ভিটে
✍পল্লব চক্রবর্ত্তী
সকাল থেকেই ভ্যাপসা গরমে হাস ফাঁস করছে শরীরটা,,। তার মধ্যে দুপুরে বিশ্বাস বাড়ির ভোজে অস্থিরতা আরও বেড়ে গিয়েছে,,। কোন রকম ছাতাটা মেলে হাঁটা শুরু করলেন নিবারণ,,পুরো নাম নিবারণ রায়,,।
দুই ক্রোশ মেঠো পথ তার সামনে,। খড়মের ঘষায় জামড়ো পরা পা গরম ধুলোয় আরাম বোধ করলেও বয়সের ভার বয়ে চলা বড়ই কঠিন আজ,,।
পূর্ব পুরুষের ভিটে বাড়ি, কোন রকম তাপ্তি দিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু রোদ বা বর্ষা কোনটাই বাঁধ মানে না,,।। যোগেশ গঞ্জের এই বাড়ি তাদের সাত পুরুষের,,। শুধু এই গ্রাম নয় পুরো হেমনগর থানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বংশ পরম্পরায় যজমান,,,। আর এই যজমানে ভরসা করেই নিবারণ তাঁর একমাত্র ছেলে বিপিন কে কষ্টেসৃষ্টে বি এস সি পড়িয়েছেন,,। ছেলেও ছোট থেকেই খুব ভালো পড়া লেখায়,,। তার পর ছেলেটা আরও পড়তে গেল শহরে,। প্রথম তিন মাসে বার তিনেক সে বাড়ি এসেছিল,,। অতঃপর নিরুদ্দেশ,,,। গ্রামের পরিচিত যারাই শহরে কাজ করেন বা যান তাদের কাছে নিবারণ ছুটে যান ছেলের কোন খোঁজ আছে কিনা জানতে,,,। কেউ বলে না কাকা কোথাও দেখিনি, কেউ বলে ভগবান কে ডাকো যদি সব ঠিক থাকে নিশ্চয়ই আসবে,,,। বৃদ্ধ চোখে জোয়ারের জল ছাপিয়ে বন্যা বয়ে যায়,,,।।
জমিদার পরিবার অনেক আগেই গ্রামের সব পাঠ চুকিয়ে শহরে আস্তানা গড়েছে,,,। নিবারণের পূর্ব পুরুষ ঐ জমিদার বংশের পুরোহিত বংশ,,। বারো মাসে তেরো পার্বন লেগেই থাকত,,,।,,জমিদার সমরেশ মুখার্জি ছিলেন অতি প্রভাব শালী মানুষ,,। আসে পাশের দু দশটা জমিদার যার ভয়ে কাটা হয়ে থাকত,,। তাঁর মৃত্যুর পর আর তেমন কোন যোগ্য পুরুষ ঐ বাড়িতে আসেনি,,,। তবে লোক মুখে শোনা যায় কলকাতায় গিয়ে ব্যবসা বনিজ্য করে এখন তারা বিশাল ধনী হয়ে উঠেছে,,,।।
ছেলে শহরে যাবার দু বছরের মধ্যে ছেলের শোকে তাঁর স্ত্রী পরলোক গমন করেন,,। যার মুখাগ্নিটাও নিবারণ কে করতে হয়েছিল। বিয়ের পর তোলা স্ত্রীর একটা ছবি এখন দেওয়াল থেকে নিবারনের সঙ্গ দেয়,,। এই ভাবেই সূর্য ওঠে প্রতিদিন আবার পশ্চিমে ঢলে যায়,,। কিন্তু ঐ আটচালা ঘর, যজমানের আতপ চাল , পায়ের জামরো, ছেলের জন্য পথ চেয়ে থাকা কোনটার কোন পরিবর্তন ঘটে না,,,।।
কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী অজয় মুখার্জির একমাত্র মেয়ে, পরমা সুন্দরী ময়ূরীও পড়াশোনাতে খুব মনযোগি,,। সে ছোট থাকতে সাহিত্য প্রেমি হলেও বাবা মায়ের ইচ্ছা পুরনের জন্য তার বিষয় এখন অঙ্ক,,।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এস সি ফাস্ট ইয়ার ম্যাথ,
পরিচয় হয় ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এস সির সব থেকে কৃতি ছাত্র বিপিন রায়ের সাথে,,। সদ্য শহরে আসলেও তার ব্যক্তিত্ব হাব ভাবে কিছু বোঝার উপায় নেই,,। তবে পোশাকে গরীবি ছোঁয়া আছে,,। কথায় কথায় ময়ূরী জানতে পারে৷ বিপিন অঙ্কের ছাত্র,,। বাবা অনেক দিন থেকেই তার জন্য গৃহ শিক্ষক খুঁজছিলেন,,।আর বিপিন একটা মজবুত আশ্রয়,,।
ময়ূরী বড়ি ফিরে বাবা কে বলতেই ডেকে পাঠানো হল বিপিন কে,,। তার পরিচয় পরিচিতি শোনার পর,, অজয় বাবু দেরি না করে বাড়ির একটা অতিরিক্ত ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করলেন,,।এখন বিপিন এম এস সি পাশ করে অজয় বাবুর ব্যবসা দেখা শুনা করে,,। দেশ বিদেশ বিপিন কে ঘুরতে হয়,,। ময়ূরীর ও পড়াশোনা শেষ,,,। অজয় বাবু আর তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করেন, এত ভালো ছেলে ঘরে থাকতে মেয়ে কে আর বাইরে কোথায় দেবে,,। গিন্নি ও রাজি হয়ে যান,,। ও দিকে মেয়ে অনেক আগেই মন দিয়ে বসে আছে,,,।।
বিপিন সবে জার্মান থেকে ফিরেছে,,। এমন সময় অজয় বাবু তাকে জানালে বিপিন লজ্জা লজ্জা মুখে সম্মতি জানাল,,। আর বুকের মধ্যে অসম্ভব আনন্দ সে যেন তার জীবনের সব টা ই আজ পেয়ে গেল,,। যে টুকু বাকি ছিল সবটাই,,। সন্ধ্যায় ময়ূরীর সাথে ছাদে দেখা হয়ে গেল,,। সে চিরদিনই অপরূপা আজ গোলাপি শাড়ি তে আরো মোহময়ী লাগছে,,। একটু কাছা কাছি আসতেই বিপিন ময়ূরী কে দেখতে লাগল,,।এত গুলো বছর এত পাশা পাশি থেকে ও কোন দিন আগে এই ভাবে দেখেনি,,। ওর চোখ নাক মুখ ঠোঁট সব যেন বিপিনের একার,,। ময়ূরীর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন ওর মুখে জমা হতে লাগল,,। বিপিন ময়ূরী কে আরও কাছে টেনে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে,,,। ময়ূরীর সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে,,।
নিচের ঘরে তখন পরিকল্পনায় ব্যস্ত অজয় বাবু ওনার স্ত্রীর সাথে,,,। ময়ূরী বিপিনের হাত ছাড়িয়ে এক ছুটে ঐ ঘরে ঢুকতেই, অজয় বাবু পরম স্নেহে পাশে বসিয়ে বললেন কিছু বলবি মা,,,?,,ময়ূরী বলল বাবা আমি বিয়ের আগে একবার তোমার জন্ম ভিটে দেখতে চাই,। আমার পূর্ব পুরুষের ঐ মাটি আশির্বাদ আমি মাথায় নিতে চাই বাবা,,। বিপিন নিচে আসতেই অজয় বাবু তাকে বললেন বিপিন কাল ভোরে তৈরী হয়ে নিও আমরা বেরব,,,।
ভোর হতে না হতেই সবাই তৈরী হয়ে গাড়িতে উঠে বসল গাড়ি চলতে শুরু করল,,। বিপিন এখনও জানে না তাদের গন্তব্য,,। গাড়ি বসিরহাট হয়ে হাসনাবাদ পার করতেই বিপিন কেমন হারিয়ে যেতে লাগল,,। চোখের সামনে বাবা, মা, ছোট বেলার নানা ঘটনা সব ফুটে উঠতে লাগল,,। তবে কি অজয় বাবু আমাকে আমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন,,? কিন্তু তারা কি ভাবে জানবেন আমার ঠিকানা,,!! বিপিন ভেবেই চলেছে,, আজ আর কোন মুখ নেই তার বাবা মায়ের সামনে দাঁড়ানোর,,,। গাড়ি দুলদুলি রায়মঙ্গের পাড়ে দাড়াতে ই ময়ূরী বলল আজ আমার পূর্ব পুরুষের ভিটা তোমাকে দেখাব,,।।
যোগেশ গঞ্জে গাড়ি ঢুকতেই ছোট ছোট বাচ্চারা রাস্তার ধূলো উপেক্ষা করে গাড়ির পিছনে ছুটতে লাগল,,। তারা কেউ এমন দামি গাড়ি আগে দেখেনি,,,। গাড়ি থামল একটা কালি মন্দিরের সামনে,,। আসপাশের লোকজন ভীড় জমিয়েছে,,। সুন্দর দামি গাড়ি থেকে অভিজাত পোশাকের ফর্সা মানুষদের নামতে দেখে,,। অজয় বাবু মন্দিরের সিড়িতে প্রণাম করে মেয়ে কে নিয়ে মন্দিরে উঠে গেলেন,,। বিপিনের সারা জীবনের শেখা কোন অঙ্ক আজ আর মিলতে চাইছে না,,। ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা ছেলে বিপিনে দিকে এগিয়ে এসে এক দৃষ্টিতে বিপিন কে দেখতে লাগল,,,। বিপিন ওর চোখে চোখ রাখতে পারল না,,,। না চেনার ভান করে মাটিতে তাকিয়ে থাকল,,।একটু পরেই ময়ূরী ছুটে এসে বিপিনের হাত ধরে দেখাতে লাগল তাদের বংশের প্রতিষ্ঠিত মন্দির,,। ঠাকুর মশায় এগিয়ে এলেন চরনামৃত দিতে,,। বিপিন হাত পাততেই ঠাকুর মশায় বসে পড়লেন মন্দিরের দাওয়ায়,,। বিপিন নিজেকে সামলাতে না পেরে দুপা জরিয়ে ধরলো,। বাবা তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও আমি ভুল করেছি,,,,। ভ্যাবাচাকা খেয়ে ময়ূরী দুজন কে দেখতে লাগে,,,।অজয় বাবু এগিয়ে এসে বলেন ঠাকুর মশায় আমি আগেই জানতাম বিপিন আমার গ্রামের ছেলে কিন্তু আপনার ছেলে তা জানতাম না,,। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমার একমাত্র কন্যার সাথে আজ এখানে আপনার ছেলের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হোক,,। আর গ্রামের সবাই আমার আমন্ত্রিত,, কি বলেন,,? নিবারন ঠাকুরের চোখের জল বাঁধ মানছে না,,। খোকা আজ তোর মা থাকলে,, মা লক্ষীকে বরণ করতে পারত,,। বিপিন কেঁদে ফেলল মা নেই,,!!
ঐ রাতে গন্ধর্ব মতে ঐ মন্দিরে ওদের বিবাহ সম্পন্ন হল,,। ময়ূরী জেদ করে শশুর ভিটেতে গিয়ে উঠল,,। রাতে ভাঙা চালা দিয়ে চাঁদের আলো ওদের দেহে এসে পড়ছে,,,। রাতের আকাশ আগে দেখলেও আজ যেন ময়ূরীর বেশি ভালো লাগছে,,। বিপিন ওর হাত নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বলল ঘুমিয়ে পড় কাল ভোরে ফিরতে হবে,,,। ময়ূরী বিপিনের বুকে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল,,। বিপিন কি করবে বুঝে উঠতে পারল না,। আর ওর কি চাই তাও বুঝতে পারছে না । ,,,আজ, ও যেন ছোট্ট একটা শিশু,। পরম স্নেহে বিপিন ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে,, কি হয়েছে বলো,,,? ময়ূরী বলল আমায় কথা দাও আমার শ্বশুরের ভিটে আমার বসবাস যোগ্য করে দেবে,,আমি আর কিছু চাই না,,,।।
যোগেশ গঞ্জের বাড়িটা আজ সুন্দর ফুল আর নানা গাছ দিয়ে সাজানো,,।মাটির দেওয়াল গুলো দালান হয়েছে , ওপরে ছাদ,,। নিবারণ রায় আজও ছেলের জন্য পথ চেয়ে থাকেন,,। আর ময়ূরী কে দেখলেই জানতে চান বৌমা খোকা কখন আসবে,,,?
–~০০০XX০০০~–