পারলৌকিক
✍ বৈশাখী রায়
বাবার মোটা রজনীগন্ধার মালা পরা ফটোটার সামনে মাথা নীচু করে বসেই আছি আমি, কিছুতেই একটুও জল আসছে না চোখে। অথচ পাশ থেকে পুরোহিত জেঠু ফুল তিল গঙ্গাজল ইত্যাদি ছেটাতে ছেটাতেই নীচু গলায় বলছেন,
“পারলে অন্ততঃ দু’ফোঁটা জল আনো চোখে মা, ওটুকু দরকার!”
আমি প্রানপণে চোখ বুজে বাবার কথা মনে করার চেষ্টা করছি, মাথার মধ্যে কেমন ঝাপসা লাগছে সবটা, আমার স্মৃতিভ্রম হলো নাকি! আশেপাশে বসা আত্মীয়রা উৎসুক হয়ে চাতকের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কখন দু’ফোঁটা জল পড়বে আমার চোখ থেকে, এই আশায়। নতুন পাটভাঙ্গা শাড়ির আঁচলটা অকারণেই গায়ে জড়িয়ে নিলাম একটু। অপ্রভিত লাগছে আমার, এতো চেষ্টা করছি, তবুও এতটুকুও জল আসছে না কেনো চোখে?
অথচ আমি তো ভালোবাসতাম বাবাকে, অন্ততঃ এতোদিন তো তাই জানতাম! যদিও চোখের জলের ওপর ভালোবাসার গভীরতা নির্ভর করে নাকি, জানা নেই আমার!
অবশ্য ঘাটকাজের দিনও প্রায় একই অবস্থা হয়েছিলো।পাশাপাশি বসেছিলাম আমি আর জ্যাঠতুতো দাদা, সামনের কলাপাতায় আতপ চাল, ঘি, কালো তিল, কলা ইত্যাদি রাখা। মা পইপই করে বলে দিয়েছেন, ঘি ইত্যাদি দিয়ে আলোচালের মণ্ড যেনো আমিই মাখি, বাবার আত্মাকে আমিই যেনো পিণ্ডদান করি। যদিও প্রায় সবারই আপত্তি তাতে। বংশের কূলপ্রদীপ থাকতে ভিনগোত্রের মেয়ের হাতে তিলজল নিলে নাকি আত্মা কাছছাড়া হবে না। সবার প্রশ্নের উত্তরেই মৃদু হেসেছি আমি। যারা বেঁচে থাকতে সামান্য ওষুধটুকু এনে দিতে পারেনি তারা তিল-জলে উদ্ধার করবে! তবে ওইদিনেও দেখেছিলাম, সামান্য দু-ফোঁটা জলও পড়েনি আমার চোখ থেকে। দূর থেকে ভেসে আসছিলো তুমূল কান্নার হল্লা। বিভিন্ন জ্ঞাতিকুটুম্বরা সব বাবার ডাকনাম ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে বলছিলেন, “ছেলেটা বড়ো খাওয়ার শৌখিন ছিলো গো দিদি। পাঁচ পদ নৈলে মুখে রুচতো না। ওই খেয়ে খেয়েই তো সব কঠিন ব্যামোগুলো ধরলো! আর আজ দেখো কি খাচ্ছে !”
আমি তখনো আলোচাল, ঘি , তিল চটকে মাখছি, ভাগ ভাগ করে রাখছি এক একটা মণ্ড, আমার গোটা তালু চ্যাটচ্যাট করছে ঘি-কর্পূর-শান্তিজলে; তবে চোখদুটো সেদিনও মরুভূমির মতো শুকনো খটখটে। ঘাটকাজ শেষ করে ওঠার সময় শুনি কেউ একজন বলছে, “ওরে বাছা আমার দু-ফোঁটা চোখের জলও পেলো না রে!” সেদিনও সমান অপ্রভিত হয়েছিলাম আমি! আচ্ছা সবাই এতো কাঁদছে; একা আমিই কি আবেগশূণ্য! এমন তো ছিলাম না কখনোই!
“ওঁ অদ্বেত্যাদি–কাশ্যপগোত্রস্য পিতুরমুকদেবশৰ্ম্মণঃ অমাবস্যাক্ষয়নিমিত্তক-পাৰ্ব্বণবিধিক–শ্রাদ্ধাৰ্থং পিতুরমুকদেবশৰ্ম্মণঃ!”…..চাল, ডাল, তেল মশলাপাতি, কাপড়, গামছা, ছাতা, চটি, ধুতি ইত্যাদির স্তূপের মধ্যে বসেই মন্ত্র পড়ে যাচ্ছিলেন পুরোহিত জেঠু, হাতের কুশি দিয়ে শান্তির জল ছিটোচ্ছিলেন মাঝে মাঝেই। খানিকক্ষণ দম নেবার জন্যই হয়তো ফস করে বিড়ি ধরিয়ে বসলেন একটা। বাবার হাঁপানির টান উঠতো মাঝে মাঝেই, বুকে পিঠে তেল মালিশ করতে করতে কফের দলা না ওঠা পর্যন্ত কেশেই যেতেন মানুষটা, ধূলো ধোঁয়া সহ্য হতো না মোটেই। আমার হঠাৎ অস্বস্তি লাগছে খুব! শ্রাদ্ধকর্ম পুরো না হওয়া পর্যন্ত বিদেহী আত্মা নাকি আশেপাশেই থাকে! তাদেরও কি কাশি হয়? কি জানি! আমার অস্বস্থি লক্ষ্য করেই হয়তো পুরোহিত জেঠু তাড়াতাড়ি বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপর শান্তি জল দিয়ে হাতটা ধুয়ে বললেন,
“মুখার্জীদা মোটে ধোঁয়া সহ্য করতে পারতেন না মা! আমারি ভুল!” তারপর গলাটা একটু নীচু করে বললেন,
“আসলে গাঁ-ঘরে সবাই হাউমাউ কান্না দেখতেই আদ্যশ্রাদ্ধের দিন হত্তে দেয় মা। ছাড়ো! তুমি হাত এগোও তো দেখি, কুশটা পরাই….!
***
“ওনার মুখাগ্নি কিন্তু মানুই করবে!”
উঠানে তখনো বাবার সদ্যমৃত দেহটা শায়িত, একটু আগেই বাবার গালে কপালে হাত ছুঁইয়েছি আমি, গরম এখনো। দেখে মনে হচ্ছে এখনি উঠে বসে বলবে, “মানু আমার ইসবগুলের ভুষিটা তোর মা কোথায় রাখলো বল্ তো। খুঁজেই পাই না!” অথচ মা আমাকে বলছেন মুখাগ্নি করতে!
বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মা হঠাৎ করে কেমন যেনো বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। অথচ আমি জানি, মা কি তীব্রভাবে পুত্রসন্তানের কামনা করতেন। জন্মের বহুবছর পরেও সেভাবে আমাকে আদর করেননি কখনো, কোলেও নেননি! বহুবার বলেছেন, উনি স্বপ্নে দেখেছিলেন ওনার কোল আলো করে গোপাল ঠাকুর আসবে! আর এলো এক চ্যাং-মুড়ি কানি! সেই মা’ই এখন মেয়ের অধিকার নিয়ে সোচ্চার! “বংশের-প্রদীপ, বংশের-প্রদীপ” করে জ্যাঠতুতো দাদাকে নিয়ে কম আদিখ্যেতা তো করতেন না মা! অবাক হয়েছিলাম আমি।
জ্ঞাতিকুটুম্বরা সব অনেক আপত্তি করেছিলো, পাড়ার লোকেরাও। মা শোনেননি, কিছুই বোঝানো যায়নি মা’কে। আমি তো জানিই মা কেমন বরাবরের একগুঁয়ে, জেদি! কাজেই এরপর শ্মশানযাত্রীরা অবাক হয়ে দেখেছে, এই প্রথম তাদের গাঁয়ের কোনো মেয়ে ছুঁয়ে আছে মৃতদেহ অথবা অপটু হাতে মালসা করছে শ্মশানে বসে কিম্বা ভরা কলস নিয়ে প্রদক্ষিণ করছে সাজানো চিতা! আমার নিজের কাছে এসব আচার অনুষ্ঠান সত্যিই তেমন অর্থ রাখে না কোনো, মানুষের জীবৎকালে বরং তাকে যথাসম্ভব সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া উচিৎ, তবুও যথাসম্ভব শ্রদ্ধার সাথেই পালন করছি সবটা, সত্যিই যদি বাবা তাতে শান্তি পান, পাক না! আমার তুচ্ছ বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিই বা যায় আসে!
দিনদুই পরে সন্ধ্যার দিকে এক কাপ চা হাতে বসেছিলাম একটু ! আজ যেনো সারা বাড়িতে আশ্চর্য নীরবতা। আসলে এই সময়টায় বাবা টিভি সিরিয়াল দেখতো রোজ। হাহা করে চিৎকার করতো খুব, মায়ের মুখঝামটাও খেতো খুব। আজ সব চুপচাপ। মা কখন যেনো এসে বসলেন পাশে। ধাক্কাটা সামলে নিয়েছেন অনেকখানি। যদিও চোখের পাটা ফোলা, কোলটা ভিজে ভিজে, তবুও মনে হচ্ছিলো মা সামলেছে অনেকটা। মায়ের খালি হাতদুটোর দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি, মুখ ঘুরিয়ে নিলাম তাই। মা দেখলাম বসলেন থেবড়ে! তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
” তোর বাবা খেতে বড়ো ভালোবাসতো মানু। আজীবন ছেঁড়া ধুতি রিপু করে পরেছেন, কিন্তু বাজার থেকে মাছ এনেছেন এক নম্বর। তাঁর শ্রাদ্ধশান্তিতে, বৈষ্ণফ বা বামুন কাঠুরে জ্ঞাতিকুটুম্ব খাওয়ানোতে কেনো খামতি রাখিস নে মা!”
মায়ের হাতে দেখি একটা টাকার বান্ডিল, না গুণেই বুঝলাম ওতে কম করে হলেও লাখ খানেক টাকা আছেই। মা’কে বলতেই পারতাম এসব নিষ্প্রয়োজন। লোকে আজ খাবে, ঢেকুর তুলবে, তারপরেই বলবে মাছটা পচা, দইটা বাসি! এসব কথা বোঝানো যায় না, ঠেকে শিখতে হয়। আমার জেদি এবং একগুঁয়ে মা এতো চড়াই-উৎরাই দেখার পরও শিখতে পারেননি এগুলো। আমার বা আমাদের পুঁজির স্বল্পতার কথা ভালোই তো জানি আমরা! জানি এটুকু রেখে দিলে কাজে লাগবে অনেক। তবুও এই যে নিজের শেষ সম্বলটুকু উজাড় করে প্রিয়জনের শেষযাত্রায় পাথেয় তৈরি করা, এর মধ্যে শান্তি আছে অনেক। সদ্য সব হারানো বৃদ্ধাকে এই সুখটুকু থেকে বঞ্চিত নাই বা করলাম। টাকাটা তাই হাত বাড়িয়ে নিয়েই নিলাম আমি। মায়ের খসখসে, শক্ত, অল্প বলিরেখাজীর্ণ হাতে ছোঁয়া লাগলো একটু। একটু দোনামোনা করে মায়ের হাতদুটো ধরলাম আলতো করে। ভরসার মতো করে এই প্রথম হয়তো ধরলাম মায়ের হাত। স্পর্শটুকুর দরকার ছিলো হয়তো মায়ের, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়লো এতোক্ষণে! আর আমি হাত বোলাতে লাগলাম আমার গর্ভধারণীর মাথায়, কোমরে , এলোচুল ছড়ানো পিঠে।
আজ এইমুহুর্তে আমি মা হলাম। মা এখন ছোট্ট মেয়ে। জানি সামলে নেবো সবটা। শুধু অসুবিধা হলো, আমার কান্না পাচ্ছে না একটুও। আচ্ছা, আমি কি পাথর হয়ে গেলাম!
***
শ্রাদ্ধশান্তি ভালোভাবেই মিটে গেলো গতকাল। আমাদের বাড়িতে বিশ্রামের দিনেই ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব ভোজন আর সন্ধ্যায় নামগানের আয়োজন হয়। আমি যতদূর সম্ভব যোগাড়যন্ত্র করেছি। সত্যি বলতে পাড়াগাঁয়ে লোকের অভাব নেই তেমন, কিন্তু কাজের সময়টা সব কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায়! এই কিছুদিন আগে কাকার ছোটো ছেলেকে বলেকয়ে পাড়ার নিমন্ত্রণ পত্রগুলো বিলি করিয়েছি, বাড়ির কাজ তো ওরও; তবু একটু ঘুরে ঘুরে ‘গঙ্গা’ লেখা কাগজটা দেওয়ার জন্য আমার থেকে হাতখরচ চেয়ে নিয়েছে। হাসি পায় আমার! কাকা তাও দূরের আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িগুলো ম্যানেজ করে দিচ্ছেন, এই অনেক!
খাতাপত্র নিয়ে বসে গত কয়েকদিনের জমাখরচের হিসাব লিখছিলাম আমি। অবশ্য জমা বলে তো কিছুই নেই, সবই খরচ! মা হাতে দিয়েছিলো হাজার সত্তর মতো! আমার নিজস্ব কিছু জমানো টাকা আছে হাজার কুড়ি মতো। ঘাটকাজে শাড়িজামা, নানা সামগ্রী, ব্রাহ্মণ খরচ দিয়ে গেলো হাজার পাঁচেক, শ্রাদ্ধশান্তির দিন তো পুরোহিত জেঠু মাসকাবারির হিসাব নিয়ে হাজির- তেল, নুন, চিনি, গামছা, কাপড়, জামা, মশারি, তোষক মায় একটু সোনা রুপোও চাই! তাতেও গেলো হাজার পনেরো। আজ ব্রাহ্মণভোজন আর পালাগান মিলিয়ে নয় নয় করেও হাজার পাঁচেক খসবে! হাতে বাকি কি আর থাকে! নিমন্ত্রিতের সংখ্যা কাটছাট করেও দুশোর কম করতে পারলাম না, শাখায় প্রশাখায় জ্ঞাতিকুটুম্ব তো কম নেই। পার প্লেট চারশো করে ধরলেও আশি হাজার তো এখানেই পড়ছে, এছাড়া প্যাণ্ডেল, জল, পরেরদিন যেসব আত্মীয়রা থেকে যাবেন তাদের খাওয়া দাওয়া; সত্যি বলতে খরচের গাছপাথর থাকছে না কোনো!
মা দেখি ধীরে ধীরে পাশে এসে বসলো, হাতে দুটো সরু সরু চুড়ি পরেছে আজ, শাড়িটা সাদাটে হলেও সাদা নয়, স্বস্তি পেলাম একটু। বাবাকে দেখতাম পূজো বা পয়লা বৈশাখে মায়ের জন্য চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি আনতো, কখনো সখনো কেয়াপাতায় জড়ানো যুঁই ফুলের মালা, সেদিন হয়তো বাবা-মা’র বিবাহবার্ষিকী, মা লজ্জা লজ্জা মুখ করে সাজতো একটু। মোটা শাখা-পলা, টানা সিঁদুর, খোঁপায় ফুল– বাবা এই সেদিনও অপলকে দেখতো মা’কে। মায়ের এমন খালি হাত, শূণ্য সিঁথি দেখলে খুব রেগে যেতেন বাবা নিশ্চয়ই।
মা দেখি ইতস্ততঃ করছে একটু, কিছু বলতে চাইছে, পারছে না হয়তো, খানিকটা জোর এনেই শেষে বললো,
“তোর বড়জ্যাঠামশাই বলছিলেন মুখার্জীবাড়িতে পাত পড়বে, আর তাতে গলদা চিংড়ি পড়বে না? এ কেমন কথা! বলছি মানু, পারশে বাদ দিয়ে চিংড়ি করলে কি খরচ খুব বেড়ে যাবে? আমার তো একটা ফিক্সড ডিপোজিট আছে, তালে সেটা ভাঙ্গতাম! এখন নয় ধারদেনা করে….!”
শেষ করতে পারলো না মা। আসলে জেঠু দুইতিনবার আমার কাছে গলদার কথা বলেছিলেন, আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম, তাই মায়ের মাথায় ঢুকিয়েছেন। চিংড়ি নিলে নয় নয় করেও প্লেটপ্রতি দু’শো বাড়বে, আমি বুঝি না, একটা মানুষ মরে গেলেও , একটা পরিবার সর্বসান্ত হলেও কি গলদা-বাগদা খেতেই হয়? আড়ম্বরটাই হয়তো আজকাল সব!
মা চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার স্বামীর কাছে হাত পাতলে হয়তো আমি পেয়ে যাবো সব টাকাই, কিন্তু আমার বাবা বড়ো অভিমানী মানুষ ছিলেন, মাসের শেষে জুতোর অর্ধেক ছিঁড়ে গেলেও, তাই পরে অফিস যেতেন। কখনো এক পয়সা ধারবাকিতে থাকতেন না। সেই মানুষটার পারলৌকিক কাজে আমি যদি তাঁর জামাইয়ের সাহায্য নিই, খুব কি খুশি হবেন তিনি? জানি খুশি হবেন না। অথচ মা যে বড়ো ভরসা নিয়ে এসেছেন। এই প্রথম হয়তো পেটের মেয়ের ওপর ভরসা করছেন। তাকে ফিরিয়ে দেবো? পারবো আমি!
মায়ের দিকে ফিরে সামান্য হেসে বললাম,
“এখুনি ক্যাটারারকে ফোন করছি, গলদার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না।”
মা হয়তো আমার সামান্য দোনামোনা ভাবই আশা করেছিলেন, থমকে গেলেন তাই। তারপরেই স্বস্তি পেলেন অনেকটা। একটু শ্বাস নিয়ে বললেন,
“এফডিটা তালে ভাঙ্গার ব্যবস্থা করিস মানু! আমি সইসাবুদ করে দেবো নয়।’
বারণ করে দিলাম মা’কে! ওইটুকুই তো শেষ সম্বল মায়ের! ওই সামান্য পুঁজিতে আর হাত দিতে দেবো না আমি। কখন কি লাগে ঠিক আছে?
কিন্তু বাকি টাকাটা জোগাড় করি কিভাবে? কার কাছে ধার চাইবো? ন’বৌদি বলছিলেন কোন ব্যাঙ্ক থেকে নাকি ক্ষুদ্র ঋণ দেয়। কথা বলবো নাকি? আচমকা হাসি পেলো আমার। যার জন্য এসব করা তার বরাদ্দ তো ওই আলোচাল আর ঘি। তবুও অতীতকুটুম মানতে হবে; সমাজে নাক উঁচু করে চলতে গিয়ে যদি পিছনের কাপড় ফেঁসে যায়, যাক না!
আচমকা মনে পড়লো বিয়ের সময় বাবা আমাকে একটা কঙ্কন দিয়েছিলেন, পুরোনো আমলের খাঁটি জিনিস। কখনো পরা হয়নি ওটা, শোবার ঘরের আলমারিতে বাবার লকারেই রাখা আছে কঙ্কনটা। আজ অনেকদিন পর লকার খুলে বের করলাম লাল কাপড়ে মোড়া ভারী জিনিসট। পালিশ একদম তেমনি আছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একটা। বাবার জিনিসেই বরং বাবার কাজটা হোক। লোকের কাছে হাত পাতার থেকে বরং এই ভালো! আমার জায়গায় বাবা থাকলেও তাই করতেন। আমি নিশ্চিত জানি! নিজের বাবাকে এটুকু অন্ততঃ চিনি আমি। কঙ্কনদুটো শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম তখনি। রাতের মধ্যে চিংড়ি না এলে সকালে রান্না করতে দেরি হয়ে যাবে তো!
***
সব কাজ ভালোভাবেই মিটে গেলো অবশেষে। দু’একটা এদিক-সেদিকের ঘটনা ছাড়া তেমন একটা গোলযোগ হয়নি তেমন। প্রায় সবাই খাবারের প্রশংসা করেছেন, হয়তো মানও রক্ষিত হয়েছে মুখার্জীবাড়ির। পাড়ার মহাকুঁচুটে মানুষটাও সেদিন আমার গায়ে-মাখায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে গিয়েছেন। আমার কাছে তো এইটুকুই প্রাপ্তি, বাকি আড়ালে আবডালে কে কি বললো, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
নিমন্ত্রিতের ভিড় গত দু’দিনে কমতে কমতে বাড়ি আজ পুরোই ফাঁকা। এতোদিনের যজ্ঞিবাড়ির হাঁকডাক এখন নিস্তব্ধতায় পরিণত হয়েছে। এতোদিন রোজ নিয়ম করে হিসাব নিয়ে বসতাম, ফোন করতাম নানান জায়গায়, হাজার কাজের অছিলায় ভুলে থাকতাম অনেক কিছু। আজ হাতে কাজ নেই, মনটা ভারী হয়ে আসছে মাঝে মাঝেই। বাবার ছবিটা বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছি। বেশ বড়োসড়ো বাঁধানো ছবি, সুন্দর পালিশ করা কাঠের ফ্রেম চারিদিকে। বাবা বসে আছেন নিজের প্রিয় আরাম কেদারায়, পরনে সাদা পাঞ্জাবি। পাশে শরৎ রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাসমগ্র। ওইটুকুই শখ বাবার ছিলো।
কখন যেনো মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কাঁধে হাত রাখতেই আলতো হাসলো;
“কষ্ট পাস না মানু, তোর বাবা ভালোই আছেন উপরে। রোগেভোগে কম কষ্ট তো পাচ্ছিলেন না। তারচে বরং এই ভালো!”
মা সামলে নিয়েছে পুরোই। ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে অনেকটা সুস্থ লাগছিলো মাকে। আমিও হাসলাম একটু। জানি, যারা চলে যায়, তারা পুরোপুরি চলে যায় না। এদিক ওদিক থেকে যায় ঠিক। মা একটু ইতস্ততঃ করছিলেন, তারপর বললেন,
“জানিস তোকে বলা হয়নি, তোর বাবা এসেছিলেন একবার, আমি স্পষ্ট দেখলাম কেমন হাসিহাসি মুখ, আর চেহারা যেনো ফেটে পড়ছে, কেমন সুন্দর একটা গন্ধে ভরে গিয়েছিল ঘরটা। তুই তখন শ্রাদ্ধের কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি কাশছেন খুব। তারপর একটু সামলে নিয়েই কেমন মিহি স্বরে বললেন, মেয়েটা আমার লাখে এক! ওর কদর কোরো প্রতিমা!”
আমি অবাক হলাম একটু। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত জেঠু বিড়ি খাচ্ছিলেন খুব। তাই কি বাবা কাশছিলেন! মা দেখি পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন কাছে, আমার চিবুকে হাতটা রেখে বললেন,
“কিভাবে একা হাতে সামলালি মা! এ যে দশের অসাধ্যি কাজ!” তারপর একটু দম নিয়ে বলে চললেন, “তোর বাবা বারবার বলতো রে, ছেলেতে মেয়েতে তফাৎ কোরো না প্রতিমা, খারাপ হলে দুটোই খারাপ, ভালো হলে দুটোই ভালো! আফসোস কি জানিস, আমার সেটা বুঝতে এই এতোদিন লেগে গেলো রে!”
আমি চুপ করেই ছিলাম। বাবা মায়ের কাজ আমিই তো করবো, তাতে আর নতুন কি! তবে নতুন বলতে মায়ের এই ভালোবাসাটুকু। এটুকু পেতে একজন্ম লেগে গেলো আমার।
মা আলতো করে হাত রাখলেন চুলে, হাত আস্তে আস্তে ছুঁয়ে যাচ্ছে কাঁধ বা পিঠ। স্নেহ-মায়া-মমতা মাখানো এই স্পর্শটুকুর বড়ো কাঙাল ছিলাম আশৈশব। জুলজুল চোখে দেখতাম মা আদর করে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে খুড়তুতো দাদাকে, আমি এলোমেলো হাতে না খেয়ে উঠে গেলেও দেখার ছিলো না কেউ। আজ এই মধ্যতিরিশে দাঁড়িয়ে আমি বাচ্চামেয়ের মতো আদর খাচ্ছিলাম মায়ের, অচেনা স্বাদে ভরে উঠছিলো মন। বাবা কতবার বলেছে মা’কে মেয়েটাকে একটু যত্ন করো প্রতিমা, পেটে তো ধরেছো। আজ বাবা থাকলে বড়ো আনন্দ পেতেন। বাবার ফটোর দিকে তাকালাম। মনে হলো হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকেই, আর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একটু চোখ টিপে বলছেন,
“দেখলি তো মানু, কেমন নেই হয়ে গিয়ে তোদের মা মেয়েকে মিলিয়ে দিলাম। নে বাপু, তোরা এখন আমে-দুধে মিশে গেলি তো; আমি এখন আঁটি!” বাবার সেই উদাত্ত কন্ঠের গমগম হাসি স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি। মা কি শুনতে পাচ্ছে না কিছু?
আমি কাঁদছিলাম। বাবার মৃত্যুর প্রায় একপক্ষকাল পরে মা’কে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিলাম আমি।
–~০০০XX০০০~–