নববর্ষ
✍ সলিল চক্রবর্ত্তী
“গুড মর্নিং দাদু, হ্যাপি পয়লা বৈশাখ।”
বছর দশেকের নাতি টয় প্যান্টের ভিতর জামা গুজতে গুজতে ভীষণ ব্যাস্ততার সাথে অমিতাভ বসুর ঘরে ঢুকে উইশ করেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কারণ দেরি হলে মা বকবে। সপ্তাহে এক দিন ড্রয়িং ক্লাস লেট হলে পিছিয়ে পড়বে। দাদু মুচকি হেঁসে – “সুপ্রভাত দাদু ভাই, শুভ নববর্ষ”।
দশ বারো বছরের টয় দাদুর অন্ধের যষ্টি। কিন্তু মনের ক্ষুধা নিবারণে নাতিকে আর কাছে পান কই ? সমস্ত সপ্তাহ ধরে তার এডুকেশন রুটিন চলে, শৈশব জীবনটা বুঝে নেওয়ার ফাঁক ফোকরও নেই। দাদুর ইচ্ছা একমাত্র নাতি বড় স্কুলে পড়ুক, ভালো ইংরেজি জানুক, কিন্তু বাংলা কালচার যেন লোপ না পায়। ড্রাইভার দুই তিন বার গাড়ির হর্ন বাজাতেই বৌমা টয়কে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
কোলকাতা শহরের তিন কামরার ফ্ল্যাট টাই এখন অমিতাভ বাবুর কাছে গ্রাম বা পাড়া। রুটিন মাফিক কিছু কাজ আর দিনের বাকি সময় খেয়ে ঘুমিয়ে অবসর জীবন কাটানো। কমপ্লেক্সের দারোয়ান আর তাঁর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই , দারোয়ান দরজার বাইরে পাহারা দেয়, বোস বাবু দেন ভিতরে। ছুটির দিনগুলোতে ব্যাস্ততা যেন আরো বেড়ে যায়। ফলে তাঁর অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। উনি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন দোকান পাঠ সব খুলে গেছে কিন্তু কোনো সাজ সাজ রব নেই। অথচ ফার্স্ট জনুয়ারির সপ্তাহ দুই আগে থেকেই দোকান পাট সব সেজে ওঠে। চায়না লাইটে মুদি, পান বিড়ির দোকানও সেজে ওঠে। হালখাতা প্রায় উঠেই গেছে। বিকালের দিকে সাত আট রকম মিশিয়ে এক বাক্স মিষ্টি আর ঠাকুরের ফটো যুক্ত একটা পঞ্জিকা ক্যালেন্ডার এখন আর ঘরে আসে না। ছেলে রাতে বাড়ি ফেরার সময় হয়তো নামি কোম্পানির চকচকে মোড়কে লাড্ডু বা শনপাপড়ী নিয়ে আসবে।
মনটা কেমন পানসে হয়ে গেল। বাইরে রোদ্দুরের তাপটা অনেক বেড়ে গেছে। বোস বাবু ব্যালকুনি থেকে ঘরে এসে আরাম কেদারাতে শরীরটা এলিয়ে দিলেন। একটা গরম বাতাস জানালার বাইরে দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো, তাতেই শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল। বোস বাবু চোখ বন্ধ করে পৃথিবীর সব থেকে দ্রুতগামী যানে চেপে বসলেন। যাতে করে ষাট বছর থেকে সেকেন্ডের মধ্যে দশ বছরে পৌছে যাওয়া যায়।
ভোর পাঁচটায় টাইম পিস ঘড়ির এলার্ম ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠল। ছোট্ট অমিতাভের ঘুমের ঘোর তখন কাটেনি, পাশ বালিশটা পাঁজা করে পাশ ফিরে শোয়। ঠাকুমা জানালা খুলে দিয়ে সুতির তালি দেওয়া মশারিটা পেরেকের এক কোন গুজতে গুজতে দাঁত ফোকলা গালে গান ধরেছেন – “এস হে বৈশাখ এস এস”। অগত্যা অমিতাভ বিছানা ছেড়ে হাতে এক খাবলা লাভা মাজন নিয়ে পুকুর পাড়ে যায়। পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে গ্রামের রাস্তা গিয়ে উঠেছে নকপুলের বড়ো রাস্তায়। পুকুর পাড়ে আরো দুই চারটে বাচ্চা আসে। দাঁত মাজা উপলক্ষ মাত্র, লক্ষ হলো সারাদিনের খেলার রুটিন। পচা নামে নয় বছরের ছেলেটি ঘুটের ছাই দিয়ে দাঁত মাজছিলো, ওর আঙ্গুল থেকে ঘুটের ছাই মেশানো লালা গড়িয়ে কব্জি বেয়ে কনুই দিয়ে পড়ছে। দূর থেকে রবীন্দ্র সংগীতের আওয়াজ ভেসে আসলো। কচি মন উৎকন্ঠায় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। পয়লা বৈশাখের প্রভাত ফেরি ততক্ষণে অনেক এগিয়ে এসেছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা শাড়ি ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে লাইনের প্রথমে আছে। অমিতাভর বাবা বাচ্চা গুলোকে পরিচালনা করছেন এবং দরাজ কণ্ঠে একের পর এক রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে চলেছেন। যেন পয়লা বৈশাখ, দোল পূর্ণিমা, আর পঁচিশে বৈশাখ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
বাড়িতে ফিরে অমিতাভ মাকে অনুরোধ করলো আজ সে আচ্ছটি পাতার তিতো রস খালি পেটে খাবে না। মা সম্মতি দিলে অমিতাভ খুশি হয়ে বই পত্র নিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় বাবা ঘরে ঢুকে বললেন। আজ আর অমিতাভকে পড়তে বসতে হবে না। শম্ভু ঘোষের মিষ্টির দোকানে নিমন্ত্রণ করেছে ওখানে যেতে হবে। অমিতাভের মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সকাল থেকেই একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। পড়তে হলোনা, তিতো খেতেও হলনা। ঘোষ সুইটস এর মিষ্টি দিয়ে প্রাতরাশ শুরু, ভাবাই যায় না।
সমস্ত বাড়ি কাজের মাসি আজ গোবর জলে সুন্দর করে লেপেছে। প্রতিটা ঘরের দরজায় অর্ধচন্দ্রাকৃতি মালা লাগানো হয়েছে যেটা আম পাতা ও গাঁধা ফুল দিয়ে তৈরি। আজ সব ঘরের রাজা ঠাকুর ঘর অমিতাভের মায়ের হাতের ছোঁয়ায় যেন এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। সমস্ত বাড়ি ধুপ ধুনোর গন্ধে ম – ম করছে। ঘোষ সুইটসের পূজা খুব সকালে হয়ে যায়। পূজার পর শম্ভু ঘোষ বিশেষ কিছু বাড়িতে এক হাড়ি রসগোল্লা আর একটা নুতন বছরের দেব-দেবীর ক্যালেন্ডার পাঠিয়ে দেন। বোস বাড়ি বিশেষ বাড়ির মধ্যে একটি।
আজকের দিনে বোস বাড়িতে দুপুরের খাওয়াটা বেশ অনুষ্ঠান বাড়ির মতো ঘি, শুক্তো, ডাল, বেগুন ভাজা, ধোঁকার ডালনা, ইচড়ের ডালনা, চাটনি, পায়েস, সব নিরামিষ। সংস্কার আছে বছরের প্রথম দিন যেমন কাটবে সমস্ত বছর তেমনি যাবে। দুপুরে পেট পুরে খেয়ে অমিতাভ আই ঢাই শরীরটা নিয়ে সোজা আম বাগানে ছুটলো। সেখানে পচা, ন্যাদা, রসূল, গণশা, কেতো সবাই হাজির। ঝড়ে পড়া আম খাওয়ার উৎসব চলবে। তারপর সন্ধ্যাবেলা বাবার হাত ধরে মোড়ের মাথায় বিভিন্ন দোকানে গিয়ে হালখাতা করা, ভাবাই যায় না কত ধরনের মিষ্টি। মনে হয় সব খাই, কিন্তু পেট তো পারমিট করবে না। তখন তো ফ্রিজের প্রচলন ছিল না, তাই মা মিষ্টি গুলো জল পেতে মিটসেভের ভিতর রেখে দিতেন যাতে পিঁপড়ে আরশোলা ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা হয়। এত কিছুর মধ্যেও উপরি পাওনা বিকালে গাজনের মেলা। বলাকা সংঘের মাঠে বিরাট মেলা। নাগরদোলা, বাঁদর নাচ, পাঁপড় ভাজা, ভ্যাপুর আওয়াজ মাটির পুতুল আরো কত কি ! এত বড় দিনটাযে কিভাবে কেটে যায় ছোট্ট অমিতাভ তার হিসাব মেলাতে পারেনা।
“দাদু স্নান করবে না” ? নাতির প্রশ্নে বৃদ্ধ অমিতাভের সম্বিত ফিরল। “ঠিক বলেছ দাদুভাই অনেক বেলা হয়ে গেছে, খিদেও পেয়েছে।” স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রণাম করে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলেন।
ভাত, ডাল, আলুভাজা, চিকেন, আর আমূল কোম্পানির টক দই দিয়ে ভাত খেয়ে বিছানায় এসে শরীরটা এলিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য ছোট একটা ভাত ঘুমের। ঘুম তো এলোনা ভাবতে থাকলেন পয়লা বৈশাখের একাল সেকাল।
পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। বছরের প্রথম দিন। পৃথিবীর সব দেশই পালন করে তাদের মতো করে। প্রকৃতপক্ষে এটি নুতন বছরকে বরণ করার উৎসব। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কোন উৎসব হতো না, এটি ছিল শুধু হালখাতার দিন। ফারসি ভাষায় হাল মানে নতুন। দিনটি ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে নতুন খাতা খোলার দিন। এইদিনে রাজা, মহারাজা, সম্রাটরা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি জমির খাজনা আদায় করতেন। মোগল সাম্রজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। হিজরি সন গননা করা হত চাঁদের হিসাবে। আর চাষবাস চলত সৌরবছর মেনে। তাতে কৃষকরা ভীষণ সমস্যায় পড়তেন। কারন অসময়ে কৃষকদের খাজনা দিতে হত। প্রজা হিতৈষী সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখ খাজনা আদায়ের দিন ধার্য করলেন। কথিত আছে সম্রাট আকবর বাংলা সন হিসাবে হালখাতার প্রবর্তন করেন। প্রতি বছর কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সমস্ত খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন। সেই নীতিই প্রনয়ন করেন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ, জমিদারদের উপর নবাবি কায়েম বজায় রাখার জন্য পয়লা বৈশাখ খাজনা আদায় করতেন। ছোট রাজা, জমিদাররা এই দিনে মুর্শিদাবাদে আসতেন এবং নবাবের দরবারে খাজনা জমা দিতেন। নবাবও তাঁদের পদমর্যাদা অনুযায়ী নানা রকম উপহার দিতেন। সেই নিয়ম আজও চলে আসছে। তাই আমরা হালখাতা করতে গেলে কিছুনা কিছু উপহার পেয়ে থাকি। নির্দিষ্ট দিনের এই হালখাতাকে উৎসবের আঙিনায় এনে যিনি বাঙালির প্রাণের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিলেন, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যা ছিল বানিজ্যিক উৎসব, তা কবি গুরুর মসির গুনে (কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক) সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিনত হল।
হঠাৎ জানালার শব্দে অমিতাভ বাবুর সম্বিৎ ফিরে এলো। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দেখলেন প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। দরজা জানালা বন্ধ করে চার দেয়ালের মধ্যে বসে শুনতে থাকলেন বাতাসের শব্দ। বছরের প্রথম দিনে কালবৈশাখী বুঝিয়ে দিচ্ছে তার করাল ভয়ংকর রূপ। ঘরের টিউব লাইট কয়কেবার নিভে জ্বলে একেবারে ফ্যানকে নিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে ভ্যাপসা গরম কিন্তু জানালা খোলার কোনো উপায় নেই। বাইরে তখন ঝড়ের তান্ডব চলছে।
ঘন্টা খানেক ঝড়ের তাণ্ডব চলার পর বৃষ্টি শুরু হলো। সেও প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চললো, তাতে অবশ্য ধুলোটা মরে গেলেো । জানালা দরজা খুলে দিতেই বেশ সুন্দর ঠান্ডা বাতাস ঘরটা ভরিয়ে দিলো। এরি মধ্যে কারেন্ট চলে এলো, অমিতাভ বাবু টিভিটা চালালেন। কাজের বউটি এক কাপ গরম চা হাতে ধরিয়ে দিতেই সেটি নিয়ে আয়েশ করে বসে কালবৈশাখী কোথায় কিভাবে তাণ্ডবলীলা চালালো তা টিভির পর্দায় দেখতে থাকলেন। ততক্ষনে ছেলে অফিস থেকে ফিরে এক কাপ চা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাবার পাশে এসে বসলেন। টিভির স্ক্রীনে তখন কাল বৈশাখী কোলকাতায় কিভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে তাই দেখাচ্ছে। চায়ের কাপে ঠোট ঠেকিয়ে অমিতাভ বাবুর পুত্র বললেন “কালবৈশাখী পয়লা বৈশাখ দিনটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিল, মনেই হচ্ছেনা আজ নববর্ষ।”
অমিতাভ বাবু মনে মনে হেসে ভাবলেন ভাগ্যিস কালবৈশাখী ঝড়টা হল। তাতে অন্তত বাংলা নববর্ষের অনাড়ম্বরতা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের হাতে একটা অজুহাত তো এলো।
–~০০০XX০০০~–