স্ফুলিঙ্গ
✍ চয়ন সমাদ্দার
ভোর হতে না হতেই বেরোল বেষ্টা। অনেকটা পথ। এই খানাকুলের রাধানগর থেকে সেই মোকাম কলকেতা। বেষ্টার কানে এসেছে সেখানে বামুন মহারাজ গরীবের দুঃখ বোঝেন। জমিদারবাবুর কাছ থেকে কর্জ সে নিয়েছিল ঠিকই। শোধ দিতে পারেনি, তাও ঠিক। তা বলে, দেওয়ান এসে তার এক বিঘে জমি ক্রোক করে নেবে? প্রজা না থাকলে রাজা কাদের ওপর রাজত্ব করবেন? অবশ্য, জমিদার রামকান্ত রায় পরম বৈষ্ণব। তাঁর পায়ে কেঁদে পড়তে পারলে কাজ হতো বলে এখনও বিশ্বাস করে বেষ্টা। কিন্তু, তাঁর দেখা পাওয়াই দায় আজকাল। একবছরের খোকারাজাকে নিয়েই তিনি মশগুল। তার অন্নপ্রাশনে পেট ভরে খেয়েছে বেষ্টা। শুনেছে, খোকার নাম রাখা হয়েছে রামমোহন।
কলকেতায় যখন ঢুকল বেষ্টা, সূর্য তখন মাথার ওপর। ফৌজদারি বালাখানা বাঁয়ে রেখে, চিৎপুরের জঙ্গলের মধ্যেকার শুঁড়িপথ ধরে সে এক বিরাট পুকুর ধারে পড়ল। চারদিকে খড়ের ঘর, বাগবাগিচা। লোককে জিগ্যেস করে জেনে নিল তাকে কোনদিকে যেতে হবে। বাগবাজারে এসে ডাইনে মোড়। প্রচুর শিমূল গাছে ঢাকা পথ। এই জায়গাটার নাম সিমূলিয়া বা সিমলে। আরও সামনে এগোতে হবে। ঐ যে পেল্লাই প্রাসাদ। ওখানেই মহারাজ থাকেন।
সামনে এগোতেই ফটকের পাইক বাধা দিল।
– কী চাই?
– মহারাজের কাছে দরবার আছে।
– আর দরবার! মহারাজ কয়েদ হয়েছেন গো! আদালতে বিচের চলছে!
– আদালত কোন দিকে?
– সে বলে দিচ্ছি। কিন্ত, গিয়ে করবে কী?
– এখানে থেকেই বা কী করব? সেখানে যদি কোনও জ্ঞানী গুণীর দেখা পাই। জমিদারের হাত থেকে জমি ছাড়ায় কী করে জেনে নেব।
বিরাট লালদীঘি। তার উত্তর-পুব কোণে কোর্ট হাউস। ঐ দূরে, সারি সারি কম্পানি বাহাদুরের মালগুদাম। আদালতের সামনে একটা বিরাট বটগাছ। তার নীচে একটা জটলা। বেষ্টা আশ্বস্ত বোধ করল। তারই মতো ছোটলোকদের ভিড়। এগিয়ে গেল সে। জটলার মাঝখানে এক বুড়ো ফকির বসা। তাকে দেখে হাসল।
-:কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
– খানাকুল।
– নাম?
– বিষ্ণুচরণ দাস।
– এখানে কেন?
– এসেছিলুম মহারাজের কাছে। গরীবের মা বাপ। আমাদের জমিদারবাবুও তাই। নায়েব ব্যাটা আমার জমি ক্রোক করে নিয়েছে। জমিদারবাবুর কাছে পৌঁছতে পাল্লুম না। বামুন ঠাকুরদের মুখে শুনেছি মহারাজ গরীবের কথা শোনেন। তাঁর ওখানে গিয়ে শুনলাম তিনি আদালতে। তাই এখানে এলাম। যদি কেউ বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
ফকির হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল।
-;আরে বাহবা কি বাহবা! একদম ঠিক ঠাক এগিয়েছ তো! জমিদার না পারলে মহারাজ। সে না পারলে আদালত! মাঝে একটা রাজা বাদ গেছে খালি! মানে, রাজা হয়ে মহারাজে আসা উচিত নয়? হা হা হা হা!
বেষ্টা হাঁ করে রইল। ফকিরের হাসি থামল। তারপর খুব নীচু গলায় বলতে লাগল,
– তোমাদের এই মহারাজ আগে নবাব সিরাজের কাছে খুব যাতায়াত করতেন। তারপর, তিনি বুঝলেন, এ নবাব বেশিদিন টিঁকবেন না। নতুন নবাব মীরজাফরের দেওয়ান হলেন পরে। রাজস্ব আদায় করতেন। তখনই দিল্লীর বাদশার কাছ থেকে মহারাজ খেতাব পান। তারপর এল সন ১১৭৬। একদিকে নবাব, অন্যদিকে কম্পানি। চাষীর ঘরে যেটুকু চাল ছিল, সব লুট হয়ে গেল। তার ওপর ভয়ঙ্কর অজন্মা। কোটি কোটি লোক মরল। আমি নিজের চোখে মানুষকে মানুষ খেতে দেখেছি।
বেষ্টার অস্বস্তি হচ্ছে। তাদের গ্রামে মন্বন্তর ততটা থাবা বসাতে পারেনি। কিন্তু, এরকম কথা তার কানেও এসেছে। বছর পাঁচেক আগের কথা।
একজন বলল,
– আমরা শুনেছি, নবাবের দেওয়ান রেজা খাঁর নামে মহারাজ নালিশ করেন, অত্যেচারের জন্য।
ফকির আবার হাসল।
– করেন। রেজা খাঁ সব চাল গুদোমে পুরে বাজারে চড়া দামে বেচত। গরীবের নাগালের বাইরে সে দাম। বহু লোক না খেয়ে মরে এই কারণেও। আর, সে নাকি তহবিলের বহু টাকা হজম করেছিল। মহারাজ তার ভাগ চেয়েছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু, এটা জানি রেজা খাঁ মুসলমান সমাজের মাথা ছিল। মহারাজ ছিলেন বামুন-কায়েত-বদ্যিদের মাথা। প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করার সুযোগ তিনি ছাড়বেন কেন? ইংরেজ সরকারে এই নালিশ করার জন্যই, তিনি গরীবের দরদী – এই কথাটা ছড়িয়েছে। তবে, এখন তো হেস্টিংস সাহেব কালেকটার দিয়ে খাজনা আদায় করেন। জমিদার কালেকটারকে খাজনা দেন। তাঁর হয়ে খাজনা আদায় করে নায়েবরা। দু’পাঁচ লাখ বিষ্ণুচরণ দাসের জমি ক্রোক হয়। আর তারা আশা করে, কেউ তাদের হয়ে বিচার করে দেবে! আরে হো হো হো হো!
বেষ্টার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা। দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে সে বলল,
– কোনও পিতিকের নেই। হায় ভগবান!
হঠাৎ ফকিরের চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে উঠল। গলার স্বর আরও খাদে নেমে গেল।
– ভগবান, আল্লাহ্, গড, বলেছেন, হাত, পা, মগজ দিলুম। নিজেরটা করে নে। আমায় জ্বালাবিনি! মন্বন্তরের সময় জোট বেঁধেছিল কিছু সন্ন্যাসী আর ফকির। সঙ্গে ছিল চাষাভুষোরা। লাঠি, সড়কি, ল্যাজা, বল্লম,, তলোয়ার নিয়ে একজোট হয়েছিল। এটাই পিতিকের। তোমার ঐ রাজা, মহারাজ, উঁচু জাতের মধ্যে যতই আকচা আকচি থাক, একটা জায়গায় সবাই এক, বিষ্ণুচরণ! গরীবের রক্তে মুখ ধোয় ওরা!
হুম হুনা, হুম হুনা, হুম হুনা। একটা ঝালরদার পালকি এসে দাঁড়ালো আদালতের সামনে। নেমে এলেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মতো দেখতে। শাল দোশালা পরা। মাথায় শামলা। ফকিরের গলা আবার মজাদার শোনালো।
– ঐ দেখ বিষ্ণু। আরএক মহারাজ। শুধু মহারাজ নন। মহারাজাবাহাদুর। এখন মুখ ভেটকে কী হবে গোকুল? আমি তো বলেইছিলাম, হুজুরের সরকারী মহলে যেরকম প্রতিপত্তি, বেকসুর খালাস তিনি পাবেনই!
বেষ্টারই বয়সী একজনের মুখ ঘেন্নায় বেঁকে গেছে। ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলল,
– নীবু বামণীর বর বলেছিল মহারাজার চোখে একবার যদি পড়ে আমার বোনটা তবে আর রক্ষে নেই! শুনেছিলুম নীবুকে ঘরে ঢুকে দিনের আলোয় তুলে নিয়ে গিয়েছিল মহারাজার পাইক বরকন্দাজ। বিশ্বাস করিনি। তারপর, সেদিন সকালে রাম বেনিয়া, আর রাম সোনার এক হরকরার সঙ্গে এসে জোর করে ধরে নিয়ে গেল ওকে।
– বিষ্ণুচরণ, তোমার মতোই আদালতে বিচার পাওয়া যায় বলে ভেবে বসে এই গোকুল সোনার। মামলা করে মহারাজাবাহাদুরের সঙ্গে। শুধু কয়েকটা জিনিস ও ভাবেনি। এক, মহারাজা নিজে দুঁদে উকিল; দুই, পলাশীর লুটের টাকায় তিনি মালামাল, তিন, এই পুরো সুতানুটির মালিকানা ওঁর। মামলা খারিজ হয়ে যায়।
– আমার বোনটা কোথায় গেল ফকির সাহেব?
– মহারাজের দয়ার শরীর! তাঁর প্রাসাদের লাগোয়া সোনাগাজীর পল্লী। উনিই মালিক। ওখানে অনেক মেয়ের খাওয়া পরা জোটে। আমার বিশ্বাস তোমার বোন ওখানেই আছে। রাজার এঁটো তো! অনেক শাঁসালো মক্কেল জুটবে।
– ফকির!
– আমাকে চোখ রাঙিয়ে কী হবে রে হারামজাদা? দুই পাইকের হাত থেকে বোনকে বাঁচাতে পারিসনি কেন? হাতের হাতুড়িটা দিয়ে ঐ নবো মুনশীর মাথা গুঁড়োতে পারিসনি কেন? যখন পারিসনি, মুখ বুজে মর!
মহারাজাবাহাদুর আদালতে ঢুকলেন। বিষ্ণুচরণ লালদীঘির দিকে তাকালো। দীঘির টলটলে জল সত্যিই রক্তের মতো লাল মনে হচ্ছে। চারদিকে চাইল বেষ্টা। আকাশ লাল, আদালত লাল, মহারাজের পালকিটা লাল। তাজা খুনের মতো লাল।
সুপ্রিম কোর্ট। বৃটিশ ন্যায়বিচারের প্রতীক। বিচার চলছে।
– মহারাজাবাহাদুর নবকৃষ্ণ দেব। আপনি পাঁচটি ভাষায় সুপণ্ডিত। আপনি বহু বৃটিশ সিভিলিয়ানের ফারসী ভাষা শিক্ষক। হস্তলিপি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার তুলনা নেই। আপনি মামলার সারমর্মটুকু শুনে নিন। তারপর প্রশ্ন করব।
– শেঠ বুলাকীদাস আগরওয়ালের কাছে মহারাজ একছড়া মুক্তার কন্ঠী, একখানি কল্কা, একটি শিরপেঁচ এবং ছ’টি হীরের আংটি বিক্রয়ের জন্য দান করেন। দাম ঠিক হয় আটচল্লিশ হাজার একুশ টাকা। নবাব মীর কাশেমের পরাজয়ের পর দেশজোড়া লুঠ তরাজের সময় এই জহরত লুট হয়। মহারাজ বলছেন, বুলাকীদাস তাঁকে এক কবুলিয়ত লিখে দেন। তাতে বলা থাকে, বুলাকীদাস মহারাজকে আটচল্লিশ হাজার একুশ টাকা আসলের ওপর টাকায় চার আনা হিসেবে সুদ দেবেন। কম্পানির কাছ থেকে পাওনা দুই লক্ষ টাকা বুলাকীদাস পেলেই মহারাজ এই অর্থ পেয়ে যাবেন। এই কবুলিয়তে বুলাকীদাস মোহর করেন। সাক্ষী হিসেবে দস্তখত করেন তাঁর পক্ষের উকিল শীলাবৎ। এই কাগজের জোরে মহারাজ, বুলাকীদাসের মৃত্যুর পর, তাঁর সম্পত্তির এগজিকিউটর পদ্মনাভ দাসের কাছ থেকে ঐ অর্থ আদায় করেন। পদ্মনাভ দাস বর্তমানে পরলোকগত। এখন, শেঠ বুলাকীদাসের আমমোক্তার মোহনপ্রসাদ দাবী করছেন এই নথি জাল। বুলাকীদাস এমন কোনও অঙ্গীকার করেননি।
-:মহারাজাবাহাদুর, যাদের নাম শুনলেন, তাদের মধ্যে কারও দস্তখত কি আপনি চেনেন?
– উকিল শীলাবতের স্বাক্ষর আমি বিশেষভাবে চিনি।
– এই কবুলিয়তটা ভালো করে দেখুন। এটা কি শীলাবতের দস্তখত?
– মনে হয় না। উঁহু, শীলাবতের দস্তখত নয়। আমার কাছে তার অনেক লেখা আছে।
– ধন্যবাদ মহারাজাবাহাদুর।
– বিপক্ষের আইনজীবি প্রশ্ন করবেন?
– হ্যাঁ ধর্মাবতার।
– করুন।
– মহারাজাবাহাদুর নবকৃষ্ণ, আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত তো, যে এটা শীলাবতের হাতের লেখা নয়?
– শীলাবৎ আমাকে এবং লর্ড ক্লাইভকে অনেক চিঠি লেখে। তবে এটা তার লেখা কিনা ঈশ্বর জানেন!
– কোন ঈশ্বর? আপনি তো নিজেই একজন দেবতা! কাশীতে শিব আছে না আপনার নামে?
– আপত্তি জানাচ্ছি। অপ্রাসঙ্গিক।
– আপত্তি বহাল রইলো।
– আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে সামান্য কিছু জানলে সাহেব একথা বলতেন না।
– এইটুকু অন্তত জানি, ব্রাহ্মণদ্রোহিতাকে আপনার ধর্ম পাপ মনে করে। একবার তাকান ঐ ব্রাহ্মণের মুখের দিকে। গলার উপবীতের দিকে। তারপর বলুন, এই স্বাক্ষর সম্বন্ধে আপনি ঠিক কী মনে করেন?
-:ধর্মাবতার, আমি সমাজপতি ঠিকই, কিন্তু, সর্বদা মনে রাখি আমি কায়স্থ। তাই, ব্রাহ্মণ দেবতার অমর্যাদা করিনি কখনও। আমার সাক্ষ্যে এক ব্রাহ্মণের প্রাণসংশয় হলে আমাদের ধর্ম বিপণ্ণ হবে।
– প্রাণ সংশয়? আপনি মহামান্য আদালতের রায় অগ্রিম জানেন বুঝি?
– আপত্তি জানাচ্ছি। অকারণ বিদ্রূপ।
– বহাল রইলো।
– হস্তলিপি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলুন। এই কবুলিয়ত দেখে কী বুঝছেন?
– পাকা হাতের লেখা। চমৎকার। শীলাবতের হাতের লেখা মন্দ নয়। কিন্তু, এত ভালো ছিল না।
– তার মানে? স্পষ্ট করে বলুন।
– ধর্মাবতার, যে সব সত্য কথা বলতে আমার মন চাইছে, ধর্মের কারণে তা আমি প্রকাশ করতে পারছি না। আমায় মার্জনা করবেন।
– আমরা যা বোঝার বুঝেছি মহারাজাবাহাদুর। ধন্যবাদ।
আসামী হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠলেন।
– এইবার এই বিচারের প্রহসনটা বন্ধ করলে হয় না? সমস্ত বাংলা জানে ঘুঁটির চাল ঠিকঠাক পড়লে মহারাজাবাহাদুর আমার জায়গায় থাকতেন আজ। আর আমি ওঁর জায়গায়। সরকারী মহলে ওঁর কথার কী দাম তাও সবার জানা। উনি তো বলেই দিলেন যা বলার! রায়টা দিয়ে ফেলুন।
– মহামান্য আদালত, আসামী আদালত অবমাননা করছেন।
– লিখিত রইলো।
আদালতে আসাটা এখন অভ্যেস হয়ে গেছে বেষ্টার। গোকুল সোনারের বাড়িতে উঠেছে সে। গোকুল তাকে থাকতে দিতে আপত্তি করেনি। কিন্তু সে আর আদালতে যায় না। সত্যি বলতে, গত কয়েকদিন বেষ্টা আর ফকির ছাড়া কেউ ছিল না বটতলায়। ফকির বলে চলে ইংরেজ, রাজারাজড়া আর উঁচু জাতের অসহ্য অত্যাচারের কথা। বলে, ফুঁসছে চাষীর দল, বারুদ হয়ে আছে চুয়াড়রা, সাঁওতালরা। একটা আগুনের ফুলকির দরকার শুধু। আনমনে নিজের কথা ভাবছিল বিষ্ণুচরণ। মা-বাবা ছোটোবেলাতেই মারা যায়। মামাবাড়িতে মানুষ। জোয়ান হওয়ার পর মামা ওকে বাপের খেত আর বাড়ি বুঝিয়ে দেয়। এদিক থেকে তার কপাল ভালো। তার যতটুকু ছিল মামা যত্নে আগলেছে। ঐ যে রাস্তার উলটো দিক থেকে ফকির আসছে। মুখ ভর্তি হাসি। হঠাৎ, একদল গোরা সৈনিক ফকিরকে ঘিরে ধরল। একজন সাহেব ওর কাঁধে হাত রাখলেন।
– আজম শা বুরহান, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা মজনু শার তুতো দাদা! তোমার মতো যোদ্ধাকে শত্রু হিসেবে পাওয়া গর্বের ব্যাপার!
– কালা আদমিকে এতটা সম্মান মেজর গার্ডনার?
– আমাকে আমার দেশবাসীরা খুব একটা পছন্দ করে না। তবু আমাকে ওদের দরকার হয়। তাই আমি নিজের নিয়মে চলি। রাজশাহীতে যুদ্ধের সময় আওধ থেকে আমায় ডেকে আনা হয়। তোমাদের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়। তুমি উধাও হয়ে যাও। কোথায় ছিলে এতদিন?
– আপনিই বলুন না দেখি!
– বেশ বলছি! মার খাওয়াদের এককাট্টা করতে চাইছিলে। পারোনি। আমি বলছি কোনওদিন পারবে না। তোমার দেশের মানুষ এক হতে জানে না। একেবারে ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে লুকিয়েছিলে কলকাতা এসে। জানতে, এখানে তুমি থাকতে পারো, কেউ ভাবতে পর্যন্ত পারবে না। জানতে না, যাদেরকে জাগাতে চেয়েছিলে তাদেরই একজন কেল্লায় খবর দেবে। আবার আমাকে আওধ থেকে ডেকে আনা হবে, যেহেতু আমি তোমার মুখোমুখি হয়েছি। একটা কথা জেনে নাও আজম শা। তোমার দেশের মানুষ বিক্রী হতে খুব ভালোবাসে।
ফকিরকে ঘিরতে দেখেই আর এগোয়নি বেষ্টা। শুধু শরীরের পেশিগুলো ফুলে উঠেছিল তার। হাত মুঠো হয়ে উঠেছিল। দেখছিল ফকির হাঁটছে। কাঁধ ঝুলে পড়েছে। হঠাৎই যেন অনেক বুড়ো হয়ে গেছে লোকটা। অন্যদিকে মন ছিল না বলেই মখমলে মোড়া পালকিটা দেখতে পায়নি। আদালতের সামনে পালকি দাঁড়ালো। এক ব্রাহ্মণ নেমে এলেন। বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা দিয়ে গলার পৈতে ধরলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
– আমার ফাঁসি হবে একটু পর। কিন্তু, আমি, মহারাজ নন্দকুমার, পৈতে ছুঁয়ে শপথ করছি, জালিয়াতি আমি করিনি। সবাই শোনো। আমি নির্দোষ।
তাড়াতাড়ি নন্দকুমারকে তুলে নিয়ে পালকিটা এগিয়ে গেল। পুরো ঘটনাটা বিন্দুমাত্র রেখাপাত করল না বেষ্টার মনে। সে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আশপাশের লোকজনের দিকে। এক অন্ধ আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাদের। মাথার ওপর দু’হাত তুলে ছুটছে, ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে, উঠে আবার ছুটছে। গলা ফেড়ে চ্যাঁচাচ্ছে,
– বেম্মহত্যে! ওরে বাবারে! বজ্জরপাত হবে। ওরে সপুরী একগাড়ে যাবে! পালা! পালা!
দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে মাটিতে থুতু ফেলল বেষ্টা। তারপর চলতে শুরু করল।
অনেকটা পথ হাঁটবে বিষ্ণুচরণ দাস। তারপর হয়তো পৌঁছবে সেই দেশে, যেখানে চাঁদের আলোয় মাদল বাজে, টাঙ্গি ধরা হাজার হাত শূন্যে ওঠে, চুয়াড়রা তীরের ফলা শানায়, চাষীরা তেল মাখায় পাকা বাঁশের লাঠিতে। হয়তো। একদিন।
[নন্দকুমারের বিচারের দৃশ্য একটু নাটকীয় করতে হয়েছে। নবকৃষ্ণকে ক্রস এগজামিন করা হয়নি। মামলার বিষয়, নবকৃষ্ণের সাক্ষ্য, গোকুল সোনারের মামলা সংক্রান্ত সব তথ্য ঐতিহাসিক। নিখিলনাথ রায়ের মুর্শিদাবাদ কাহিনী থেকে নেওয়া। কিন্তু, গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। সবচেয়ে বড় কল্পনা হলো ১৭৭৫ এ শ্রেণীচেতনা উন্মেষের কল্পনা।]
–~০০০XX০০০~–