খাট
✍ সুতপা বিশ্বাস ঘোষ
এখন সকাল দশটা। এক এক করে সব জিনিসপত্র লোকগুলো বাইরে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে দেখছি, মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি এই বিরক্তিকর কাজটা শেষ হয়, ভালো হয়। এমনিতেও সন্ধ্যা সাতটা পনেরোর ফ্লাইট ধরব, খুব বেশিক্ষন থাকতেও পারব না। একটা থেকে দুটোর মধ্যে বেরিয়ে যেতেই হবে। এখানকার কাজ শেষ হলেই, একবার নিউ ব্যারাকপুর যেতে হবে। রুমেলার জন্য আমার শাশুড়ি মা কিছু দিয়ে দেবেন, সেটা আনতে যাব। বাসনপত্র আগেই সবাইকে দিয়ে দিয়েছি। বিলিয়েই দিয়েছি। আরতিদি আমাদের বাড়িতে কাজ করত, মায়ের সাথে শেষ পর্যন্ত ওই ছিল। বাসনের বেশিটাই নিজে নিয়েছে, কিছুটা বোধহয় ওর মেয়েকে দিয়েছে। শুধু একটা প্লাস্টিকের বাক্স ,আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দাদা, এইটা তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও। এটা মাসীমার বড় প্রিয় ছিল। বউদিকে দিও।
জিজ্ঞেস করলাম,কি আছে এতে? সে বলল, মাসীমার বড় প্রিয় বস্তু আছে গো দাদা এতে। তিনি বিয়েতে উপহার পেয়েছিলো। বড় যত্ন করে ব্যবহার করত। কতবার আমাকে সাবধান করেছে, আরতি সাবধানে কাপ প্লেটগুলো নাড়াচাড়া করবি। এখন আর এসব জিনিস পাওয়া যায় না। তুমি এটা নিয়ে যাও দাদা। এমনিতেও আমার কাছে থাকলে দুদিনেই ভেঙে যাবে।
আমি বাক্সটা খুলে দেখলাম তার মধ্যে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা, সাদা রঙের ছটা কাপ, ছটা প্লেট, একটা মিল্ক পট, একটা সুগার পট আর একটা টি পট। সবগুলোর প্রায় মাঝ বরাবর ওপর দিক থেকে একটু নীচে সরু সরু দুটো সোনালী রেখা পুরো পাত্রটা বেষ্টন করে রেখেছে। সোনালী রঙ আজও একইভাবে জ্বল জ্বল করছে। বোন চায়নার পাতলা পাতলা এই কাপ প্লেটগুলো এতো দিন পরেও কি উজ্জ্বল। মনে হয় একটু আগেই যেন কেউ দোকান থেকে কিনে এনেছে। এ জিনিস এখন সত্যিই দুর্লভ। কিন্তু রুমেলা ? তার কি ভালো লাগবে, শাশুড়ির পুরনো ধাঁচের কিছু? সে তো শাশুড়ির কিছুই তার সংসারে ঢোকাতে রাজী নয়। অথচ একথা আমি আরতিদিকে কি করে বলি? কি করে বলি, তোমার বৌদিদি তোমার মাসীমার কোনও কিছুই তার সংসারে রাখবে না। হিসেব করে দেখলাম, আমার বয়স এখন আটচল্লিশ বছর, তার মানে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমার মা তার বিয়েতে এই বস্তুটি উপহার পেয়েছিলেন। বাবা মার বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমি এসেছিলাম।
মনে পড়ল, মা একবার বলেছিল, বাবু তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন যখন আমাদের বাড়ি আসবে, আমি সবার প্রথম এই কাপ প্লেটে সাজিয়ে চা দেব, আগে চা খাওয়া হবে তারপর জলখাবার দেব।
আমি বলেছিলাম, আর তারা যদি আবার চা খেতে চায়? দেবে না?
মা খুব হেসেছিল, হ্যাঁ রে বাবা আবার এই কাপেই দেব। পাগলা কোথাকার।
জানি না, রুমেলাদের বাড়ি থেকে ওর বাবা-মা, দাদা বৌদি যখন এসেছিলেন তখন মা কি করেছিল। আমি তো তখন এখানে ছিলামই না। রুমেলাকে বিয়ের আগে আমি শুধু ছবিতেই দেখেছি। বিয়ের দিন সকালে কলকাতায় এসে প্লেন থেকে নেমেছিলাম। পরে আর কাপ প্লেটের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি। সত্যিকথা বলতে কি, আমার মাথা থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল। আজ হঠাৎ অনেক বছর পর ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। চোখদুটো এমন জ্বালা করে উঠল কেন? আমি তো চাইছিলামই, মা যেন চলে যায়। বাবা তো বছর দশেক আগেই চলে গেছেন। মাও শেষ দুবছর এত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো, আরতিদি তো ছিলই, সাথে দিন রাতের আয়া রাখতে হয়েছিলো। আমি আর পেরে উঠছিলাম না। মার তো আর পেনশন ছিল না, দু’একটা ফিক্সড ডিপজিট থেকে যা সামান্য সুদ আসত, ওতে আর কি হয়, কতটুকু হয়? মা সুস্থ্য থাকতে মাকে আমি অনেকবার বলেছি,আমার কাছে চলে এসো, কি আছে ওখানে? সে কিছুতেই রাজী হয় নি। এত কি আছে এই বাড়িটাতে আমি আজও বুঝতে পারি না।
দু’মাস আগে যখন ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিলেন, তখন আমি মাত্র দু’দিনের জন্য এসেছিলাম। তখনই আত্মীয় স্বজনদের বলে গেছিলাম, বাড়িটার জন্য খদ্দের দেখতে। ওরাই সব ঠিক করে আমাকে খবর দিয়েছে। বাড়িটা এবার তাই বিক্রিই করে দিলাম। আসবাবপত্র যা ছিল যতটা সম্ভব নামমাত্র দামে ছেড়ে দিয়েছি। কি হবে আর এসব দিয়ে। টিভিটা আরতিদিই নিয়ে গেছে। আরও কিছু চাইলেও দিয়ে দিতাম। কিন্তু ও আর কিছু নিতে চাইল না। মা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, যে , আর থাকবে না, তাই নিজের শাড়ি, জামাকাপড় যা কিছু ছিল, সবই প্রায় নিজেই একে তাকে দিয়ে গেছে । আলমারি প্রায় ফাঁকাই ছিল, টুকটাক দু’একটা গয়না আর কাগজপত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সে একদিকে ভালই হয়েছে, নাহলে আমার আর একটা কাজ বাড়ত।
মার আলমারি, ড্রেসিং টেবিল,ফ্রিজ, সোফা সেট, ডাইনিং টেবিল,খাট সবকিছু পুরনো আসবাবপত্রের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছি। আজকে ওরাই এসেছে, সব খুলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা জিনিস মা খুব কষ্ট করে করেছিল। বাবার ওই সামান্য আয়, সংসার ভালো করে চলত না, আমিও তখন পড়াশোনা করছি, মা সেখান থেকেই কিভাবে টুকটুক করে এসব করত, কি জানি? আমি তো এখন ভাবতেও পারি না। মনে আছে, যেদিন সোফাটা আসল, বাবা কি অশান্তি করেছিলেন। সোফা নাকি বড়লোকদের ঘরে থাকে। আমাদের মত সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে এসব জিনিস মানায় না, বিলাসিতার নামান্তর।
মার মুখটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। নীচুস্বরে বলেছিল, দু’জন লোক ঘরে আসলে ঠিকমত বসতে দিতে পারি না, আমার বড্ড খারাপ লাগে।
**
এদিকের সব কাজ মোটামুটি কমপ্লিট। মনে মনে বেশ ভালো লাগছে একটা বড় ঝামেলা মিটল, এতদিনে।
আরে একি, আমি কি ভুল দেখছি, এতক্ষন তো সব ঠিক ছিল, খাটটার দিকে ওরা এগিয়ে যেতেই যেন বাবাকে দেখতে পেলাম, সেই আগের মত খাটে বসে বসে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। ছাত্ররা সবাই এক একটা চেয়ার নিয়ে খাটের সামনে বসে আছে। এই খাটটা বাবা যখন কিনেছিলেন তখন এর দাম ছিল মাত্র সাড়ে চোদ্দশ’ টাকা। দোকানদার বাড়িতে এসে খাট সেট করতে করতে মাকে বলেছিল, বৌদি, শিশু কাঠের খাট। দেখবেন পঞ্চাশ বছরেও কিছু হবে না। এত ভালো পলিশ দিয়েছি না, যত ব্যবহার করবেন তত বুঝতে পারবেন। শুধু রোজ একবার করে মুছে দেবেন। বছরের পর বছর চকচক করবে। সামনের পদ্মফুলটা দেখেছেন? শুধু ওই ফুলটার দামই দুশ’ টাকা।
সেই থেকে সেই খাট ওই ঘরে, একইভাবে আছে। জায়গার অভাবে ঘোরানও সম্ভব হয় নি।
বাবা শুধু টিউশনি করেই সংসার চালাতেন। তার মধ্যে অদ্ভুত নীতি আদর্শ নিয়ে চলতেন, কারও থেকে বেশি টাকা নেবেন না। আমাদের এই দমদম অঞ্চলে আমার বাবার মত অঙ্কের টিচার আর কেউ ছিলেন না। কতজনকে যে পড়িয়ে মানুষ করেছেন। তখন যখন সবাই একটা সাবজেক্টে দেড়শ টাকা নিতেন বাবা চল্লিশ পঞ্চাশ টাকার বেশি নিতেন না। যে যা দিত, কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। মা অনেক সময় রাগারাগি করলে, বলতেন, কেন তোমার সংসার কি চলছে না?
মা বলতেন, সংসার কি আর চলছে, আমি যে কিভাবে চালাচ্ছি তা আমিই জানি।
বাবা হেসে বলতেন, আমি জানি তো তুমি আছো, আমার আশা আমার ভরসা। তুমি ঠিক পারবে। আমি আমার আদর্শকে বাদ দিয়ে চলতে পারব না। আমি একজন শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। আমি অন্যদের মত বেশি টাকা নিতে পারব না। আমাকে এমন অনুরোধ ক’রো না।
মা আর কিছু বলতে পারত না।
ওই খাটে আমিও বসতাম বাবার অন্য ছাত্র ছাত্রীদের সাথে। আমাকেও পড়াতেন সবার সাথেই। আলাদা করে নয়। বাবা পড়াতে পড়াতে মগ্ন হয়ে যেতেন, আর আমরা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি শুরু করতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কাটাকুটি খেলতাম। কত যে ফাঁকি মেরেছি। এখন মনে পড়লে বাবার মত ভালো মানুষটাকে ঠকানোর জন্য কষ্ট হয়। আবার বন্ধুদের কথা মনে হলে হাসি পায়।
আমি যতদিন ছোট ছিলাম, বাবা-মার সাথে ওই খাটে একসাথেই শুতাম। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমার একটা আলাদা ঘর হল। ভাগ্যিস দু’কামরার এই বাড়িটা আমার ঠাকুরদা করে গিয়েছিলেন। নাহলে হয়ত আমরা সারাজীবন ভাড়া বাড়িতে ঠোকর বেয়ে বেড়াতাম।
ওই খাটে বসেই তো প্রথম দেখেছিলাম মৌকে। আহ্ মৌ; কতদিন পর আবার মনে পড়ে গেলো। পুরো নাম মৌমিতা। আমার জন্য শুধু মৌ। আমাদের পাড়াতেই কয়েকটা বাড়ি ছেড়ে ওরা থাকত। যখন বাবার কাছে প্রথম পড়তে এসেছিল তখন ও ক্লাস সেভেনে পড়ত। আর আমি ক্লাস টেন। তখন কি ভেবেছিলাম এই মেয়েটা আমার জীবনে জড়িয়ে যাবে, আমার সব হিসেব ওলট পালট হয়ে যাবে। মৌ পড়াশোনায় খারাপ ছিল না, আবার খুব ভালও ছিল না। মাঝারি মাপের। দেখতে কিন্তু বেশ ভালো ছিল। আমাদের পাড়ায় ঐ সময় ওই সব থেকে সুন্দরী ছিল। তা সেই মেয়ে যে আমার প্রেমে পড়েছে একথা বুঝতে বুঝতেই তো আমার কয়েক বছর পার হয়ে গিয়েছিল।
যেদিন আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল, দেখা গেল আমি পাঁচটা লেটার নিয়ে স্টার পেয়েছি। বাবা মায়ের আনন্দের সেদিন বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। পাড়ার সব বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন দু’জনে। মার্ক শীট হাতে পাবার পর বাবা কখনও শুয়ে, কখনও বসে কতবার যে সেটা উল্টে পাল্টে দেখলেন। তাঁর পাশে বসে মার চোখেমুখেও প্রশান্তি। সেদিন মনে হল পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ আমরা।
এরপর উচ্চ মাধ্যমিক। তাতেও তিনটে লেটার ছিল, তবে স্টার ছিল না। আমি ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম। মৌয়ের সেবার মাধ্যমিক ছিল। নানাভাবে ও দেখতাম মার খুব কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করত। আমার মাও বোধহয় তার মেয়ের অভাবটা পূরণ করতে চাইত ওকে দিয়ে। একেক সময় আমার কাছে এসে অঙ্ক নিয়ে বসে পড়ত। ও নাকি জেঠু মানে আমার বাবার কাছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। অস্বীকার করব না,আমি মুখে বিরক্তি দেখালেও মনে মনে খুশিই হতাম। তার উপর আমার মায়ের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় থাকত ওর সাথে, আহ্ বাবু বিরক্ত হচ্ছিস কেন, দেখছিস তো মেয়েটা বুঝতে পারছে না, একটু বুঝিয়ে দিতে কি হয়?
মৌ অমনি মহা উৎসাহে বলে উঠত, জেঠীমা দ্যাখো তো, তণ্ময়দাকে বলো তো, আমার সাথে এমন কেন করে?
পড়তে বসে কিন্তু পড়ত কম,আমকে দেখত বেশি। একদিন রেগে বললাম,আমার মুখে কি আছে? এরকম করলে কিন্তু তুই ফেল করবি।
ও হাসতে হাসতে বলে, ফেল করলে করব, তাতে কি? তোমাদের বাড়ি আর এক বছর বেশি আসার সুযোগ পাবো।
– কি? পাগল নাকি? আমাদের বাড়ি আসার জন্য ফেল করতেও রাজী তুই ?
– কেন আসতে চাই, তুমি বোঝো না? বলতে বলতে চোখ নামিয়ে নিলো।
– না, বুঝি না; বুঝিয়ে বল্ ।
– তোমার জন্য।
আমি ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ও দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি কিন্তু তার মধ্যেই বিস্মিত হয়ে দেখলাম একটা সলজ্জ ভাব ফুটে উঠেছে ওর চোখে মুখে। মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে। সত্যি আমি কি বোকা। এতদিন ধরে মেয়েটা আসছে, আমি কিচ্ছু বুঝি নি? কেন? হঠাৎ করে পৃথিবীটা যেন অসম্ভব রঙিন মনে হচ্ছে। সেইদিন প্রথম মনে হল, মেয়েটা সত্যিই খুব সুন্দর।
সে কিন্তু মাধ্যমিকটা ভালভাবেই পাশ করে গেল। লেটার,স্টার না থাকলেও ফার্স্ট ডিভিশন ছিল।
আমি কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছিলাম না। ও যেন আমাকে টানত। ওকে একবার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম। মৌও তখন নানা অছিলায় আমাদের বাড়ি আসত। এইভাবে বেশ চলে যাচ্ছিল, পকেট মানি বাঁচিয়ে টুকটাক সিনেমাও দেখতাম দু’জনে। ওর সাথেই প্রথম ফুচকা খেয়েছিলাম। তার আগে ফুচকা টুচকা আমি খেতাম না। ওর হাত ধরেই প্রথম ভিক্টোরিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানেই একদিন স্বর্গীয় অনুভব, ওর পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট দুটোতে আমার প্রথম চুমু। “এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু”।
ঘুরে বেড়ালাম মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, তারামণ্ডল। আর এইভাবেই একদিন ধরা পড়ে গেলাম ওর দাদার হাতে। ধরা পড়লাম, কারণ আমরা তখনও বাড়িতে কিছু জানাই নি। সবটাই চলত লুকিয়ে। সেটাই কাল হল। এখনও মনে আছে, আমরা সেদিন গিয়েছিলাম শারুখ-কাজলের সুপারহিট ছবি ‘বাজীগর’ দেখতে। ম্যাটিনি শো থেকে বেরিয়ে দেখি রূপমদা তার বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরকে দেখেই বলল, এতদিনে পেয়েছি। আমার কাছে অনেকদিন থেকেই খবর ছিল, কি ভেবেছিস তোরা? বেলেল্লাপনা করে পার পেয়ে যাবি?
আমি মিনমিন করে প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করলাম, বেলেল্লাপনার কি দেখলে?
রূপমদার একটা বন্ধু আমার শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, বোকাচোদা, খানকীর ছেলে কোনও কথা বলবি না।
আমারও মাথায় আগুন জ্বলে গেলো, এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বললাম, একটা বাজে কথা যেন না শুনি।
এরপর আর কিছু বলা হয় নি, কিল,চড়, লাথি ঘুষির চোটে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসে আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিল। উঠে দাঁড়ানোর পর মৌকে আর দেখতে পাই নি। সম্ভবত রুপমদার সাথে চলে গিয়েছিল।
পাড়ায় আমার খুব বেশি বন্ধু ছিল না। ভালো ছেলে বলে অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলত। আবার সুযোগ পেলে আমাকে টিজ করতেও ছাড়ত না। হয়ত কোনও ঈর্ষাও ছিল। জানি না। এদের মধ্যে একজন ছিল রূপমদা, মৌয়ের দাদা। ওর থেকে আট বছরের বড়। তার ওই বয়সেই লেখাপড়াটা বাদ দিয়ে বাকি সব অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথে তার যত আড্ডা আর মেলামেশা।
বাড়ি ফিরে দেখি আর এক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। এরই মধ্যে রূপমদা তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে এসে মা বাবাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে শাসিয়ে গেছে। আমাকে পাড়ায় দেখলে নাকি আর জীবিত পাওয়া যাবে না। বাবা কি করে টিউশনি করে দেখে নেবে।
দেখলাম অন্যদিনের মত আজকে বাবার ছাত্র ছাত্রীরা কেউ নেই। মা বোধহয় সবাইকে চলে যেতে বলেছে। বাবা পড়ানোর অবস্থায় নেই।
মা ভয়ে ,আতঙ্কে অঝোরে কান্নাকাটি করছেন, বাবা গুম হয়ে খাটের এক কোণায় বসে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে মা বলে চলেছেন, আমাদের টাকা নেই,পয়সা নেই, কিন্তু মান সম্মান তো আছে। তোর বাবাকে এভাবে কেউ অপমান করতে পারে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ওদের মুখের ভাষা এত খারাপ, এরা তো সব সাংঘাতিক ছেলে।
আমার নাক্মুখ ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসছিল। হাতে পায়েও অনেক আঘাত ছিল। আমাকে দেখে মার কান্না, আতঙ্ক আরও তিনগুণ বেড়ে গেলো।
বেশ বুঝতে পারলাম,বাবাও আতঙ্কিত। যদিও মুখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললেন, শোনো আমি ঠিক করেছি, তোমাকে হায়দ্রাবাদে তোমার বড়মামার কাছে পাঠিয়ে দেব, এখানে থাকা তোমার জন্য সেফ না।
আমি প্রতিবাদ করলাম, কেন যাবো আমি? কি অপরাধ আমার, বল তুমি।
বাবা বললেন, শোনো সব সময় বীরত্ব দেখানো যায় না। আর তুমি সেরকম ছেলেও নও। সেভাবে মানুষ হও নি। এদের সাথে আমরা পারব না। তুমি চলে যাও।
বাবার সাথে তর্ক করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু আমি ব্যাবস্থাটা মেনে নিতেও পারছিলাম না। নিজের ঘরে এসে চুপচাপ মুখ গুঁজে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অপমানটা অসহ্যকর ছিল। অথচ আমি অসহায়।
কিছুক্ষণ পর মা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল, বলল, বাবু চা খা, একটু ভালো লাগবে।
বললাম, খাব না আমি, তুমি চা নিয়ে যাও।
মার গলার স্বরে অপার স্নেহ, না বাবা, অমন করে না। না খেয়ে কি থাকা যায়? আমি তো জানি আমার ছেলেকে। আমার ছেলে কোনও অন্যায় করতে পারে না। তবে বাবা, ওই রূপমরা যে ধরণের ছেলে ওদের সাথে তুই পারবি না বাবা।
মা আমার হাতে ছোট্ট একটা ভাঁজ করা কাগজ দিয়ে, বলল, পড়, পড়ে দ্যাখ।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি এটা?
মা উঠে যেতে যেতে বলল,মৌ পাঠিয়েছে ওদের কাজের লোকের হাত দিয়ে। সে এখানে এসে উঁকিঝুঁকি মারছিল, তোকে খুঁজছিল আর কি। আমিই কাগজটা ওর থেকে চেয়ে নিয়েছি। পড়ে দ্যাখ।
খুলে দেখি মৌ ঠিক দু’লাইনের একটা চিঠি লিখেছে,
তন্ময়দা,
তুমি এখানে থাকলে আমার দাদা তোমাকে মেরে ফেলবে। ওর বন্ধুরা সাংঘাতিক। ওরা রীতিমত প্ল্যান কষছে। তুমি কিন্তু যেভাবে হোক অন্য কোথাও চলে যাও। আমার জন্য চিন্তা করো না। আমাকে ওরা কিছু বলবে না। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো—মৌ।
পরের দিনই বাবা মা তাদের সবটুকু আর্থিক সম্বল উজার করে, আমার হাতে সামান্য কিছু হাতখরচ দিয়ে হাওড়া ষ্টেশন থেকে হায়দ্রাবাদের ট্রেনের জেনারেল বগিতে, তাদের একমাত্র সন্তানকে উঠিয়ে দিল। আমার কোনও ওজর, অজুহাত কাজ করল না।
আর আমি? আমার শৈশব, কৈশোর, কলেজ, লেখাপড়া, আমার ক্যেরিয়ার, আমার ভালবাসা, দুচোখ ভরা স্বপ্ন,আমার বাড়ি, আমার পাড়া, আমার কলকাতা, আমার বাবা মা সব কিছুকে পিছনে ফেলে ভারাক্রান্ত মন আর বুকভরা অভিমান নিয়ে, কোনোমতে ট্রেনের এক কোণায় জায়গা করে নিলাম।
***
–বাবু বাবু…
মনে হল যেন মা ডাকছে। আপন মনে বলে ফেললাম,
— হ্যাঁ মা, বল কি বলবে ?
চিন্তার জালটা ছিঁড়ে গেলো। মিস্তিরি দের একজন দাঁড়িয়ে আছে, ডাকছে, বাবু বাবু…
–হ্যাঁ বলো।
–বাবু খাটের পেরেকগুলো খোলা যাচ্ছে না যে। বড্ড পুরনো তো, একদম আটকে ধরেছে। মরচে লেগে গেছে।
–তাহলে উপায়?
–কাটতে হবে,বাবু। আপনে যদি বলেন কেটে ফেলব। করাত আমাদের কাছেই আছে।
–কেটে ফেলবে? তা ফেলো। আমার কি বলার আছে? যা মনে হয় করো।
–তন্ময়দা…
–কে? মৌ? হ্যাঁ মৌ-ই তো; কিন্তু ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন? বয়সের একটা ছাপ পড়েছে, সে তো পড়বেই। আমার হিসাবে এখন মৌয়ের অন্তত পয়তাল্লিশ বছর। কোথায় আঠেরো বছরের মৌ আর কোথায় এ? কিন্তু ও কি বিধবা হয়ে গেছে? কই তেমন কিছু তো শুনি নি। অবশ্য আমি জানতেও চাই নি কখনও। যবে থেকে শুনেছি ওর বিয়ে হয়ে গেছে ওর ব্যাপারে আর কোনও আগ্রহ দেখাই নি।
— অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? আমাকে চিনতে পারছ না তন্ময়দা?
–পারছি। বল্,কি দরকার? আশা করি ভালই আছিস।
–দেখা করতে এলাম তোমার সাথে, আর কোনোদিন তো সুযোগ পাবো না। জানি তুমি এখানে আর আসবে না। তাই আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। তোমাকে একবার অন্তত দেখে যাই।
–আমার সাথে দেখা করতে আসলি, তোর বাড়ির লোকেরা রাগ করবে না?
–বাড়ির লোক বলতে তো ওই দাদা। আমার আর কে আছে বল? বাবা মা তো কবেই চলে গেছেন। দাদাও আর সেই দাদা নেই। পাঁচ বছর ধরে ভুগছে সমানে। মদ খেয়ে খেয়ে লিভারটার তো আর কিছু নেই। সেই স্বাস্থ্যও নেই, প্রতাপও নেই। সব সময় শুয়েই থাকে।
–কেন তোর বর? সে তো আছে।
–বর? তুমি কি পাগল হলে? আমার বিয়ে কোথায় হল? কবে হল?
ঘরের মধ্যে যদি বাজ পড়ত তাহলেও বোধহয় আমি এতটা চমকাতাম না। মৌয়ের কথায় যেভাবে চমকে উঠলাম। বুঝলাম আমার চমক মৌয়ের নজর এড়ায় নি। বললাম,
–কেন? মা যে বলেছিল, তোর বিয়ে হয়ে গেছে?
–ওহ্, সেটা তো আমাকে জোর করে মাসির বাড়ি দেওঘর পাঠিয়ে দিয়েছিল, আমার বাবা,মা। এখানে সবাই ভেবেছিলো নিশ্চয়ই বিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য অবশ্য সেটাই ছিল, কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হই নি। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম যে, অপেক্ষা করব।
কে যেন সপাং করে চাবুক মারল আমার পিঠে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। বললাম,
–তুই আমাকে জানালি না কেন?
–কি জানাতাম? যতদিনে জানাতাম ততদিনে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তোমার সংসারটা নষ্ট হোক এটা আমি কি করে চাই বলো তো?
স্বগতোক্তির মত করে বলে গেলাম, আসলে আমি ওখানে যাবার পর থেকেই না, সব ব্যাপারে বড্ড অমনোযোগী হয়ে পরেছিলাম। কোনও কিছু ভালো লাগত না। সারাক্ষণ কলকাতার কথা মনে হত। পড়তে বসতেই পারতাম না। গ্রাজুয়েশনে ফেল করলাম। সবাই আবার পড়তে বলল, পরের বার ওখান থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিলাম, কোনোমতে টেনেটুনে পাশ। বড়মামা একটা কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিল। তোর কাছ থেকে একটা চিঠি অন্তত পাব, আশা করেছিলাম। কিন্তু কোথায় তোর চিঠি; উল্টে মার চিঠিতে খবর পেলাম তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তখনই ঠিক করে নিলাম আর কোনোদিন কলকাতায় ফিরব না, হায়দ্রাবাদেই সেটল্ করব। এর বছর দু’এক পরে রুমেলার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিল সবাই মিলে। সেই যে গিয়েছিলাম তারপর আমার বিয়ের সময় এসেছিলাম।
মৌ বলল,তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও সুযোগ আমি পাই নি। প্রথমে তো ভেবেছিলাম দেওঘরেই থেকে যাবো, এখানে যে অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম, পুরোপুরি বন্দি জীবন। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে আসতে বাধ্য হলাম। মা বড় একা হয়ে পড়েছিলো গো। দাদার তো ওই অবস্থা। ছ’বছর পর যখন ফিরে এলাম তখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। ওখানে থেকে আমি আমার লেখাপড়াটা কমপ্লিট করেছি। তোমার শুনে ভালো লাগবে, আমি এখন একটা স্কুলে ম্যাথ্স টিচার।
বললাম, বাহ্ খুব ভালো। তো এবার একটা বিয়ে কর তুই।
সেকথার কোনও উত্তর না দিয়ে মৌ বলল, জানো তো, আমি কিন্তু শেষের দিকে জেঠিমার কাছে আসতাম। কথা তো বলতে পারতেন না, আমাকে দেখে ওনার দুচোখ দিয়ে খালি জল গড়াত। যত বলতাম আমি ভালো আছি, তুমি এমন করো না, মাথা নেড়ে কি যে বোঝাতে চাইতেন কি জানি?
–বাবু, খাট কাটা হয়ে গেছে। আমাদের কাজ শেষ। আমরা এবার যাই বাবু ?
–আচ্ছা যাও।
মৌ যেন আঁতকে উঠল, খাট কাটা হয়ে গেছে মানে? কোন খাট ?
–ওই যে বাবা মার ঘরের খাটটা।
–যেটাতে বসে জেঠু পড়াতেন?
–হ্যাঁ, অনেকদিনের পুরনো তো, এমন শক্ত করে লেগেছিল যে কিছুতেই খোলা গেলো না।
মৌএর চোখে মুখে যন্ত্রণা ফুটে বের হচ্ছে। ধীরে ধীরে বলল, খাটটা কেটে ফেললে তন্ময়দা?
তাড়াতাড়ি কথা ঘোরালাম , বললাম, শোন না মৌ মায়ের একটা জিনিস যদি তোকে দিই তুই কি নিবি? না আমায় ফিরিয়ে দিবি?
মৌ বলল, কি জিনিস?
আমি টি সেটের বাক্সটা ওর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, এটা মার বিয়ের উপহার। তুই ছাড়া এর মূল্য কে বুঝবে?
মৌ বলল, আমি জানি তো, এটা জেঠিমা বিয়ের সময় পেয়েছিলেন। তুমি এটা আমাকে দিতে চাও? ঠিক আছে দাও। আমি খুব যত্ন করে রেখে দেব।
বললাম, আর একটা কথা মৌ, আবারও বলছি, এখনও সময় আছে, দেরীতে অনেকেই বিয়ে করে। তুইও এভাবে জীবনটা নষ্ট করিস না। তুই চাইলে আমিও তোকে হেল্প করতে পারি।
মৌয়ের মুখে হাসি কিন্তু চোখভর্তি জল, হয় না তন্ময়দা,আর হয় না। অনেকদিন আগেই জীবনের সুতোটা অনেকদিন আগে ছিঁড়ে গিয়েছিল, আমি তাকে জোড়া দিতে পারি নি। আর কোনোদিন পারব না। তোমাকে যদি বলি, কেটে ফেলা খাটটা জুড়ে দাও, পারবে জুড়তে ? বল না,পারবে?
–~০০০XX০০০~–