জবাব
✍ কাকলি ঘোষ
ইদানিং ব্যাপারটা টের পাচ্ছেন স্বপন বাবু। এতদিন খেয়াল করেন নি। ছিল নিশ্চয় ওদের মনের মধ্যে। না হলে আজ প্রকাশ পেল কি করে? তিনিই অন্ধ। চোখ বুজে ছিলেন এতদিন। রিটায়ার করার পর একবুক খুশি নিয়ে ছেলে বউ নাতি নাতনীদের সঙ্গে কিছু না বুঝেই দিব্যি ছিলেন। কখন ভেতরে ভেতরে মেঘ ঘনিয়েছে , অন্ধকার নেমেছে হদিশ ও পাননি। মাস খানেক হলো সব একটু অন্য রকম ঠেকছে।
একদিন চা খেয়ে কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছেন হঠাৎ কানে এলো বড়ছেলের গজগজানি।
” কেনো আমাকে যেতে হবে কেন বাজারে ? আজ বিনু যাক। আমার তাড়া আছে ”
” বিনু পরপর দুদিন গেছে। আজ তোমার পালা। ওই বা রোজ করবে কেন?”
বড় বৌমার সপাট জবাব।
” তাহলে বাবাকে বলো। বসেই তো থাকেন বাজারটা করে দিতে পারেন না?”
” সে তোমরা দু ভাই তে বোঝ। পারবেন না কেন ? ভালই পারেন। বলতে নেই শরীর খাওয়া দাওয়া সবই তো ভালো। কাজের বেলায় কেবল___”
বাকিটা অনুক্ত থাকলেও বুঝতে অসুবিধে হয়নি
স্বপনবাবুর। স্ত্রী প্রভাময়ী বেঁচে থাকলে ,শুনলে দুঃখ পেতেন। তার খাওয়া দাওয়া নিয়ে কারুর কিছু বলা ভীষণ অপছন্দ ছিল তার। ভাগ্যিস বেঁচে নেই প্রভা।
বাজার করাটা কোন কথা না। বললেই করতে পারেন। কিন্তু এভাবে বলা কেন? শুধু বাজার ই কি? ছোট বৌমা তো রীতিমতো ফরমাশ করে,
” তিতলিকে নিয়ে আসুন তো। রোজ রোজ এই রোদ্দুরে যেতে ভাল লাগে না।”
বাইরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ দেখে মনে মনে একটু দমে গেলেও__ না করেন নি স্বপন বাবু। গেছেন তো নাতনিকে আনতে। তবে! শুধু কি এটুকুই! ইলেকট্রিকের বিল দিয়ে আসা, লন্ড্রি থেকে জামাকাপড় আনা , একটু একটু করে সবই তো ঘাড়ে এসে পড়েছে। অথচ প্রভা থাকাকালীন কিছুই করতে হত না। কি করে যে সবদিক সামলাতো ও! কোনদিন গায়ে একটু একটু আঁচ লাগতে দেয়নি। এখন থাকলে এসব দেখলে খুব কষ্ট পেতো। রাতে শুতে গেলে প্রভার মুখ যেন গম্ভীর দেখেন। যেনো বলতে চায়,_এরকম তো তুমি ছিলে না? প্রতিবাদ করো! না হলে ওরা পেয়ে বসবে যে। কেনো বুঝছো না!!!__
বোঝেন সবই। ছেলে বৌমা দের ইচ্ছাকৃত অবহেলা, ফাই ফরমাশ করার ধরন! তবু এসবে কিছু মনে করেন না স্বপন বাবু। গায়ে মাখেন না। সংসারে থাকলে কাজ তো করতেই হবে। করছেন ও তো সবই। শুধু একটু যদি সম্মান দিয়ে বলতো__ তাও মেনেই নিয়েছেন। যুগধর্ম। কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট বুঝছেন__ আসলে কাজ টা কথা না। অন্য কিছু একটা ওরা তলায় তলায় মতলব করছে, আঁচ করছেন__ কিন্তু ধরতে পারছেন না।
কাল রাতে হঠাৎ চিনু ঘরে এসে হাজির। শোবার উদ্যোগ করছেন তখন। এমন অসময়ে বড় ছেলেকে দেখে শুধু অবাক না একটু অস্বস্তি ও। কী ব্যাপার! এত রাতে!!
ভনিতা না করে সরাসরি ই প্রস্তাব করেছে চিনু।
” তোমার ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে বাবা। তুমি কোণের ঘরটায় চলে যাও। দীপ বড় হচ্ছে। পড়াশুনোর জন্য একটা জায়গা দরকার। ”
প্রথমে থতমত খেলেও পরে সামলে নিয়েছেন । এই কথা আগেও শুনেছেন। বড় বৌমার মুখে।
” বাড়ির মধ্যে সেরা ঘরটা উনি দখল করে রেখেছেন। কেন? একটা মাত্র নাতি। তার পড়াশুনার জন্য নিজেরই তো বলা উচিত।”
উচিত! হয়তো !
কিন্তু ওই কোণের ঘরটা! ওটায় যে একদম আলো বাতাস ঢোকে না। অ্যাজমা র রুগী তিনি। বেড়ে যাবে না!
” তাহলেই বল। আমার একমাত্র ছেলে! তোমার একমাত্র নাতি ওই ঘরে দিনরাত কী করে থাকে?”
বলার অনেক কিছুই ছিল। বলা ও যেত । যেমন অনায়াসেই বলতে পারতেন__ বাপু হে। বাড়িটা আমি তৈরি করেছি। তুমি না। আমার ছেলে মেয়েকে আমি বড় করেছি। তুমি না। তাই এ বাড়িতে আমি কোন ঘরে থাকব তা ঠিক করব আমিই__ তুমি না। তোমার ছেলের ভালো মন্দ তুমি ভাবো গে যাও।__
না। বলেন নি কিছু। মন বলেছে এখানেই শেষ নয়।আরো কিছু আছে এর পরও। হল ও তাই। ঘর ছাড়ার কথা বলার দুদিনের মধ্যেই এলো আবার। এবার চিনু না। বিনু। এলো একেবারে কাগজ পত্র নিয়ে।
প্রস্তাব শুনে কিছুক্ষণ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন স্বপনবাবু। বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট! প্রোমোটারের সাথে কথা হয়ে গেছে! তিনি কিচ্ছু জানলেন না!
বিরক্ত চোখে তাকিয়েছে বিনু। এতে আবার এত
জানাবার কি আছে? ফ্ল্যাট হলে সুবিধা বই অসুবিধে কিছু নেই। ফ্ল্যাট ও হবে আবার টাকাও আসবে। ঘরের অসুবিধের কথা কি অজানা কারুর? জেনেশুনে এসব ন্যাকামোর কোন অর্থ হয় কি?
কয়েক পলক চেয়ে থেকে কাগজ পত্রে চোখ রেখেছেন। দুটো ফ্ল্যাটের কথা স্পষ্ট বলা আছে কাগজে। অর্থাৎ রিমি কে কিছু দেবে না ওরা। কিন্তু তিনি বাপ হয়ে মেয়েকে কি করে___! তাছাড়া ফ্ল্যাট ও তো সব দুই রুমের। তাহলে তার নিজের? প্রশ্নের চোখে তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিল বিনু।
” তুমি যে কোনো কারুর কাছেই থাকতে পারো। ওটা কোন ব্যাপার ই না। ”
তাই!!! কয়েক মুহুর্ত। প্রভার ছবির দিকে একবার তাকালেন স্বপন বাবু। হ্যাঁ। সম্মতি পেয়েছেন।তারপর মৃদু হেসে , ধীরে সুস্থে কাগজপত্র গুটিয়ে বিনুর হাতে তুলে দিলেন ।
” কি হল? তুমি সই করবে না? ”
” না। ” দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দেন স্বপন বাবু, ” বাড়ি আমার। সেটা ভাঙব না রাখব সে সিদ্ধান্তও আমার। তোমাদের থাকার অসুবিধে মনে করলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পার। আর হ্যাঁ বড় বৌমাকে বলে দিও আমি আমার ঘর ছেড়ে নড়ছি না।তার ছেলের জন্য ঘর তিনি যেনো নিজেই বানিয়ে নেন। এ বাড়িতে থাকতে হলে আমার সুবিধে মতই থাকতে হবে। ”
” কি!! ” বিস্ময়ের শেষ সীমায় চলে যায় বিনু, “তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ বাবা” _
বাড়াবাড়ি! দপ করে জ্বলে উঠতে গিয়েও নিজেকে দমন করেন স্বপন বাবু। দিব্যি হেসে হেসে বলে ওঠেন,
“বাড়াবাড়ির আর দেখলে কি? এখনও অনেক বাকি। শোন। তোমার বউকে বলে দিও এবার থেকে তার মেয়েকে তিনি যেন নিজেই স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। আর নিজের জামাকাপড় লন্ড্রি থেকে আনার ব্যবস্থাটা ও তুমি নিজে করবে। আরো একটা কথা। বাজার করার ভাগাভাগি টাও নিজেদের মধ্যে করে নিও। হ্যাঁ। এবার তুমি যেতে পারো।”
” আচ্ছা। আমি ও দেখছি। তুমি__”
কথা শেষ করতে পারেনা বিনু।
তীব্র চোখে তাকান স্বপন বাবু। সে দৃষ্টির সঙ্গে বেশিক্ষণ চোখ মেলাতে পারে না ও। পায়ে পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
এতক্ষণের উত্তেজনা আর বইতে পারেনা শরীর। বিছানার ওপরেই ধপ করে বসে পড়েন স্বপন বাবু। ঘামে চপ চপ করছে সারা শরীর । গা থেকে জামাটা টেনে খুলতে গিয়ে চোখ পড়ে প্রভাময়ীর ছবিতে।
হাসছেন প্রভাময়ী। নিশ্চিন্ত। নিরুপদ্রব, মধুর হাসি।
–~০০০XX০০০~–