বহুযুগের ওপার হতে
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
কিছু বলব বলে –
এ লেখাটি যে বয়সের তখন উদ্যম ছিল বেশী, আত্মপ্রকাশের ছটফটানিও। একটি সদ্যজাত ছোট পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার জন্য বন্ধুরা অনুরোধ করেছিল। অর্থাভাবে সে পত্রিকা যদিও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। সেও প্রায় পনের ষোল বছর আগেকার কথা। আজকের এই কাঁচাপাকা চুলের বয়সটাতে এসে ওই সময়ের কাঁচামিঠা হাতের লেখাটিকে সকলের সামনে এনে আমার প্রথম অপ্রকাশিত উপন্যাসটিকে তার প্রাপ্য পিতৃপরিচয়টুক অন্তত আজ প্রদান করলাম।
*************
একটু বেলায় টিপু মিঞার টমটম করে হাটের দিকে গেলাম। হেল্থসেন্টারের লাগোয়া একটা ডিস্পেনসারী আছে, যদি ওষুধ পাই সেই আশায়। ওখানে গিয়ে একটা হিন্দী খবরের কাগজ পেলাম দিন দুয়েক আগেকার।এখানে আসা ইস্তক টেলিভিশন আর খবরের কাগজের প্রয়োজন হয়নি একদিনের জন্যও।একটা খবরে চোখ আটকে গেল। নয়াগড়ে একটা মিশনারিদের চার্চ আর ফ্রি ইস্কুল ছিল জোন্স সাহেবের। ওদিকটা আবার অনগ্রসর ট্রাইবাল বেল্ট। খ্রীস্টের সেবায় নিয়োজিত সৌম্যদর্শন মধ্যবয়স্ক মানুষটি ওই এলাকায় গত পাঁচ বছর ধরে একটি বিনেপয়সার স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর প্রাইমারী ইস্কুল চালাতেন। সদরে যাওয়ার সময় হঠাৎ আক্রান্ত হন স্ত্রী পুত্র সহ। নিজের গাড়ির মধ্যেই ওদের সবাইকে জ্বলন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে কিছু উগ্রবাদী ধর্মীয় মানুষ। মধ্যযুগ আমাদের আর কতদিন এভাবে পিছনে টেনে ধরবে? এই খবরগুলো কি কাগজের পাতা থেকে কোনওদিন কি যাবে না?
ফিরতি পথে ফের চান্দু গাহকের সাথে দেখা। চান্দুর একটি চোখ অন্ধ। অন্যটিতে একটু আধটু দেখতে পায়। গলায় একটা দোতারা মতন যন্ত্র ঝোলে সর্বদা। গানের ভিতর দিয়েই ওর ভুবন, সব অন্ধকারকে ও দূর করতে পারে অবলীলায়।সকলে ভালোবেসে যা খুদ কুঁড়ো দেয় তাতেই ওর দিন চলে। টমটমে ওকে তুলে নিলাম। একটু গান হলে মনটা হাল্কা হত এসময়। চান্দুর গানের ভাষা বুঝিনা ঠিকই, কিন্তু ওর মেঠো সুরটা মনকে ছোঁয়। সারা রাস্তা রুক্ষ,শুষ্ক ধূলো উড়ছে উন্মাদিনীর মতো । বাংলোয় পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ দুপুর গড়িয়ে গেল।
শরীরের ওপর এইটুকু ধকলে কাহিল লাগছিল। সুভদ্রা খাবার এনে দিল। ওর কাছে খবর পেলাম এখানকার নিস্তরঙ্গ জীবন যাপনে আবার নতুন করে পুলিশী উপদ্রব শুরু হয়েছে মহাবীরদের ধরার জন্য। ভক্তরামের কাছেও এসেছিল ওরা। মহাবীরের জন্য আশঙ্কায় ওর মন উচাটন হচ্ছে।
যতদিন যাচ্ছে এখানকার প্রকৃতি, বাঘমোন্ডা পাহাড়ের কালচে ন্যাড়া ন্যাড়া মাথা, অর্জুন, শাল, কেঁদ,বহেড়া গাছের কুমারী অরণ্যানী, অসংখ্য নাম না জানা পাখির কলতান, বালির মধ্যে লুকোচুরি খেলা রেখাই নদী আর অবশ্যই এখানকার মানুষজনের সাথে অকল্পনীয় বন্ধনে বাঁধা পড়ছি। এখানে এসেই প্রথম জঙ্গলকে চিনলাম। দু একটা হঠাৎ চলে আসা কৃষ্ণসার হরিণের প্রেয়সীর মত কালো চোখের দৃষ্টির সুভদ্রাকে চিনলাম আর চিনলাম নিজেকে। কোলকাতায় নিজেকে সবসময় মেকী আড়ম্বরের আড়ালে সাজাতে সাজাতে আসল আমিটা কবেই চাপা পরে গেছিল। এখানে এসে তার শাপমুক্তি ঘটলো যেন। প্রকৃতির আদিম বৃক্ষবনের কোলে একদিন না একদিন সবাইকে ফিরতেই হবে। সাধে কি জীবনানন্দ তাঁর সব কবিতাতেই এই ফেরাটার কথা বলে গেছেন
…’এই মাঠে এই ঘাসে ফলসা ক্ষীরুয়ে
যে গন্ধ লেগে আছে, আজো তার;
যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক দুপুরের রোদে..’
একটা মুখবন্ধ খাম নিজেই হাতে করে দিতে এলেন পোস্টমাস্টার আনন্দ সিংহ বাবু। ভদ্রলোক বোধহয় বিহারী। কথায় পূর্বদেশের টান আছে যেন। ডিউটি শেষ করে ফেরবার পথে আড্ডা দেওয়ার জন্যই আমার কাছে এসেছেন। সুভদ্রা ফুলকপির বড়া করেছিল আর সঙ্গে মকাইবাড়ীর চা। ও বস্তুটি আমার সঙ্গেই থাকে যে কোন ট্যুরেই। ভদ্রলোক শখের কবি। এব্যাপারটা বাড়তি তো বটেই, তবে হিন্দিতেই লেখেন। দুএকটা পত্রিকায় টুকটাক সে সব লেখা ছাপাও হয়েছে বললেন। ওনার পরিবার থাকেন রায়গড়ায়। মাসান্তে সেখানে কখনো কখনো যান বাকি সময়টা এই জঙ্গুলে দেশের প্রেমে তিনি বন্দী। আড্ডায় আড্ডায় ভালোই কাটলো বিকেলটা।
চিঠিটা আসলে কাগজের আপিসের ফিচার এডিটারের তাগাদা। একটা স্পেশাল অফবিট ভ্রমণের এডিশান বেরোবে ঠিক পূজোর মুখেই তার জন্যই আসলে আমায় পাঠানো কিছু একটা ভদ্রস্হ গোছের ট্র্যাভেলগ লেখার জন্য।
কাজের কোন জিনিসটা কবেই বা আমি ঠিক সময়েই করেছি !
আজ যুগলদের বস্তিতে একটা খাওয়াদাওয়া ছিল। যুগল বাবাজীবন পুত্রসন্তানের পিতা হয়েছেন। সেই আনন্দে শুয়োরের মাংস পোড়া আর কলাপাতায় করে গরম ভাত। সাথে তাড়িও ছিল। সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যবস্হা। চান্দু গলা ছেড়ে গান ধরেছিল ওর ভাষায়। তিরতির করে কাঠকুটো জ্বালানো আগুনটা কাঁপছিল হাওয়ায়। চান্দুর জীবনটা ভারী দুঃখের। ছোটথেকেই গানটান লেখে সুরও দেয়, ও হঠাৎ প্রেমে পড়লো মাহাতোর মেয়ে মুনরীর। বিয়েও ঠিক হল ভিনগাঁয়ে একদিন। কিন্তু বিয়ের রাত্রে পাত্রী নিঁখোজ হয়ে যায় অজ্ঞাতকারণে। বেচারার আর ফুলশয্যা হলনা। সেই থেকে রেখাই এর তীরে তীরে ও আজও ওর প্রিয়াকে আকূল হয়ে খুঁজে বেড়ায় ওর গানে গানে – বরঅ আইলঅ! বরআ আইলঅ! বহু আসুনিই ! বহু আসুনিই…..
মুন্তার ছেলেটা আজ ভোরবেলা মারা গেল। ওই ঘা’টা বিষিয়ে গেছিল শেষ অবধি। রেখাই এর তীরে গেছিলাম অন্ত্যেষ্টিতে। মুন্তাকে সুভদ্রা আর কয়েকজন ধরে সামলে রেখেছিল, মধু কি বুঝছিল জানি না হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে একটা পাথরের ওপর পাথর হয়েই বসেছিল চুপ করে। আরও অনেকেই এসেছিল সেখানে। প্রায় বিনাচিকিৎসায় একটি অসহায় শিশুর মৃত্যুতে এখানকার বাতাস ভারী হয়ে রইল। মুন্তার স্বামী বিরজু ওদের ছেড়ে কেসিঙ্গায় আলাদা সংসার পেতেছে কবেই। ছেলে আর ভাই ওর এই জীবনের অবলম্বন ছিল এতদিন। ঈশ্বরকে দত্তাপহারক যারা হলেন তারা খুব ভুল বলেন না বোধহয়।
রাতে একচোট বৃষ্টি নামল। শুকনো মাটির সাথে প্রথম বর্ষার রমণে সোঁদা গন্ধটা বুক ভরে নিচ্ছিলাম। গাছের ওপর জলতরঙ্গের শব্দ আর ঝিঁঝি পোকার সিম্ফনি বেশ জমে গেছিল।
রান্নাঘরের দাওয়ায় মোড়া টেনে সুভদ্রার সাথে রোজই গল্প জমাই। ওর কথা, মহাবীরের কথা এসব শুনি। মহাবীর ওর অহঙ্কার। ওকে শুধোই ” যদি মহাবীর কখনো বদলে যায় ভিতরে ভিতরে তবে কি করবি? ” হরিণকালো চোখে সে উত্তর দেয় ‘ বিষ খাব বাবুজী..’ ভালোবাসার এক্সপায়ারি ডেট পার হয়ে গেলে শহুরে সভ্য মানুষদের মতো লোকলজ্জায় সেটাকে মৃতদেহের মতো টেনে টেনে তিক্ত করতে ওরা শেখেনি। এই শিক্ষাই আসলে সুভদ্রাদের প্রকৃতির দান।
সুভদ্রাকে যতই দেখি অবাক হয়ে যাই।তথাকথিত এ্যাকাডেমিক শিক্ষা না পেয়েও কি অসম্ভব মানবিকবোধ ও পেয়েছে এই বনজঙ্গলের পরিবেশে ! এর মধ্যে একদিন ওকে নিজের হাতে রেঁধে মুরগীর ঝোল আর লুচি ভেজে খাইয়েছি সামনে বসিয়ে। যাবার সময় আমায় ঢিপ করে প্রণাম করে সে। ওর আয়ত দুচোখে তখন লক্ষহীরার শিশির বিন্দু।
সবকথা মুখে না বলে দিলেও চলে। যেমন সব নামের কোনও ডাকনাম হয়না কখনো। আমি চলে গেলে কোনও এক অলস বন্ধ্যা দুপুরবেলা যখন ঘুঘুর ডাক কান ভারী করে তুলবে তখন হয়তো কূয়োতলায় বসে ও কি একবার হলেও আমার কথা ভাববে না? আমার জন্য তুলে রাখা সেই মনখারাপের নির্দোষ কান্নায় ওর ভাবী সংসার জীবন মলিনতায় ভরে যাবেনা নিশ্চয়ই।
–~০০০XX০০০~–