা হবে।
কাঠুরে এসে গাছ কাটা শুরু করেছে। বেশ কিছুদিন ধরে মোটা সারি গাছগুলো কাটার কর্মযঞ্জ চলছে। শরৎবাবু রোজ বাগানে আসেন না। বছর পচিশের ছেলে বাদলবাবুই দেখাশুনা করেন। অবসরে একদিন শরৎবাবু বাগানে এলেন। তখন গাছ কাটার কাজ চলছে। কুড়ল দিয়ে যখন গাছের বড় বড় ডাল গুলো কাটা হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় গাছের ডাল থেকে একটা পাখির বাসা নিচে পড়ে যায়। যাতে দুটো পালকহীন সদ্য ডিমফোটা পাখির বাচ্চা ছিল। পড়বি তো পড় একেবারে শরৎবাবুর পায়ের কাছে। বাচ্চা গুলো উচু গাছ থেকে পড়ে ফেটে রক্তাত্ত হয়ে মারা যায়। শরৎবাবু ঐ দৃশ্য দেখে কয়েক মুহুর্ত বাকরুদ্ধ হয়ে যান। মনে পড়ে যায় বৃদ্ধ এন্তাজ আলির কথাগুলো। তার সাথে পাখির বাচ্চাগুলোর মা, বাবা ও সঙ্গি-সাথী পাখিগুলোর করুন কলরব, মুহুর্তে শরৎবাবুর মনে একটা পরিবর্তন এনে দেয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটা বন্ধ করে দিলেন। পরে বাগানটি কাঁটাতারের বেড়া দিলেন। শরৎবাবু মাঝে মাঝে বাগান পরিদর্শনে আসতেন। তার অনুমতি ছাড়া বাগানের একটি পাতাও ছেড়া যেত না।
১৯৪৭ -৪৮ সাল, ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পর পূর্ববঙ্গ থেকে কাতারে কাতারে মানুষ পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিল। প্রথমে শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। তারপর সরকারের পূনর্বাসনের অপেক্ষাতে না থেকে জলাজমি, খাসজমি দখল করে বাড়ি ঘর বানিয়ে কলোনি গড়ে তুলল। বাদলবাবু তখন ওকালতি পাশ করে প্র্যাকটিস করছেন। শরৎবাবু বাদলবাবুর কাছে আগামী দিনের পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটা চিত্র তুলে ধরলেন এবং বৃদ্ধ এন্তাজ আলির কাছে বাগান রক্ষা করার প্রতিশ্রুতির কথা বাদলবাবুকে বললেন। বোঝালেন চারদিকে এত বসতি গড়ে উঠলে প্রকৃতির দান পশুপাখি, স্বাভাবিক উদ্ভিদ কোথায় থাকবে ? বাদলবাবু যেন তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে এই বাগান রক্ষা করার বীজ বপন করে যান।
১৯৭০ -৭১ সাল, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌছাল। এর মধ্যে পাক ফৌজির অত্যাচারে পূর্ববঙ্গে অবস্তিত হিন্দুদের অবস্থাও চরম পর্যায়ে পৌছালো। ভারত-পাক যুদ্ধ দোরগোড়ায় এসে দাড়াল। পূর্ববঙ্গে বসবাসস্থিত হিন্দুরা শরনার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরা ও অসমে আশ্রয় নিল। ভারতীয় রেললাইন, রেল প্লাটফর্ম পরিত্যক্ত জলাজমি শরনার্থীদের আশ্রয়স্থল হল। সরকারী খাল, রেললাইনের ধারের গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে বসতি গড়ে উঠল। বাদলবাবু বুঝতে পারলেন এই জনজোয়ার কোথায় গিয়ে ধাক্কা মারতে পারে। স্বাধীন ভারতে দিনে দিনে কলকারখানা গড়ে উঠছে, আর বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে উঠছে। এতে বাতাসে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ যেমন বেড়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি অক্সিজেনের পরিমাণও কমছে। বিশুদ্ধ বাতাস দিনে দিনে সমতা হারিয়ে ফেলছে। তাছাড়া আগের মতো এখন আর পাখির কলতান শোনা যায় না। তারা হয়ত বিরল প্রজাতিভুক্ত হয়ে পড়ছে। বাবার কথাগুলি মনে করে বাদলবাবু খুব চিহ্নিত হয়ে পড়লেন। ছুটির দিনে এক বিকেলে বাদলবাবু আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কিছু বইপত্র ঘাটাঘাটি করছিলেন। হঠাৎ একটি লেখার উপর নজর পড়তে তিনি নড়েচড়ে বসলেন।
শ্রীলঙ্কায় এন. রঙ্গনাথন নামে এক ভদ্রলোকের বাড়ির ঘটনা। তিনি একজন পরিবেশবিদ। তাছাড়া তিনি পশুপ্রেমীও বটে। একদিন বাড়িতে তার বছর পনেরোর ছেলেটি একটা টিকটিকিকে লাঠির আঘাতে মেরে ফেলে। রঙ্গনাথন বাবু ব্যাপারটি জানতে পারে ভীষন ব্যাথিত হন এবং ছেলে সহ বাড়ির সকলকে ডেকে বলেন “দ্যেখো, এই পৃথিবীতে আমরাও জীব হিসাবে জন্মেছি। ওই টিকটিকিটাও জীব হিসাবে জন্মেছে। দুজনেরই এই পৃথিবীতে বাঁচবার সমান অধিকার আছে। আমরা উন্নত জীব তাই বাসস্থান তৈরী করে বাস করি। ওরা নিকৃষ্ট জীব, পারেনা – তাই বসবাসের উপযুক্ত স্থল বেছে ওরা বাস করে। আমাদের যেমন কেউ ইচ্ছে করলেই তাড়াতে বা মেরে ফেলতে পারেনা। তেমন আমরাও তা ওদের সাথে এমন করতে পারিনা। আমাদের বাসস্থানের একটা দলিল আছে। তাই আমাদের কেউ স্পর্শ করতে পারেনা। ঠিক তেমন ওদের যদি দলিল থাকত? আমরা কি পারতাম ওদের মেরে ফেলতে বা তাড়িয়ে দিতে?”
ঘটনাটা পড়ার পরে বাদলবাবুর মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। উনি ভাবলেন “আমার বয়স হয়েছে, আজ আছি কাল নেই। আমাকে কিছু একটা করতেই হবে”। বাদল চক্রবর্ত্তীর ছেলে অমল চক্রবর্ত্তী। উনি সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। পাশাপাশি সমাজ কর্মী, যুক্তিবাদি মানুষ। দাদু ও বাবার চিন্তা ভাবনাতে অনুপ্রাণিত। শিক্ষিত, মার্জিত, অর্থশালী পরিবার বলে এলাকাতে নাম ডাক তো আছেই রাজনৈতিক নেতারাও কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। বাদলবাবু একদিন অমলবাবুকে ডেকে তার হাতে একটি সিল করা ফাইল দিয়ে বলেন “অমল, আমার কবে কি হয়ে যায়, মানুষের কথা তো কিছুই বলা যায় না। তুমি এই ফাইলটি তোমার কাছে সযত্নে গচ্ছিত রাখ। ফাইলটি কেউ কখনও সিল খুলে দেখবেনা। যদি কখনো এই বাগান নিয়ে কোর্ট-কাছারি হয় তবে একমাত্র বিচারপতি আদালতে এই ফাইল খুলে দেখতে পারেন। তুমি বা তোমার বংশধরেরা কেউ খুলতে পারবে না। শুধু কটি কথা বলি শোনো এবং কথাগুলি তুমি তোমার উত্তরসুরিদের বুঝিয়ে বলবে। বাগান রক্ষা করা নিয়ে মুসলিম বৃদ্ধকে তোমার দাদু যে কথা দিয়েছিলেন, তা আমারা রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর। বাগান রক্ষা করতে একটা খরচ হয় বটে কিন্তু সে টাকার সমস্তটাই বাগানের ফল-মূল বিক্রি থেকে আসে। তাছাড়া আমি চারধার উচু পাচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছি। ফলে বাইরের সমস্যা আর থাকবে না।
বাগান সংলগ্ন এলাকা এখন আর ফাঁকা নেই। একাত্তর-বাহাত্তরে জলা জমি পরিষ্কার করে যেসব টিন-টালির বাড়ি তৈরী হয়েছিল, আজ দিনে দিনে সেসব অট্টালিকাতে পরিনত হয়েছে, মধ্যে শুধু এই কুড়ি বিঘার বাগান ছাড়া। দালালচক্র অমলবাবুর মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ক্রমান্বয়ে কাঠা প্রতি দাম বাড়িয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসে। অমলবাবু একটাই বক্তব্য “এই সম্পত্তি তাদের যেমন কেনা নয়, তেমনি বিক্রির ও অধিকার তাদের নেই। শুধু রক্ষা করার দায়িত্ব তারা বংশ পরম্পরায় বহন করে চলেছে।” রাজনৈতিক নেতাদেরও ঐ বাগানের উপর নজর কম ছিলনা। তারা ঠাড়ে ঠোড়ে অমলবাবুকে বোঝাতেন, এই বাগান যদি উনি বিক্রয় করে সুন্দরবন লাগোয়া জমি কিনতেন, তাহলে অন্তত একশো বিঘা জমি পেতেন এবং তাতে বাগান কেন জঙ্গল তৈরী হয়ে যেত। প্রচুর পশুপাখির আশ্রয়স্থল হত। অমলবাবু যুক্তিবাদি মানুষ। উনি সব শুনে মুচকি হেসে বলেন “আপনারা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সেই জঙ্গলে তো ঐ এলাকার পশুপাখি আশ্রয় নেবে। আর এই জঙ্গলের পশুপাখির কী হবে ? তাদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কে নেবে ? তাছাড়া এই বাগানের গাছপালা যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে তা বন্ধ হয়ে গেলে এলাকার পরিবেশও তো দূষিত হয়ে যাবে। বাগানটা থাক না – এই কংক্রিটের মরুভূমিতে একটুকরো মরুদ্যান হয়ে।”
অমলবাবুর ছেলে রঞ্জিত চক্রবর্ত্তী, যিনি সমাজে উদ্ভিদ চক্রবর্ত্তী নামে খ্যাত। এনার ধ্যান জ্ঞান-ই পরিবেশ নিয়ে। নিজের বাগান ব্যাতিত পার্শবতী এলাকাতেও এনার বিরাট অ্যাক্টিভিটিস। ভীষন কালচারাল মানুষ। পরিবেশ বাঁচানো নিয়ে এনার মাথায় সবসময় ইনোভেটিভ প্ল্যান তৈরী হয়। ওনাদের সংগঠনের আর একজন অ্যাক্টিভ সভ্য হলেন প্রেমাঙ্কুর মালাকার। যার গাছ এবং পরিবেশ নিয়ে শ্লোগান সরকারি প্রতিষ্ঠানেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি স্লোগান আজকাল খুব সারা ফেলে দিয়েছে।
১) বৃক্ষরোপণ, বনের সৃজন, / বনের বিষ্ফোরণ! /
সুজলা ধরণী, তবেই বাঁচবে, / কমে যাবে প্রদূষণ। /
২) বৃক্ষনিধন, গড়ে আবাসন, / শহরের গ্রাসে গ্রাম; /
এমন চললে, দূষণের বিষে, / ভরে যাবে ধরাধাম! /
৩) দুষণের ফলে, বিপন্ন আজ, / পৃথিবীর পরিবেশ; /
বহু প্রাণী আর কীট পতঙ্গ, / চিরতরে হলো শেষ! /
৪) ধ্বংসের থেকে, বাঁচাও ধরণী / এখনো সময় আছে; /
এসো একজোটে, ধরণী ভরাই / সবুজাভ গাছে গাছে! /
শিশু দিবসে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে মাষ্টারদের বোঝান তারা যেন ছাত্রদের পেন, লজেন্স না দিয়ে একটা করে গাছের চারা দিলে পরিবেশ বাঁচবে। কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুরষ্কার হিসাবে চারাগাছ উপহার দিতে উৎসাহিত করেন। ছোটদের অঙ্কন প্রতিযোগিতাতেও উনি চারাগাছ বিতরনে উৎসাহ দেন। তাতে তাদের শিশুবয়স থেকে মনে পরিবেশ সচেতনতা আসবে। রঞ্জিত বাবুর একটি সংগঠনও আছে যার সদস্য – পরিবেশবিদ সুভাষ পাল, সমাজকর্মী নিশিথ অধিকারী ও অ্যাডভোকেট সোমনাথ দে-র মতো নামি দামি লোক। ঠিক এই সময় ওনারা যে প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত সেটা হল বিবাহ বাড়িতে বরযাত্রী বা কনেযাত্রীর হাতে গোলাপের জায়গায় চারাগাছ উপহার দেওয়া। আবার কোন দম্পতির কন্যাসন্তান হলে তাদেরকে মেহগনি গাছ উপহার দেওয়া হয়। যাতে ২৫ বছর পর বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে দিতে টাকার অভাব না হয়। রঞ্জিত বাবুরা এই যে এত চারাগাছ উপহার দেন তা সম্পূর্ণই বিনামূল্যে সংগঠন থেকে দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকার থেকে প্রচুর গাছ সংগঠন বিনামূল্যে পায়। রঞ্জিত বাবুদের এই সংগঠনের একটি বিরোধী পক্ষ আছে। যারা দালালি করে সুবিধা করতে পারেনি, প্রোমোটিং করে সুবিধা করতে পারেনি। আর আছে এদের মদত দাতা কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি। রঞ্জিত বাবুদের বাগানের বতর্মান মূল্য পঁচিশ কোটি টাকার উপর। চাক ভরা মধু, মৌ-চোররা চাক না ভাঙতে পারলে গাত্র দাহ তো হবেই। কুড়ি বিঘা বাগানের উপর যাদের নজর তারা সবসময় ঐ বাগানের ক্ষতির চিন্তা করবে, এটা তো স্বাভাবিক। কখনও কখনও বিড়ালের ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে। কল্যানী হাইওয়ে এগিয়ে আসছে, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে স্পর্শ করবে বলে। ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাস্তু জমি কিনে নেওয়া হচ্ছে। সড়ক এগোচ্ছে আর সেখানে যাদের জমি, বাড়ি পড়ছে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে তারা জমি ছেড়ে দিচ্ছেন। যাদের রাস্তার মধ্যে জমি পড়ছেনা তাদেরতো আরও অর্থনৈতিক সুবিধা। কারন জমির দাম লাফাতে লাফাতে বাড়ছে। প্রমোটার চক্র দালাল চক্র যথেষ্ট সক্রিয়। বাধ সাধলো কুড়ি বিঘার বাগান। ম্যাপ অনুযায়ী রাস্তা এগোবে, বাগানের ঠিক মাঝ বরাবর। বতর্মান মালিক রঞ্জিত বাবুর কাছে জমি অধিগ্রহণের নোটিশ আসলো।
সুবিধাবাদিরা মজা দেখতে থাকে। তারা এই সুদিনের আশায় অপেক্ষা করছিল। অনেক চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেনি। এবার কী হবে ? হাইরোড়ের কাজ, সরকার অধিগ্রহণ করলে তো জমি দিতেই হবে। তিনশো ফুটের মত চওড়া জমি বাগানের মাঝ বরাবর চলে গেলে বাগান দু টুকরো হয়ে যাবে। তারপর বাধ্য হয়েই জমি বিলি বন্টন করতে হবে। কিন্তু রঞ্জিত বাবুর এক রা। বাগান উনি দেবেন না। পরিচিত মহলে অনেক আলাপ আলোচনা করে বন্ধু অ্যাডভোকেট সোমনাথ দে-কে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কেস করলেন। ন্যাশানাল হাইওয়ে অথোরিটিও পিছিয়ে পড়া সংস্থা নয়। কারন জনগণের কল্যাণমূলক কাজে সরকার যে কোন সময় ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। এদিকে রঞ্জিত বাবুদের সই সংগ্রহের কাজ চলছে। কিন্তু বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা বার করার বিপক্ষে যত সই পাওয়া গেছে, পক্ষে তার থেকেও অনেক বেশি। কারন এলাকার উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।যখন কোর্টে দুই পক্ষের না দেওয়া আর দেওয়ার যুক্তির দড়ি টানাটানি চলছে। তখনই একদিন রঞ্জিতবাবু গন্যমান্য ব্যাক্তিদের ডাকলেন। এবং দাদুর দেওয়া সিল করা ফাইলটি অ্যাডভোকেট সোমনাথ দে-কে দেখালেন। সোমনাথ বাবু আগেই শুনেছেন বাদল বাবু এডভোকেট ছিলেন এবং একটা সিল করা ফাইল বংশ পরম্পরায় গচ্ছিত রাখতে বলে গেছেন। তিনি অনুমান করলেন এই ফাইলটির মধ্যে নিশ্চয় কোন সমাধান সূত্র গচ্ছিত আছে। তা না হলে কেন এটি সিল করা রয়েছে এবং অপারক পরিস্থিতিতে কেনই বা কোর্টের বিচারপতির হাতে তুলে দিতে বলা হবে। উনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর উপস্থিত সভ্যদের বিশেষত রঞ্জিতবাবুকে আশ্বস্ত করে বললেন – “দেখি, মনে হচ্ছে একটা সমাধান সূত্র বার হবে।”
পরের শুনানিতে কোর্ট ভর্তি লোক। তিল ধারনের জায়গা নেই। কোর্টের বাইরে সংবাদ বিভাগের লোক ভিড় করে আছে। আজকের রায় পশ্চিমবঙ্গের বড় খবর। দালাল ও প্রমোটার চক্র লাড্ডু নিয়ে রেডি। জাতীয় সড়ক পরিবহণ দপ্তরের পক্ষে রায় গেলে ঐ লাড্ডু বিতরণ হবে। একই সাথে আবার রঞ্জিতবাবুর বাড়িতে হোম-যজ্ঞ চলছে। কারন ঈশ্বর যাতে একশো বছরের পূরনো বাগানটিকে রক্ষা করেন।
বিচারকের সামনে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছুক্ষণ প্রশ্নের তির এবং উত্তরের ঢাল ছোড়াছুড়ি পর্ব চলল। তারপর অ্যাডভোকেট সোমনাথ দে বললেন “হুজুর, এই বাগান বহু বছরের পুরনো। চক্রবর্ত্তী পরিবারের ১৯৩০ সালে এই আদর্শ বাগানটি কেনেন। আদর্শ বাগান বলছি এই কারনে, তখনই অর্থাৎ ১৯৩০ সালে বাগানটিতে বহু পুরনো গাছ ছিল। চক্রবর্ত্তী পরিবার ব্যক্তিগত স্বাথের কথা না ভেবে বংশ পরম্পরায় প্রায় ১০০ বছরের এই বাগান রক্ষা করে আসছে। হুজুর, রঞ্জিতবাবুর দাদু স্বর্গীয় বাদল চক্রবর্ত্তী একটি সিল করা ফাইল রেখে বলে গেছেন, যদি কখনো এই বাগান নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয় সেইদিন বিচারপতি একমাত্র এটি খুলে দেখতে পারবেন এই বলে ফাইলটি পেশকারের হাতে দিলেন। পেশকার ফাইলটি নিয়ে বিচারকের হাতে দিলেন। বিচারক অতি সন্তর্পনে গালা দিয়ে সিল করা ফাইলটি খুলতে থাকলেন। নিস্তব্ধ কোর্ট কক্ষে যেন একটি পিন পড়লে আওয়াজ পাওয়া যাবে। সবাই নিশ্চুপ, উদ্বিগ্ন, কী আছে ফাইলে তা জানার আগ্রহ কোর্ট মধ্যস্থ সকলের। এমনকি স্বয়ং রঞ্জিতবাবুরও।
বিচারক ফাইল খুলে দেখলেন তাতে একটি দলিল আছে। যেটি তৈরী হয়েছে ১৯৬৩ সালে। একটি ট্রাস্টি দলিল। দলিলে যা বলা হয়েছে, সেটি হল ঐ কুড়ি বিঘা বাগানটি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হল ঐ বাগানের প্রতিটি গাছপালা, পশু পাখিদের। তারাও বংশ পরম্পরায় ঔ বাগান ভোগ দখল করবে। যেহেতু তাদের রক্ষা করার ক্ষমতা নেই। তাই চক্রবর্ত্তী পরিবার বংশ পরম্পরায় এটি দেখভাল করবে। গাছের ফল ফলাদির উপর সম্পূর্ণ অধিকার তাদের থাকবে। কিন্তু কোন জীবন্ত গাছ কাটার অধিকার তাদের থাকবে না। স্বাভাবিক ভাবেই মৃত গাছ কেটে নিতে পারবে। চক্রবর্ত্তী পরিবারের যতই প্রয়োজন পড়ুক না কেন ভোগ দখল করে থাকতে পারবে কিন্তু বিক্রয় করতে পারবেনা। কারন সম্পত্তি আর তাদের থাকলোনা শুধু রক্ষা করার দায়িত্ব থাকলো। যদি বংশধরেরা কেউ কখনো রক্ষা করতে অপারগ হয়, তবে ‘রামকৃষ্ণ মিসন’ অথবা ‘ভারত সেবাশ্রম সংঘ’ অথবা ‘সরকার’-এর হাতে অর্পন করতে পারবে। অবশ্যই তিন সংস্থার মধ্যে যারা বাগান রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেবে। বিচারক মুসলিম বৃদ্ধের জরাজীর্ণ দলিলটিও ফাইলের মধ্যে দেখলেন। যেটি রেজিস্ট্রি হয়েছিল ১৮৮২ সালে। বিচারক ভাবলেন ১৮৮২ সালের বাগান। এক গরীব বৃদ্ধ অতি কষ্ঠে রক্ষা করেছেন। তারপর বংশ পরম্পরায় চক্রবর্ত্তী পরিবার অর্থ লালসায় না গিয়ে বাগানটিকে রক্ষা করে চলেছেন। তাহলে সুযোগ পেয়ে কি তারও উচিত নয় যে বাগানটি যাতে রক্ষা হয় সে ব্যবস্থা করার।
বিচারক ফাইল থেকে মাথা তুলতেই আবার গুঞ্জন শুর হল। সবাই জানতে চায় গোপন ফাইলে কী বলা আছে! বিচারক হাতুরি ঠুকে কক্ষ মধ্যস্থ কৌতুহলী জনগনকে শান্ত করে বলতে শুরু করলেন “এই বাগন প্রায় ১৪০ বছরের পুরনো। ১৯৩০ সাল পযর্ন্ত এন্তাজ আলি নামে এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ছিল। তারপর শরৎচন্দ্র চক্রবর্ত্তী কিনে নিয়ে বংশ পরম্পরায় রক্ষা করে চলেছেন। শরৎবাবুর ছেলে বাদলবাবু বিচক্ষন মানুষ ছিলেন। উনি বুঝেছিলেন এই বাগান কালের নিয়মে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই যাতে বাগান বিক্রয়ের সুযোগ কেউ না পায় তাই তিনি বাগানটি, বাগানস্থিত গাছপালা ও পশুপাখির নামে রেজিস্ট্রি করে একটা ট্রাস্ট করে যান। যেটা বংশ পরম্পরায় চক্রবর্ত্তী পরিবার দেখভাল করবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ। কারন এতে ঐ এলাকার বাস্তুতন্ত্র রক্ষা হচ্ছে। সেইজন্য এই বাগানের অধিকার শুধুমাত্র বাগানের গাছপালা ও পশুপাখিদের। কোন প্রচেষ্টাই এই বাগানের পরিবেশ নষ্ট করতে পারবেনা। এটা ঠিক যে জাতীয় সড়ক একটি জনকল্যানমূলক কাজ। তাই বলে একটি জনকল্যাণ মূলক কাজকে ধ্বংস করে আরেকটি জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায় না। আমি আশা করব সরকার পক্ষ এটা বুঝবে। এবং সমস্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে বাদি-বিবাদি দের প্রশ্ন-উত্তর শোনার পর আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, ঐ বাগান যেমন আছে তেমনই থাকবে। প্রয়োজনে সরকারী বনদপ্তর বাগান অধিগ্রহণ করে আরও সুরক্ষা দিতে পারে। উইলে তেমনই উল্লেখ আছে। আর কল্যানী হাইওয়ে বাগান থেকে অন্তত হাজার ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা হবে কারন পরিবেশের স্বার্থে তারও প্রয়োজন আছে। আদালত এখানেই মুলতুবি ঘোষনা করা হল।”
রায় শোনার পর আদালত কক্ষে খুশি এবং হতাশার গুঞ্জন শুরু হল। সেই সাথে আস্তে আস্তে কক্ষ মধ্যস্থ মানুষজন একে একে বেরিয়ে যেতে থাকল। ঠিক সেইসময় সুভাষ বাবু, সোমনাথ দে ও নিশিথ অধিকারীদের নজর পড়ল রঞ্জিত বাবু একটি চেয়ারে বসে পক্ষে রায় শোনার আনন্দে কেঁদে চলেছেন। আজ স্বার্থক হল তার ব্যাঙ্গক্তি নাম “উদ্ভিদ চক্রবর্ত্তী”।
তথ্য সহযোগিতায় :- দেবব্রত গুহ
–~০০০XX০০০~–