ভালোবাসা কারে কয়
✍ মঞ্জুলিকা রায়
ক্যাবের ডিকি থেকে লাগেজ নামাচ্ছিল রণি, ততক্ষণ চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিচ্ছিল ঋতি । দোতলা বাড়িটার সামনের জমিটায় এককালে হয়তো বাগান ছিল কিন্তু এখন কিছু ঝোপঝাড় ছাড়া বাগানের চিহ্নও নেই। অনেক দিন বাড়িটায় রঙ করা হয় নি, একটু বিবর্ণ হলুদ রঙ, জানলায় ফ্যাকাশে সবুজ রঙ। বেশ বড় বাড়ি, পুরনো দিনের মতো জানলাগুলো বড় বড়, মাটি থেকে প্রায় দরজা সমান উঁচু উঁচু তাতে খড়খড়ি সাঁটা। সামনে মোটা মোটা থামওয়ালা লাল রঙের গোল বারান্দা, দরজা জানলা অবশ্য একতলা দোতলার সবই বন্ধ। ক্যাব চালককে পেমেন্ট করে রণি কাছে আসতেই ঋতি বলে ” হ্যাঁরে, এটা কি কোন ভুতুড়ে বাড়ি নাকি? আশেপাশে তো কেউ থাকে বলে মনে হচ্ছে না, দোতলায় মানুষজন আছে?
— বাড়ির মালিক দোতলায় থাকেন আর তুই তো বললি যে তোর সবুজ গাছপালা চাই, নীল আকাশ চাই, পাখী চাই, হ্যানো চাই ত্যানো চাই, বহু খুঁজে শেষে একটা এজেন্সির মাধ্যমে এই বাড়িটা পেয়েছি।
— এখান থেকে অফিস ট্রিপ পাবো তো?
— আমি সব খোঁজখবর নিয়েই ভাড়া নিয়েছি রে। কুড়ি কিলোমিটার পর্যন্ত গাড়ি দেয় আর এই জায়গাটা সেক্টর ফাইভ থেকে উনিশ কিমি, সুতরাং নো চিন্তা।
রণি বারেবারে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় আসতো শুধু বাড়ি দেখার জন্য, খোঁজ খবর নিয়ে এগারো মাসের এগ্রিমেন্টে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে।
ভিতরে ঢুকে সবকিছু দেখে ঋতির বেশ পছন্দ হলো, বাইরে রঙ না থাকলেও ভিতরের দেওয়ালে ইমালসন পেন্ট , ফার্নিচারগুলোও নতুনের মতো, দুটো বেডরুম, একটা হল উইথ ওপেন কিচেন। ঋতি মাস্টার বেডরুমটায় ঢুকে নিজের ট্রলিটা রেখে, ঘোষণা করলো ” এটা আমার ঘর আর ওই বেডরুমে তুই থাকবি। ”
— সরি ম্যাডাম, এই বাড়িতে সবই হামারা, অলগ অলগ কুছ নহী চলেগা, এটা আমাদের দুজনের বেডরুম আর ওটা হলো অল পারপাস রুম, স্টাডি বলতে পারিস কী কাপড় শুকানোর স্ট্যান্ড রাখার জায়গা, সবকিছু ওই ঘরটাকেই করবো।
— রণি, ল্যাণ্ডলর্ডকে জিজ্ঞেস করেছিস এখানে হোম ডেলিভারি পাওয়া যাবে তো ?
— নো ম্যাডাম, হোম ডেলিভারির অখাদ্য রান্না কেন খাবো?
এটা আমাদের সংসার, আমরা দুজনে মিলে রাঁধবো আর খাবো।
— আমি রাঁধবো? দূর তাহলে আর সেটা মুখে তোলার যোগ্যই হবে না। তুই রাঁধিস, আমি বরং অন্য কাজগুলো করবো।
— না, আমি রাঁধবো আর তুই আমাকে হেল্প করবি, তাহলে দেখবি কিছুদিনের মধ্যে তুইও ভালো রাঁধতে পারছিস।
রণি মানে রণিত আর ঋতি বা ঋত্বিকা দুজনেই শিলিগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে এইবছরই বি টেক করেছে , ক্যাম্পাসিং এ দুজনেই কলকাতায় দুটো আলাদা আলাদা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে । তিন বছর ধরে ওরা স্টেডি রিলেশনশিপে আছে, কয়েক বছর পরে বিয়ে করার ইচ্ছা, এখন ওরা একসাথে থাকবে বলে এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে। ভাড়ার এগ্রিমেন্ট পেপারে অবশ্য ঋতিকে রণির কাজিন দেখানো হয়েছে। প্রথম প্রথম খুব ভালোই কাটছিল ওদের সময়। সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যায়, লাঞ্চ যে যার অফিসেই করে। রাতে দুজনে মিলে রান্না করে। অফিস থেকে যাওয়ার সময়ে গাড়ি পায়, ফেরাটা নিজের নিজের সুবিধামত ঘটে। ছুটির দিনে জমিয়ে রান্না করে রণিত, ঋতি তাকে হেল্প করে। রণির হবি রান্না আর ঋতির হবি হলো বার্ড ওয়াচিং, শনি রবিবারের অনেকটা সময় ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেরায়।
ঋতি মেয়ে হিসাবে বেশ লম্বা, গায়ের রঙ মাজামাজা, চোখদুটো খুব উজ্জ্বল আর সুন্দর, মাথা ভর্তি লম্বা চুল আর রণি ছেলে হিসাবে মাঝারি উচ্চতার , গায়ের রঙ খুব ফর্সা, দেখতেও বেশ সুন্দর, হাসিখুশি, আমুদে স্বভাবের ছেলে। ঋতি আবার একটু চুপচাপ, অন্তর্মুখী , সামান্য গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে, প্রচুর বই পড়ে, আপাতত ওর বার্ডার হওয়ার শখ জেগেছে, সেলিম আলীর বই কিনে পাখি চিনছে।
ঋতির মা ডিভোর্সি, শিলিগুড়ির একটা কলেজে বটানি পড়ান আর রণিতদের পুরুষানুক্রমিক ব্যবসা, হোটেল, ক্যাটারিং সার্ভিস, চালু মিষ্টির দোকানের মালিক ওরা । রণিতের বাবা আর দাদা দুজনেই ব্যবসার দেখাশোনা করে, বাড়ির ছোটছেলে বলে রণিত খুব আদরের, ওদের পারিবারিক বন্ধনটাও বেশ জোরালো । ঋতি আবার বারো বছর পর্যন্ত বাবা মায়ের মধ্যে রোজ ঝগড়া, অশান্তি, কান্নাকাটি দেখে বড় হয়েছে , তারপরে মায়ের ডিভোর্স হলো আর ওর মা শিলিগুড়ির কলেজে জয়েন করলেন, আগে গুড়্গাঁওতে পড়াতেন। বাবার ওর জন্যে টাকা পাঠানোর কথা ছিল কিন্তু তিনি আবার বিয়ে করেছেন এবং প্রায়ই ভুলে যেতেন পাঠাতে। ওর মা আর মামলা করতে চান নি , ডিভোর্সের মামলায় প্রচুর খরচ হয়ে গিয়েছে। আজকাল মায়ের সাথে শিলিগুড়ির একজন গভর্মেন্ট কন্ট্রাক্টরের বন্ধুত্ব নিয়ে অনেকেই গুঁজগুঁজ ফুঁসফুঁস করে। ঋতির মাঝেমধ্যে পাগল পাগল লাগে। দুই বাড়ির কেউই জানে না যে ওরা এখানে একসাথে রয়েছে যদিও রণির মা ঋতির সাথে রণির রিলেশনশিপটা জানেন।
জায়গাটা বড্ড ফাঁকাফাঁকা, আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কোনো বাড়িঘর নেই। দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন, লোকটাকে দেখতে কেমন গুন্ডার মতো আর স্বভাবটাও খুব অদ্ভুত , রণি একদিন গেটের সামনে ওনাকে দেখে আলাপ করতে গিয়েছিল, উনি মুখের উপর বলেছিল ” আপনি টেনান্ট, মাসের প্রথমে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়েছেন কি না, সেইটুকুই সম্পর্ক আপনার সাথে, আপনার সাথে গল্পগাছা করার আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।” রণি খানিকক্ষণ বোকাটে মুখ করে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ চলে এসেছিল। লোকটা একাই থাকে, দরজায় তালা লাগিয়ে অফিস যায় আবার সন্ধ্যেবেলা তালা খুলে ঢোকে। রাতে রান্নাবান্নার গন্ধ ভেসে আসে। রণির ধারণা বাড়িওয়ালাটি অত্যন্ত অসামাজিক। শনি রবিবারের ছুটির দিনে ভোরবেলায় উপর থেকে ভেসে আসে নারীকন্ঠে আহীর ভৈরবের সুর বা অনেক রাতে দরবারি কানাড়ায় উচ্চাঙ্গ সংগীত । রণিদের বাড়িতে গানবাজনার চর্চা আছে তাই ও রাগরাগিণী চেনে, রণি বলে , খুব উঁচুদরের গায়িকার গলা কিন্তু কোনো প্রথিতযশা গায়িকার চেনাগলা নয়, শুধুমাত্র তানপুরা বাজিয়ে গাইছেন। রণি বলে ‘ মনে হয় পুরনো কোন রেকর্ড বাজায় লোকটা। ‘
মাস দুয়েক আনন্দেই কেটে গেছিল , তারপর এক রবিবার ওদের বাথরুমের গিজারটা ঠিকমতো কাজ করছিল না বলে রণি ওদের বাড়িওয়ালাকে ফোন করেছিল। বাড়িওয়ালা দেখতে এলেন, দেখে চলে যাবার পরে রণি ঋতিকে বলেছিল ” তুই ওনার সামনে এইভাবে শর্ট প্যান্টস পরে ঘুরছিলিস কেন? মিনিমাম একটা ক্যাপ্রি তো পরতে পারতিস? ”
—- কেন এটা কি অশ্লীল পোশাক যে আমি ওনার সামনে পরতে পারবো না? আমি বাড়িতে যা পরি তাই পরে রয়েছি, ল্যান্ডলর্ড আসবে বলে আমি কি বোরখা চাপিয়ে ঘুরবো?
— তোর সাথে কথা বলাই যায় না, আমি বলতে চেয়েছি যে বাইরের লোকের সামনে ডিসেন্ট ড্রেসেই থাকা উচিত।
—- তুই নিজে কি পরে রয়েছিস তা দেখছিস না? আমি যেহেতু মেয়ে তাই আমাকে পা ঢেকে রাখতে হবে? রণি তোর মাইন্ড সেটআপ পুরো মধ্যযুগীয়দের মতো, একটু আধুনিক হবার চেষ্টা কর।
— হ্যাঁ, তোর ধারণা তুই খুব মর্ডান আর আমি পুরো ফিউডালিস্টিক ! এখানকার মানুষেরা এখনো তোর মতো মর্ডান হয়ে উঠতে পারেন নি, ল্যান্ডলর্ড তোর দিকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিল।
—- সে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সব মেয়ের দিকেই পুরুষেরা তাকায়, মেয়েরা এসব উপেক্ষা করতে শিখে যায় একটু বড় হতে না হতেই।
ঋতির অনেক সময় খারাপ লাগে, ও না চাইলেও মাঝেমধ্যে রণির সাথে রাফ ব্যবহার করে বসে। রণির পুরো পরিবার ওর সাথে শনিবার সন্ধ্যায় স্কাইপে কথা বলে তখন ও ব্রাত্যের মতো অন্যঘরে চুপচাপ বসে থাকে, বুকের মধ্যে সামান্য হিংসার চিনচিনানি অনুভব করে যখন রণি তার ফ্যামিলির সাথে হি হি হা হা করে। ঋতির মা মাঝেমধ্যে যখন ওকে ফোন করেন তখন শুকনো গলায় শুধু কাজের কথাই বলেন, সাবধানে থেকো, পয়সাকড়ি বুঝে খরচ করবে এইসব। কখনো বলেন না যে ‘ ঋতি তুই নেই, আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে রে। কেমন আছিস সোনা? ” এইসব কথা হামেশা রণির মা রণিকে বলে থাকেন, তখন অন্য ঘরে বসে ঋতির বুকের মধ্যে কেমন একটা হিংসের জ্বালা অনুভব করে আর ও চুপচাপ বসে সিগারেট টানতে থাকে ।
একদিন যখন রণি বাড়ির সাথে গল্প গুজব করে এঘরে এসে দেখে ঋতি সিগারেট টানছে, রণি বলে বসে ” তুই এই বদভ্যাসটা কবে ছাড়বি? আশেপাশের কেউ স্মোক করলে আমার কাশি হয় তুই জানিস না? ”
ঋতিও তেড়িয়া হয়ে উত্তর দেয় ” তোর যখন কাশি হয় তখন এঘরে আসার দরকারই বা কি? যা আবার ওই ঘরে গিয়ে মায়ের আদর খাগে যা । ” রণিও রেগে উত্তর দেয় ” প্রশ্নটা আমার প্রব্লেম নিয়ে নয়, সারা পৃথিবীতে স্মোকিং এর খারাপ এফেক্ট নিয়ে কতো প্রচার চলছে সেসব জেনেও এই খারাপ হ্যাবিট তুই ছাড়ছিস না। ”
—- আমার পয়সায় আমি সিগারেট খাই কি মদ খাই তাতে কোন শালার কি? তুই তো প্রথম থেকেই জানিস যে আমি সিগারেট খাই।
—- যদিও আমি তোর শ্বশুরেরই পুত্র কিন্তু তাই বলে আমাকে শালা ফালা বলার রাইট তোর নেই।
আবার একটা ফাটাফাটি ঝগড়া হয়ে গেল, সেই রাতে আলাদা ঘরে শুয়ে ঋতি নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে আর মনে মনে ভাবে ‘ কেন আমি সবসময় আগ বাড়িয়ে খারাপ কথা বলি!’ মনে মনে ভাবে আর বলবে না কিন্তু নিজেকে চেক করতেও পারে না। কয়েক দিন পরে আবার লেগে যায় দুজনের মধ্যে সামান্য কোনো না কোন ছুতো নাতায়। যেমন একদিন সন্ধ্যায় রণির ফিরতে বেশ দেরি হচ্ছিল, ফিরলো যখন তখন মুখটা লাল, অসুস্থ দেখাচ্ছে, ফিরেই বললো ‘ ভীষণ মাথা ধরেছে রে, কড়া করে কফি বানা, মনে হয় জ্বর আসছে। ‘ কফি খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল, ঋতি কপালে হাত দিয়ে দেখে বেশ জ্বর এসেছে। ওকে একটা অ্যাসপিরিন দিয়ে রান্না করতে গেলো, ভাত বানিয়ে খেতে ডেকেছিল। খেতে এসে রণি চ্যাঁচালো ” শুধু ডিম আর আলুসিদ্ধ দিয়ে কি করে খাবো? একটু ডালও কি বানাতে পারতিস না?
—- আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যা মাসি কাজে না এলে আমরা এইরকম সেদ্ধ ভাতই খাই।
— আমি কি তোকে কোনো দিন এইরকম খাইয়েছি? সামান্য রান্নাও শিখলি না, আসলে শেখার কোনো ইচ্ছেও তোর নেই।
— না নেই, আমাদের বাড়ির সাত গুষ্টিতে কেউ রাঁধে না, আমার দ্বারাও ওইরকম দশপদে রান্না সম্ভব নয়।
— কি বলতে চাইছিস পরিষ্কার করে বল, তোদের বাড়ির সবাই ইন্টেলেকচুয়াল আর আমার বাড়ির সবাই রাঁধুনে বামুন।
—- আমি এটা বলি নি, তুই আগ বাড়িয়ে নিজেই বলছিস, যদি নিজেই ক্লেম করিস তবে তাই!
— ইন্টেলেকচুয়ালের অ্যায়সি কি ত্যায়সি ! তবু যদি পুরো শিলিগুড়ি তোর মায়ের কেচ্ছার কথা না জানতো। ওই জন্যেই তো বরের ঘরে ঠাঁই হয় নি।
ঋতির মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে , অন্ধ রাগে সে রণির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে আঁচড়াতে কামড়াতে থাকে। রণিও ঋতির হাত শক্ত করে ধরে মুছড়ে দিয়েছিল। মারপিট শেষ হলে দুজনের ঘর ভাগ হয়ে যায়, রাতে বরফ জলে ভেজানো কাপড় হাতে জড়িয়ে ঋতি নিঃশব্দে কাঁদে, ভাবে ভুল হয়ে গেছে, তিন বছর ধরে যে রণিকে সে চিনতো এই ছেলেটা সেই রণি নয়। বিয়ের আগেই তার পরিবার নিয়ে কুৎসিত কথা বলছে, হাতে কালসিটে ফেলে দিয়েছে, এর সাথে সারাটা জীবন সে কিভাবে কাটাবে? পরের পুরো সপ্তাহে সে ফুল হাতা শার্ট পরে অফিস করেছে, সম্ভবপর সবরকম খোঁজ চালিয়েছে একটা থাকার জায়গার খোঁজে। রণির সাথে বাক্যালাপ বন্ধ, রাতের খাবার দুজনেই বাইরে থেকে কিনে আনে।
পরের উইকএন্ডে রণি এসে বলে ” তুই আমার সাথে কথা বলছিস না কিন্তু এমন একটা জিনিস চোখে দেখে তোকে না বলে থাকতেও পারছি না। উপরে ল্যান্ডলর্ড ছাড়াও কেউ একজন থাকে। আমি নিজের চোখে দুদিন দেখেছি, প্রথমবার ভেবেছিলাম চোখের ভুল কিন্তু কাল বিকেলে আবার উপরের বারান্দায় আমি কারুর ছায়া দেখেছি, মনে হলো কোনো মহিলা হবেন!
তারপর দেখি দরজায় যেমনটি তালা লাগানো থাকে তেমনটি লাগানো আছে। মনে হয় গুন্ডাটা কোনো মহিলাকে আটকে রেখেছে ঘরের মধ্যে, আমার কি পুলিশকে ইনফর্ম করা উচিত? ” তখন ঋতিরও মনে হয় সে এক শনিবার পিছনের বাগানে সিগারেট খেতে গেছিল, ঘরে খেলে রণির অসুবিধা হয় তাই, ওরও মনে হয়েছিল নাইটি পরা কারুর ছায়া উপরের ঘরে। ঋতি বলে ” পুলিশকে ইনফর্ম করার আগে আমাদের কনফার্ম হওয়া উচিত সত্যিই কোনো মহিলাকে লোকটা আটকে রেখেছে কি না? ”
—- কিন্তু আমরা কিভাবে কনফার্ম হবো? লোকটা তো দরজায় তালা লাগিয়ে অফিস যায়, কোনো ছুঁতোয়ও যদি চেষ্টা করি উপরে যাওয়ার ও অ্যালাউ করবে কেন?
— – লোকটা সিঁড়িঘরের দরজা দিয়ে উপরে যায়, একতলা থেকে দোতলায় যাবার আর একটা দরজা তো আছে আমাদের দিকে।
—- তাতে কি হলো! লোকটা তো সেই দরজা ওইদিক থেকে বন্ধ করে রেখেছে।
—- দরজার এইদিকেই হ্যাচবোল্ট লাগানো, ওইদিকে মনে হয় শুধু ছিটকিনি বন্ধ, লোকটা যখন বাড়িতে থাকে অনেক সময়ই সিঁড়ি ঘরে ঢোকার দরজাটা খোলাই থাকে, তখন যদি চুপিচুপি ওই ছিটকিনিটা খুলে আসা যায় তবে লোকটা যখন অফিসে যাবে তখন আমরা এইদিক দিয়ে উপরে গিয়ে দেখতে পারি সত্যিই কাউকে গুন্ডাটা আটকে রেখেছে কি না!
ঋতি আর রণি তক্কেতক্কে থাকে, না ওদের মধ্যে ভাব হয় নি বরং একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে। দুজনেই অফিসের টিম লীডারকে বলে ইভিনিং ডিউটি নিয়েছে তাই বেলায় অফিস যায়, একদিন সিঁড়ির দরজা খোলা দেখে রণি চুপিচুপি গিয়ে ওইদিকের ছিটকিনি খুলে এসেছে। ওদের দিক থেকে বন্ধই আছে তাই বাড়িওয়ালা বুঝতে পারে নি। বাড়িওয়ালা দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যাবার পরে ওরা সিঁড়ি বেয়ে চুপিচুপি দোতালায় যায়। দোতালার জানলা দরজা প্রায় সব বন্ধ তাই খানিক আবছায়া অন্ধকার হয়ে রয়েছে ঘরদোর, ঋতি ভেজানো দরজা খুলে শোবার ঘরে মুখ যেই বাড়িয়েছে, এক নাইটি পরা মহিলা কেমন একটা আওয়াজ করে ওঠে। ভয় পেয়ে ওরা দুড়দাড় করে পালিয়ে এসেছিল একতলায়।
সন্ধ্যেবেলা ল্যান্ডলর্ড বেল বাজালো, ওরা জানতো লোকটা আসবে তাই তৈরিই ছিল। লোকটা এসে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললো ” আপনারা কাল পরশুর মধ্যে ঘর ছেড়ে দেবেন। আমি প্রথমেই বলে রেখেছিলাম অতিরিক্ত কৌতুহলী ভাড়াটে আমি রাখবো না, আপনারা ট্রেসপাস করেছেন, আমার অবর্তমানে আমার বাড়িতে ঢোকার জন্য আমি আপনাদের পুলিশে দিতে পারি, তা জানেন? ” রণি তেড়িয়া হয়ে উত্তর দেয় ” আপনার মতো লোকের বাড়িতে আমরাও থাকতে চাই না। আপনি একজন মহিলাকে তালাবন্ধ করে আটকে রেখেছেন, আমরাই কাল পুলিশের কাছে যাবো ভাবছি। ”
লোকটা হো হো করে হেসে উত্তর দেয় ” যান যান পুলিশের কাছে যান, আমি আটকে রেখেছি আমার স্ত্রীকে ? ”
— এখন ওই মহিলা স্ত্রী হয়ে গেলেন? স্ত্রীকে কি কেউ তালা বন্ধ করে আটকে রাখে?
—- শোনো ছোকরা ! মিথ্যে কথা তোমরাই বলেছ, এই মেয়েটি যে তোমার বোন নয় সেটি গীজার খারাপের দিন এসেই আমি বুঝেছিলাম কিন্তু আমার শুধু রেন্টের টাকাটায় মতলব তাই কিছু বলি নি।
লোকটা তার পকেট থেকে পার্স বের করে একটা ফটো দেখায়, প্রায় ঋতির বয়সী একটা মেয়ের ফটো, মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী।
লোকটা বলে ” আমার স্ত্রীর কম বয়েসের ছবি আর তার গানের গলা নিশ্চয়ই শুনেছ। এখন মনে হচ্ছে তোমরা তাকে দেখতে পাও নি ঠিক করে, চলো উপরে চলো, আমার স্ত্রীকে দেখে আসবে।। ”
লোকটার কথায় ওরা আবার উপরে যায়, ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে, লোকটা গিয়ে মহিলাকে নিয়ে আসে, বলে ” বেলু, এরা আমাদের নীচে থাকেন , আজ এরাই উপরে এসেছিলেন।” ” মহিলা পিছন ফিরে ছিলেন, ঘুরিয়ে দিতেই রণি আর ঋতি অতিকষ্টে নিজেদের আঁৎকে ওঠার আওয়াজ আটকায়। মহিলার মাথায় একটা কাপড় আটকানো কিন্তু মাথায় যে চুল নেই তা বোঝা যাচ্ছে। মুখের একদিকের চামড়া পুড়ে গিয়ে দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, চোখদুটোও গলে গেছে, গলা আর বুকের উপরের দিকের চামড়া কুঁচকে গিয়ে এক হয়ে গেছে।
লোকটি মহিলাকে বলেন ” এরা আমাদের বাড়িতে প্রথম বার এসেছেন, একটু চা বানাবে ওদের জন্য। ” মহিলা ধীরে ধীরে কিচেনের দিকে চলে যান। বাড়িওয়ালা আস্তে আস্তে বলেন ” ঈশ্বর বেলুর চোখ কেড়ে নিয়েছেন বটে কিন্তু অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে আরও তীক্ষ্ণ বানিয়ে দিয়েছেন। ও তোমাদের দেখতে পায় নি ঠিকই কিন্তু অনুভবে বুঝেছে যে কেউ বা কারা উপরে উঠে এসেছে । আজকাল গ্যাস জ্বালিয়ে টুকটাক কাজও করতে পারে, পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় শিক্ষক, সেই সব কিছুই শিখিয়ে দেয়৷
ও আর আমি একই পাড়ায় বড় হয়েছি, ও ছিল আমার বন্ধুর বোন । পড়াশোনায় ভালো, দেখতেও অপূর্ব সুন্দরী , ছোট থেকেই ওকে আমার ভালো লাগতো কিন্তু আমি বা ওর দাদা কেউই তেমন পড়াশোনা শিখি নি, দেখতেও যে আমি ভালো না সে তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছ। তাই আমার ভালোলাগাটা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিলাম। বেলুর পিছনে প্রচুর ছেলে লেগেছিল, ও কিন্তু কারুর দিকেই ফিরে চায় নি , ওর ইচ্ছে ছিল গান নিয়ে এগোবার কিন্তু এক নির্বোধ শয়তানের তা সহ্য হলো না। প্রত্যাখ্যানের জ্বালায় সে ওর মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল।
রাস্তায় পড়ে ছিল, খবর পেয়ে আমি দৌড়ে ওকে স্পট থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওর দাদাটা এতোটাই স্বার্থপর যে খরচের ভয়ে ওকে একদিনও হাসপাতালে দেখতে পর্যন্ত যায় নি।
মাসের পর মাস হাসপাতালে নেটের ঘেরাটোপে পড়েছিল, বাঁচার কথাই ছিল না, বহু কষ্টে প্রাণে বেঁচেছে কিন্তু চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, গলার স্বর চলে গেছে, এমনকি খাদ্য নালীরও ক্ষতি হয়ে গেছে ।
ওকে বাঁচাতে আমার ব্যবসার শেষ মূলধনটুকুও খরচ করে ফেলেছি, যাদবপুরে দোতলা বাড়ি ছিল তাও বেচে দিয়েছি, ওর দাদার সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই । আপদ বিদেয় হয়েছে বলে বরং সে নিশ্চিন্ত হয়েছে। তবে যে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল তাকে আমি ছাড়ি নি, পুলিশের পিছনে পড়ে থাকার জন্যেই হোক বা ভগবানের ইচ্ছার জন্যেই হোক লোকটার দীর্ঘ সাজা হয়েছে। ওর গান তো শুনেছ নিশ্চয়ই, এখন আর ও গান দূরে থাক কথাই বলতে পারে না, গোঁ গোঁ করে যা বলে তা শুধু আমিই বুঝি। শক্ত খাবার খেতে পারে নি বহুকাল, আজকাল সেমি সলিড খাবার খেতে পারছে। আমি কাজে যাবার সময়ে তালাবন্ধ করে যাই, ভয় লাগে যে ওর কমজোর অবস্থার সুযোগ নিয়ে কেউ বা কারা যদি ওর উপর হামলা চালায় তবে ও বিন্দুমাত্র বাধা দিতে পারবে না। অনেক ক্ষতি হয়েছে কিন্তু তবুও তো বেঁচে আছে, রাতে ঘুমের মধ্যে যখন ওর মৃদু শ্বাসের আওয়াজ পাই তখন ওকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য ঠাকুরের কাছে কৃতজ্ঞ হই আবার এও ঠিক, ওর এই অবস্থা না হলে ও কোনো দিনই আমার হতো না।
ঋতি রণি একটা ঘোরের মধ্যে নীচে চলে এসেছিল, সেদিন রাতে আবার ওরা একসাথে ওদের পুরনো বিছানায় শুয়েছিল।
রণি বুঝতে পারছিল ঋতি দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাঁদছে, ও ঋতির মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে ” সরি সোনা, আমায় মাপ করে দে। আমি তোর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি, আমি তো জানি তোর ট্রমাটিক চাইল্ডহুডের কথা তবু আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি। ছোটখাটো ইগো এসে দাঁড়ায় সম্পর্কের মধ্যে আর ঘুণপোকার মতো রিলেশনকে নষ্ট করে দেয়। আমি আর কখনো এমন করবো না, তুইও আমায় একটু হেল্প করিস। ”
ঋতি বলে ” না, আমিই তো প্রথমে খারাপ কথা বলেছিলাম। উপরের ভদ্রলোক যেমন মন, প্রাণ সমর্পণ করে ভালোবেসেছেন, আমরা কেন তেমনটি পারি না রে ! আমি যদি অসুখে, অ্যাক্সিডেন্টে বা বুড়ো হয়ে কুৎসিত হয়ে যাই তবেও কি তুই ওই লোকটার মতো ভালোবাসবি আমায় ? রণিরও চোখে জল আসে, ফিসফিসিয়ে বলে ” জানি না রে, আমি সত্যিই কী করবো জানি না রে কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোকে সব অবস্থাতেই ভালো বাসতে চাই, শুধু তুই আমার পাশে থাকিস, কাছে থাকিস চিরকাল।
–~০০০XX০০০~–