পাউরুটি
নিলয় বরণ সোম
সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছোট ছোট লাল নীল চৌখুপী , তেলতেলে মোড়ক। এই হচ্ছে আমাদের ছোটবেলার ছবি পাউরুটির, অর্থাৎ এর ‘স্লাইসড ‘ রূপের। পরিকল্পনা ও রূপায়ণে ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পাড়ায় পাড়ায় তখন স্থানীয় বেকারী ছেয়ে যায় নি এত। স্লাইস না করা লোফ , সেও কি ব্রিটানিয়া পরবর্তী জমানার ? বলতে পারবো না।আমাদের ছোটবেলাতে স্কুলের টিফিন হিসেবেও জ্যাম পাউরুটি বা পাউরুটি মাখন চলত, তবে এসব এলেবেলে টিফিন এখন চলে না , নিতান্ত ব্রেড পাকোড়া বা স্যান্ডুইচ না হলে কোন জাতের টিফিন হয় না বোধহয় এখন।
তবে হোল হুইট ব্রেড, মাল্টি গ্রেন ব্রেড, এসব বাজারে এসেছে অনেক পরে। তেকোনা আকৃতির ব্রেড বা বিশেষ ভাবে লেখা স্যান্ডুইচ ব্রেডও অনেক পরের আবিষ্কার।ক্যালোরি সচেতন সুন্দরীরা সাদা রুটির সঙ্গ ছেড়ে মজেছেন ব্রাউন বা মাল্টি গ্রেনে।আরেকটি আশ্চর্যের বিষয় হল, গ্রামে লেখা থাকলেও জনগণ এখনো পাউন্ডের মাপে পাউরুটি কেনা বেচা করেন -এও এক ব্রিটিশ ঐতিহ্য!
গার্লিক ব্রেড এখনো কিন্তু কিছুটা উচ্চকোটিতেই অবস্থান করছে -সাধারণ্যে এর জনপ্রিয়তা এখনো নেই , তবে কোনদিন হবে না তা বলা যায় না। তবে দিনের পর দিন মূলত খরিদ্দারহীন হয়ে ফ্রেঞ্চ লোফ বা এই জাতীয় দোকানগুলো কী করে ব্যবসা চালাচ্ছে কে জানে !
বলে রাখা ভালো , পাউরুটি কিন্তু ব্রিটিশদের হাত ধরে প্রথম ভারতে আসে নি। প্রথম সে আসে পর্তুগীজদের হাত ধরে ,পর্তুগীজ’pao’ শব্দটির মানেও নাকি রুটি !তবে ব্রিটিশ আমলেই এর প্রবেশ ভারতীয় খাদ্যতালিকায়। তারপর কালের নিয়মে একে আমরা দেশজ করে নিয়েছি।
অল্পবয়সে পড়াশুনা করার মুশকিলটা এই, এখন যখন বইয়ের ধার কাছে ঘেঁষা অনেক কমে গেছে , তখন কোন কিছু লিখতে গেলে আবছা স্মৃতির উপরই ভরসা করতে হয়, যদি না গুগুল বাবা সহায় হোন। সেরকম একটি তথ্য,কবে কোথায় পড়েছি মনে নেই। তথ্যটি এই, আমাদের দেশে পাউরুটি প্রথম দিকে ‘ম্লেচ্ছদের খাবার’ বলেই গণ্য হত।ইয়াং বেঙ্গলের এক তরুণ তুর্কী নাকি সাহস করে একবার পাউরুটিতে কামড় বসিয়েছিলেন, তারপর তার একঘরে হবার জোগাড়-সমাজপতিরা তার এই ‘লোভের’ জন্য তাকে যারপরনাই তিরস্কার করেন।এখন এ কথা শুনলে হাসি পেলেও ইতিহাস এমনই।তেমনি আমাদের ছোটবেলা অব্দি ,হয়ত বা এখনো,অনেকের স্থির বিশ্বাস, পাউরুটি একটি অস্বাস্থকর খাদ্য,কারণ পা দিয়ে ময়দা দলাই মলাই করে এটি তৈরী করা হয়!
পাউরুটির দেশি আত্মীকরণের পরিচয় পাউরুটি কিভাবে খাওয়া হচ্ছে সে দিয়েই বোঝা যায়। সুকুমার রায় যদিও পাউরুটি আর ঝোলাগুড়কে সবথেকে ভাল খাবার বলে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন, ভারতীয়দের বা বাঙালীদের টেবিলে জনপ্রিয় হচ্ছে পাউরুটি-মাখন। সঙ্গে কলা বা ডিম্ সেদ্ধ থাকলে কথাই নেই।শীতকালে পিকনিক পার্টি গুলির স্ট্যান্ডার্ড জলখাবার এই , কর্মকর্তারা আরেকটু খাদ্যরসিক হলে সঙ্গে জয়নগরের মোয়া কী সন্দেশ জুটে যেতে পারে সঙ্গে। অবশ্য মাখনের বদলে পাউরুটি জ্যামও যথেষ্ট জনপ্রিয় , যদি ছোটবেলায় জেলি-পাউরুটি কথাটা বেশি চালু ছিল। জ্যাম জেলি আর মার্মালেডের মধ্যে কিছু একটা পার্থক্য আছে, আমার মনে থাকে না সে সব।
যৌথ পরিবারে অনেক ক্ষেত্রে জলখাবার হিসেবে ঢালাও ভাবে পাউরুটি মাখন সুবিধাজনক বলে গণ্য ছিল। দুটি পাউরুটির মাঝখানে মাখনের পরিমান নিয়ে একরকম রাজনীতি চলত।পরিবারের কর্তা ও উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের পাউরুটিতে আঙুলের এক কড়া, পরের পর্যায়ের পুরুষদের ও শিশুদের আরেকটু কম আর মহিলাদের কপালে হয়ত ছুরি বা চামচ পুছে যেটুকু মাখন উঠে আসত, সেটুকুই বরাদ্দ হত।নস্টালজিয়ার চোটে যৌথ পরিবারের মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে এই দিকগুলো অনেক সময় আমরা ভুলে যাই।
তবে পাউরুটির সদ্ব্যবহার সবথেকে বেশি বোধহয় কলকাতার অফিসপাড়াগুলোতে। রাস্তার ধারের ছোট ছোট স্টল গুলোতে কী অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় লোফ কেটে , গোলমরিচ বা চিনি সহযোগে বাটার টোস্ট অথবা মাখনের সঙ্গে একচিলতে ওমলেট দিয়ে সার্বজনীন টিফিন তৈরী করা হয়, সে এক অবাক কান্ড।হাইজিন সম্বন্ধে অতি সতর্ক হয়ে বেড়ে ওঠা আমার ছেলেকে তার ছোটবেলায় একবার পরিচিত করেছিলাম এই খাবারটির সঙ্গে। প্রাথমিক কুন্ঠা কাটিয়ে সে একবার কামড় বসিয়েই এই খাবারটির পরমস্বাদ উপভোগ করেছিল, তার স্মৃতিতে সেটি এখনো টাটকা।
পাউরুটি দিয়ে অমৃত সদৃশ এক খাবারের হদিশ পাওয়া যায় আমার এক বন্ধুর কাছে। মূল উপাদান স্থানীয় বেকারির লোফ, আন- স্লাইসড। ঘন দুধের মধ্যে , লোফ টি ডুবিয়ে , তার মধ্যে একটি গরম জিলিপি ফেলে , ধীরে ধীরে খাওয়া নাকি অমৃতের আস্বাদ।এরকম একটি পাত্র রাখা থাকলে দেবাসুরের যুদ্ধের রি-রান নাকি সুনিশ্চিত, তার স্থির বিশ্বাস।
পাউরুটি খাওয়ার কোনো স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিউর নেই। হাত দিয়ে বা কাঁটা চামচ সহযোগে পাউরুটি মাখন বা পাউরুটি ঝোলাগুড় খাওয়া যেতে পারে। কারো কারো কাছে পাউরুটির সবথেকে মূল্যবান টুকরো হল , যাকে বলে পিঠ। একটু তেলতেলে বেশি বলেই হয়ত এর কদর বেশি !
তবে বেশ কিছু লোকের, বিশেষত মহিলাদের অনেকের অভ্যাস আছে পাউরুটির চারকোনের বর্ডারটিকে বাদ দিয়ে দেওয়ার।এই অভ্যাসটির একটি কৌতুককর উল্লেখ আছে প্রয়াত অশোক মিত্রর ‘ আপিলা চাপিলা ‘ বইটিতে। ওঁর সহধর্মিনী, অর্থাৎ গৌরী মিত্রর অভ্যাস ছিল এভাবে পাউরুটি খাবার।সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে মুম্বাই, মানে তখনকার বম্বেতে উনি এক দাদার বাড়িতে উঠেছিলেন। গৌরী দেবীর এভাবে পাউরুটি খাওয়া দেখে , মিত্র মহাশয়ের দাদা, ওঁর মতই ঠোঁটকাটা ছিলেন হয়ত , বলেছিলেন, “তোমার পাউরুটি খাওয়ার ধরণটি তো খুব রাজসিক !”
একটু হিসেবী (?) গৃহিনীরা আবার ওই বর্ডার গুলোকে ফেলে না দিয়ে একটু তেল দিয়ে মুচমুচে ভাজা করতেন , খেতে বেশ লাগে।
এবার প্রথাগত দু একটি চুটকিতে আসা যাক, অন্তর্জাল সূত্রে পাওয়া।
একবার মাঝ সমুদ্রে এক জাহাজে নাবিকরা খাবার ট্রে থেকে ব্রেড বাদে প্রতিটা খাবার বেশ তরিয়ে তরিয়ে খাচ্ছিল। যে মেস অফিসার সেদিন ব্রেডটি বানিয়েছিলেন , উনি গেলেন ক্ষেপে। জিজ্ঞাসা করে জানলেন, ব্রেডটি নাকি ভয়ানক শক্ত হয়েছে। কিন্তু উনি সেটা মানতে রাজি না , কেউ ফেসবুকে লেখার বিরুদ্ধ সমালোচনা করলেই আমরা , অর্থাৎ লেখক বা ফেখকরা রেগে যাই, উনিও রেগে গেলেন। বললেন, “এই ব্রেড যদি কলম্বাস পেতেন, দলবলশুদ্ধু সাঁটিয়ে দিতেন এটা!” একটি ফচকে ছোকরা তাতে ফুট কাটল, “তা তো বটেই , সে সময় তো ব্রেডটি বেশ টাটকাই ছিল!”
পরের চুটকিটিতে ব্রেড পার্শ্বচরিত্র।লন্ডনের উপকণ্ঠে একটি এপার্টমেন্ট। শনিবারের সকালে সোনালীচুলের বিড়ালাক্ষী ডোরা ব্রেকফাস্ট তৈরীতে ব্যস্ত , তার প্রোগ্রামার স্বামী রবার্ট এনিমেল প্ল্যানেট দেখছিল। মধু ঢালা কণ্ঠে ডোরা বলল, ” এ মা , ঘরে ব্রেড নেই তো ! লক্ষী সোনা নিচের দোকানটা থেকে একটা ব্রেড নিয়ে এস না! আর ডিম্ থাকলে, ছ’টা।” একটু গড়িমসি করে রবার্ট নীচে গেল , পাঁচ মিনিট বাদেই নাচতে নাচতে চলে এল। এবার ডোরার বিস্ময় , “একী ! ছ’টা ব্রেড নিয়ে এলে কেন?”
রবার্টের স্থিরপ্রজ্ঞ জবাব,”ওদের ষ্টকে ডিম্ আছে তো!”
আমার বন্ধুবৃত্তে প্রোগ্রামার বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রসঙ্গান্তরে যাই।
প্রাচ্যে না হোক,পাশ্চাত্যে ব্রেড কিন্তু প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাশ্চাত্যে ব্রেড (আমেরিকায় লোফ নামেই অভিহিত)ব্রেড মানে প্রধান খাদ্য, ব্রেড মানে জীবনI দীর্ঘদিন ব্রিটিশ, ওলন্দাজ বা ফ্রেঞ্চ কলোনী হিসেবে গড়ে ওঠা আফ্রিকার দেশগুলোতেও ব্রেড অন্যতম প্রধান খাদ্য।যুদ্ধ বা রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় ব্রেড অমিল হয়, রেশনিং চালু হয়। সিয়রা লিয়েন শুধু নয় , রবার্ট মুগাবের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে জিম্বাবুয়েতে ব্রেডের জন্য লম্বা লাইনের গল্প আমার শোনা।
জনের কাহিনীতে (Gospel )প্রভু যীশুর মুখ দিয়ে বলান আছে ,”‘I am the bread of life’। আমার শরণাপন্ন যে হবে, সে ক্ষুধার্ত রইবে না , তৃষ্ণায় মরবে না” কথিত আছে , যীশুর পিছনে পিছনে এক বিরাট জনতা জড় হয়েছিল। কিছু সময় বাদে প্রভু ,ফিলিপকে জিজ্ঞাসা করেন, “লোকজনকে খাওয়ানোর কী ব্যবস্থা আছে?” ফিলিপ জবাব দিয়েছিল, তাদের কাছে সবাইকে অল্প কিছু খাওয়ানোর মত টাকাও নেই।এন্ড্রু তারপর একটি ছেলেকে যীশুর কাছে নিয়ে আসে , ছেলেটির কাছে পাঁচটি ছোট রুটির টুকরো আর দুটি মাছ ছিল। ঐশ্বরিক ক্ষমতার মাধ্যমে ওটুকু খাবার দিয়েই জনতার খাবার ব্যবস্থা হয়, উচ্চারিত হয় সেই অমোঘ বাণী।
বিশ্বাসে মেলায় বস্তু , এই আপ্তবাক্যটির অন্যতম উদাহরণ এই কাহিনী, সন্দেহ নেই।
ব্রেড প্রসঙ্গে সবথেকে জনপ্রিয় গল্প বোধহয় ,”Let them eat cakes (brioches)” । উদ্ধৃতিটি ঘিরে যেটি বলা হয় ফ্রান্সের রানী, মারী আঁতোয়ানেত বলেছিলেন বলে।ষোড়শ লুইয়ের এই বিলাসী পত্নী নাকি খাদ্যসঙ্কটের সময়, বিশেষত পাউরুটির আকাল দেখা দেওয়াতে আম- আদমির জন্য এই সরল সমাধানটি দিয়েছিলেন। অনেকের মতে, কথাটি নাকি রানী বলেন নি, কারণ বাক্যটির উল্লেখ নাকি রুশোর ‘Confessions’ বইটিতে পাওয়া যায় , কোন এক রাজকন্যার উদ্ধৃতি বলে, কিন্তু বইটির রচনাকালে মারীর বয়স মাত্র নয় বছর। আসলে অন্য অনেক কিছুর মত ইতিহাসও সম্ভাব্যতার শিল্প তো বটেই, .সুতরাং, ফরাসী বিপ্লবপূর্ব সে ঘোর মন্বন্তরে, মারী রানিসাহেবাও সে কথাটি বলেন নি , সেই বা বলা যায় কী করে ?
আসলে একরকম দম্ভ , একরকম সারল্য , একরকম নাক উঁচু উদাসীনতা যুগে যুগে শাসকদের মুখে , শাসকদের কাজে প্রকাশ পায়।মারীর বর্ণিত এই উক্তিটি তাই এক দুঃখজনক প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।শেষ বিচারে, সারা পৃথিবীর নিরিখে, পাউরুটি আর পাউরুটি থাকে না , সেটি হয়ে ওঠে এক থালা ভাত, বা আরো সঠিকভাবে, একটি স্কোয়ার মিল !
–~০০০XX০০০~–
রম্য রচনাতে বীরবলী রীতি আর বৈঠকী মেজাজ মুগ্ধ করে
ধন্যবাদ 💐💐💐