তবু গঙ্গা বয়ে চলে
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
চুপ করে বসে থাকতে থাকতে গুপে দেখতে পেল কলকলিয়ে গঙ্গায় জোয়ারের জল আসছে। আর নিমতলা ঘাটের সেই কাঁচাপাকা রাস্তাটা গঙ্গার ধার ঘেঁষে বোধহয় অারো দূরে গিয়ে হারিয়েই গেছে। এই নদীকে এখানকার সবাই বলে ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে’ !
এর কাছেই বৈঠকখানা বাজারটায় কদিন আগেও একটা বুড়ো সাহেব হুঁকো খেতে খেতে ওদের লোকজনের কাছ থেকে ওনার কোম্পানীর নুনের গোলার ব্যবসার খবর নিত বা বসে খাগের কলমে কিসব লিখে হিসেব নিকেশ করত। ওনাকে সবাই ‘চন্ন সাহেবের নাতি’ বলত। এগুলো এখনও গুপের আবছা আবছা মনে আছে।
ওর বাপ মা কেউ নেই। অনেককাল আগে মহামারী কলেরায় সক্কলে মরে হেজে গেছে সেই ছোটবেলায়। এখন অবশ্য তার বাড়ন্ত বয়েস।
ওর একটা হাত ফিরিঙ্গিদের ডুয়েল লড়াইয়ের সময় তলোয়ারগুলোকে কাপড় দিয়ে মুছে দিতে গিয়ে নেবুতলার কাছে হঠাৎ তারই একটার বাঁকানো ধারালো ফলাটা ডানহাতের তেলোতে মাঝখানে বসে গিয়েছিল। তারপর যে কত রক্ত বেরল তার ঠিক নেই। ঘা টা একরকম বিনে কোবরেজী ওষুধে দিনে দিনে শুধু যন্ত্রণার সাথে পচতেও লাগল। তারপর একদিন খুব জ্বর হল আর তার সাথে ছিল আরো অসহ্য ব্যথা।
সাহেব মিশনারীরা ততোদিনে খাস কলকেতায় এসে তাদের সেবাকর্মের সাথে গরীব রোগীদের কেরেস্তান করতে শুরুও করে দিয়েছে। সেইরকম ওদের একজন এসে নিমতলার কাছে গাছতলায় হঠাৎ জ্বর গা নিয়ে গুপে কে মরতে দেখে দরদ দেখিয়ে চিকিৎসা করতে নিয়ে যায়। সেই সাহেবটা সত্যিই খুব ভালো লোক ছিল। যে কদিন সে ছিল সেই যত্ন করে গুপেকে দুধ আর রুটি নিজের হাতে এনে খাইয়ে দিত।
গুপের ডানহাতটা কেটে বাদ দিয়ে দিলেও ওই সাহেবটা ওকে কিন্তু সেবার প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সেই তিনদিন গুপে সুস্থ হয়ে ওদের কাছেই একটা গীর্জে ঘরে ছিল।
আর একটু ভাল হতেই ওরা যেদিন ঠিক করল ওকেও কেরেস্তান বানাবে, জাত খোয়ানোর ভয়ে তার দু দিন আগে সে ওদের সেই আস্তানা ছেড়ে পালিয়েছিল। পালানোর সময় ও সেদিন কিন্তু টমসন্ সাহেবের সামনেই হঠাৎই পড়ে গেছিল। বুড়ো সাহেব তখন কিন্তু বাধা দেননি বরং ওকে ডেকে ” হেই বয়! ইডিকে শুন্ ! নাউ প্লীজ গেট দিস্ এন্ড লীভ ফর হোয়ার ইউ আর গোয়িং!” এই বলে একটা ঝুড়ি থেকে চারটে কমলালেবু আর কয়েকটা আখরোট তুলে দিয়েছিল। ওদের ঘরে একজন মা এর মূর্তি আর তার কোলে একটা বাচ্চা দেবশিশুর মতন মূর্তিও থাকত। ওরা তাদেরকে নমষ্কার করত, প্রণাম করত আর বলত
” হিজ হাইনেস্”! ওর কিন্তু বাচ্চা কোলে ওই মাতৃমূর্তিটাকে খুব দয়ালু বলেই মনে হত।
গুপে আজও সেইসব ঘটনাকে ভুলতে পারে না।
ঘাটে আজ সংক্রান্তির জন্য অনেককটা দেশী জুড়িগাড়ি এসে থেমেছে। আজ শো’বাজারের বাবুরা ঘাটের কাঙালীদের কি সব এনে কাঙালীভোজন করাচ্ছে। অার তারই দূরে অন্তর্জলি যাত্রায় শুয়ে আছে কয়েকজন সারি সারি অর্ধোন্মৃত বৃদ্ধ মানুষ। ওদের ঘিরে আবার খোল করতাল বাজিয়ে বেজায় জোরে কেত্তন হচ্ছে।
অন্য হাতটায় পাতার দোনাটা বাড়িয়ে দই চিঁড়ের ফলারটা নিয়ে একপাশে সরে আসতে আসতে একটা প্রবল গোলমাল হঠাৎ কানে এল।
আদালত থেকে একজন মুহুরীগোছের লোক এসে একটা পাকানো কাগজ ধরে কিসব যেন বলছিল। গুপে ওর কথায় বুঝতে পারল যে এ দেশে ইংরেজবাহাদুর আইন করে স্বামীর চিতায় মেয়েদের পুড়ে মরাটা কদিন আগে রদ করে দিয়েছে। আর আদালত থেকে তাদের সব লোক শ্মশানঘাটে এসে সবাইকে ডেকে সেসব কথাই শুনিয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে ঘাটের বামুনদের সাথে আবার ওদের ভীষণ ঝগড়া লেগেছে।
গুপে ফলারটা শেষ করে এবারে বুড়ো শিবের মন্দিরের দিকে চলে এল। এখানটায় আগে জোয়ারের জল এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যেত বলে লোকেরা মোটা আর শক্ত শেকল দিয়ে শিবলিঙ্গটাকে বেঁধে রেখেছে ততোধিক ধুমসো একটা বুড়ো বটের সাথে।
গুপে এই ঝগড়া কাজিয়ার মধ্যে থাকতে ভালবাসেনা বলে সরে এল। ওর খিদে পেয়েছিল বলে এর মধ্যে পাওয়া ওই কলাপাতার দোনাটাকেও আবার ফেলতে পারেনি।
কালীমতী বলে একজন বাজারের মেয়েমানুষ গুপের সামনে দিয়ে স্নান সেরে ফিরে যাওয়ার সময় ওর গায়ে গতরে জড়ানো কাপড়টা স্নানের পর জলে ভিজে লেপ্টে যাওয়ায় পুরুষ্টু বুক দুটো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সে দিকে তাকাতেই গুপের শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। সে ভিখারী হলেও একজন উঠতি বয়সের ছেলে। শরীরের মধ্যেকার আগুন স্বাভাবিক কারণে তাকেও মাঝেমধ্যে টানে! গুপে আড়চোখে কালীমতীকে দেখছিল ইচ্ছে করেই। মনে হচ্ছিল ওকে গিয়ে একবার জড়িয়ে ধরতে। অবশ্য একটা হাত যে নেই একদমই সেটা ওর মনে থাকতে চায়না।
আদালতের লোকেরা ফিরে যেতেই আর একটা কেরাঞ্চিগাড়ি এসে ঘাটে থামল। একজন বাবু তার পাগড়ীর নীচে আছে কাঁচাপাকা বাবরি ঢেউখেলানো চুল আর নাকের নীচে বলিষ্ঠ একটা গোঁফ আর গায়ে রয়েছে দামী শাল আর পরণে বাহারি একরকম মুসলমানী কামিজ পড়ে এসে ঘাটের পাশটায় এসে দাঁড়ায়িছেন। ওনার দুচোখের উদাসী দৃষ্টিটা গঙ্গার জলের ঢেউএ একনিষ্ঠ ভাবে কি যেন খুঁজছে। গুপে সাহস করে এক পা এক পা করে ওই লোকটার দিকে এগিয়ে এল। লোকটি এখন হতোদ্যমের মত ঘাটের পৈঁছায় এসে বসলে তখন আরেকটা কেরানী মতন লোক ওঁর কাছে এসে বলল – ” ও রাজাবাবু! চলুন গ্যে ফিরি এবার! ভাটপাড়া আর গুপ্তিপাড়ার সব বামুনরা একজোট হয়ে আপনার বিরুদ্ধে সবার সাথে বসে বেদম ঘোঁট পাকাচ্চে। ওরা আবার ইংরেজের আইন টাইন কিছুই মানতে চাইচে নাকো ! চলুন আজকে আলো পড়ে আসতেছে একোন আর একেনে থাকাটা মনে হয় আর উচিৎ হবে নে কো! ”
গুপেকে দেখতে পেয়ে উনি স্নেহবশতঃ একবার হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলেন। তারপর কামিজের ভিতর থেকে কয়েকটা কাজু আর কিশমিশ বের করে মুচকি হেসে ওর হাতে দিলেন। গুপের মনে হচ্ছিল এই লোকটার বুকের ভিতরেও আর একটা টলটলে গঙ্গা বইছে। যদিও বাইরে থেকে সবাই সেটা একদম দেখতে পাচ্ছেনা।
নিমতলা ঘাটের শিবমন্দিরে একটু পরে আরতি শুরু হবে। গাঁজা আর গুলিখোরদের দল এবার আস্তে আস্তে এদিকে আসতে শুরু করেছে। ওই বাবুটিও এবারে আস্তে আস্তে হেঁটে গাড়ির দিকে চলে যাচ্ছেন। গাড়িতে ওঠার আগে একবান্ডিল খবরের কাগজ বের করে গুপেকে বললেন এগুলো নাকি ওর জন্যই এনেছিলেন। অবাক কান্ড! গুপে কে উনি চিনলেনই বা কি করে? উনি যেন হাসির সাথে স্নেহ মিশিয়ে বলতে চাইছেন ওকে আর শুধুশুধু ভিক্ষা না করে এখন থেকে ওই কাগজগুলোকে এক কি দেড় পয়সায় করে ঘাটের কাছে নানা কাজে আসা লোকেদেরকে বেচতে পারে। দু তিনদিন পরে এসে আবার উনি বা ওনার লোক ওকে আরোও এক বান্ডিল কাগজ এসে দিয়ে যাবে। এগুলোর নাম নাকি ” সংবাদ প্রভাকর” ! আর এই কাগজগুলোই কদিন আগে ছিল ওঁর দিনবদলের অন্যতম হাতিয়ার।
গুপে কাগজগুলোকে প্রাণপণে একহাতে ধরে আছে আর দেখছে কালাকালের গঙ্গায় ভেসে যাওয়া দিনবদলের একটা আসন্ন ইঙ্গিত। সূর্য পাটে নাবতে বসেছে। ততোক্ষণে ওই ‘রাজাবাবু’ নামের সেই ভদ্রলোকটিও তাঁর ঘোড়ার গাড়িটিতে চেপে দিনশেষের রাঙা আলোয় ছুটে চলেছেন নিমতলা ঘাট ছেড়ে আর্মহাস্ট্র স্ট্রীটের দিকে তাঁর বসতবাড়ির ঠিকানায়।
গুপে বুঝতে পারল, যে সহজকঠিন দিনবদলের যে কথাগুলো ও ঘাটের গন্ডোগোলে এতক্ষণ ধরে একটু আগেই ও শুনেছিল এ যেন তারই সার্থকতাকে সফল করে আনবার লক্ষ্যেই এবারে সবাইকে মিলে তৈরী হচ্ছে এক অতল জলের আহ্বান।
আর সেটাই যেন জোয়ার শেষে গঙ্গার জলে হঠাৎ করে ঢেউ এর সাথে মিশে গিয়ে ডিহি কলকেতায় এখন একটা নতুন আলোড়ন তুলেছে !
–~০০০XX০০০~–