আত্মার আকুতি
সলিল চক্রবর্ত্তী
ঐ… তে.. ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে”
এক্কা গাড়ি চললো জামালপুর মোল্লা পাড়ার দিকে। এদিকটা টুরিস্ট স্পট নয়, তবুও বেশ সাজানো গোছানো। প্রতিটা বাড়ি বিঘা খানিক জমি নিয়ে নারকেল, সুপারি গাছ দিয়ে ঘেরা। সুন্দর পিচ রাস্তাটা জামালপুরের দিকে এগিয়ে গেছে। চারদিক খোলা এক্কা গাড়িতে সওয়ার হয়ে বেশ লাগছে। ভোরবেলা তো চোখে একটা ঘুম ঘুম ভাব রয়েছে, কারন গত রাতে ট্রেনে ভাল করে ঘুম হযনি। এদিকে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোও হাতছাড়া করতে ইচ্ছ করছে না। সোমনাথ জিঞ্জাসু দৃষ্টি ভঙ্গিতে এদিক ওদিক দেখতে থাকল। এর পর সোমনাথের নজরে আসলো দুরে একটা প্রাসাদ্যোপম অট্টালিকা। সে মনোজ ঘোষকে জিজ্ঞেস করতে যবে বাড়িটি সম্পর্কে, এরি মধ্যে মনোজ ঘোষ বলে উঠলো -“এসে গেছি, ও -ই যে বড়ো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে” – সোমনাথ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন – “ওই বড়ো বাড়িটা আপনাদের”? মনোজ বাবু একটু লজ্জিত হয়ে বললেন – “আরে না না, ওটা একটা দেড়শো বছরের পুরনো ভুতুড়ে বাড়ি, ওই বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি”। সোমনাথ বিঞ্জান মঞ্চের লোক, ভুতুড়ে বাড়ির নাম শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন, কারন তাকে তো ভুতুড়ে বাড়ির কাণ্ডকারখানার রহস্য সমাধান করতে যেতে হয়। মনোজ ঘোষ অল্প সময়ে হালকা করে যেটুকু বললেন – ওই বাড়িটা আজ প্রায় একশো বছর ধরে ওই ভাবেই পড়ে আছে। লতা পাতা, গাছ পালায় ভরে ওঠেনি কারন সরকারি কাজের উদ্দেশ্যে বাড়িটিকে প্রয়োজন মতো পরিস্কার করা হয়। প্রশ্ন হলো তাহলে ভুতুড়ে বাড়ি কি করে হলো? আসলে রাত্রে ওই বাড়িতে কেউ থাকতে পারেনা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ওই বাড়িতে অপদেবতার উৎপাত চলে। পূর্ণিমা রাত্রে ভৌতিক কাণ্ডকারখানা আরো বেড়ে যায়। অনেক সাহসী মানুষ এর রহস্য উদঘাটন করতে এসেছে, লাভ তো কিছু হয়নি বরং তাদের ক্ষতি হয়েছে। সোমনাথ বাবুর কিউরিসিটি বেড়ে গেলো। উঁনি জানতে চাইলেন ক্ষতিটা কেমন হয়েছিল। মনোজ বাবু তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে থাকেন – একবার তিন জন ভদ্রলোক এলেন বাড়ির রহস্য উদঘাটন করতে। মূলত বাড়ির রহস্যটা সবার সামনে আনা। সারাদিন তিনজন মিলে এলাকায় ঘুরলেন, পাঁচ বিঘা বাগানসহ ভিটে বাড়িটা ঘুরেফিরে নিরীক্ষণ করলেন। কাজ না মেটায় সেই রাত্রে ভুতুড়ে বাড়িতে থেকে যেতে মনস্থ করলেন। গ্রামের যে মানুষজন তাঁদের গাইড করছিলেন তাঁদের বারনও শুনলেন না। পরদিন সকালে দেখা গেলো ওই বাড়িতে তিন জায়গায় তিনজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। জ্ঞান ফিরতেই তারা গত রাতের ঘটনার বণর্নার থেকে কোলকাতায় ফেরার উপর গুরুত্ব বেশি দিচ্ছিলেন। তার মধ্য থেকে যেটুকু জানা গেল- ওঁরা রাত্রে কিছু অশরীরী ক্রিয়াকলাপ দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলেন। ঘটনাটা শুনে তারক, পরিমল, উজ্জ্বল বিশেষজ্ঞের মতো তাদের মত প্রকাশ করে উঠলো। সোমনাথ কোনো মন্তব্য না করে মনোজ বাবুর কাছে জান্তে চান আর কি, কি ঘটেছিল? মনোজ বাবু আবার বলতে শুরু করলেন – আর একবার এক মধ্য তিরিশের যুবক এসেছিল আত্মা নিয়ে রিসার্চ করতে সে তো সারাদিন বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখলো এবার রাতের পালা। আগের তিন জনের মতো এলাকার সবাই তাকে সাবধান করলো, পুরোনো বাড়িটার কিছু ভৌতিক কান্ড কারখানার কথাও বললো কিন্তু কে শোনে কার কথা। একাই ওই বাড়িতে রাত কাটাবে ঠিক করলো, পরদিন খুব ভোরে গ্রমের লোকজন গিয়ে দেখে যুবকটি উদভ্রান্তের মতো পোড়ো বাড়িটার ভেতরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকলে কি হয়েছে জানতে চাইলে যেটুকু বোঝা গেল যুবকটি সম্ভবত ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। সোমনাথ বাবু জানতে চাইলেন তারপর কি হলো? মনোজ বাবু বললেন – আর কি পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল পুলিশ যুবকটিকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। শুনেছিলাম ছেলেটি সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট হয়ে গেছে। ততক্ষনে এক্কা গাড়িটা পুরানো বাড়ির সামনে চলে এসেছে। সোমনাথ মনোজ বাবুকে বাড়িটা একটু দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। এক্কা গাড়ি এসে দাড়াল দেড়শো বছরের পুরোনো বাড়িটার সামনে। বিরাট বড়ো বাড়ি, সামনে অনেকটা বাগান আছে। বেশ কিছু পুরনো সারি সারি গাছ আর লতা পাতার জঙ্গলে ভর্তি। বাড়ির একতলায় অনেক ঘর, তার মধ্যে দুই একটা ঘরে পঞ্চায়েতের মালপত্রে ভর্তি, বাকি দশ বারটি ঘর খালি খাঁ খাঁ করছে। পুরোনো আমলের বড় বড় ঘর, যার জানালা গুলো ঘরের তুলনায় ছোট, ফলে দিনের বেলাতেও কেমন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। সোমনাথ দোতালায় উঠে গেলেন ওখানেও নিচের মত অনেক ঘর, ঘর গুলো বেশ বড়ো, আলো বাতাস খেলছে। দক্ষিণ খোলা বড়ো একটা ব্যালকুনি আছে। মনোজ বাবু বললেন এখানে স্বাস্থ্যসাথী, অঙ্গনওয়াড়ী, আশাকর্মী, একশো দিনের কাজ কর্মের পরিচালনা করা হয়। জায়গা প্রচুর তো লোক সমাগামও হয় অনেক। কিন্তু সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই সব ফাঁকা। সম্পূর্ণ বাড়িটা জনমানবহীন শূন্যতায় রাতের অপেক্ষায় সময় গোনে। সোমনাথ মনোজ বাবুর মুখের কথা কেড়ে বলেন , “সবাই মনে ভাবে ভুত আসার সময় হয়ে গেছে”। মনোজ বাবু হেঁসে বললেন – ঠিক তাই, এবার বাড়ি যাই চলুন, সবাই আমাদের যাবার অপেক্ষায় রয়েছে।
সাপ কখনো গরুর দুধ খেতে আসে না। আসলে সাপ দুধ খেতেই পারে না। কারণ তরল পদার্থ চুষে খেতে হলে জিভের প্রয়জন, কিন্তু সাপের জিভ চেরা হওয়ায় সাপ চুষে খেতে পারেনা। জিভটি শুধু শ্রবণ ইন্দ্রিয় হিসাবে কাজ করে।
এরি মধ্যে সঞ্জিত ঘোষের সাথে, বেঁটে খাটো রোগা পাতলা বছর সত্তরের এক পৈতেধারী বৃদ্ধ হুঁকো হাতে কলকাতা বাবুদের কাছে গুটি গুটি পায়ে হাজির হলেন। সঞ্জিত বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনিই দা -ঠাকুর। এবার দা – ঠাকুরের কাছ থেকে ওই ভুতুড়ে বাড়ি সম্পর্কে যা যা জানতে চান জেনে নিন, কারণ এই গ্রামে একমাত্র উনিই ওই বাড়ির ইতিহাস ভালোভাবে বলতে পারবেন। বিয়ে বাড়ি তো অনেক কাজ, আমরা ওদিকটা দেখিগে। এই বলে সঞ্জিত বাবু, মনোজ বাবু বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
দা ঠাকুর আমাদের জন্য পেতে দেয়া শীতল পাটিতে বসে, আগে হুঁকোতে কয়েকটি সুখটান দিলেন, তারপর ধোঁয়া ছাড়তেই পরিমল বলে উঠলেন- গন্ধে বেশ একটা মাদকতা আছে। দা ঠাকুর হুঁকো থেকে মুখ সরিয়ে বললেন- গন্ধ তো থাকবেই, তামাক যুক্ত নেশার জিনিস না। আপনারা যেমন পুরোনো বাড়ির নাম শুনেই একটা ভুত ভুত গন্ধ পেয়েছেন, ঠিক তেমনি। আমার যেমন হুঁকোর নেশা, আপনাদের তেমনি ভুতের নেশা। তারক বললো- না না আমাদের না শুধু সোমনাথের। সোমনাথ বললো- বিতর্কের দরকার নেই , আপনি আমাদের পোড়ো বাড়ির ইতিহাসটা বলুন।
ওই দিনের পর থেকে রুকসানা বিবি ও তাঁর পরিচারিকা কে আর দেখা যেত না। দিনে দিনে মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। গ্রামের সকলে মিলে মির মনছুরের নামে কতোয়ালিতে নালিশ জানিয়েছিল। খবরটা মির মনছুর আগেই পেয়ে গিয়ে ছিল। তাই পুলিশ আসার আগেই মনছুর পালিয়ে যায়। সে আর কখনো গ্রামে ফেরেনি।
সেই সময় থেকে বাড়িটা ওই ভাবেই পড়ে আছে। কিছু ভুতুড়ে কান্ড কারখানার জন্য ঐবাড়িতে কোনো মানুষ জন থাকে না।পুরোনো বাড়ির ইতিহাসটা যে এত তথ্য বহুল এবং বেদনা দায়ক হবে সোমনাথ তা ভাবতেও পারেনি। একটা সুন্দর মনের বৃদ্ধার শেষ পরিণতি কি হলো কেউ জানতে পারলো না ! উজ্জ্বল, তারক, পরিমল নিছক সুন্দর গল্পের তারিফ করলো বটে, সোমনাথের মাথায় একটা খটকা থেকেই গেল। ইংরেজ পুলিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরতে যতটা গুরুত্ব দিতো ভারতীয়দের বেক্তিগত সমস্যায় সেই ভাবে গুরুত্ত্ব দিতনা। এরই মধ্যে মনোজ এসে স্নান খাওয়া করে নিতে বললেন। কারণ বেলা অনেক হয়ে গেছে। মফস্বলের বিয়ে বাড়িতে দুপুর থেকেই প্রচুর লোক সমাগম হয়। স্নান খাওয়া সেরে সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়ে সোমনাথ, তারক, পরিমল, উজ্জ্বল বিয়ে বাড়ির ছোট ছোট কাজে লেগে পড়লো, তাতে সময়টা কেটে যাবে। দা ঠাকুর কোনে কর্তা হয়ে একটি চেয়ারে বসে বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে থাকেন।
সন্ধ্যায় লগ্ন ছিল বলে রাত এগারোটার মধ্যে সব কমপ্লিট। সোমনাথদেরও খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে। এবার শোয়ার পালা, বাড়িতে অনেক অথিতি, শোয়ার তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দা ঠাকুর প্যান্ডেলের ভিতর পরিষ্কার করিয়ে শোয়ার ব্যাবস্থা করছেন। তারক ফিস ফিস করে বললো- মনে হয় এই খাবারের গন্ধের মধ্যে মাটিতে মাদুর পেতে শোয়াবে। সোমনাথ একটু ব্যাঙ্গ করে বললো- তবে কি তোমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে পালঙ্কে শোয়াবে? আমার কথা শুনলে রাত্রে ভালো করে ঘুমাতে পারবে। পরিমল জানতে চাইলো সোমনাথের ইচ্ছেটা। সোমনাথ বললো পোড়ো বাড়িটায় দক্ষিণ খোলা একটা ব্যালকুনি আছে, ওখানে চারটে মাথার বালিশ একটা শতরঞ্চী নিয়ে গেলেই যথেষ্ট। খেপেছ নাকি, রাতে ঘুম না হলে এখানে জেগে বসে থাকবো, তবুও ওই অনিশ্চিন্ত জায়গায় নিশ্চিন্তে ঘুমুতে যাবো না,উজ্জ্বল একটু রেগে গিয়ে কথাটা বললো। এদের চাপা স্বরে বাগবিতণ্ডা খেয়াল করে দা ঠাকুর এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা। পরিমল সোমনাথের ইচ্ছেটা দা ঠাকুরকে জানাতেই ,দা ঠাকুর বিস্ময়ে চমকে উঠলেন-বলেন কি ? বিয়ে বাড়িতে এসেছেন ,বিয়ে কাটালেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন। এবার সোমনাথ তার বক্তব্য পরিষ্কার করলো, যে সে আজ রাতটি ওই পোড়ো বাড়িতে কাটাবে, কারণ সে নিজে চোখে দেখতে চায় সেখানে কি ঘটে। ইতিমধ্যে সেখানে মনোজ ও সঞ্জিত বাবু এসে পড়েন। তারাও বাধা দিলেন। তারক, উজ্জ্বল, পরিমল বলে দিল তারা ওই ভুতুড়ে বাড়িতে শুতে যাবে না। কিন্তু সোমনাথ কারোর কথা শুনলো না। একটা বালিশ, একটা শতরঞ্চী, একটা টর্চ লাইট নিয়ে গট গট করে ভুতুড়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।দা ঠাকুরের দুশ্চিন্তায় রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। একটা গোঁয়ার ছেলে, কারোর কথা শুনলো না। যদি ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায় তবে সঞ্জীব বেচেরা বিপদে পড়ে যাবে। তাই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে গুটি গুটি পায়ে চলে আসেন মনোজ ঘোষের বাড়িতে। উদ্দেশ্য সকলকে নিয়ে পোড়ো বাড়িতে গিয়ে সোমনাথের খবর নেওয়া।
দা ঠাকুর, সঞ্জীব বাবু, মনোজ বাবু তারক, উজ্জ্বল, পরিমল আরো কয়েক জন মিলে পোড়ো বাড়িতে গেল। ওরা গতকাল সোমনাথ কে ব্যালকুনিতে শোবে বলতে শুনেছিল, তাই সোজা বালকুনিতে চলে গেল। ওখানে গিয়ে দেখল সোমনাথ নেই , শতরঞ্চীটা গুটিয়ে এককোনে পড়ে আছে, মাথার বালিশ ও টর্চলাইট টা মাটিতে পড়ে আছে।ওরা সেখানে সমনাথকে না দেখতে পেয়ে রীতি মতো ভয় পেয়ে গেল। সম্পূর্ন বাড়ির ঘর গুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও নেই। এলাকার দুই একজন ছিল, তারা বাগানের দিকটা খুঁজতে গেল।
বৈশাখী পূর্ণিমা রাত্রি, চাঁদ তখন মধ্য গগনে। ফুরফুরে বাতাস বইছে। সোমনাথ টর্চের আলোতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সোজা দোতলার ব্যালকুনিতে চলে যায়। ব্যালকুনিতে সুন্দর বাতাস বইছে, চাঁদের আলোতে ব্যালকুনি পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। সোমনাথ শতরঞ্চী পেতে বালিশটা নিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। সারাদিনের ক্লান্তি চোখে ঘুমের আবেশ। সোমনাথ শুয়ে শুয়ে ভাবলো, এসে ভালোই করেছে, নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা বিয়ে বাড়ির মতো কোলাহল নেই, ঘুমটা ভালোই হবে। যতক্ষন ঘুম না আসে সোমনাথ ভাবতে থাকে- এই এত বড় বাড়িটায় কোনো মানুষ না থাকায় বাড়িটা খাঁ খাঁ করে, আর লোকে বলে ভুতুড়ে বাড়ি। অথচ একটা সময় হয়তো এই বাড়ি লোক সমাগমে গমগম করতো। নিশ্চই সেই পূর্ণিমা রাতে এমন কিছু ঘটেছিল যে সেইদিনের পর থেকে আর ওই ভালো মনের বৃদ্ধা রুকসানা বিবিকে দেখা যায়নি। সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যে সোমনাথের মনে হলো দূর থেকে একটা এক্কা গাড়ির শব্দ এই পোড়ো বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছে আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে, এক সময় এক্কা গাড়ির শব্দ পোড়ো বাড়ির নীচে এসে থামল। সোমনাথ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, একটা সাদা ধপধপে ঘোড়া একটা সুন্দর করে সাজানো রথের মতো গাড়িকে টেনে এনে বাড়ির লনে দাঁড়ালো। বাড়ির সামনেটা আর জঙ্গলাকীর্ণ মনে হচ্ছে না। সোমনাথ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তাও বুঝতে পারছে না। বাড়িটা আর চুন সুরকি খসা পুরোনো বাড়ি নেই, একটা ঝা চক চকে জমিদার বাড়ির মতো লাগছে। সোমনাথ নিজের শরীরের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে না। শুধু দুই চোখের সামনে ঘটে চলা ঘটনা ছবির মতো দেখে চলেছে।
এক্কা গাড়ি থেকে নেমে এলেন ষাট পয়ষট্টির এক বৃদ্ধা। সঙ্গে কম বয়সী আর একজন মহিলা। সম্ভবত তার পরিচারিকা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভিতর ঢুকছেন।
– আপা, আজ তুমি যদি ঠিক সময়ে না পৌঁছোতে ওই গরিব ব্রাহ্মণের মেয়েটি লগ্নভ্রষ্টা হতো, মেয়েটির জীবনটা তো নষ্ট হতই, ওই গরিব বাপটি ও সমাজচ্যুত হতো। ছেলের বাড়ির লোকগুলো কি মানুষ? একশ টাকা বরপন না দিতে পারায় বিয়ের পিঁড়ি থেকে বর তুলে নিয়ে যায়! বৃদ্ধা সমাজ ব্যবস্থার নিন্দা করে বলেন- আমি নই আল্লা ওকে বাঁচিয়েছে, আল্লাতলা তো নিজে হাতে কিছু করে না আমার হাত দিয়ে হলো এইযা। এরই মধ্যে মদ্যপ অবস্থায় বছর তিরিশের এক বলিষ্ঠ যুবক তাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। টলতে টলতে বৃদ্ধা কে আঙ্গুল তুলে বলে- মুসলমানদের মধ্যে এতদিন দান ধ্যান করে আসছো, মেনে নিয়েছি, কিছু বলিনি, এখন হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ শুরু করেছ? আর তো মেনে নেওয়া যায় না। বৃদ্ধা যুবককে মদ খেয়ে তার সামনে আসায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন- মাতাল , লম্পট আমার টাকা আমি কাকে দেব না দেব তোর কাছে অনুমতি নিতে হবে? লোকে ঠিক বলে, “মীরজাফরের বংশ ধরদের রক্তে বেইমানি আছে” তা না হলে খাওয়ার দুধ টুকু জুটত না সেই রংপুর থেকে এনে বড়ো করলাম এই তার প্রতিদান? তোকে আমি কিচ্ছু দেব না , তোকে তেজ্য পুত্র করবো , ইংরেজ সরকার আমার মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করুক। এই কথা শুনে মাতাল যুবক সম্পত্তি হারাবার ভয়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বৃদ্ধার উপর আক্রমণ শানাল। চিৎকার করে বললো – সেই সুযোগ আমি তোমাকে দেব না, তার আগেই তোমাকে আমি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেব। এই বলে কোথাথেকে একটা ধারালো ছুরি এনে বৃদ্ধা কে মারতে গেল। অল্প বয়সী মহিলাটি বৃদ্ধা ও যুবকের মাঝখানে এসে বাধা দিতে গেলেই যুবকটি অল্প বয়সী মহিলার পাঁজরের নীচে ছুরি বসিয়ে দিল। মহিলাটি একবার চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। বৃদ্ধা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চিৎকার করে বললেন-তোর’ “কিত্যি” , সকালটা হতে দে, আমি সবাইকে জানিয়ে দেব, কতোয়ালিতে নালিশ করবো, তোকে গারোদের ঘানি টানবো। তুই পার পাবি ভেবেছিস? কথা গুলো বলতে বলতে , মেঝের উপর পড়ে থাকা মহিলাকে তুলতে গেল। যুবকের মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। তাছাড়া তার আসল লক্ষ অল্প বয়সী পরিচারিকা নয় ওই বৃদ্ধা। সে ছুরি হাতে বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো-পার তুমিও পাবেনা বুড়ি, আমি এই মুহুর্তে তোমাকে আল্লার দোরে পৌঁছে দেবে। এই বলে ছুরিটা বৃদ্ধার তল পেটে ঢুকিয়ে দিলো। এবং বৃদ্ধা বিকট স্বরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
তীব্র চিৎকারে সোমনাথের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙতেই সে মনে করতে পারছিলনা সে কোথায় আছে। স্বপ্নের ঘোরে সে ভাবলো বৃদ্বার বাড়ির মধ্যে আছে। একটু ধাতস্থ হয়ে সে দেখল , যে শতরঞ্চী পেতে শুয়েছিলো সেটি হওয়াতে গুটিয়ে গেছে। কোথা থেকে শুকনো পাতা পড়ে ব্যালকুনি অপরিস্কার হয়ে আছে। সোমনাথের শরীরে বালি কিচ কিচ করছে। চাঁদের আলো অনেকটা কমে এসেছে। একটা প্যাঁচা চিৎকার করে ডেকে উঠলো, মুহূর্তের মধ্যে একটা বাদুড় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তার কানের পাশ দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে গেল। রীতিমতো ভৌতিক ব্যাপার , কিন্তু সোমনাথ তো ভুত বিশ্বাস করে না। তার ধারণা মানুষ নিজের প্রয়োজনে ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি করে। সে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত আড়াইটে বাজে। এখনো তাকে অনেক্ষন ঘুমুতে হবে, এই ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে শতরঞ্চীটা ঠিক করে পাততে গেল। কিন্তু কিছুতেই সে শতরঞ্চীটা ঠিক করে পাততে পারছে না, মনে হচ্ছে কে যেন শতরঞ্চীটা টেনে ধরে রাখছে। সোমনাথ থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো ব্যাপারটা কি! হঠাৎ মনে হলো ওর পিছনে কে যেন দাঁড়িয়ে। সোমনাথ দ্রুত গতিতে যেই ঘুরে দেখতে গেল, অমনি তার পিছন থেকে একটা ছায়া মূর্তি সরে গেল। সোমনাথ ভাবলো সে কোনো ধান্দাবাজি চক্রতে পড়ে গেছে। আগে যারা এখানে এসে রাত কাটিয়েছে, প্রত্যেককে ভয় দেখিয়ে হয়ত নিজেদের কার্য সিদ্ধি করেছে। সোমনাথ চিৎকার করে বলল- ভুল করছ, আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। সাহস থাকে তো সামনে এসে দাঁড়াও। মাঝ রাতে শুনশান অট্টালিকাতে তার চিৎকার তার কাছে বিভীষিকা হয়ে ফিরে এলো। সেই শব্দে প্যাঁচা, বাদুড়, চামচিকা এমন বিকট শব্দে ডেকে উঠলো যে একটা ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। সোমনাথের শরীরটা কেমন ভারী হয়ে উঠলো। একটা অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি তাকে যেন ব্যালকুনি থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। সোমনাথের ভুত সম্পর্কিত অবিশ্বাস আস্তে আস্তে কমতে থাকলো, আর ভুতের ভয় মনে গেড়ে বসতে শুরু করলো। মনের সাথে সে আর যুদ্ধ করতে পারছে না। তবুও আত্ম বিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দিতেও পারছে না। সে ছায়া মুর্তির দিকে তাকিয়ে বলল- কেন আমায় হিপ্নোটাইস করার চেষ্টা করছ, কি চাও তুমি? এর আগেও তুমি রাতে যাদের একা পেয়েছ তাদেরকেও ভয় দেখিয়েছো। এই কথা শুনে, কর্কট, ভয়ঙ্কর ভয়াল স্বরে দৈব বাণীর মতো ছায়া মুর্তি বললো- ভুল শুনেছ, আমি কটি কথা বলতে চেয়েছি। তারা ভয় পেয়েছে। ছায়া মুর্তি কথা বলতে বলতে দোতলা থেকে নেমে বাগানের পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো- রোকেয়া বিবি আর আমাকে মনছুর খুন করে পশ্চিমের ঘরে পুঁতে রেখেছে। আমাদের আত্মার আজও মুক্তি হয়নি। চেতনা ও অবচেতনের মধ্যে দিয়ে সোমনাথের চিন্তা ভাবনা কাজ করছে। অনেকটা ঠিক ঘুমের ঘোরের মতন। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের গলোক ধাঁধায় পড়ে সোমনাথ বললো – এ সব মিথ্যা, হতেই পারেনা। প্রেত আত্মা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো- না মিথ্যা না । এত ভয়ঙ্কর সেই আওয়াজ যে সোমনাথের শরীরে শিহরন খেলে গেল, এবং সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
সমস্ত ঘটনা শুনে উপস্তিত অনেক বয়স্ক মানুষ যাঁরা পোড়ো বাড়ির ইতিহাস অল্প বিস্তর জানেন তারা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দা ঠাকুর খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকলেন তারপর নিজের মনে বলে উঠলেন – একটা বিস্মৃত ইতিহাস আজ একশো বছর পর উন্মোচিত হল। ততক্ষনে গ্রাম প্রধান জাকির হোসেন এসে পড়েছেন। জাকির সাহেব দা ঠাকুরকে খুবই সন্মান করেন। তিঁনি দা ঠাকুরের কাছে সংক্ষেপে সব শুনলেন, এবং পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা আলোচনা করে নিলেন।
খবর দেয়া হলো থানায়, হসপিটালে। ঠিক সেই সময় ভিড়ের মধ্য থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাবি করে বসলেন তিনি নাকি মির খোদাবক্সের বংশধর। দা ঠাকুর শুনে বললেন – আপনার নাম কি? তিনি বললেন – মির করিম বক্স। দাঠাকুর বললেন- সত্যি মিথ্যে যাই হোক আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন।
থানা থেকে পুলিশ এসে ভিড় সরিয়ে কুটিরের সামনেটা ফাঁকা করে ফেললো। হসপিটাল থেকে ডোম এসে গাইতি, কোদাল নিয়ে কুটিরের মেঝে অতি সাবধানতার সাথে খুঁড়তে শুরু করলো। বেশি খুঁড়তে হলো না। কারণ মির মনছুর যখন মৃত দেহ লুকিয়ে ছিল তখন সে মেঝেতে মৃতদেহ রেখে তার উপর বালি সিমেন্ট ঢেলেছিলো। যাই হোক দুটি কঙ্কাল এক সাথে বেরিয়ে আসলো। এমন ভাবে কঙ্কাল দুটি ভেঙেচুরে আটকে ছিল যে মনে হচ্ছিল একে অপরকে বাঁচাতে একই সাথে প্রাণ ত্যাগ করেছে। দুইটি কঙ্কালের মধ্যে একটি গলায় একটা চেন সহ লকেট পাওয়া গেলো । লকেটটিতে নাম খোদাই করা আছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা না গেলেও সম্ভবত কঙ্কালটি রুকসানা বিবির।
গ্রাম প্রধান জাকির হোসেনের উদ্যোগে এবং গ্রামের গণ্য মান্য দের তত্ত্বাবধানে মিলাতের আয়োজন করা হলো। মুর্শিদাবাদের বড়ো মসজিদ থেকে মৌলবী আসলেন , দা ঠাকুর স্বঘোষিত বংশধর করিমবক্স কে ডেকে নিলেন। তারপর রুকসানা বিবির জন্ম ভিটেতে নুতন করে কবর খুঁড়ে, মুসলিম শাস্ত্র মতে রুকসানা বিবি ও তার ছায়া সঙ্গী রোকেয়া বিবিকে গোর দেয়া হলো।
একশো বছরের ইতিহাসের আকাঙ্খিত পরিসমাপ্তি ঘটলো, এবং তার সাক্ষী থাকলো জামালপুর গ্রামের অধিবাসী বৃন্দ।
শোনা যায় এরপর থেকে আর ওই পোড়ো বাড়িতে কোনো ভুতের উপদ্রব হয়নি।
খুবই রোমাঞ্চকর এবং সুন্দর লাগল 👌👌
ধন্যবাদ 😊