অসমাপিকা
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
” ড্রপসিনটো ইবার পইড়ব্যেক বইল্যেই হলঅ? বড় দুঃখের পালাটো ইবার অধিকারী মশায় কি জন্য ইনিছেন বাপু। শালা, রাঢ়দেশে দুঃখঅ কি এত্ত মাগনা নাকি! টুকুন পালা দেখতি গেল্যা চখের জলটোও ঝর্যায়ে লিব্যে ক্যেনে ? ”
আকন্ঠ তাড়ি গিলে নব চিৎকার করে প্রতিবাদ করে। এবারে এসেছে সুখেন অধিকারীর দল। ফি বছর এই গাঁয়ে তেরাত্তির বায়না থাকে। একটা ঠাকুর দেবতার,একটা রাজা রাজড়ার আর একটা সামাজিক। সব গুলোতেই এবার মধ্যমণি জোছনাকুমারী। চিৎপুরের সুপারহিট হিরোইন এখন ওই।
***
আসর শেষে হ্যাজাকের আলোয় মুখে নারকেল তেল ঘষে মেকআপ তোলে জোছনা। এই নামটা সুখেন অধিকারীর দেওয়া।আসল নামটা আর নিজেই মনে করতে চায়না আর কখনো। বেশ আছে এখন এই পালাঘরের অন্দরে। পুরনো জীবনের ফেলে আসা স্মৃতি শুধু কষ্টের,গলায় দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে। একটা চুবড়ির মধ্যে ছোট ছোট দুটো জরিপাড় পাঞ্জাবি পায়জামা যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা। দশটা বছরের প্রত্যেকদিন রাতে আসরের পর ওগুলোকে বুকে চেপে একবার করে নীরবে কাঁদবার অভ্যেস তার। ‘সে মানিক আমার এলই যদি; ভগমান কেড়ে নিলে ক্যানে?’
***
নব ঝিম মেরে বসে থাকে মাদুরে। তারও একসময় যাত্রাগানে মন গেছিল। গলাখানাও সরেস ছিল। এখন মদ তাড়ি গাঁজায় তার কিছুই বাকী নেই। কমলি তখন পেছন পেছন ঘুরতো। দুটো গান শেখার জন্য বড় বড় দীঘল চোখে চিকুর হানতো বুকে। নব তখন এখানে ওখানে গায়েন হয়ে বেশ দুটো পয়সা করছে। আলবোট চুল, গিলে করা পাঞ্জাবী, শরীরটাও অতটা ভাঙেনি। কিন্তু ভেতর ভেতর খারাপ রোগ ধরলো। সেবারে কার্তিকমাসে নতুনপাড়ার আসর থেকে ফিরল নব এক গা ধূম জ্বর নিয়ে সাথে চাকা চাকা ঘা। কমলির শরীরে সেই রোগ আর একটা সাতমাসের মরা বাচ্চা দিয়ে তারপর কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কেউ জানল না। কমলি ভেবেছিল গলায় কলসী বেঁধে তালদীঘিতে ডুবে মরবে। কিন্তু মরতে তাকে হলনা।
‘ছিরিকেষ্ট নাট্যমন্দিরে’র সুখেন অধিকারী তার মাঝবয়সী কাঁধটা বাড়িয়ে দিল। কমলি ও ভেসে যেতে যেতে ঠাঁই পেল, চিকিচ্ছে পেল। হোক না রক্ষিতা তাও তো একদিন দলের হিরোইন হল। নামডাক হল ! দু’পয়সা হাতেও তো এল! কমলি তো মরেই গেছিল কবে সবার কাছে। শুধু ওই ছোট ছোট জামা গুলো কমলিকে আসলে মরতে দেয় নি। রোজ একটা বোতল ভরা দুঃখহরা সুধা আর সুখেনের হ্যাঁচোরপ্যাচোর আদর এই নিয়ে তার রাত্তিরগুলো কাটে। বাকি সময়টা সে আজ জোছনাকুমারী, যাত্রার টপ হিরোইন।
***
উইংসের উল্টোদিকে রাস্তার ওধারে একটা লোক বেহেড মাতাল হয়ে পড়ে আছে। জীর্ণ পোশাকে কাদামাটি লাগা। আর একটু হলে জোছনার পা পড়ত লোকটার গায়ে। হাতের হ্যারিকেনের আলোয় মুখটা দেখে খানিক থমকে যায়। মদ খেয়ে খেয়ে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে গেছে ! ভাত জোটেনা গোঁসাইএর রোজ,কিন্ত দুবেলা মদটা চাই। কোনওমতে টেনে হিঁচড়ে ধরে সে রাস্তার একধারে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে নবকে।
***
নব খোয়ারী ভেঙে পিটপিট করে তাকায়। হ্যারিকেনের আলোয় ও দেখে আজকের শাজাহান পালার উটি জাহানারা না? চারপাশে ‘কনসার্টটো বেজে উঠ্যছ্যে না কেন্যে রে ! আর বেহুলোয় মহিম ছড়টো বুল্যায়ে করুণ ফুকার তুইলত্যে ভুলছিস্ নাকি রে শালা! লিজ্যের ত গলায় কাশি ! আর মুখ থিক্যে ভলকে ভলকে রক্ত উঠ্যে নইল্যে গানটা কি ধইরত্যাম না রে ঢ্যামনা!
এর মধ্যেই সে যাত্রার ঢং করে স্বগতোক্তি করে –
” জীবনটো এত্ত ছোট্টঅ ক্যেনে বল ! সব কিছু ফুরাবেক ! উই ভালোবাসাটো ফুরাবেক লাই ! উয়্যার লেইগ্যাই ত বেঁচ্যে আছি গ ! বুকটো এক্যুনো ধরাস্ ধরাস্ কর্যা গ ! ” নব’র চোখের জল কমলি মানে জোছনাকুমারীর মুখে ফেলে আসা ছায়ার মত হঠাৎ ঘনিয়ে আসে। বাইরে আহ্লাদী চাঁদের আলো লুটোপুটি খায় আশশ্যাওড়া আর বনতুলসীর ঝোপেঝাড়ে। দুজনে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে আর স্তব্ধতাকে আশ্রয় দেয় জিহ্বায়। পরক্ষণেই বাক্সবন্দী ওই জরিপাড় ছোট ছোট জামা গুলোর ভিতরে লুকিয়ে থাকা মনকেমনের গন্ধটা নাকে আসে জোছনার। তীব্র ঘৃণায় দ্রুত পা চালাতে চালাতে হিসহিসিয়ে গলায় বলে ওঠে –
‘ শালা তুর মরণ হবে ল্যাই বটে !’
–~০০০XX০০০~–