হোটেল ওয়ালা
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
অনেক কান্ড করে জগন্নাথ বি,এ, পাশ করলো।বাপ আনন্দে আটখানা।জ্ঞাতিশত্রুদের বাড়ির সামনে গিয়ে চিৎকার করে বললে “ছেলে যদি হতে হয় তো আমার জগা।জল চিবিয়ে খেয়ে কত ক্লাস পড়লে”।
জগা মা কে বলে “কী দরকার মা।তুমি বাবাকে মানা করে দাও পাড়া গাবাতে।এটা এমন কী ব্যাপার।আমার লজ্জা করে”।
মা গজগজ করে “ওই লোকটাকে নিয়ে আমার চিরকালের মরণ।বললে শোনে না।”
বাড়িতে আজ বেশ আনন্দের ঢেউ।বাপ বললে “জ্ঞাতিরা আমাকে ঠকিয়ে শুধু এই ভিটেটুকু দিয়েছে।স্টেশন বাজারে একফালি জমি দিয়েছে আর নিজেরা ভালো ভালো জায়গা নিয়েছে।কথায় আছে জোর যার মুলুক তার।তবে ওদের ছেলেরা কেউ মাধ্যমিক পাশ দেয় নি।ওখানে আমার জিত।বলবো না মানে।বেশ করবো।”
জগন্নাথ রায়।রসুলপর স্টেশনের অনতি দূরে ওদের পুরোনো দু কামরার কোঠা।পাশে রান্নাচালা আর বাড়ির পিছনে বাথরুম।ওর বাবা বসন্ত।রসুলপুর স্টেশনে ভাগে পাওয়া দেড়শতক জমিতে চা এর দোকান।বেশ রমরমা।ভোর বেলা চলে যায় বসন্ত।সেই যখন কিষেনরা কাজে যায়।পাউরুটি, চা এর খদ্দের ওরা।
অনেক দিন পর বসন্তের বড়ো আনন্দ।স্ত্রী সুরমা আজ রান্নার কাজে ব্যস্ত ।সকালে আমেরিকান রুই এর ডিম এনেছে কর্তা বাজার থেকে বললে “সুরো।ডিমের বড়ার টক রাঁদবি।আর জগা আমার দিশি মুরগী ভালোবাসে।জমিয়ে ঝোল করবি।শুকনো লঙ্কা আর গোলমরিচ বেটে দিবি।”
অন্যদিন হলে এত ফিরিস্তি শুনে রেগে যেত সুরো।আজ একটুও রাগে নি।পুত্রগরবে সোহাগীনি মা।মা এর হাসিটা জগার খুব ভালো লাগে।উঁচু আর ফাঁকা ফাঁকা দাঁত নিয়ে মা যখন হাসে বেশ সুন্দর লাগে জগার।
পাড়াতুতো পিসি পাঁচি।রান্নাচালার কাছে গিয়ে বলল “আজকে কত কী রাঁদছিস বৌ।গন্ধে পাড়াসুদ্ধু ম ম করছে”
সুরো তেমনি হাসতে হাসতে বললে “সাপুনে শাক আর নটে শাক একত্রে মিশিয়ে ভাজছি।ওপাড়ার মোতি দিয়ে গেসল কাল।আর দিশি মুরগির ঝোল হবে।একটু আলুপোস্ত করবো।”
পাঁচির চোখ গোল গোল হয়ে গেল।বললে “পোস্ত!অনেক দাম।এখন আর খেতেই পাই না।”।
সুরো মাথা নাড়ল।বললে “তা যা বলেছো দিদি।তা তুমি একটু প্যাঁজ রসুন গুলো ছাড়িয়ে কেটে দাও না”।
পাঁচি যেন এটার অপেক্ষাই করছিল।বললে “এখনি দিচ্ছি।আমি বাসি কাপড় ছেড়ে এখুনি আসছি”।বলেই পাঁচি প্রায় ধড়ফড় করে কাপড় ছাড়তে গেল।
ননদ ভাজে রান্না করলো ওরা।সুরো বললে “এখানেই দুটো খেয়ে যেও।”
পাঁচিকে খুব খুশি দেখাচ্ছে।বললে “ছেলে আমাদের শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে পাশ দিয়েছে।খাবো না মানে কব্জি ডুবিয়ে খাবো”।
এরমধ্যেই বসন্ত আসে ।হাতে দৈ এর সরা।পাঁচি কতদিন দৈ খায়নি।
বাবা মা যতই আহ্লাদে গদগদ হোক জগা কিন্তু জানে বাস্তবের মাটিটা কত কঠিন।সামান্য আয়ের গৃহস্থ বসন্ত।আর জগা নিজেও বোঝে যে তার নম্বর গড়পড়তা।এই রেজাল্ট নিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়া দুঃসাধ্য।খেতে বসে বসন্ত বললে “রাসু মুখুজ্যে দোকানে এসেছিল।বললে ছেলেকে আরো পড়া বসন্ত।তা তুই তাহলে এবার কী পড়বি”।
জগা বলে “আমি আর পড়বো না বাবা”।
বসন্ত বলে “কেন।আমার কথা ভাবিস না।আমি ঠিক টাকা জোগান দেবো।তুই পড়”।
জগা বললে “না বাবা।আমি এবার চাকরি করবো।তাছাড়া এই রেজাল্ট আহামরি কিছু নয়।এম.এ পড়তে গেলেও ভালো রেজাল্ট চাই।”
বাপ বললে “কী চাকরি করবি?,ঠিক করেছিস কিছু?
জগন্নাথ শান্তভাবে বললে “দেখা যাক কী করি’।
ছেলে বড়ো হয়েছে।এখন আবার পাশ করা।ওর মতামত কে গুরুত্ব দেয় বসন্ত।বলে “নিজের পা এ দাঁড়াতে হবে বাবা।”
জগন্নাথ ঘাড় নাড়ে।সুরো বলে “আরো দু পিস মাংস নে বাবা”।
জগা খেতে খেতে কী যেন ভাবে।
খাওয়া দাওয়া মিটে গেলে পাঁচি বলল “চল বৌ।দুজনে মিলে সকড়ি আবরি মেজে ঘষে নে আনি।আমি ন্যাতা বালতি আনছি।তুই বাসন গুলো নিয়ে নে।”
জগার মা বললে “তাই চলো দিদি।এরপর গা মতরে যাবে।কাজ করতে ইচ্ছে করবে না।একেবারে পুকুর ঘাটে চল।”
দুজনে চলে যায় পুকুর ঘাটে।সুরো দেখলে ওর হাঁসগুলো পুকুরের জলে সাঁতার কাটছে।কিছু ভাত বাটিতে দিয়ে ডাক পাড়ে সোই-,সোই,সোই-সোই।পাঁচি বলে “তোর তো হাঁসের পাল বেড়েছে।সব কটা ডিম দেয়?”
“হ্যাঁ দিদি।এখন তো প্রতিদিন ডিম পাড়ে।তবে বর্ষা কালে একদম দেয় না।”
পাঁচি বলে “হবে না কেন?কেঁচো খায় যে।ওইজন্য”।
“তোমাকে দুটো হাঁস দেবো খনে।তুমি পুষবে”।
পাঁচির বুকে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।বলে “বৌ।তোর মনে কত মায়া দয়া।বিধবা হবার পর বাপ ভাই এর সংসারে আবর্জনা হয়ে আছি।”বলেই আঁচলের খোঁটায় চোখ মোছে পাঁচি।
কাজকর্ম শেষ করে বাড়ির পাশে আমগাছের তলায় মাদুর বিছিয়ে বসলো সুরো আর পাঁচি।পাঁচি বৌ এর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল “বৌ।একটা কথা বলছিলুম।আমার দু হাজার টেকা খুব প্রয়োজন।দিতে পারবি?”
সুরো বলে “অত টেকা কোথায় পাবো।একশ দুশো হলে দেওয়া যায়।আর তোমার অত টেকা কিসে লাগবে”।
পাঁচি বলে চলে “ঘোষেদের দুটো পাঁঠি বাচ্ছা বিক্রি আছে।কিনবো।ঠিক মতো পালতে পারলে পাল বাড়বে।তবে আর একটা কথা।বসন্তদাকে বলে আমার কানের দুল দুটো দিয়ে দু হাজার টেকা এনে দে না বৌ।তুই আমার দুঃখ বুঝিস।তাই তোকেই বলছি”।
সুরো বললে “আচ্ছা সে হবে খনে।এখন আমার পাশে একটু শুয়ে পড়ো ।
বিকেলে বসন্ত চা এর দোকান খোলে।দুপুরটা একটূ গড়িয়ে নিল।জগন্নাথ ঘুমাতে পারে নি।বললে “মা।আমি একটু গোবিন্দ কাকার বাড়িতে যাচ্ছি”।
মা বললে “কেন রে।কিছু দরকার?”
“হ্যাঁ মা।গোবিন্দ কাকা খুব ভালো মানুষ।আমাকে বলেছিল কোন এক কোম্পানি তে নাকি ওর হাত আছে।যদি একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়।তবে কাজে লেগে যাবো।আমার বন্ধু সন্দীপকে গোবিন্দ কাকা ব্যবস্থা করে দিয়েছে।”
জগা চলে গেলে সুরো হাত দুটো কপালে ঠেকায়।বলে “ছেলেটাকে তুমি দেখো ঠাকুর”।
খুশি মনে পাঁচি দুটো হাঁস নিয়ে বাড়ি গেল।বললে “সন্ধ্যায় কানের দুটো আনবো বৌ”।
সুরো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
গোবিন্দ নস্কর সৎ মানুষ।বললে “প্রাইভেট ব্যাঙ্কের একটা চাকরির সন্ধান আছে।সকাল দশটা সাতটা ডিউটি।মহিলা দের উন্নয়নে এই ব্যাংক কাজ করে।কুড়ি হাজার টাকা বেতন”।
জগা বলে “আমি সামনের মাস থেকেই কাজে যাবো।আপনি কথা বলুন”।
গোবিন্দ বলে “এইসব কাজে প্রচুর খাটনি।তুই যদি বলিস আমি কথা বলবো।আমার জানা শোনা।”
পুজোর দুমাস আগেই জগন্নাথ এর চাকরি হল ।সাড়ে সাতটার লোকাল ধরে প্রতিদিন যাওয়া।পাঁচি বললে “তুই ভাবিস না বৌ।ভোর বেলা চলে আসবো।দুজনে মিলে সব রান্না করে ফেলবো।ছেলে খেয়ে যাবে আবার নিয়েও যাবে।আমাকে শুধু রাঁদা অন্ন চাট্টি দিস।কোথায় আর যাবো বল!”
পাঁচিকে এবাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে।কপাল খারাপ।অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে কত লাঞ্ছিত হয়েছে ও।
পুজোতে মা এর শাড়ি কিনেছে জগা।সাথে পাঁচি পিসির একটা ।বসন্ত বললে “আমাকে একটা গান শোনার বক্স কিনে দিবি জগা”।
জগা হাসে।বড় ভালো লাগে আজ।নিজের উপায়ে বাবাকে কিছু দেবে।কত পরিশ্রম করেছে মানুষ টা ।নিজের কথা ভাবে নি।এই অশিক্ষিত চা ওলা ওর বাবা।ওকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে।আবেগে দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে জগার।মনে মনে ভাবে “সকলকে খুব খুশি রাখবে ও।সবাই সুখে থাকবে”।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল।উঠানে শিউলি ফুল কুড়োচ্ছে পাঁচি।বললে “মা দুগ্গার মুখের রঙ যেন শিউলি ফুলের বোঁটা।”
সুরো কপালে হাত ঠেকায়।বলে “দিদি গো।মা দুগ্গা আসছে।তাই প্রকৃতি সাজগোজ করছে।এটা মা এর বাপের বাড়ি।”
পাঁচি বলে “অনেক দিন পুজোতে ঠাউর দেখিনি।তুই আর আমি এবারে যাবো।যাবি তো বৌ।ছেলে নতুন বস্ত্র দিলে।এ আমার কত আনন্দ।অমন রত্ন তুই প্যাটে ধরিছিস”।
পাঁচি র এই কথাগুলো তে খুব আহ্লাদ হয় সুরো র।বলে “হ্যাঁ গো দিদি।জগা আমাদের হীরের টুকরো।
এদিকে ছেলে চাকরি পেতে বসন্তের আনন্দ দেখে কে।রসুলপুর স্টেশনে রমারমা ব্যবসা ওর।দোকান টা সুন্দর করে সাজিয়েছে ও।পাশেই হচ্ছে এগরোল ,মোগলাই।বিকেলে চপ,সিঙারা,মুড়ি।রাসু মুখুজ্যে অনেক দিন পর এসে অবাক।বললে “এ কী রে।এতো এলাহি ব্যাপার স্যাপার।”
বসন্ত বলে “ছেলেটা সংসারের হাল ধরেছে।আমি তাই এগুলো করছি।যা দু পয়সা আসে”।
রাসু বললে “বাব্বা।আবার বক্স।গান বাজছে।”
খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত বসন্ত রাসুকে চেয়ারটা এগিয়ে দেয়।বক্সে গান হচ্ছে “দিদি তেরা দেবর দিবানা”।
রাসু মুখুজ্যে বললে “শ্যামা সঙ্গীত বাজা।এসব গান ছেলে ছোকরা দের।’
বসন্ত গান চালিয়ে দেয় “সকল ই তোমার ইচ্ছা”।
হাসি মুখে বলে ‘পুজোতে ছেলে কিনে দিয়েছে “।
পুজোতে কদিন ছুটি পেয়েছে জগা।না।বোনাস ও পায় নি।তবে এক মাসের মাইনে অ্যাডভান্স পেয়েছে।ভাবলে টাকাটা কাজে লাগাতে হবে।আস্তে আস্তে কোম্পানি কে ফেরত দেবে ও।
পঞ্চমীর দিন পাঁচি কুড়িটা নারকোল আনলে।সুরো বললে “বেশ বড় খোল।কত করে দাম চাইলে দিদি।”
পাঁচি যেন বিশাল কান্ড করেছে।চোখ বার করে বললে “কত খুঁজে পেতে রায়গিন্নিকে পঁচিশ টেকায় রাজি করালাম।কিছুতেই দিতে চাইছিল না।নেহাত আমিও ছাড়বার পাত্রী নয়।বললেম দাও।না দিলে আমি যাই কোথা”।
সুরো বললে “সময় করে টেকা দিয়ে আসবে।”
উৎসবের দিনগুলো বড় কাছে টানে মানুষ কে।কোত্থেকে যে এত ভালোলাগা এসে হৃদয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে।তখন শুধু গান করতে ইচ্ছে করে।
আজ সকাল থেকে গান বাজছে বসন্তের দোকানে।হঠাৎ কী মনে হল জগার।সাইকেল টা নিয়ে বললে “মা।আমি আসছি।”
মা বলে “কোথায় চললি।দুটো খেয়ে যা বাবা।সময়ে না খেলে শরীর খারাপ করবে যে।’
জগা বলে “আমি বাবার কাছে দোকানে যাচ্ছি।ওখানেই খেয়ে নেবো”।
সুরো চেঁচায়।”ওসব খাবার কেন খাবি।ঘরের খাবার খা।”
পাঁচি বলে “কাকে বলছো।সে এই সীমানাতে নেই।হাউই এর মতো উড়ে বাপের কাছে চলে গেল।”
ছেলেকে দেখে বসন্ত আহ্লাদে আটখানা।বললে “তুই এলি কেন?ঘরে বিশ্রাম নে।এই তো কটা দিন ছুটি।”
বসন্ত এখন কচুরি ভাজছে।বললে “গরম কচুরি ঘুগনি দিয়ে খা কটা।”
বাপের রান্না তৃপ্তি করে খায় জগা।আর ভাবে “এই দোকান টাকে আরো বড় করতে হবে।
খেতে খেতে বলে “বাবা।চেয়ার টেবিল গুলো বদলাতে হবে।একটু ঝাঁ চকচকে করতে হবে।”
বসন্ত বলে “ঘরটা যদি ভালো করে করা যায় বুঝলি,দোকানটা আরো বড় হবে।”
জগা বলে “প্ল্যান করে করলে হোটেল করা যাবে।স্টেশনের ধার তো।অনেক খদ্দের পাবে।যেমন ধরো ভাত,ডাল,সব্জী,মাছ,মাংস।এইসব”।
বসন্ত বলে “সব ই বুঝলাম।কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।অত কোথায় পাবো বাবা।”
জগা পকেট থেকে কুড়ি হাজার টাকাটা বের করে বাবা র হাতে দেয়।বলে “কিছুই অসম্ভব নয় বাবা।সাহস,পুঁজি আর পরিশ্রম।এই তিনটে থাকলেই আমরা পারবো।তবে আমাদের দেখতে হবে এই এলাকার রুচি আর ক্রয়ক্ষমতাকে।আচ্ছা।আমি আসছি।তুমি চেয়ার টেবিল কেনার ব্যবস্থা করো।”
জগা চলে গেল।ওর যাবার পথে তাকিয়ে থাকে বসন্ত।ভাবে তার মতো অধমের কী করে এমন ছেলে হল।
রাসু মুখুজ্যে চা খেতে খেতে শুনেছে বাপ ছেলের আলোচনা।
বললে “বসন্ত রে।এ তোর সারাজীবন এর সততা আর নিষ্ঠার ফল।ভগবান খুশি হয়ে তোকে এমন ছেলে দিয়েছে”।
আবেগে চোখে জল চলে আসে বসন্তের।দোকানে টাঙানো শিবের মূর্তি টার দিকে চোখ চলে যায়।
পুজোর ক’টা দিন ভালোই আয় হচ্ছে বসন্তের।জগা মাঝে মাঝে গেছে ।বাবাকে সাহায্য করেছে।মহাষ্টমীর দিন নাড়ু হচ্ছে বাড়িতে।পাঁচি নাড়ু করছে।জগা বলল “পিসি।তুমি খুব ভালো নাড়ু করতে পারো।”
পাঁচি হাসে।বলে এসব কাজের কদর কী বাছা!কেউ মূল্য দেয় না।কেউ বলে না কেমন আছো পাঁচি।তোমার কোথায় কষ্ট!”
জগা অপ্রতিভ হয়।ভাবে পিসির কত দুঃখ।কিছুক্ষণ পরেই বাটি ভরে নাড়ু নিয়ে এসে পিসি বলে “খেয়ে নাও নাড়ুগোপাল।”
নাড়ুর বাটি নিয়ে জগা হাসতে হাসতে ঘরে যায়।
নাড়ু পাকাতে পাকাতে পাঁচির মনে পড়ে তার বিগত জীবনের কথা।বিয়ের পর তখন ও নতুন বৌ।লাল শাড়ি পরে নাড়ু পাকাচ্ছিল।সোয়ামিটা কত যে ভালোবাসতো।সেদিন বলেছিল “তোর হাতের রান্না যেন অন্নপূর্ণার হাতের রান্না।তারপর আর কেউ কোনোদিন বলেনি।সবাই বলেছে অপয়া,অলক্ষ্মী,অশুভ।একদিন ঝড়,জল,বন্যার রাতে যখন বাজ পড়ল তখন চারিদিকে আলো আর আলো।শুধু পাঁচির জীবনে নেমে এল চিরকালের অন্ধকার।কে যেন চিৎকার করে জানালে “অমুক বাজ পড়ে মরল”।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে পাঁচি র চোখের জল বাগ মানে না।মনে মনে ভাবে “একটা ছেলে বা মেয়ে যদি থাকত পাঁচিকে মা বলতো।পাঁচির মাতৃহৃদয় হু হু করে।জগাটা আছে তাই সুরো কত সুখী”।
জগার মাথায় এখন অন্য ভাবনা।এখন টাকা চাই।প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।ওর তো জায়গা আছে।
বসন্ত বাড়ি ফিরে ছেলেকে উদাস দেখে।বলে “কী ভাবিস তুই দিনরাত”।
জগা বলে “হোটেল করবো বাবা”।
বসন্ত উত্তেজিত হয় ।বলে “ওসব চিন্তার ভূত মাথা থেকে নামা।তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে?এত লেখাপড়া শিখে শেষে হোটেল?না না।আমি বেঁচে থাকতে এসব হবে না।”
জগা দমবার পাত্র নয়।বাবাকে বোঝায় “বাবা।তুমি ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করো।কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকলে হবে না।প্রাইভেট চাকরি।আজ আছে কাল নেই।যৌবনের উদ্যম কে কাজে লাগাতে হবে।দাসত্ব কেন?স্বাধীন ব্যবসা করবো।তাই আমি একটা পরিকল্পনা করেছি।”
বসন্ত বলে “পরিকল্পনা!কী পরিকল্পনা?”
জগা উত্তর দেয় “পুজোটা মিটুক।তারপর বলছি”।
বসন্ত চুপ করে থাকে।জগা দেখে মা রান্নার কাজে ব্যস্ত।মা এর গা ঘেঁসে বসে।বলে “কী রান্না হবে মহানবমীতে?”
পাঁচি কোঁচলে করে কী সব আনে।জগাকে দেখিয়ে বলে “এই যে।পুঁই আর পলতা।নবমীতে খেতে হয়”।
মা বলে “আজ তো পেঁপে দিয়ে খাসির মাংস রাঁদবো।সাথে ধনেপাতার চাটনি।”
পুজোর দিন গুলো আনন্দেই কাটলো।এবার শীতটা যেন সকাল সকাল এসে গেছে।বাড়িতে সীতানাথ মঙ্গলচন্ডী ঠাকুর।পাঁচি গজগজ করে “আর ফুল পাওয়া দুস্কর।শিউলি ফুল ছোট্ট হয়ে এসেছে”।
জগা বললে “বাজার থেকে কিনে আনছি”।
পাঁচি বলে “তুই কাজে বেড়োবি না”।
সুরো রান্না ঘরে।পাঁচি এগিয়ে গেল।বললে “আজ একটু দেরি হয়ে গেল আসতে।সকাল হতেই অশান্তি”।
জগা বলে “অশান্তি!কীসের অশান্তি?”
পাঁচি বলে চলে “দুল দুটো বন্ধকী দিয়ে পাঁঠি কিনেছিলুম দুটো।এখন পাল বেড়েছে।ভাই এর বৌ বলে আদ্ধেক ভাগ আমার।আমি বললাম দুটো ছাগল বিক্রি করে দুল দুটো ছাড়াবো।তা বলে কিনা আমার বাড়িতে ছাগল রাখা যাবে না।এত রিরিংসে কেন বুঝতে পারি না।কী আছে আমার।”
সুরো বলে “কেন?বাপের ভিটেয় তোমার ভাগ নেই!এখন যদি সব চুল চিরে ভাগ চাও।গাঁ এর লোকরাও তেমনি।পরনিন্দা পরচর্চা করতে রোজ আসর জমায়।আর কার কিসে ভালো হবে সেদিকে হুঁশ নেই”।
জগা বলে “ওরা রাখতে না দিলে বিক্রি করে দাও।”
পাঁচির চোখে জল।বললে “বাবা।একটা রান্নার কাজ দেখ।আমি শহরে চলে যাবো।সেখানে অনেক লোকের অভাব”।
জগা বলে “আমদের ছেড়ে কোথায় যাবে।তুমি এখেনেই থাকো।সব ব্যবস্থা হবে।”
পাঁচি আবার বলে “তুই ছুটি নিয়েছিস?”
জগা বলে “হ্যাঁ গো পিসি।আজ বি.ডি.ও তে যাবো।তোমার আধার কার্ড আর ভোটার কার্ড টা দাও।সাথে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি”
পাঁচি ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।বলে “কেন রে?কিছু ব্যবস্থা করবি আমার জন্য।আমার সব আছে।এখুনি আনছি।”
জগা বলে “সরকার থেকে বিধবা ভাতা দেয়।বি.ডি.ও বলেছেন তোমার টা করে দেবেন।আর শোনো।রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এর একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।ওটা পরের দিন জমা দেবো।”
সুরো অবাক হয়।বলে “বি.ডি.ও তোকে চিনলো কেমন করে?”
জগা বলে “এক ই ট্রেনে রোজ যাই।বয়স্ক মানুষ।ট্রেনে আমার জায়গাটা ছেড়ে রোজ বসতে দিই।পিসির কথা বলতেই উনি বলেছেন ভাতার ব্যবস্থা করে দেবেন।আর তার সাথে আমার ও একটা ব্যবস্থা করবেন।তাই তো ছুটি নিলাম আজ।”
পাঁচি ধড়ফড় করে বাড়ির দিকে দৌড় দিল।জগা নিজের সব ডকুমেন্ট নিয়েছে।পাঁচি এলে সব কিছু নিয়ে জেরক্স করতে গেল স্টেশনে।দেখলে বসন্ত কচুরি ভাজছে।ছেলেকে দেখে বললে “খেয়ে যা।আলুর দম হয়েছে।”
জগা মাথা নাড়ে।এখন খাবো না।ভাত খাবো।মা রাঁদছে”।
বসন্ত বললে “তবে বললি ছুটি নিয়েছি”।
জগা বললে “বি.ডি.ও যাবো”।
রাসু মুখুজ্যে জগাকে ডাকলে।বললে “কেমন আছো ভাই”?
জগা প্রণাম করে বললে “আপনি কেমন আছেন?”
“আমি সংসারে ছেলে বৌ এর ঝাঁটা লাথি খেয়ে বেঁচে আছি।কী আর বলবো।কটা টাকা যদি আয় করতে পারতাম”বলেই বলল “তুমি কোথায় যাবে বলছিলে।যাও।ঘুরে এসো।”
জগা বাড়ি ফিরে এল।আনন্দে চিকচিক করছে পিসির মুখ।বললে “কলাই এর ডাল বাটছি।বড়ি দেবো।দোকানের বড়ি খাওয়া যায় না।চালগুঁড়ো মেশায় আহাম্মকরা।আমরা গাঁ এর মানুষ।অমন ভেজাল জিনিস মুখে রোচে না।”
সুরো বললে “ও দিদি।চট করে একটু ডালবাটা দাও না।সরষে দিয়ে ঝাল করে দি।”
পাঁচি বলে “বাটি দে।নুন দিয়ে ফেটিয়ে দি।জগা আমার বড়ো ভালোবাসে”।
সাড়ে দশটায় জগা ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসে পৌঁছালো।অনাথবন্ধু ভট্টাচার্য।ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক।বললেন “অ্যাকাউন্ট খোলা হয়ে গেলে প্রথম পাতাটা জেরক্স করে ট্রেনে দিয়ে দিও”।তারপর ই কাকে ফোন করে ডাকলেন।একটা লোক এসে জগাকে চা বিস্কুট দিয়ে গেল।
অনাথবন্ধু বাবুর কাছে কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে এল।জগার থেকে বয়সে সাত আট বছরের বড়ো হবে।অনাথবাবু বললেন “আরে রাহুল।এসো এসো।এই ছেলেটার কথাই তোমাকে বলছিলাম।উদ্যমী আর পরিশ্রমী।তুমি এর ব্যাপারটা দেখো”।
রাহুল বললো “কী যেন নাম তোমার”।
জগার আগেই অনাথ বাবু বললেন “ও জগন্নাথ।”
রাহুল জগাকে ডেকে নিয়ে গেল অন্য একটা দপ্তরে।জগা দেখলে “যুব কল্যাণ দপ্তর”।
রাহুল বললে “সব কিছু দিয়ে যান।তবে জায়গাটা আপনার নামে হতে হবে।আমরা তিন লক্ষ টাকা ঋণ করে দেবো।সবটা শোধ করতে হবে না।সরকারের ভর্তুকি আছে।আপনি যখন অনাথ বাবুর পরিচিত।আর কোনো কথাই নেই।”
সব ঠিক হয়ে গেলেও একটা ব্যাপার জগাকে ভাবিয়ে তুলল।বলল “জায়গাটা তো বাবার নামে।তাহলে বাবাকেই ঋণ টা দেওয়া হোক।”
রাহুল বলল “সেটা নিয়মে নেই।শিক্ষিত যুবকদের এই লোন দেওয়া হয়”।
জগা বাড়ি ফিরে এল।ঘরে বসে বসে ভাবছে “বাবাকে কী বলা উচিত হবে”।
দুপুরে বাপ বেটা একসাথে খেতে বসেছে।পাঁচি অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যাঙ্কে গেছে।বসন্ত বললে “কতটা কাজ এগোলো?”
জগা বললে “হবে না।নিজের জায়গা দেখাতে হবে।জায়গা তো তোমার নামে”।
বসন্ত চোখ কপালে তুলে বলে “সে তোর হতে কতক্ষণ।আমি তোর নামে করে দেবো জায়গাটা”।
জগা স্বস্তি পায়।এবার হয়তো স্বপ্ন সফল হতে চলেছে।এদিকে পাঁচি এসে জানায় “নিবারণ সেন অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে তদারকি করে।”
বাড়িতে যেন খুশির হাওয়া।
রাতে ঘুম হয় না জগার।বুকে এক আকাশ স্বপ্ন।মনে পড়ছে স্কুলের কথা।কত সামান্য ঘরে ও জন্মেছে।তবু স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন মাস্টারমশাই রা।বলেছিলেন “মানবসম্পদ।কার্যকারিতা থাকলেই তা সম্পদ।নৈলে নিষ্ক্রিয় সামগ্ৰী”।
পিসি ছাগল পুষে আয় করেছে।তাহলে মানুষ পারে না এমন কাজ নেই।
বসন্ত জাগ্ৰত দ্বারে।পাঁচি বাড়ির পিছনে একফালি জায়গায় ফুলের বাগান করেছে।বললে “আর ফুলের জন্যি হাহাকার করতে হবে না”
“না।আর কিছুর জন্যই হাহাকার নেই।ভাতার টাকা ঢুকেছে একসাথে ছয়মাস এর।”
আনন্দে কেঁদে ফেলে পাঁচি।বলে “তোর লোনের কী হল”?
জগা হাসতে হাসতে বলে “ওটাও হয়ে গেছে”।
সবাই এখন উঠে পড়ে লেগেছে হোটেল সাজাতে।জগা বললে “পিসি।তুমি রান্নার কাজ চাইছিলে না।হোটেলে তুমি রাঁধবে।তিনহাজার টাকা দেবো।পরে লাভ হলে মাইনে বাড়বে”।
পাঁচি চোখ ছানাবড়া করে বলে “এত সুখ ছিল আমার কপালে”।
দোকান চালু হল পয়লা বৈশাখ।জগা দেখলে রাসু মুখুজ্যে এসেছে।বললে “আপনি ক্যাশিয়ার হবেন।হোটেলে খেয়ে নেবেন।আর একহাজার টাকা দেবো মাসে”।
রাসু দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে জগাকে।ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে জগা হোটেল ওয়ালা।জগা বলেছে “সবার সাদর আমণ্ত্রণ র’ইল”।
–~০০০XX০০০~–