যতনের শৈশব
✍ ডঃ রতনশ্রী ভিক্ষু
জানুয়ারী মাস। ২০১৫ সাল। রাত্রি তখন ১১ টা৪৫ মি. ছুই ছুই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিনাজুরী গ্রাম। স্বাভাবিকভাবে গ্রাম বলে কথা। সুনশান রাস্তাঘাট লোকজনের সাড়াশব্দ তো নেই। গ্রামের রাস্তা বৈদ্যুতিক বাতির কোন ব্যবস্থা নেই। রাস্তাগুলি ইট বিছানো। কবে ইট বিছিয়েছে তার কোন সন তারিখ জানা ছিল না গ্রামের ছেলে যতনের। রাস্তায় হাঁটতে গেলে অসতর্ক হলেই বিপদ। হোছট খেয়ে পড়ে গেলে হাত পা ভাঙবে নিশ্চিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী। নাম তার সোনাই। জোয়ারে নদী জলে থই থই করে। একসময় নৌকা, সাম্পান চলত। এখন চলে না।এই সময় যতনের বয়স ১৪ বছর ছুই ছুই। কৃষিকাজে আধুনিকতা আনতে সরকারের পক্ষ থেকে নদীতে বাঁধ দিয়ে একটা গেইট করে দিয়েছে। জোযারের সময় জল প্রবেশ করানো হয় আর ভাঁটার সময় গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাঁধের পাশে জেলে পাড়া রয়েছে। এই পাড়ার লোককে সকলেই ‘ ডোম’ বলে থাকে। এই পাড়ার একজন গ্রাম্য চিকিৎসক ছিল। তার নাম তেজেন্দ্র জলদাশ।
তার দুই ছেলে ছিল। একজনের নাম মানিক অন্যজনের নাম দানিস। এই পাড়ার লোকজন নদীতে ধরার কাজও করে আবার মরা পোড়ানোর কাজও করে। সরকারের পক্ষ থেকে বাঁধ তৈরীর সময় জনগণকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, শুধু চাষাবাদ নয়, উন্নত প্রজাতির চিংড়ি মাছের চাষও করা হবে যাতে করে স্থানীয় মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে। সরকারী প্রতিনিধি যারা গ্রামে বসবাস করে তারা অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করল। আর মানুষজনকে পুনঃপুনঃ আশ্বাসবাণী শোনাতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে বাঁধ তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। স্বাভাবিক জলযানগুলির চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। বাঁধের অপর দিকে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বনী, নাম তার ” হালদা নদী”। বিশ্বের দ্বিতীয় মৎস্য প্রজনন স্থল, এই হালদা নদীর মোহনা। এখানেই সোনাই নদী হালদার সঙ্গে মিশেছে।
বাঁধের পাশে এক বিশালকায় অশ্বত্থগাছ। তার ছায়াতলে পথচারীরা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেয়। অশ্বত্থগাছের সম্মুখে একটা ধান ভাঙানোর কল আছে। গ্রামের মানুষ এই ধান ভাঙনোর কলে ধান ভাঙায়। ধানভাঙানোর কলের মালিক মোহাম্মদ জব্বর মিঞা। খুব ভাল লোক। লোকের উপকারে ঝাপিয়ে পড়ে। তার দুই ছেলে হানিফ আর মকবুল।হানিফ ধানভাঙানোর কল চালায়।আর মকবুল পড়াশুনা করে। গ্রামের ছেলে যতন মকবুলের ক্লাশমেট।দুজনেই পাশ্ববর্তী গ্রাম গহিরা এ. জে. ওয়াই. এম. এস মাল্টিলেটারেল হাইস্কুলে পড়াশুনা করে। পায়ে হেঁটে প্রায় ২ কিমি পথ অতিক্রম করে তারপর স্কুলে যায়। মাঝেমাঝে মকবুল স্কুলকামাই করে।যতন নিয়মিত স্কুলে যায়।
বাঁধের গোড়ায় সেই অশ্বত্থ গাছের পাশে স্রোতস্বনী সোনাই নদী লাগোয়া প্রি প্রাইমারী স্কুল।এই স্কুলে যতন, মকবুল, বিধান, মুকুল, নিফুল, বন্দনা, রবি, বুলবুলি, আমেনা, আসিফা, সোহিনী, মল্লিকা প্রমুখ যতনের সমবয়সী অনেকে পড়াশুনা করেছে।
প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টারমশাই নিকুঞ্জ বিহারী বেশ ভাল শিক্ষক। একদম কড়া শাসন ছিল তার। স্কুলের অপর একজন ইংরেজীর শিক্ষক ছিল। তিনি অনিল স্যার। ভাল পড়াতেন। একজন হুজুর শিক্ষক ছিলেন। তিনি অমায়িক ছিলেন।রাস্তা দিয়ে যতনরা যাতায়াত করতে গিয়ে যেই হুজুরকে দেখত তখন গড় করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসত। হুজুর খুব খুশী হতেন। তার জন্ম জনপদ ছিল নোয়াখালীর ছাগলনাইয়া গ্রাম।
একদিন যতন বাঁধের কাছে সেই অশ্বত্থ গাছের নীচে বসেছিল। সেই সময় সরকারী আমলারা এসে বাঁধের কাযর্কারীতা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।তাও প্রায় বাঁধ নির্মাণের ছয় মাস অতিক্রান্ত। মানুষ বলাবলি করতে লাগল, ‘ কি যে হল, কোথায় সেই প্রদত্ত আশ্বাসের বাস্তবায়ন।’ যতন কান পেতে শুনল সেই সমালোচনা। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জোয়ারভাঁটা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত। চাষবাস প্রায়ই বন্ধ হতে বসেছে। মাছ চাষের তো কথাই নেই।
এরই মধ্যে যতন শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পন করল। এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে। ছোটবেলা থেকে যতন শুনে আসছে, সোনাই নদীকে সোনাইর খাল বলতে। সরকারী আমলারা যা বলছিল তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পারলেও মোটামুটি বুঝতে পেরেছে।কিন্তু যতনের তো করার কিছুই নেই। যতনের এক বন্ধু ছিল, নাম তার জাহাঙ্গির আলম। তার সঙ্গে একদিন কথা বলতে গিয়ে বাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে যে সরকারী আমলারা যে বিষয়ে কথা বলছিল সেই কথার পুনরাবৃত্তি করতেই বন্ধু জাহাঙ্গীর বলল, যতন, ওসব কিছ্যু হবে না। ওদিকে কান দিস না রে যতন। এই করে প্রায় কুড়ি বছরের বেশীবছর অতিবাহিত হয়ে গেল। প্রতিশ্রুতি প্রতিশ্রুতির জায়গায় থেকে গেছে। সরকার আসে আর যায়।তবুও পরিবর্তন কিছু দেখতে পায় না জাহাঙ্গীর মকবুলরা।
সোনাই নদী ধীরে ধীরে আয়তনে অনেক ছোট হয়ে আসে। সোনাই নদীর এক শাখানদী। মহেশখালী তার নাম। আয়তনে অনেকটা ছোট। শৈশবে যতন, মুকুলরা ঐ নদী যখন জোয়ারে ফুলে জলে নদীর কানায় কানায় হযে যায়, তখন সখ করে যতন, মকুল, অনুকুলরা সাঁতার কাটত। এপার-ওপার সাঁতরে পারাপার করত। এতে কত আনন্দ হত ওদের তা ব্যক্ত করার ভাষা এই মুহূর্তে হয়ত যতন, মুকুলদের নেই। সুদিনে ঐসব নদীর ধারের জমিতে রবিশস্যের চাষ হত। মরসুমি কত সবজি জমিতে ফলত তা ও হয়ত তাদের মনে পড়ে। গ্রীষ্মের দুপুরে নদীরধারে যে আমগাছ ছিল তাতে যে আমের ফলন হত তা মালিকের অজান্তে গাছ থেকে পেড়ে নুন মেখে খাওয়ার সাধ সত্যি অতুলনীয়। যতন, মুকুল, দুকুল, মনু, আনন্দ সকলে মিলে লঙ্কা ক্ষেত থেকে মিষ্টি কুমড়োর পাতা নিয়ে তাতে আম কুচি কুচি করে কেটে লঙ্কা ক্ষেত থেকে লঙ্কা আর আধ পাকা টমেটো এবং ঘর থেকে কাগজে বেঁধে নিয়ে যাওয়া নুন মিশিয়ে মনের আনন্দে খেত।এই অভিজ্ঞতা শৈশবের বয়সী সকলের কাছে অসাধারণ।
বিকালের পড়ন্ত বেলায় খালি ধানি জমিকে খেলার মাঠ বানিয়ে ফুটবল খেলার কথা যতন ভুলতে পারে না। বাবা মায়ের কত বকুনি খেয়েছে, পাড়া পড়শিদের গালমন্দও কম খায়নি। খেলতে গিয়ে কারও জমির ফসল নষ্ট করে ফেলা বা জমির ফলন চুরি করে খাওয়া ইত্যাদির জন্য সর্বদা বকুনি খেতে হত যতনদের।
ভাদ্রমাস। বৃষ্টি বাদলে চারদিকে রাস্তাঘাট জলময়, কর্দমাক্ত হয়ে থাকত। এই সময় দিনের বেলায় মেঘভাঙা রোদে অল্পজলমগ্ন যে ধানি জমিগুলি থাকত, সেখানকার জমা জল রোদে উত্তপ্ত হযে যেত। আর তাতে থাকা ছোটবড় মাছ মরে যেত। উক্ত মরে যাওয়া তাজা মাছ সংগ্রহ করতে গিয়ে রতন অসুস্থ হয়ে পড়ল। কাটফাটা রোদ রতন সহ্য করতে পারে নি। তড়িঘড়ি যতনের সেই মুকুলরা, দুকুলরা ধরাধরি করে গাছের ছায়া পড়েছে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে চোখেমুখে ঠান্ডা জল দেওয়ায় তার স্বস্তি ফিরে আসল।
ভাদ্রমাসে পাকা তাল খুড়ানোর ধূম পড়ে যায়।যতনরা দল বেঁধে তাল খুড়াতে যায়। গ্রাম্য মানুষজনের ধারণা তালগাছের তলায় অশরীরি আত্মা বিরাজ করে। লোকে বলাবলি করে কখনও কখনও ঐ অশরীরি আত্মা মনুষ্যরূপে সাদাকাপড় পড়া অবস্থায় দেখা যায়। ভাদ্রমাসের এক অমাবস্যার রাতে গ্রামের নির্জন মাঠ প্রান্তরে অবস্থিত তাল গাছ থেকে পড়া তাল খুড়াতে গিয়ে যতনের বন্ধু মুকুল ভয় পেল। সে একেবারে অজ্ঞানাবস্থায় মাঠের এক কোনায় পড়েছিল।অনেক খোঁজাখুঁজির পর মকুলের সন্ধান মিলল। সে তখন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। তাকে ঘরে নিয়ে আসল পাড়ার কতিপয় লোকজন। পরে তাকে পুন তাল খুড়াতে বললে, সে আর কোন দিন তাল খুড়াতে যাবে না বলে দিয়েছে।কারণ সে ভয় পেয়েছে। এখানে অশরীরি আত্মা বলতে ভূতকে বোঝানো হয়েছে।
ভূত বা প্রেতাত্মা নিয়ে মানুষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়ই। এই ভূত বা প্রেতাত্মা আবার সকলেই দেখে না বা অনুভব করে না। যে বা যারা দেখে শাস্ত্রমতে তারা ঐসব ভূত বা প্রেতাত্মার নিকটাত্মীয় বা আপনজন ছিল বিধায় দেখা দেয়। যারা ধর্মকেন্দ্রিক শাস্ত্র পড়েন বা অন্য কারও কাছ থেকে গল্পের মত করে শাস্ত্রকথা শোনেন তারা অবশ্যই বিশ্বাস করেন বা উপলব্দি করেন ঐ সব ভূত, পেত্নী আসলেই আলাদা এক প্রকারের সত্ত্বা। তাই শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, ” বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”। গ্রামাঞ্চলে লোক জনবসতি যেখানে তুলনামূলক ভাবে কম, সেখানে এসব দেখা যায়।
একবার কোন এক মন্দিরে এক মধ্যবয়ষ্ক যুবক গলায় দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে। পাড়ার লোকজন তা সরজমিনে তদন্ত করে সত্বর দাহ কার্য সমাপন করে ফেলে। ঐ গ্রামের মন্দিরে অবস্থানকারী পুরোহিত প্রায় সময় রাত্রিবেলায় ঐ ব্যক্তিকে দেখতে পায়। তবে অমাবস্যার রাত হলে তো কথাই নেই।ঐ ব্যক্তি দেখা দেবেই, সে মন্দিরের পুরোহিতকে জ্বালাতন করবেই। পুরোহিত কিন্তু ভীতু নন। প্রায়ই পুরোহিত অশরীরি আত্মার সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেন। এতে পুরোহিত সহজে ভয় পান না। পুরোহিত যে মন্দিরে থাকেন তা কিন্তু একেবারে শ্মশানে অবস্থিত। প্রতিনিয়ত সেই পুরোহিত মরাপোড়া দেখে থাকেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব বয়সের মৃতদেহ এই শ্মশানে নিয়ে আসা হয় পোড়ানোর উদ্দেশ্যে। মরাপোড়ানো দেখতে দেখতে পুরোহিতের মন শক্ত হয়ে গেছে।
একদিন যতন নামে যুবক ঐ পুরোহিতের কাছে দীক্ষা নিয়ে ঐ শ্মশানের মধ্যে অবস্থিত মন্দিরে অবস্থান করতে লাগল। যতন আগে অনেকবার শুনেছে, শ্মশানমন্দিরে প্রায়ই অশরীরি ভূত-প্রেত অমাবস্যা-চতুর্দশীর গভীর রাতে দেখা যেত বা দেখা দিয়ে থাকে। আগে শুনে থাকার কারণে যতন তেমন একটা ভয়ার্ত হয় না। জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ যতন যথারীতি শুয়ে পড়েছে। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী-অমাবস্যার রাত তখন ১১-৪৫ মি. হয়ত হবে।যতন যেখানে শুয়েছে, সেই ঘরে পুরোহিতও শুয়েছে। হঠাৎ ঘরের সামনের বারান্দায় উত্তর-পশ্চিম কোনা বরাবর কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁধছে। বারান্দায় একটা কম পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। কতকগুলি কুকুর বয়ারান্দায় শুয়ে আছে। কান্না শুনে কুকুরগুলি উক্ত অশরীরি ভূতকে তাড়া করে অনেকদূর নিয়ে গেছে।ঠিক কয়েক মিনিট পর কুকুরগুলি পুনঃ বারান্দায় এসে শুয়ে আছে। যতন কিন্তু জেগে আছে তবে সারা শরীর জড়সড় হয়ে গেছে। সে তো লোকমুখে শুনেছে, কিন্তু এরকম বাস্তব অভিজ্ঞতা তার কোনদিন হয়নি। এরপর যতন যে ঘরে পুরোহিতের সঙ্গে শুয়েছে, সেই ঘরের দরজা অর্গল ধরে যেন সম্ভবত ঐ অশরীরি ভূত টান মারল। এবারও আগের মত কুকুর তাড়া করল সেই অশরীরি ভূতকে। কথায় আছে মানুষ অশরীরি আত্মাকে দেখতে না পেলেও কুকুররা দেখতে পায়।তাই কেউ মারা গেলে রাত্রিবেলায় কুকুর চিৎকার করে থাকে।তাছাড়া অন্যভাবেও কুকুর চিৎকার করে থাকে। সব চিৎকার কিন্তু অশরীরি ভূতাত্মাকে দেখলেই যে হবে তা নয়। দেখার ভিতরও কতকগুলি কারণ থাকে। কারণগুলি আসলে কি? কি? তা জানার উপায় নেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কুকুর চিৎকার করে ভয় পেয়ে যায় বলে। আবার প্রভুর অত্যধিক আদরের ঠেলায়ও চিৎকার করে থাকে। আসল কথায় ফিরে আসি, ঐ যে কুকুরগুলি চিৎকার করে অশরীরি ভূতকে তাড়া করল।তখনই শুরু হয়ে গেল তাণ্ডব। অশরীরি ভূত এবার চড়াও হল কুকুরগুলির উপর।মন্দিরের মধ্যে থাকা আমগাছগুলি দিয়ে যেন কুকুরগুলিকে মারছে। রীতিমত ঘরের ভেতর থেকে যতন শুনতে পেল। এরপর হঠাৎ যতনের মনে হল অশরীরি আত্মাকে তুষ্ঠ করতে একটু মন্ত্র জপ ধ্যান করতে হয়। তারপর তাদের উদ্দেশ্যে পুণ্যবিতরণ করতে হয়।সাধারণতঃ হিন্দুবৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা রয়েছে, পুণ্যদান বা তর্পন করা ভাল। এতে পরাত্মা খুশী হয়। যতন ঐ সময় তাই করতে চেষ্টা করল। যতন এতই ভয়ে কাতর হয়ে গেল যে তার মুখ থেকে কোন কিছুই বের হচ্ছে না।তবুও সে বলতে চেষ্টা করল। মন্ত্র বলতে বলতে সে পুন্যদানও করল। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যে পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে যে এত তান্ডব চলছিল, তা মুহূর্তে নিঃস্তব্দ হয়ে গেল। কখন যে যতন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা আর সে মনে করতে পারেনি। পরদিন তার গুরু পুরোহিত তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। সে পুরোহিত গুরুকে পূর্বরাত্রির ঘটনা বিস্তারিত বললে, পুরোহিত গুরু বললেন, ঐরকম ঘটনার সাক্ষী তিনি বহুবার হয়েছেন। ফলে পুরোহিত এখন আর ভয় পান না। তিনি পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
যতন সেই থেকে অনেকটা ভয়মুক্ত হয়েছে। একদিন সে পাড়ার মানুষকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। সময়টা শারদীয়া দূর্গাপূজা চলাকালীন। পাড়ার ছেলে মেয়ে ঠিক করেছে সন্ধ্যার সময় দূর্গাপূজা দেখতে যাবে। যতন তা আগে জানতে পেরেছে। যতন ভয় দেখানোর জন্য একটা জায়গা বেছে নিল। সেই জায়গাটা তার মাতামহের শ্মশান। সে সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢেকে নিল এবং ঐ শ্মশানের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। অমনি যারা পূজা দেখতে যাবে ঠিক করছে, তারা ঐ পথ ধরে যেতেই সাদা কাপড় জড়ানো যতনকে দেখতে পেল।তাও আবার শ্মশানের ধারে। যেই দেখল তখন চিৎকার করে যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেল। যতন এবার সেই কাপড় ঘুটিয়ে ভয়ার্তদের কাছে গিয়ে বলতে শুরু করল, কি হয়েছে! কি হয়েছে! সে তাদের বলল ভয়ের কিছুই নেই একটু গায়ে জল ছিটিয়ে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। এরকম করে সে সাহসটাকে বাড়িয়ে নিল। পরে অবশ্য যতন বলে দিয়েছিল, ভূতটা আর কেউ নয় স্বয়ং আমি। তার স্বীকারোক্তিতে কেউ বিশ্বাস করল আবার কেউ করল না।
সোনাই নদীর শাখা নদী ছিল মহেশখালী। সোনাই আর মহেশখালীর সংযোগস্থলে মৎস্য দেবতা প্রায় সময় লোককে দেখা দেয়। লোক তার কাছাকছি গেলে লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে যায়। অন্ধকারে সেই দেবতা মানুষের বেশ ধরে বসে থাকে। যেই মানুষকে দেখে তখনই নদীতে ঝাপ দেয়। তবে কখনও একাকী তার সম্মুখীন হওয়া ঠিক নয়। যে কোন ধরণের বিপদ হতে পারে। একবার যতনের দাদু ভাদ্রমাসের ভোর রাত্রে নদী মাছ ধরতে যায়।সঙ্গে অবশ্য যতনের মামা পুতুলও ছিল। কিন্ত তারা বাপছেলে ঐ মৎস্য দেবতা থেকে রেহাই পায়নি। ভয় পেয়ে বাড়ী চলে এসেছিল, কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ে। যতনের দাদু অল্প ক’দিন পর মারা যায়। পুতুল অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাসায়ী হয়ে গেল। এই ঘটনার অনেক আগে থেকে যতনের মামা পুতুলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। লোকাচার মতে গুরু মরা বছর। তাই বিয়ে পিছতে হবে। পাড়াপড়শীরা বলছিল, অন্ততঃ এক বছর অপেক্ষা করতে তো হবেই। কিন্তু পুতুল এক বছর অপেক্ষা করতে পারেনি। মেয়ের বাড়ী থেকে বলছিল ছয়মাস অপেক্ষা করলে হবে। মেয়ের বাড়ীর কোন গুরুজন মারা গেলে একবছর অপেক্ষা করতে হয়। এরই মধ্যে ধূমধামের সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেল। যতন মামার বিয়ের নিমন্ত্রণ খেল। এই আনন্দ বেশী সইল না। যতনের মামার এক ছেলে হল। ছেলে হবার পরই পুতুল অর্থাৎ যতনের মামা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। অবশেষে বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যে যতনের মামা পুতুল মারা গেল। পুতুলের সংসার ছাড়খার হয়ে গেল। সদ্য বিবাহিতা এক সন্তানের জননী পুতুরের বউ যতনের মামী জীবন সংগ্রামে অবতীর্ন হল। যতনের বাবার পরামর্শে পুতুলের বউ সবিতা লোকের বাড়ী জনখাটার কাজ করতে লাগল। সে হার স্বীকার করেনি। সংকল্পবদ্ধ হলেন এই জীবন সংগ্রামে জয়ী হবেনই। ছেলেকে কোলে করে লোকের বাড়ীতে কাজ করতে প্রতিদিন কাজ করতে যায়। এভাবে কাজ করতে করতে নিজে স্বাবলম্বী হয়। ছেলেকে স্কুলে পড়িয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে তাদের পাশ্ববর্তী মন্দিরে পুরোহিতের কাছে সমর্পন করেছে। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন ছেলে চাকুরী করে। মাকে দেখে। কোনভাবে মাকে অতীতের কোন ঘটনা মনে আনতে দেয় না। মায়ের মন, তা কি কখনও ভুলিয়ে রাখা যায়। যতন এই অভিজ্ঞতা কখনও ভুলতে পারে না।
মহেশকালীর আর একটি শাখা নদী আছে তার নাম কাসখালী। ছোটবেলায় যতন এই ছোট্ট স্রোতস্বিনীতে কত মাছ ধরেছে। আজ তা অতীত। সোনাই নদীর এই শাখা নদীগুলি মজে গেছে। বলাবাহুল্য শুকিয়ে গেছে। যতন বর্তমানে অতীতের কথা মনে আফসোস করে আর স্মৃতি রোমন্থন করে। স্বীয় অভিজ্ঞতা লোককে বলে তৃপ্তি অনুভব করে। হয়ত জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও যতনের কাছে তার শৈশবের কথা বিস্মৃত হবার নয়।
তার দুই ছেলে ছিল। একজনের নাম মানিক অন্যজনের নাম দানিস। এই পাড়ার লোকজন নদীতে ধরার কাজও করে আবার মরা পোড়ানোর কাজও করে। সরকারের পক্ষ থেকে বাঁধ তৈরীর সময় জনগণকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, শুধু চাষাবাদ নয়, উন্নত প্রজাতির চিংড়ি মাছের চাষও করা হবে যাতে করে স্থানীয় মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে। সরকারী প্রতিনিধি যারা গ্রামে বসবাস করে তারা অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করল। আর মানুষজনকে পুনঃপুনঃ আশ্বাসবাণী শোনাতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে বাঁধ তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। স্বাভাবিক জলযানগুলির চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। বাঁধের অপর দিকে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বনী, নাম তার ” হালদা নদী”। বিশ্বের দ্বিতীয় মৎস্য প্রজনন স্থল, এই হালদা নদীর মোহনা। এখানেই সোনাই নদী হালদার সঙ্গে মিশেছে।
বাঁধের পাশে এক বিশালকায় অশ্বত্থগাছ। তার ছায়াতলে পথচারীরা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেয়। অশ্বত্থগাছের সম্মুখে একটা ধান ভাঙানোর কল আছে। গ্রামের মানুষ এই ধান ভাঙনোর কলে ধান ভাঙায়। ধানভাঙানোর কলের মালিক মোহাম্মদ জব্বর মিঞা। খুব ভাল লোক। লোকের উপকারে ঝাপিয়ে পড়ে। তার দুই ছেলে হানিফ আর মকবুল।হানিফ ধানভাঙানোর কল চালায়।আর মকবুল পড়াশুনা করে। গ্রামের ছেলে যতন মকবুলের ক্লাশমেট।দুজনেই পাশ্ববর্তী গ্রাম গহিরা এ. জে. ওয়াই. এম. এস মাল্টিলেটারেল হাইস্কুলে পড়াশুনা করে। পায়ে হেঁটে প্রায় ২ কিমি পথ অতিক্রম করে তারপর স্কুলে যায়। মাঝেমাঝে মকবুল স্কুলকামাই করে।যতন নিয়মিত স্কুলে যায়।
বাঁধের গোড়ায় সেই অশ্বত্থ গাছের পাশে স্রোতস্বনী সোনাই নদী লাগোয়া প্রি প্রাইমারী স্কুল।এই স্কুলে যতন, মকবুল, বিধান, মুকুল, নিফুল, বন্দনা, রবি, বুলবুলি, আমেনা, আসিফা, সোহিনী, মল্লিকা প্রমুখ যতনের সমবয়সী অনেকে পড়াশুনা করেছে।
প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টারমশাই নিকুঞ্জ বিহারী বেশ ভাল শিক্ষক। একদম কড়া শাসন ছিল তার। স্কুলের অপর একজন ইংরেজীর শিক্ষক ছিল। তিনি অনিল স্যার। ভাল পড়াতেন। একজন হুজুর শিক্ষক ছিলেন। তিনি অমায়িক ছিলেন।রাস্তা দিয়ে যতনরা যাতায়াত করতে গিয়ে যেই হুজুরকে দেখত তখন গড় করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসত। হুজুর খুব খুশী হতেন। তার জন্ম জনপদ ছিল নোয়াখালীর ছাগলনাইয়া গ্রাম।
একদিন যতন বাঁধের কাছে সেই অশ্বত্থ গাছের নীচে বসেছিল। সেই সময় সরকারী আমলারা এসে বাঁধের কাযর্কারীতা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।তাও প্রায় বাঁধ নির্মাণের ছয় মাস অতিক্রান্ত। মানুষ বলাবলি করতে লাগল, ‘ কি যে হল, কোথায় সেই প্রদত্ত আশ্বাসের বাস্তবায়ন।’ যতন কান পেতে শুনল সেই সমালোচনা। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জোয়ারভাঁটা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত। চাষবাস প্রায়ই বন্ধ হতে বসেছে। মাছ চাষের তো কথাই নেই।
এরই মধ্যে যতন শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পন করল। এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে। ছোটবেলা থেকে যতন শুনে আসছে, সোনাই নদীকে সোনাইর খাল বলতে। সরকারী আমলারা যা বলছিল তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পারলেও মোটামুটি বুঝতে পেরেছে।কিন্তু যতনের তো করার কিছুই নেই। যতনের এক বন্ধু ছিল, নাম তার জাহাঙ্গির আলম। তার সঙ্গে একদিন কথা বলতে গিয়ে বাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে যে সরকারী আমলারা যে বিষয়ে কথা বলছিল সেই কথার পুনরাবৃত্তি করতেই বন্ধু জাহাঙ্গীর বলল, যতন, ওসব কিছ্যু হবে না। ওদিকে কান দিস না রে যতন। এই করে প্রায় কুড়ি বছরের বেশীবছর অতিবাহিত হয়ে গেল। প্রতিশ্রুতি প্রতিশ্রুতির জায়গায় থেকে গেছে। সরকার আসে আর যায়।তবুও পরিবর্তন কিছু দেখতে পায় না জাহাঙ্গীর মকবুলরা।
সোনাই নদী ধীরে ধীরে আয়তনে অনেক ছোট হয়ে আসে। সোনাই নদীর এক শাখানদী। মহেশখালী তার নাম। আয়তনে অনেকটা ছোট। শৈশবে যতন, মুকুলরা ঐ নদী যখন জোয়ারে ফুলে জলে নদীর কানায় কানায় হযে যায়, তখন সখ করে যতন, মকুল, অনুকুলরা সাঁতার কাটত। এপার-ওপার সাঁতরে পারাপার করত। এতে কত আনন্দ হত ওদের তা ব্যক্ত করার ভাষা এই মুহূর্তে হয়ত যতন, মুকুলদের নেই। সুদিনে ঐসব নদীর ধারের জমিতে রবিশস্যের চাষ হত। মরসুমি কত সবজি জমিতে ফলত তা ও হয়ত তাদের মনে পড়ে। গ্রীষ্মের দুপুরে নদীরধারে যে আমগাছ ছিল তাতে যে আমের ফলন হত তা মালিকের অজান্তে গাছ থেকে পেড়ে নুন মেখে খাওয়ার সাধ সত্যি অতুলনীয়। যতন, মুকুল, দুকুল, মনু, আনন্দ সকলে মিলে লঙ্কা ক্ষেত থেকে মিষ্টি কুমড়োর পাতা নিয়ে তাতে আম কুচি কুচি করে কেটে লঙ্কা ক্ষেত থেকে লঙ্কা আর আধ পাকা টমেটো এবং ঘর থেকে কাগজে বেঁধে নিয়ে যাওয়া নুন মিশিয়ে মনের আনন্দে খেত।এই অভিজ্ঞতা শৈশবের বয়সী সকলের কাছে অসাধারণ।
বিকালের পড়ন্ত বেলায় খালি ধানি জমিকে খেলার মাঠ বানিয়ে ফুটবল খেলার কথা যতন ভুলতে পারে না। বাবা মায়ের কত বকুনি খেয়েছে, পাড়া পড়শিদের গালমন্দও কম খায়নি। খেলতে গিয়ে কারও জমির ফসল নষ্ট করে ফেলা বা জমির ফলন চুরি করে খাওয়া ইত্যাদির জন্য সর্বদা বকুনি খেতে হত যতনদের।
ভাদ্রমাস। বৃষ্টি বাদলে চারদিকে রাস্তাঘাট জলময়, কর্দমাক্ত হয়ে থাকত। এই সময় দিনের বেলায় মেঘভাঙা রোদে অল্পজলমগ্ন যে ধানি জমিগুলি থাকত, সেখানকার জমা জল রোদে উত্তপ্ত হযে যেত। আর তাতে থাকা ছোটবড় মাছ মরে যেত। উক্ত মরে যাওয়া তাজা মাছ সংগ্রহ করতে গিয়ে রতন অসুস্থ হয়ে পড়ল। কাটফাটা রোদ রতন সহ্য করতে পারে নি। তড়িঘড়ি যতনের সেই মুকুলরা, দুকুলরা ধরাধরি করে গাছের ছায়া পড়েছে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে চোখেমুখে ঠান্ডা জল দেওয়ায় তার স্বস্তি ফিরে আসল।
ভাদ্রমাসে পাকা তাল খুড়ানোর ধূম পড়ে যায়।যতনরা দল বেঁধে তাল খুড়াতে যায়। গ্রাম্য মানুষজনের ধারণা তালগাছের তলায় অশরীরি আত্মা বিরাজ করে। লোকে বলাবলি করে কখনও কখনও ঐ অশরীরি আত্মা মনুষ্যরূপে সাদাকাপড় পড়া অবস্থায় দেখা যায়। ভাদ্রমাসের এক অমাবস্যার রাতে গ্রামের নির্জন মাঠ প্রান্তরে অবস্থিত তাল গাছ থেকে পড়া তাল খুড়াতে গিয়ে যতনের বন্ধু মুকুল ভয় পেল। সে একেবারে অজ্ঞানাবস্থায় মাঠের এক কোনায় পড়েছিল।অনেক খোঁজাখুঁজির পর মকুলের সন্ধান মিলল। সে তখন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। তাকে ঘরে নিয়ে আসল পাড়ার কতিপয় লোকজন। পরে তাকে পুন তাল খুড়াতে বললে, সে আর কোন দিন তাল খুড়াতে যাবে না বলে দিয়েছে।কারণ সে ভয় পেয়েছে। এখানে অশরীরি আত্মা বলতে ভূতকে বোঝানো হয়েছে।
ভূত বা প্রেতাত্মা নিয়ে মানুষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়ই। এই ভূত বা প্রেতাত্মা আবার সকলেই দেখে না বা অনুভব করে না। যে বা যারা দেখে শাস্ত্রমতে তারা ঐসব ভূত বা প্রেতাত্মার নিকটাত্মীয় বা আপনজন ছিল বিধায় দেখা দেয়। যারা ধর্মকেন্দ্রিক শাস্ত্র পড়েন বা অন্য কারও কাছ থেকে গল্পের মত করে শাস্ত্রকথা শোনেন তারা অবশ্যই বিশ্বাস করেন বা উপলব্দি করেন ঐ সব ভূত, পেত্নী আসলেই আলাদা এক প্রকারের সত্ত্বা। তাই শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, ” বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”। গ্রামাঞ্চলে লোক জনবসতি যেখানে তুলনামূলক ভাবে কম, সেখানে এসব দেখা যায়।
একবার কোন এক মন্দিরে এক মধ্যবয়ষ্ক যুবক গলায় দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে। পাড়ার লোকজন তা সরজমিনে তদন্ত করে সত্বর দাহ কার্য সমাপন করে ফেলে। ঐ গ্রামের মন্দিরে অবস্থানকারী পুরোহিত প্রায় সময় রাত্রিবেলায় ঐ ব্যক্তিকে দেখতে পায়। তবে অমাবস্যার রাত হলে তো কথাই নেই।ঐ ব্যক্তি দেখা দেবেই, সে মন্দিরের পুরোহিতকে জ্বালাতন করবেই। পুরোহিত কিন্তু ভীতু নন। প্রায়ই পুরোহিত অশরীরি আত্মার সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেন। এতে পুরোহিত সহজে ভয় পান না। পুরোহিত যে মন্দিরে থাকেন তা কিন্তু একেবারে শ্মশানে অবস্থিত। প্রতিনিয়ত সেই পুরোহিত মরাপোড়া দেখে থাকেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব বয়সের মৃতদেহ এই শ্মশানে নিয়ে আসা হয় পোড়ানোর উদ্দেশ্যে। মরাপোড়ানো দেখতে দেখতে পুরোহিতের মন শক্ত হয়ে গেছে।
একদিন যতন নামে যুবক ঐ পুরোহিতের কাছে দীক্ষা নিয়ে ঐ শ্মশানের মধ্যে অবস্থিত মন্দিরে অবস্থান করতে লাগল। যতন আগে অনেকবার শুনেছে, শ্মশানমন্দিরে প্রায়ই অশরীরি ভূত-প্রেত অমাবস্যা-চতুর্দশীর গভীর রাতে দেখা যেত বা দেখা দিয়ে থাকে। আগে শুনে থাকার কারণে যতন তেমন একটা ভয়ার্ত হয় না। জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ যতন যথারীতি শুয়ে পড়েছে। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী-অমাবস্যার রাত তখন ১১-৪৫ মি. হয়ত হবে।যতন যেখানে শুয়েছে, সেই ঘরে পুরোহিতও শুয়েছে। হঠাৎ ঘরের সামনের বারান্দায় উত্তর-পশ্চিম কোনা বরাবর কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁধছে। বারান্দায় একটা কম পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। কতকগুলি কুকুর বয়ারান্দায় শুয়ে আছে। কান্না শুনে কুকুরগুলি উক্ত অশরীরি ভূতকে তাড়া করে অনেকদূর নিয়ে গেছে।ঠিক কয়েক মিনিট পর কুকুরগুলি পুনঃ বারান্দায় এসে শুয়ে আছে। যতন কিন্তু জেগে আছে তবে সারা শরীর জড়সড় হয়ে গেছে। সে তো লোকমুখে শুনেছে, কিন্তু এরকম বাস্তব অভিজ্ঞতা তার কোনদিন হয়নি। এরপর যতন যে ঘরে পুরোহিতের সঙ্গে শুয়েছে, সেই ঘরের দরজা অর্গল ধরে যেন সম্ভবত ঐ অশরীরি ভূত টান মারল। এবারও আগের মত কুকুর তাড়া করল সেই অশরীরি ভূতকে। কথায় আছে মানুষ অশরীরি আত্মাকে দেখতে না পেলেও কুকুররা দেখতে পায়।তাই কেউ মারা গেলে রাত্রিবেলায় কুকুর চিৎকার করে থাকে।তাছাড়া অন্যভাবেও কুকুর চিৎকার করে থাকে। সব চিৎকার কিন্তু অশরীরি ভূতাত্মাকে দেখলেই যে হবে তা নয়। দেখার ভিতরও কতকগুলি কারণ থাকে। কারণগুলি আসলে কি? কি? তা জানার উপায় নেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কুকুর চিৎকার করে ভয় পেয়ে যায় বলে। আবার প্রভুর অত্যধিক আদরের ঠেলায়ও চিৎকার করে থাকে। আসল কথায় ফিরে আসি, ঐ যে কুকুরগুলি চিৎকার করে অশরীরি ভূতকে তাড়া করল।তখনই শুরু হয়ে গেল তাণ্ডব। অশরীরি ভূত এবার চড়াও হল কুকুরগুলির উপর।মন্দিরের মধ্যে থাকা আমগাছগুলি দিয়ে যেন কুকুরগুলিকে মারছে। রীতিমত ঘরের ভেতর থেকে যতন শুনতে পেল। এরপর হঠাৎ যতনের মনে হল অশরীরি আত্মাকে তুষ্ঠ করতে একটু মন্ত্র জপ ধ্যান করতে হয়। তারপর তাদের উদ্দেশ্যে পুণ্যবিতরণ করতে হয়।সাধারণতঃ হিন্দুবৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা রয়েছে, পুণ্যদান বা তর্পন করা ভাল। এতে পরাত্মা খুশী হয়। যতন ঐ সময় তাই করতে চেষ্টা করল। যতন এতই ভয়ে কাতর হয়ে গেল যে তার মুখ থেকে কোন কিছুই বের হচ্ছে না।তবুও সে বলতে চেষ্টা করল। মন্ত্র বলতে বলতে সে পুন্যদানও করল। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যে পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে যে এত তান্ডব চলছিল, তা মুহূর্তে নিঃস্তব্দ হয়ে গেল। কখন যে যতন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা আর সে মনে করতে পারেনি। পরদিন তার গুরু পুরোহিত তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। সে পুরোহিত গুরুকে পূর্বরাত্রির ঘটনা বিস্তারিত বললে, পুরোহিত গুরু বললেন, ঐরকম ঘটনার সাক্ষী তিনি বহুবার হয়েছেন। ফলে পুরোহিত এখন আর ভয় পান না। তিনি পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
যতন সেই থেকে অনেকটা ভয়মুক্ত হয়েছে। একদিন সে পাড়ার মানুষকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। সময়টা শারদীয়া দূর্গাপূজা চলাকালীন। পাড়ার ছেলে মেয়ে ঠিক করেছে সন্ধ্যার সময় দূর্গাপূজা দেখতে যাবে। যতন তা আগে জানতে পেরেছে। যতন ভয় দেখানোর জন্য একটা জায়গা বেছে নিল। সেই জায়গাটা তার মাতামহের শ্মশান। সে সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢেকে নিল এবং ঐ শ্মশানের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। অমনি যারা পূজা দেখতে যাবে ঠিক করছে, তারা ঐ পথ ধরে যেতেই সাদা কাপড় জড়ানো যতনকে দেখতে পেল।তাও আবার শ্মশানের ধারে। যেই দেখল তখন চিৎকার করে যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেল। যতন এবার সেই কাপড় ঘুটিয়ে ভয়ার্তদের কাছে গিয়ে বলতে শুরু করল, কি হয়েছে! কি হয়েছে! সে তাদের বলল ভয়ের কিছুই নেই একটু গায়ে জল ছিটিয়ে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। এরকম করে সে সাহসটাকে বাড়িয়ে নিল। পরে অবশ্য যতন বলে দিয়েছিল, ভূতটা আর কেউ নয় স্বয়ং আমি। তার স্বীকারোক্তিতে কেউ বিশ্বাস করল আবার কেউ করল না।
সোনাই নদীর শাখা নদী ছিল মহেশখালী। সোনাই আর মহেশখালীর সংযোগস্থলে মৎস্য দেবতা প্রায় সময় লোককে দেখা দেয়। লোক তার কাছাকছি গেলে লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে যায়। অন্ধকারে সেই দেবতা মানুষের বেশ ধরে বসে থাকে। যেই মানুষকে দেখে তখনই নদীতে ঝাপ দেয়। তবে কখনও একাকী তার সম্মুখীন হওয়া ঠিক নয়। যে কোন ধরণের বিপদ হতে পারে। একবার যতনের দাদু ভাদ্রমাসের ভোর রাত্রে নদী মাছ ধরতে যায়।সঙ্গে অবশ্য যতনের মামা পুতুলও ছিল। কিন্ত তারা বাপছেলে ঐ মৎস্য দেবতা থেকে রেহাই পায়নি। ভয় পেয়ে বাড়ী চলে এসেছিল, কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ে। যতনের দাদু অল্প ক’দিন পর মারা যায়। পুতুল অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাসায়ী হয়ে গেল। এই ঘটনার অনেক আগে থেকে যতনের মামা পুতুলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। লোকাচার মতে গুরু মরা বছর। তাই বিয়ে পিছতে হবে। পাড়াপড়শীরা বলছিল, অন্ততঃ এক বছর অপেক্ষা করতে তো হবেই। কিন্তু পুতুল এক বছর অপেক্ষা করতে পারেনি। মেয়ের বাড়ী থেকে বলছিল ছয়মাস অপেক্ষা করলে হবে। মেয়ের বাড়ীর কোন গুরুজন মারা গেলে একবছর অপেক্ষা করতে হয়। এরই মধ্যে ধূমধামের সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেল। যতন মামার বিয়ের নিমন্ত্রণ খেল। এই আনন্দ বেশী সইল না। যতনের মামার এক ছেলে হল। ছেলে হবার পরই পুতুল অর্থাৎ যতনের মামা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। অবশেষে বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যে যতনের মামা পুতুল মারা গেল। পুতুলের সংসার ছাড়খার হয়ে গেল। সদ্য বিবাহিতা এক সন্তানের জননী পুতুরের বউ যতনের মামী জীবন সংগ্রামে অবতীর্ন হল। যতনের বাবার পরামর্শে পুতুলের বউ সবিতা লোকের বাড়ী জনখাটার কাজ করতে লাগল। সে হার স্বীকার করেনি। সংকল্পবদ্ধ হলেন এই জীবন সংগ্রামে জয়ী হবেনই। ছেলেকে কোলে করে লোকের বাড়ীতে কাজ করতে প্রতিদিন কাজ করতে যায়। এভাবে কাজ করতে করতে নিজে স্বাবলম্বী হয়। ছেলেকে স্কুলে পড়িয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে তাদের পাশ্ববর্তী মন্দিরে পুরোহিতের কাছে সমর্পন করেছে। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন ছেলে চাকুরী করে। মাকে দেখে। কোনভাবে মাকে অতীতের কোন ঘটনা মনে আনতে দেয় না। মায়ের মন, তা কি কখনও ভুলিয়ে রাখা যায়। যতন এই অভিজ্ঞতা কখনও ভুলতে পারে না।
মহেশকালীর আর একটি শাখা নদী আছে তার নাম কাসখালী। ছোটবেলায় যতন এই ছোট্ট স্রোতস্বিনীতে কত মাছ ধরেছে। আজ তা অতীত। সোনাই নদীর এই শাখা নদীগুলি মজে গেছে। বলাবাহুল্য শুকিয়ে গেছে। যতন বর্তমানে অতীতের কথা মনে আফসোস করে আর স্মৃতি রোমন্থন করে। স্বীয় অভিজ্ঞতা লোককে বলে তৃপ্তি অনুভব করে। হয়ত জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও যতনের কাছে তার শৈশবের কথা বিস্মৃত হবার নয়।
–~০০০XX০০০~–