যদিও প্রেমের ফাঁদ
✍ নিলয় বরণ সোম
প্রেমে পড়া খুব একটা সুবিধার ব্যাপার নয় , সেই শিক্ষা অনীশ জীবন থেকেই পেয়েছে।
প্রেম করা দূরস্থান , প্রেম নিবেদন করতে গেলেও অনেকের মত অনীশেরও জিভ শুকিয়ে আসে , কথা জড়িয়ে যায় , আরো সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব কান্ড ঘটে। তবে সে সব উপেক্ষা করে প্রেম নিবেদনে সে পিছ পা হয় না কখনো।
কিশোরবেলায় লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে যখন ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ গানটিশুনে অনীশের খুব ভালো লেগেছিল। তবে তার জীবনে প্রেম একবার কেন , বার বার এসেছে এবং আসতেই থাকে। সব প্রেম কাহিনী লিখলে ভারত প্রেমকথা হয়ে যাবে , সুতরাং স্যাম্পল হিসেবে কয়েকটি বলাই যথেষ্ট।
অনীশের প্রথম নায়িকা সংঘমিত্রা ওরফে বুবুন , একেবারে নেক্সট ডোর গার্ল। অনীশের একটু পরিপক্ব বন্ধুরা তখন সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে ডেটে যাওয়া শুরু করেছে , কিন্তু ক্লাস নাইনের অনীশ ক্লাস সেভেনের বুবুনকেই মন দিয়ে বসে ছিল।
বুবুন , অনীশের কাছে মাঝে মাঝে অ্যালজেব্রা বুঝতে আসত। অনীশ জানে , প্রেম করা দূরস্থান , প্রেম নিবেদন করতে গেলেও জিভ শুকিয়ে আসে , কথা জড়িয়ে যায় , আরো সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব কান্ড ঘটে। তবু অনেক কসরত করে বাছাই করা অ্যালজেব্রার সূত্রের সাহায্যে অনীশ প্রেম নিবেদন করতে চেষ্টা করল , কিন্তু বুবুন সেসব জটিল সমীকরণ ঠিক বুঝল না। শেষমেশ সরাসরি প্রেম নিবেদন করল সে , জিজ্ঞাসা করল বুবুন তাকে ভালবাসবে কিনা।
বুবুন ভালবাসতে রাজি হল, কিন্তু শর্ত দিল মুখাৰ্জী দাদুদের বাড়ির কুল গাছ থেকে রোজ ওকে টোপা কুল পেড়ে দিতে হবে। সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা পড়া অনীশ প্রেমের জন্য দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল রুমাল বাঁধতে রাজি ছিল , কিন্তু বুবুনের এই বালখিল্য অনুরোধে ওর প্রেমটাই গেল চটকে। সুতরাং , বাল্য প্রেমে অভিশাপ থাকে এই আপ্তবাক্যটি পরখ করার কোন অবকাশ সে আর পেল না।
এর পর কয়েক বছর শান্ত খাতে বয়ে গেলেও কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে অনীশের হৃদয় আবার দোলা খেল। ফিজিক্স অনার্সের অনীশ তখন কলেজের ডিবেটিং চ্যাম্পিয়ন আর তার উদ্দীষ্ট প্রেমিকা তখন ইংরেজি অনার্সের মোহিনী। সেবার কলকাতা বুক ফেয়ারে বিরাট আলোড়ন , বিশিষ্ট পোস্ট মডার্নিস্ট জাক দেরিদা সাহেব কলকাতায় এসেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ওঁকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনীশ সেই অনুষ্ঠানের দুটি টিকিটও পেয়ে গেল , এবং অবাক কান্ড , মোহিনী ওর সঙ্গে সে অনুষ্ঠান দেখতে রাজিও হয়ে গেল। অনীশ জানে , প্রেম করা দূরস্থান , প্রেম নিবেদন করতে গেলেও জিভ শুকিয়ে আসে , কথা জড়িয়ে যায় , আরো সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব কান্ড ঘটে। তবু , মোহিনীকে একটু লঘু চালের মেয়ে মনে হলেও প্রেমিক প্রবর অনীশ ঠিক করল, একটি দুটি এরকম সিটিং দিয়ে মোহিনীকেই সে প্রেম নিবেদন করে বসবে।
বুধবারের পড়ন্ত বিকেলে কলেজের গ্রিন বেঞ্চে অনীশ মোহিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল। দূর থেকে চোখে গগলস , ফেডেড জিন্স আর খদ্দরের পাঞ্জাবী পরা মোহিনীকে দেখে তার পুলক একশো ভল্ট জ্বলে উঠল i
অনীশের তর সইছিল না ,মোহিনীকে দেখেই , ‘চল , বেরিয়ে পড়ি , ভাল সীট পেতে হবে ‘, বলতেই না বলতেই তার উত্তর ,
‘শোন না , একটা ঝামেলা হয়ে গেছে !”
-‘ঝামেলা আবার কী ?কিসের ঝামেলা ?’
– ‘আরে রণিতকে চিনিস তো , আমাদের ক্লাসের ?ও না, দিল সে পাগল হ্যায়ের দুটো টিকিট নিয়ে এসেছে। আর এই শুক্রবারই শেষ শো ! তুই বল , শাহরুখের এই সিনেমা আমি ছাড়তে পারি !’
কিছুক্ষন বাদে রণিত জুটে গেল আর ওরা দুজনে মিলে অনীশকে খুব শুভেচ্ছা টুভেচ্ছা জানাল , ভাল করে অনুষ্ঠান দেখার জন্য !
ডি কনস্ট্রাকশনের জনক দেরিদা সাহেবের উপলক্ষে অনীশের সদ্য উদ্ভিন্ন প্রেম যে এরকম ডিকন্সট্রাকটেড হবে, সে তা ভাবতেও পারে নি। এরপর থেকে মোহিনীর সঙ্গে প্রেম করার আর কোন ইচ্ছে তার হয় নি।
জীবনের পরের পর্যায়ে , অর্থাৎ চাকরি জীবনে অনীশ আগের প্রেমের ব্যর্থতা গুলো একবার চিন্তা করে দেখল। সে বুঝতে পারল, বুবুন বা মোহিনী কেউ ঠিক তার ক্লাসের ছিল না। মোহিনীর স্মার্টনেস কেবলি বহিরঙ্গ ,তাই দেরিদার মূল্যবান লেকচার ফেলে শাহরুখের অকিঞ্চৎ সিনেমা দেখতে গিয়েছিল । প্রেম যদি করতেই হয়, মধুছন্দার সঙ্গে করা ভাল।
মধুছন্দা , অনীশের মতোই আধুনিক চিত্রকলা ও আধুনিক কবিতার ভক্ত। অফিস ক্যান্টিনে কয়েদিন চায়ের কাপে তুফান তোলার পর ওরা ঠিক করল ,নন্দনে গিয়ে আড্ডা মারবে।যদিও প্রেম করা দূরস্থান , প্রেম নিবেদন করতে গেলেও অনেকের মত অনীশেরও জিভ শুকিয়ে আসে , কথা জড়িয়ে যায় , আরো সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব কান্ড ঘটে, তবু অনীশের বিশ্বাস ছিল , নন্দনের পেছনের দিকটাতে ভিড় কম , সেখানে বসে , গল্প করা যাবে, সুবিধামত প্রেম নিবেদনও ম্যানেজ হয়ে যাবে ! অফিস থেকে বেরিয়ে তার খিদেও পেয়েছিল প্রচন্ড। মধুছন্দাকে বেঞ্চ দখল করতে পাঠিয়ে ফাস্ট ফুড কর্নার থেকে এক ঠোঙা চপ কিনে অনীশ তাকে বলল ,” চল , খেতে খেতে গল্প করি’।
মধুছন্দার কিন্তু চোখ কপালে উঠল।
বলে উঠল , ‘জাঙ্ক ফুড ! ইউ টেক জাঙ্ক ফুড ! নেভার এভার টেক দেম !’. দ্যাখ না দ্যাখ , সেই এক ঠোঙা চপ আসে পাশে ঝিমোতে থাকা দু’হাত দূরে ঝিমোতে থাকা কুকুরটাকে ঘটা করে ডেকে খেতে দিল সে ।
গোটা তিরিশ টাকা দিয়ে কেনা ঠোঙা ভর্তি কেনা চপকে জলাঞ্জলি যেতে দেখে অনীশের সে প্রেমটিরও সেখানেই সমাধি। অতএব দুবছর বাদে বাড়ির পছন্দ মত সুন্দরী , শিক্ষিতা , গৃহকর্মনিপুণা তপতীকে সে ঘরনী করে তুলল। বরাবরের আশাবাদী অনীশ তাও নিশ্চিত ছিল , রোম্যান্সে রোম্যান্স ভরিয়ে তুলবে এ জীবন।
বিয়ের কিছুদিন পরের কথা I কোনও এক জোৎস্না ভেজা, লক্ষ তারা শোভিত রাত্রে চন্দ্রাহত অনীশ দিব্যি একখানা কবিতা লিখে ফেলল। রূপসী তপতীর সঙ্গে জোৎস্নার মানানসই মেটাফোরে ইংরেজিতে লেখা সে কবিতা।
ওদের দোতলার বারান্দায় একটি দোলনা আছে। অনীশ সেখানে তপতীকে ডেকে নিল , কবিতা শোনাবে বলেI ঘুম জড়ানো কণ্ঠে তপতী জবাব দিল , ‘ এখন না , কাল সকালে আমি ঠাকুরকে জল বাতাসা দেওয়ার পর বোলো!’
বলা বাহুল্য , জোৎস্না রাতের সেই কবিতা রোদ ঝলমল সকালে পড়ে শোনানোর উৎসাহ অনীশ আর পায় নি।
আজ মধ্য বয়সে হাই পাওয়ার চশমা চোখে, সুখী গৃহস্বামীর ট্রেডমার্ক একটি নোয়াপাতি ভুঁড়ির অধিকারী অনীশের একটা কথাই মনে হয় , প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে , কিন্তু , অন্তত ওর নিজের ক্ষেত্রে , প্রেমে পড়া বারণ !
–~০০০XX০০০~–