অন্ত্যেষ্ঠি
✍ ডঃ রতনশ্রী ভিক্ষু
একদিন সকালবেলা দু’ জন লোক এসে উপস্থিত। তারা জাতিতে চাকমা। নেঙটি পরনে আর কাঁধে একটি শান্তিনেকেতনী ঝোলার মতো থলি। থলিতে রয়েছে ধারালো দাঁ। স্থানীয় অমলদের মন্দির। মন্দিরে একজন অাধবয়সী পুরোহিত থাকেন।তিনি প্রতিদিন মন্দিরে পূজো আর্চা করে থাকেন। মন্দিরটি অন্য কোন মন্দির নয়, একটি সার্বজনীন বুদ্ধমন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একনদী। নাম তার ছামনু নদী। এক স্রোতা। পাহাড়ের বিধৌত বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে এই নদীতে পতিত হয়।
কথিত হয় এই ছামনু নদী গরম নদী। কেউ যদি নদীতে দাড়িঁয়ে কারও সম্বন্ধে ভালমন্দ বলে ফেলে তাহলে আর রক্ষা নেই।একটা কিছু তো ঘটবেই। সে রকম একটা ঘটনা অমলের গুরুদেবের সঙ্গে ঘটেছে। ঘটনটি যেদিন ঘটল সেদিন অমলের দাদা বিমল নদীতে স্নান করছিল। একজন ভদ্রমহিলা পাহাড়ের গভীর জঙ্গল থেকে ঘর ছাউনের ঘাস যাকে কথ্য ভাষায় ছন বলে তা কেটে বান্ডিল বেধেঁ মাথায় করে নিয়ে সেই নদী পার করছিল। হঠাৎ তার মনে কি হল জানা গেল না ঐ স্নানরত বিমলকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের বুদ্ধমন্দিরের পুরোহিতকে উদ্দেশ্য করে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাচ করেছে। বিমল ঐ গালিগালাচ শুনতে শুনতে একরকম বলেই ফেলল, আজ এই ভদ্রমহিলার কপালে শনি আছে। ভদ্রমহিলা ছনের বান্ডিল মাথায় করে তার বাড়ীর দিকে চলে গেল। বিমলও নদীতে স্নান করে বাড়ী চলে গেল।
এখন যেই ভদ্রমহিলা পাহাড়ের জঙ্গল থেকে ছন কেটে বাড়ী ফিরছিল, সেই ভদ্রমহিলা বাড়ী পৌঁছে মাথা থেকে ছনের বান্ডিল তার উঠোনে ফেলে প্রস্রাব করতে বার্থরূমে গেল। বার্থরূমে ঢুকেই হটাৎ প্রস্রাব বন্ধ হয়ে মুহূর্তেই মৃত্যুবরণ করল। খবরটা ছামনু গ্রামে চাউর হয়ে গেল। গ্রামবাসীকে বিমল ঘটনাটি পরিষ্কার করল। সকলেই একবাক্যে তা মেনে নিল। বুদ্ধমন্দিরের পুরোহিত ঘটনা শুনেই আফসোস করলেন এবং বললেন আমি তো ভদ্রমহিলাকে চিনি না, তবুও কেন সে আমাকে ঐরকম একটা জায়গায় দাড়িঁয়ে গালিগালাচ করল বুঝলাম না, অথচ সে দৃষ্টধর্মবেদনীয় কর্মফল ভোগ করল। দৃষ্টধর্মবেদনীয় কর্মফল হল সঙ্গে সঙ্গে কর্মের ফল ভোগ করা বুঝায়।
ছামনু নদী যে নদীতে গিয়ে মিশেছে তার নাম মনুনদী। মনুনদীর নামে একটা অঞ্চল আছে। তাকে মনুঘাট বলে। ছামনু থেকে মনুঘাটের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।
মনুনদীর ছা ছামনু, ছামনুর ছা মনুর নাতি, তাই তাকে বলে নাতিনমনু, নাতিনমনুর ছা মনুর পতিন, তাই তাকে বলা হয় পতিনমনু। অন্ত্যেষ্ঠির স্থল হল পতিনমনু। ছামুন গ্রাম থেকে ৪ ঘন্টার হাঁটা পথ।
ছামনু বুদ্ধমন্দিরের নাম অজন্তা বিহার। অষ্টকোনাকৃতি মন্দির। মন্দিরের জায়গা প্রায় তিনবিঘা।একটা বোধিবৃক্ষ বা অশ্বত্থবৃক্ষ আছে। বৃক্ষটি বুদ্ধগয়া থেকে নিয়ে এক বৌদ্ধ পুরোহিত বোধিভদ্র রোপন করেন। বোধিবৃক্ষটিও জাগ্রত; ঐ বৃক্ষের নীচে বসে কোন প্রার্থনা করলে সেই প্রার্থনা ফলপ্রসু হয়। মন্দিরের দক্ষিণপার্শ্বে একটি কুয়া আছে। প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে কুয়ার জলে দেবতারা স্নান করে বুদ্ধকে পূজা করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে যে মূর্তিটি আছে তা বর্মা( বর্তমান মায়ানমার) থেকে আনা হয়েছে। মন্দিরটি পূর্বমুখী। মন্দিরের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা গেছে। রাস্তাটি মূলতঃ বাজার ঘেষে মনুনদী পার করে বাস স্ট্যান্ডে মিশেছে। বর্তমানে রাস্তাটি পাকা হয়েছ। নব্বইডিগ্রী বরাবর মনুনদী এবং ছামনু নদীর উপর পাকা সেতু নির্মিত হয়েছে। বাজারটিকে সকলে ছামনু বাজার বলে। এই বাজার সপ্তাহে একবারই বসে। সমস্তরকম সবজি, মাছ, মাংস পাওয়া যায়। সব থেকে বড় কথা হল এখানকার জলটা খুব ভাল। রান্না করার সময় এখানকার জল ব্যবহার করলে খাবার অতীব সুস্বাদু হয়। ছামনুর অদূরে লঙতরাই পাহাড়। প্রতিবছর শিব চতুর্দশীর দিনে এই পাহাড়ে মেলা বসে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। পাহাড়ের চুড়ায় একটি পাথর আছে যার তলার দিকে চুল পরিমাণ অন্য পাথরের সঙ্গে যুক্ত। এই অভিনব সংযুক্তি সকল মানুষকে বিস্মিত করে। একবার অমল, বিকাশ, উত্তম সহ আরও অনেকে ঠিক করল লঙতরাই পাহাড়ে আরোহন করবে। সঙ্গী হিসাবে তারা তাদের মন্দিরের পুরোহিতকেও নেবে। মনস্থ করেই তারা একসঙ্গে লঙতরাই পাহাড়ে আরোহন করতে চলল। পাহাড়টি নদীগর্ভ থেকে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার। যতই পাহাড়ে ওঠা হচ্ছে ততই পাহাড়ী মেটো পথের দু’ ধারে নির্জনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একাকী হলে ভয় তো লাগবেই। অবশেষে ২ ঘন্টা হাঁটার পর গন্তব্যস্থলে তারা পৌঁছাল। এভাবে তারা কয়েকবছর লঙতরাই পাহাড়ে আরোহন করেছে। মানুষের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা যে লঙতরাই পাহাড়ে আরোহন করলে পুণ্য হয়। লঙতরাই দেবতা আশির্বাদ করেন। তবে কেউ যদি লঙতরাই দেবতাকে অমান্য করে, বিদ্রুপ করে, গালিগালাচ করে, তার আর রক্ষা নেই মৃত্যু সুনিশ্চিত। লঙতরাই দেবতা হল একটা বিকলাঙ্গ হাতির রূপে অাবির্ভূত হন। তার সামনের পা দুটি ছোট। এই অবস্থায় বিদ্রুপকারীকে আক্রমণ করে। বিদ্রুপকারী অন্যকারো মধ্যে লুকিয়ে থাকলে, লঙতরাই দেবতা শুধু তাকে অদ্ভূত প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করে অন্যদের মধ্য থেকে বের করে নিয়ে শুড় দিয়ে উপর থেকে আছড়ে মেরে ফেলে। এই কাজটা অনেকটা অভিনব। তাই কেউ সহজে লঙতরাই দেবতাকে অবজ্ঞা করে না। ছামনু বাজারের পূর্বদিকে মনুনদীতে পতিত খালের ধারে একটা লঙতরাই মন্দির আছে। এলাকার মানুষ ছাড়াও ভিন্ন এলাকার মানুষজন লঙতরাই দেবতাকে পূজা দিতে আসে। সেই মন্দিরের পূজারী একজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ। তবে সে আবার কালি সাধকও বটে। ছামনু নদীর মোহনায় তার একটা কালী মন্দিরও আছে। সেই কালীসাধক বর্তমানে বেঁচে নেই।
বৌদ্ধরা তাদের মন্দিরের পুরোহিতকে “ভন্তে” বলে ডাকেন। মন্দিরে থাকাকালীন সেই “ভন্তে” এলাকার বৌদ্ধ হিন্দু তথা উপজাতীয়দের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। কারণ তিনি সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন ছিলেন। বিশেষকরে প্রতিরক্ষা ডিপার্টমেন্টর কর্মকর্তাগণ তাকে খুব ভালবাসতেন। সেই সময় ছামনু অঞ্চল আশির দশকে উগ্রপন্থীর বাড়বাড়ন্ত ছিল। তাদের দমনের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর চেষ্টার অন্ত ছিল না। রীতিমত তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল উগ্রপন্থীরা। তাই ঐ বুদ্ধমন্দিরের চত্বর রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী উগ্রপন্থী দমনের জন্য ব্যবহার করত। যেহেতু মন্দিরের বিপরীত পার্শ্বে ছামনু নদীর অপর তীরে উগ্রপন্থীদের ঘাটি ছিল। বুদ্ধমন্দিরের ভন্তেকে তাদের সঙ্গে হিন্দীতে কথা বলতে হত। তারা ভন্তের কাছ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক কথা-উপখ্যান-গল্প শুনতে চাইতেন। ভন্তেও ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দী ভাষায় সমস্ত কথা বলতে চেষ্টা করতেন। তারা ভন্তেকে বিপদের সময় কেমন করে বাঁচতে হবে তার টিপস দিতেন। কেননা কখন উগ্রপন্থীদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা কর্মীদের গুলি বিনিময় হবে তার সঠিক তথ্য আগে জানা যেত না। একবার উগ্রপন্থীদের ঘাটিতে মিলিটারীর প্রধানের গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন রাজ্যপাল জেনারেল কে. ভি. কৃষ্ণ রাও এসেছিলেন। তিনি ছামনু মিলিটারী ক্যান্টনমেন্টে যাবার সময় বুদ্ধমন্দিরের পাশ দিয়ে যেতেই মন্দিরের ভন্তেকে দেখে মন্দিরে প্রবেশ করে ছিলেন। মন্দিরের ভন্তেরও আগে থেকে প্ল্যান ছিল রাজ্যপালকে মন্দিরে প্রবেশ করাবেন।ঠিক মন্দিরের ভন্তেকে অনুসরণ করে তিনি মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেন। মিলিটারীদের নিঃছিদ্র নিরাপত্তায় ধর্মীয় রীতি মেনে রাজ্যপাল রাও বুদ্ধের সামনে মোমবাতিধুপ জ্বালালেন এবং দু’ মিনিট প্রার্থনাও করেছিলেন। তাঁর সম্মুখে দান বাক্স ছিল, তিনি নিজ পকেট থেকে ২৫০/- টাকা দান দিয়েছিলেন। অতপর রাজ্যপাল রাও ধীরে ধীরে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেলেন।
রাজ্যাপালকে মন্দিরে প্রবেশ করানো নিয়ে মানুষের মধ্যে সেদিন কৌতুহলের অন্ত ছিল না।এলাকার মানুষ মন্দিরের ভন্তের স্বকীয় উদ্যোগ দেখে অত্যন্ত খুশী হলেন। ছামনু বাজারে মন্দিরের ভন্তের প্রশংসায় আপামর মানুষজন পঞ্চমুখ।
অন্ত্যেষ্ঠি শব্দের অর্থ হল মৃতদেহের সৎকার। এই কাজ সম্প্রদায়গতভাবে ভিন্ন ভিন্ন হয়। বৌদ্ধরা মৃতদেহ দাহ করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দাহও করেন আবার মাটিতে কবরও দেন, খ্রীষ্টানরা এবং মুসলমানরা মাটির নীচে খবর দেন। তাছাড়া অন্যান্য অনেকে তাদের মত করে মৃতদেহ সৎকার করেন। বলাবাহুল্য মৃতদেহ সৎকারে বৌদ্ধরা প্রথম দাহ করা প্রথা চালু করেন। তার আগে কোন এক প্রকান্ড জায়গায় মৃতদেহ রেখে দেওয়া হত। তাই অবস্থাকে “মশান” বলা হয়েছে। দাহক্রিয়া প্রবর্তন হলেই দাহের স্থানকে “শ্মশান” বলা হয়েছে। মাটি দেওয়ার স্থানকে “কবরস্থান” বলা হয়েছে।
একদিন সেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সেই দু’জন ভদ্রলোক যাদের পরিচয় লেখার শুরুতেই দেওয়া হল, তারা এসে মন্দিরের পুরোহিত যাকে ভন্তে বলে সম্বোধন করা হয়, তাঁর কাছে এসে বিনয় কন্ঠে বললেন, আপনাকে( ওদের ভাষায় তোকে) আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়?
পতিনমনু।
কি ব্যাপার?
একজন মরে গেছে। তাকে মন্ত্র দিতে হবে। মন্দিরের পুরোহিত ভন্তে, ভয়ে ভয়ে বললেন, যাব।
যাক যাদের বাড়ীতে ঐ পুরোহিত ভন্তের খাবারের ব্যবস্থা ছিল, তাদের জানালে তারা তাড়াহুড়ো করে পাঠিয়ে দেয়। অসময়ে কি আর পেটপুরে খেতে পারে?
যথারীতি তাদের সঙ্গে ছামনু মন্দিরের পুরোহিত ভন্তে চললেন।
কোথায়?
পতিন মনু।
হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের গা ঘেষে মেটো পথ ধরে চললেন। এমন এমন পাহাড়ী জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তা, সুনসান, কোন সাড়া শব্দ নেই। মন্দিরের পুরোহিত ভন্তে, মাঝেমাঝে ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। উগ্রপন্থীর ভয় তো আছে। উগ্রপন্থীর বেশে অন্ত্যেষ্ঠির নাম করে গায়েব করে দেবে না তো! এত সব হাজারও চিন্তা তাঁর মনে ভিড় করছে। যেতে যেতে আবার কোথাও একটা দুটো ঘর দেখতে পেলে মনে সাহস আসে। যখন দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন তিনি ভয়ে কাতর হয়ে যাচ্ছেন। প্রায় ৪ ঘন্টা পর সেই পতিনমনু পৌঁছানো গেল।
দূর থেকে দেখা গেল কতকগুলি লোক জটলা বেধেঁ কি যেন করছে।
কাছে যেতেই লোকগুলি বলল, ভন্তে, তুই এইছিস্। ভালই হল। একজন বয়ষ্ক বলে উঠল ভন্তেকে একটু দারু দেয়। তে বহুত দূরত্তুন এইচ্ছে। মন্দিরের পুরোহিত ভন্তে দারু কি জিনিস জানে? সে খেতে অস্বীকার করল। বয়ষ্ক লোকগুলো আর তেমন একটা জোর করল না।
এইবার ঐ পুরোহিত ভন্তেকে ওরা বলল মন্ত্র পড়তে। এখানে বলে রাখা উচিত, মৃতদেহটি একজন বৃদ্ধামহিলার। মাচার উপর ঘর। মৃতদেহটি মাচার উপর শুয়ে রাখা হয়েছিল আগে থেকেই।
পুরোহিত ভন্তেকে একপাশে বসতে দিল। এবার একজন বলল, ভন্তে আগে তুই শুরু গর। ওরা করকে গর বলে।
পুরোহিত ভন্তে, যাবতীয় মন্ত্রাদি পাঠ শেষ করলেন।এইবার দক্ষিণা দেবার পালা। সকলেই যার যার জ্ঞাতিদের স্মরণ করে মৃতদেহের গায়ের উপর বিভিন্ন প্রকারের কয়েনগুলি রাখতে লাগল। পরিশেষে ঐ দক্ষিণা দেবার কাজ যখন শেষ হল, তখন বয়ষ্ক একজন বলল, ভন্তে তুই মরার গাত্তুন পয়সাগুলি নিয়ে ফেল। পুরোহিত ভন্তে তাদের কথানুযায়ী কাজ করল। তাঁর ব্যাগের অর্ধেক হয়ে গেল।
এইবার কয়েকজন বলল, ভন্তে তোকে এখন চাইম্মেদং কইত্তে হইব।
পুরোহিত ভন্তে চিন্তায় পড়ে গেল, কি করা যায়?
তিনি একটা উপায় বের করলেন, মৃতদেহ দাহ করার জন্য যে শ্মশান সাজানো হল তার পাশে একটি লম্বা বাঁশের মাথায় একটা সাদা কাপড় ঝুলিয়ে দিলেন।
মরা পোড়ানোর লোকগুলি মৃতদেহটিকে শ্মশানে তুলে নিল। এইবার পুরোহিত ভন্তে, সাদা কাপড় ঝোলানো বাঁশের গায়ে দাঁড়িয়ে একটা উপজাতীয়দের তৈরী গামছা বাঁশে বাঁধলেন। অতঃপর তিনি এক হাতে গামছা ধরলেন এবং মন্ত্র পড়তে লাগলেন। সেখানেও পূর্বের মত দক্ষিণা দিল।
এবার মুখাগ্নির পালা। সাতজন নিকটাত্মীয় এক একজন একটি করে পাটকাঠি জ্বালিয়ে মৃতদেহকে প্রদক্ষিণ করে মৃতদেহের পা যে দিকে আছে সে দিকে রেখে দিচ্ছে। যখন সাতটি পাটকাঠি একসঙ্গে হল তখন শ্মশান প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। পুরোহিত ভন্তের কাজ এখানেই শেষ। অর্থাৎ অন্ত্যেষ্ঠি কার্য শেষ।
এবার পুরোহিত ভন্তেকে নিয়ে ছামনু বাজার ফিরবেন। সাধারণতঃ উপজাতীয়রা কাউকে সঙ্গে কর গ্রামে যে পথ ধরে নিয়ে যায়, সেই পথ দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায় না। পুরোহিত ভন্তেকে নিয়ে সেই দু’জন ভদ্রলোক নদী বক্ষের উপর দিয়ে ছামনু বাজার ফিরছে। আঁকাবাঁকা নদী, পতিন মনু থেকে নাতিনমনু, নাতিন মনু থেকে ছামনু। সেই পথ আরও ভয়ঙ্কর। সেক্ষেত্রে পুরোহিত ভন্তে তো বাঙালী। উপজাতীয়রা বাঙালী দেখতে পারে না। এই ভয় মনে মনে কাজ করছিল। মাঝখানে পুরোহিত ভন্তে ভয়ে কাতর হয়ে শরীর কাঁপছিল। দূরে দেখা গেল, রাস্তার পাশে আগুন জ্বলছে। তাঁর আগুন পোহাতে ইচ্ছা হল। বলা বাহুল্য যে সময়টা ছিল শীতকাল। অবশেষে পুরোহিত ভন্তে আগুন পোহায়ে শরীরটাকে একটু গরম করে নিলেন। তিনি একবারও চিন্তা করেননি যেই আগুনে তিনি শরীর তাঁতালেন, সেই আগুন কি স্বাভাবিক কোন আগুন। সেই আগুনটা স্বাভাবিক ছিল না, সবে মাত্র কোন মৃতদেহ এখানে কেউ পুড়িয়ে গেছে। পুরোহিত ভন্তের আর ভয় নেই কারণ তিনি লোকালয়ের কাছে চলে এসেছেন।এই জায়গা থেকে ছামনুবাজার মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্ব।
যথারীতি তারা তিন জনই ছামনু বাজার সংলগ্ন মন্দিরে পৌঁছে গেছেন। এটা ছিল পুরোহিত ভন্তের জীবনের এক অনুপম অভিজ্ঞতা। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও তিনি এই অভিজ্ঞতা ভুলতে পারবেন না।
–~০০০XX০০০~–