উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ ( চতুর্থ পর্ব )
✍ কাকলি ঘোষ
“বহুদিন ধরে বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বত মালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া_”
গত কাল অর্থাৎ তেইশ তারিখে পাহাড় জঙ্গল পরিদর্শন না করে সিদ্ধান্ত নিলাম একটা দিন সম্পূর্ণ রাখব বিশ্রাম আর আশ পাশের মানুষ জন কে জানার জন্য। জলঢাকা রিভার ভিউ রিসর্টের চারপাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ও দূরে দূরে থাকা ছোট ছোট গ্রাম , তাদের জীবন যাত্রা প্রবল বেগে টানছিল মন কে।
তাই সকাল বেলা লুচি আলুর দম এর জমাটি জল খাবার সাঙ্গ করে রিসর্টের কর্ণধার ইন্দ্রনীল কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম অভিযানে। আর কোন অতিথি না থাকার কারণে হাসিখুশি ইন্দ্রনীল অনায়াসেই সাথে চললেন। প্রথমেই রিসর্টের একেবারে পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলঢাকা নদীর পাশ টিতে। নুড়ি পাথরের নুপুর বাজিয়ে বাচ্চা মেয়ের মত খিল খিল হাসিতে হাত তালি দিতে দিতে ছুটে চলেছে জলঢাকা। দূরে পাহাড়ের গায়ের জঙ্গল বুঝি হাত ছানি দিয়ে ডাকে ওকে! দুহাতে সেই জল আজলা ভরে নিতে নিতে এক অবিশ্বাস্য পুলকে ভরে উঠছিল মন। অদূরেই সবুজ পাহাড়। অসীম অনন্ত বনানী। মন চায় হারিয়ে যেতে ওই অনন্তে।
কিন্তু এদিকে মাথার ওপর নীল আকাশের গায়ে তখন মেঘের প্রলেপ লেগেছে। সেদিকে তাকিয়ে তাড়া দিলেন ইন্দ্রনীল। আর নদীর পারে না। যেতে হবে আরও। চললাম গ্রামের দিকে।
” ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি ”
এক পাশে সবুজ চা বাগান, চা বাগিচার গা ঘেঁষে চাপড়ামাড়ি ফরেস্ট রেঞ্জ এর সুবিশাল বনানী, অন্য দিকে বসতি। ছোট ছোট মেহেন্দি গাছের বেড়া দেওয়া মাটি, টিন , কাঠের ঘর বাড়ি। বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে সাদা টগরএর উকিঝুকি, ঝুমকো জবার লাজুক হাসি, আর সরল ডাগর চোখের শিশুর দল। পথের মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝোরা। তাতে পা ডুবিয়ে গায়ের কাপড় সামলে গ্রামের
মেয়েরা কাপড় কাচা, বাসন মাজা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজ গুলো সেরে নিচ্ছেন। স্বচ্ছ , পরিষ্কার সে জল দেখে পা ডোবাতে ইচ্ছে করলো। আমার আনাড়ি পনাকে দেখে সহজ হাসি হেসে দিব্যি সাহায্য করলেন আনোয়ারা বিবি, রমলা বৌদি। গল্প ও জমে উঠতে সময় লাগলো না। কিন্তু ওই যে সময়ের রক্ত চক্ষু। তাকে ঠেকায় কে?
হাটতে হাটতে চলে গেলাম ভাঙ্গা সেতুর কাছে। এবারের বন্যায় সেতু ভাঙ্গার দরুন নাগরা কাটা স্টেশন থেকে এই দিকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অনেক খানি ঘুরে যেতে হচ্ছে ।
ইন্দ্রনীল জানালেন এখানে হাতির উপদ্রব খুব বেশি। আশে পাশের ধান ক্ষেতে প্রায় রোজ এদের আনাগোনা। কপালে থাকলে রাতে দেখতে পাবেন।
আশা করিনি। কিন্তু মিলে গেলো কপালে। হাতি ছাড়াও তার চেয়েও বেশি কিছু।
তখন রাত দশটা সম্ভবত। চিকেন কারি তে রুটি ডুবিয়েছি কি ডোবাইনি _ হন্ত দন্ত হয়ে খাবার ঘরে ছুটে এলেন ইন্দ্রনীল। বাইসন এসেছে নদীর ধারে জল খেতে।
পড়ি কি মরি করে ছুটে বেরোলাম। দূরে নদীর অন্য পারে সার্চ লাইটের আলোয় বন্য বাইসনের একটা দল। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখ। নির্জন অরণ্যের মধ্যে থাকা রিসর্ট এ যখন চারদিক এর গভীর জঙ্গল আদিম অন্ধকারে ডুবে আছে তার মধ্যে এই অতি আরণ্যিক দৃশ্য রক্তে যেন শিহরণ জাগিয়ে দেয়।
এক অবশ বিহ্বল মন নিয়ে খাওয়া শেষ করে ঘরে শুতে গেলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই চারদিকে পটকার আওয়াজ। নিচে থেকে অস্পষ্ট স্বরে হালকা হাঁক। এবার হাতি। একটা দুটো নয়। এক পাল। ক্ষেতে ক্ষেতে পেকেছে নেনুয়া ধান। গন্ধে পাগল বুনো হাতি বেরিয়ে এসেছে গভীর অরণ্য থেকে।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম ওই মাতঙ্গ যূথের দিকে।
হে অরণ্য। হে ভীষণ! হে দূর্জ্ঞেয় তোমাকে প্রণাম।
(এরপর… ক্রমশ…)