অস্তরাগ
✍ শিল্পী মিত্র হাতি
(‘দক্ষিণের জানলা’র শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত)
চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন দিগন্ত মুখার্জি। ঘড়িতে সকাল সাতটার আশপাশ, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ‘ভালোবাসা’ এ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্ল্যাটের পুবদিকের ব্যালকনি। বৈশাখ মাস, গতকাল রাতের ঝড়জলে গুমোট ভাব বেশ কেটেছে, মনোরম সকাল। সামনে ছোট টি টেবল। তাতে এক কাপ লিকার চা, দুটো বিস্কুট আর গোটা তিনেক বাংলা ও ইংরাজি খবর কাগজ এইমাত্র রেখে গেল গোপালের মা।
বৃষ্টি বাদল ছাড়া সারা বছরেই এখান থেকেই দিনের শুরু করা দিগন্তবাবুর বরাবরের অভ্যেস।
দিন চারেক আগে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন, হার্ট অ্যাটাক।
অম্লমধুর দাম্পত্যকে পিছনে রেখে রমলা চলে গেছে তা বছর পাঁচেক তো হল, সন্তানও আসেনি। একাশির দিগন্তবাবু আজ বড়ই নির্বান্ধব।
সারা জীবন ধরে শুধু কলমই পিষেছেন। গল্প উপন্যাসে সীমাবদ্ধ থাকেন নি, কবিতা প্রবন্ধ, রম্য সবেতেই অনায়াস পরিক্রমা।
একলা যাপনে আজ তাই গোপালের মা’র উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সকাল বিকেলের রান্না ছাড়াও বাকি কাজটুকুও সেই সারে।
চায়ে চুমুক চলছে, সাথে খবর কাগজে চোখ বোলানো। ঘন্টা দেড়েক এগুলো নেড়েচেড়ে তবেই জলখাবার। মোবাইলে ভেসে উঠলো একটা আননোন নম্বর। স্ক্রল করে ধরতেই,
“নমস্কার, আমরা বাংলা টিভি চ্যানেল থেকে বলছি দিগন্তদা। শরীর কেমন এখন?”
” এখন ভালো।”
” আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। কদিন আগে শ্যুট হবে, আপনার জন্মদিনে টেলিকাস্ট হবে”।
‘সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমি এখন কোথাও যেতে পারব না, বাড়িতে হলে অসুবিধে নেই”
“ননা, বাড়িতেই যাব,আমাদের কোন অসুবিধে নেই। কাল বাদ দিয়ে পরশু যদি আপনার বাড়িতে যাই, এই ধরুন সকাল দশটা”।
“এসো, বাড়িতেই আছি”।
দিগন্ত বাবু মনে মনে বললেন, আজকাল আশি পেরোনো লোকজন, যাদের একটু নামযশ হয়েছে, তাদের নিয়ে মিডিয়া একটু বেশি সক্রিয় ওঠে। আসছে ছাব্বিশে বৈশাখ জন্মদিন, হপ্তাখানেক বাকি, তাই ওরা তড়িঘড়ি করছে। ঠিক আছে, আসতে চাইছে, আসুক বরং।
***
দিগন্তবাবুর লেখালিখির ঘরটা ভারী সুন্দর, দক্ষিণ খোলা, সাথে চওড়া বারান্দা, নানা দেশী বিদেশী ফুল আর অর্কিড দিয়ে সাজানো ছোট্ট একফালি বাগান। এটা রমলার নিজস্ব এক্তিয়ারে ছিল, এখন পরিচর্যার কাজটুকু মালি করলেও জল দেওয়ার কাজটা নিজেই অশক্ত হাতে করে থাকেন।
আজ সকাল সকাল স্নান সেরে জলখাবারের পাট চুকিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বসেছেন রাইটিং টেবিলে। গোপালের মা’কে দিয়ে একটু গোছগাছ করিয়ে রেখেছেন ঘরটাকে। বেশ সম্ভ্রাম্ত আর রুচিশীল দেখাচ্ছে। এই ঘরেই চলবে শ্যুট।
চ্যানেলের পক্ষ থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিখিলরঞ্জন স্বয়ং আসছেন। চমৎকার বাচনভঙ্গীর এই ইয়াং মানুষটি সমাজের বহু স্বল্প পরিচিত মানুষকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছেন।
আজ আকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত প্রখ্যাত সাহিত্যিক দিগন্ত মুখার্জির ইন্টারভিউ নিতে আসছে সে। এর আগে যদিও কয়েক বার দেখা হয়েছে, দু চার কথাও হয়েছে তবে এত বড় পরিসরে এই প্রথম কাজ। মনে মনে একটু উত্তেজনা ছেয়ে আছে। এতদিনের বিপুল লেখার ভাণ্ডার, পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত টুকরো জীবনপঞ্জী, স্মরণীয় ঘটনা সব কিছুর উপর ভালোমত স্টাডি করতে হয়েছে। কিশোর বয়সের দামাল চরিত্রটি জীবনে বহু লড়াই শেষে আজ এত উঁচুতে উঠেছেন। নিখিলের নিজের কাছে এটা মস্ত চ্যালেঞ্জ, অতি সন্তপর্ণে তাই পুরো সময়টুকু সামাল দিতে হবে।
যথাসময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো, এসে পড়ল চ্যানেলের গাড়ি৷ বেশ পাঞ্চুয়াল মানতে হবে। লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা নিয়ে সব আয়োজন প্রস্তুত।
**
“আজ ছাব্বিশে বৈশাখ, আপনার জন্মদিন। কখনও মনে হয় কি, একদিন আগে জন্মালে দিনটি ঐতিহাসিক হতে পারত” নিখিলের ঠোঁটে সামান্য কৌতুক ও সলজ্জ হাসি…
“হা হা। এটা মন্দ বলনি, তবে জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে, প্রবাদ তো আছেই।
আর হ্যাঁ, একদিন আগে জন্ম হলে আমার দিক থেকে একটু লজ্জায় পড়ে যেতাম এই আরকি…” উত্তরেও কৌতুকের কমতি নেই।
যে কোন ইন্টারভিউয়ের শুরুটা সবথেকে কঠিন, প্রথম দিকটা যদি মোলায়েম না হয়, উল্টোপক্ষের যাবতীয় আস্থা যদি না অর্জন হয়, তো দায়সারা উত্তর আসবে, যা একেবারেই প্রার্থিত নয়। নিখিল ভাবল, লেখকের জন্ম ওপার বাংলায়, এখনও জন্মভিটের ওপর প্রচণ্ড টান, এ বিষয়ের প্রশ্ন দিয়ে লেখকের মনটা বরং ভিজিয়ে নেওয়া যাক।
“আপনার জন্ম তো ওপার বাংলায়” ….
“হ্যা বরিশাল, ঝালকাঠি। কাছেই কীর্তনখোলা নদী।” কথাগুলো বলার সময় লেখকের চোখ ঘর ছাড়িয়ে খোলা বারান্দায়, নদীর নামটা এত নস্টালজিক উচ্চারিত হল, উনি হয়ত স্মৃতির নৌকোয় চেপে বসেছেন।
“আপনার লেখায় ওপারের কথা, এই নদীর কথা, প্রায়ই এসে পড়ে। খুব মনে পড়ে নাহ?”
যথাসম্ভব পেলব স্বরে নিখিলের প্রশ্ন।
“দেখো, আমি যখন এদেশে চলে এলাম, তখন অনেকটাই বড়। তা…সতের আঠেরো হবে। ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে এসেছি।
সব কিছুই মনে থাকা স্বাভাবিক। কিছু আত্মীয় তো এখনও রয়ে গেছে, বাড়িঘর সবই আছে।”
শেষের কথাগুলো বলার সময় উজ্জ্বল হয়ে উঠল লেখকের মুখ।
ঠিকই আছে শুরুয়াৎ। উত্তরগুলো বড় প্রেডিক্টেবল হচ্ছে, তবু এ বিষয়ের উপর আরেকটু লেগে থাকা যায়…
“যাতায়াত করেন তো প্রায়ই….কেমন লাগে!! পরিবর্তন চোখে পড়ে?”
“বছর দশেক হল যাইনি, শরীর ভেঙে গেছে। আগে তো ওখানকার সাহিত্য মহল থেকে, সেমিনার টেমিনারে বা একুশের বইমেলা হলে ডাক পড়ত, যেতামও। এখন অবশ্য সোস্যাল মিডিয়ায় সবার সাথেই আত্নীয়তা বেড়েছে। সব খবরাখবর পেয়ে যাই না গিয়েও।”
কোথাও কি একটু বিষণ্নতা ছুঁয়ে গেল লেখকের গলায়!! থাক, প্রসঙ্গ পাল্টানো যাক বরং…
“শুরুতে ছিল শুধুই কবিতা, এরপর গদ্যে চলে আসেন। আপনি একবার বলেছিলেন, প্রকাশকদের ইচ্ছের দাবীতে এটা সম্ভব হয়েছে, এটা কতখানি সত্যি আপনার মতে..”
“একদমই তাই। ভেবেছিলাম কবিতাই লিখে যাব, দু চারটে কবিতার বই টই বেরোবে, ব্যস আরকি। চাকরিটা খুব প্রয়োজন ছিল, সংসারে মা বাবা ভাই বোন, অনেকগুলো পেট।”
ডান হাতে চশমাটা খুলে একটু সময় নীরবতা, চশমার কাঁচটা পরনের পাঞ্জাবীতে মুছে চোখে পরলেন, এরপর ধীর লয়ে বললেন শেষের কথাগুলো। বোঝা গেল পুরনো দিনের কোন্ অতল থেকে উঠে আসছে শব্দগুলো…
পরের প্রশ্নটা থাক, একটু পজ নেওয়া যাক। উনি বরং বলুন ওনার মন খুলে।
“এরপর পত্রিকার অফিসে চাকরি, ওখানে সম্পাদক মশাইয়ের পীড়াপীড়িতে প্রথম উপন্যাস লেখা, ‘এপার ওপার’, খুব প্রশংসিত হল, সেটা বই হল, ভালো বিক্রিও হল…সেই শুরু। তারপর প্রকাশকের চাহিদায় বেশিটাই গদ্য লিখেছি”।
নিখিল এখন বেশ কনফিডেন্ট, লেখক নিজেকে খুলে ধরছেন একটু একটু করে, এটাই তো চাই। বাকি রাস্তাটুকুও এমনি সহজ করে বেরিয়ে যেতে হবে।
“কবিতাকে দূরে ঠেলতে হয়েছে বলে আক্ষেপ হয়!!.. ” ঠোঁটের কোণে একটু হাসি নিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়েই দিল শেষমেষ।
“তা একটু হয় বইকি, যতই গদ্য লিখি আমার শিকড় তো কবিতায়, কবিতায় আমার মুক্তি হয়।” চেয়ারের হাতলে হাত দুটো রেখে শরীরটাকে একটু পিছনে রাখলেন আরাম করে। তারপর আবার শুরু করলেন..
“তবে ভাবতেও পারিনি জানো, এক জীবনে এতো লিখব।”
মুখে প্রসারিত হাসিটি নিঃসন্দেহে জানিয়ে দিল এ আত্মতৃপ্তির।
“আপনার কবিতার নায়িকা ‘তিতলি’। এটি কি বাস্তব চরিত্র না কল্পনা?” প্রশ্নকর্তার চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক, তবুও থ্রোয়িং এ একটু দ্বিধা থেকে গেল।
“এই প্রশ্নটা এর আগে অনেক বার উঠেছে, সেদিন যা বলেছি, আজও তাই। তিতলি রহস্যেই থাক”। দৃঢ় কঠিন গলায় উত্তর এলো।
সত্যি তো, বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে, উনি আজকাল আগের মত কৌতুক বোধ করেননা, একটু বিরক্তই হন।
ভুল চাল দেওয়ার জন্য নিখিল নিজের উপর একটু অসন্তুষ্ট হল। এই প্রশ্নটা না করলেও হত।
**
মাঝে একবার কফি এসে গেছে। কফি মাগ হাতেই চলেছে প্রশ্নোত্তর পর্ব। এবার কিছুক্ষণের বিরতি।
সব জায়গাতেই তুমুল প্রতিযোগিতা। অন্তত আর পাঁচটা সাধারণের থেকে এই ক্লোজ আপকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যেতে হবে, ব্যতিক্রমী করে তুলতে হবে। বিখ্যাত এই সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকারকে ঐতিহাসিক করে তুলতে নিখিল বদ্ধপরিকর। বিরতির সময় মনে মনে সে আরেকটু ছকে নেয়, আগের থেকে তৈরি করা স্টাডি মেটিরিয়ালসের উপর আরেক দফা চোখ বুলিয়ে নেয়।
পরবর্তী পর্বের শ্যুট শুরু হল।
“আপনার তো বিদেশী সাহিত্যে প্রবল আগ্রহ, সেসব নিয়ে আপনার সাপ্তাহিক একটা করে লেখা বেরোয় একটি জনপ্রিয় পত্রিকায়। সে নিয়ে বিশদে যাব না। কৌতূহল জাগে, আপনি রবীন্দ্রোত্তর যুগের কার লেখা বেশি ভালোবাসেন?”
দুই হাতের পাঞ্জায় আঙুলে আঙুল জড়িয়ে মাথার পিছনে নিলেন, চোখ দুটো বুজলেন ক্ষণিক, তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
“দেখো, সেভাবে কি কিছু বলা যায়। একেক ফুলের একেক গন্ধ, গোলাপ, বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা সবই তো সুগন্ধী, কারটা বেশি ভালো বলা যায় কি! রবীন্দ্রনাথের পরে যারা লিখেছেন সবার লেখারই আলাদা শৈলী। আলাদা করে কারো নাম বলা সম্ভব নয়”।
নিখিল আশাহত হল একটু, প্রশ্নটা অন্যভাবে করলে হয়ত ভালো হত। তাই এবার প্রসঙ্গ পাল্টে,
“তখন বলছিলেন সোস্যাল মিডিয়ায় দেশের লোকের খবরাখবর সব পান, তা আপনাকে এখন বেশি একটা অ্যাকটিভ দেখা যায়না তো ফেসবুকে…”
“এখন শরীর তেমন জুতের নয়। স্পন্ডিলাইটিসে কাহিল। বেশিক্ষণ ল্যাপটপে কাজ করতে পারিনা৷ আমরা তো পুরনো মানুষ, তাই কাগজ কলমেই বেশি সাবলীল”।
“আপনার কি মনে হয়, ফেসবুকে লেখালিখি কতটা সদর্থক একজন লেখকের জন্য?” চোখে চোখ রেখে প্রত্যয়ের সাথে প্রশ্ন রাখল।
“আমি তো মাত্র বছর বারো আগে ফেসবুক হাতে পেয়েছি। প্রথম দিকে নতুন গ্যাজেটে খুব আগ্রহ ছিল। যদিও কিছু কবিতা, টুকটাক মুক্তগদ্য, নিজের রাজনৈতিক ভাবনা এগুলো লিখতাম। বাকি সব লেখাই পত্র পত্রিকা আর বইয়ের জন্য বরাদ্দ থাকত, ফেসবুকে প্রকাশ করিনি।”
“আপনার তো প্রচুর ফ্যান ফলোয়ার ছিল। তাদের সাথে যোগাযোগ থাকত? উঠতি লেখকদের লেখা পড়তেন সময় করে?”
সজোরে হেসে উঠলেন দিগন্তবাবু,
“পাগোল নাকি!! ওসব লেখা পড়ার সময় কোথায়, নিজেরই এত লেখার চাপ থাকত৷ তবে দিনে এক দুবার ঝাঁকিদর্শন করতাম, এই আরকি”
“আপনি তো প্রখ্যাত লেখক, আপনার একটা ছোট্ট লাইক বা কমেন্ট কিন্তু একজন উঠতি লেখকের জন্য খুব উৎসাহব্যঞ্জক হত।”
একটু লজ্জা লজ্জা মুখে বলে ফেলল।
“সে হয়ত ঠিক, কিছু তো প্রতিক্রিয়া জানাতাম, সেটা ইনবক্সে। আসলে একজনকে যদি কিছু বলি, আর পাঁচজন আবার কিছু আশা করতে পারে, সে কারণেই বিরত থাকতাম, তাছাড়া এত সময় কোথায় বলোতো, নিজের সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দরকার”।
সোস্যাল মিডিয়া কতখানি প্রভাবশালী এই শতকে, কতখানি বিপ্লব যে করে ফেলতে পারে, নিখিল ভালো করে জানে। অন্য সব কিছুর মত সুফল কুফলও আছে বইকি। দ্বিতীয় পর্বের প্রশ্নগুলো তাই বেশ খোলাখুলি আর ভনিতাহীন।
“আপনার এত ভালো চাকরি, এত বই, এত লিখছেন, তবু ফেসবুকে থাকতেন কেন?”
“শোনো ফেসবুকে থাকাটা হল কিছুটা যুগের সাথে তাল মেলানো, আপডেটেড থাকা। আর কিছু লিখলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া চলে আসে, জনসংযোগ এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যায়, সেটা অবশ্যই প্লাস পয়েন্ট।
আরেকটা কথা, ফ্যান ফলোয়িং দের একটু হাতে রাখা হয়। আগামী বইয়ের বিজ্ঞাপন টাও দেওয়া হয়, এসব তো যথেষ্ট কারণ”।
সাক্ষাৎকার নেবার সময় উত্তরদাতার চোখের ভাষা, ভ্রুর আঁকবাঁক, স্বরের ওঠানামা, সমগ্র শরীরি ভাষার উপর প্রখর নজর রাখে নিখিলের চশমায় ঢাকা বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ। কোন শব্দের উপর জোর দিলে একই বাক্যের ভোল যায় পাল্টে, কোন মোক্ষম সময়ে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলে মনের অন্তঃপুরের গোপন চাবি যায় খুলে, এগুলো নিখিল সুচারুভাবে রপ্ত করেছে অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা আর মনোঃসংযোগের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায়। এ লাইনে কৃতী হবার জন্য ইচ্ছে করেই সাইকোলজি নিয়েও পড়াশুনা করেছে।
প্রশ্নোত্তর পর্ব এবার প্রায় শেষের পথে। দরকার মতো লাটাই থেকে সুতো ছেড়েছে, আবার গুটিয়ে নিয়েছে, নাহ খোলা আকাশে ঘুড়ি ভালোই উড়ছে। শেষটুকু সামলে নিলেই……
“একটা সবশেষ প্রশ্ন, জীবনে কোন কিছু পাওয়া হল না এমন মনে হয়?”
মন দিয়ে শুনলেন লেখক, ডান হাত দিয়ে মাথার উপর সাদা চুলগুলোকে পিছনের দিকে ঠেললেন কিছুটা আনমনে, চেয়ারে আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে বসলেন, মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন উত্তর।
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে,
“নাহ, আমার এই দীর্ঘ জীবন শেষে মনে হয়, অনেক তো পেয়েছি৷ এতো কজনে বা পায়, কোন ছোট থেকে লড়াই করতে শুরু করেছিলাম, এতখানি তো নাও আসতে পারতাম, লিখে এতো সাফল্য পাব, ভাবিনি…”
“অতীতে বলতে, সুদূর অতীতে কোনো কাজের জন্য আপনার অনুশোচনা হয়?”
প্রশ্নটায় চিন্তান্বিত দেখাচ্ছে দিগন্ত মুখার্জিকে, চোখ দুটো বোজা, কিছু ভাবছেন কি, মনের অতলে হাতড়াচ্ছেন কি কিছু, যদি হাতে ওঠে, আজ ক্যামেরার সামনে বলতে চাইবেন কি কিছু…নিখিল এই দুর্বলতার সময়টুকু কাজে লাগাতে চাইল, এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, তুরুপের তাসটি বের করার উপযুক্ত সময়, ধীরে ধীরে খেলিয়ে খেলিয়ে বলতে থাকল…
“আচ্ছা, প্রথম যখন পৃথিবীটা ছোট একটা গ্রাম হয়ে গেল, নেট ওয়ার্ল্ডে বিরাট পরিবর্তন এলো, সোস্যাল মিডিয়া বলে এক নতুন মিডিয়ার আমদানি হল, ফেসবুক এলো, আপনার প্রচুর ফ্যান ফলোয়িং, তখন কি অনভিপ্রেত কোন ঘটনা ঘটেছিল? মনে পড়ছে কি? বহু বছর আগের ঘটনা যদিও” বেশ ভারী শোনালো নিখিলের গলা।
স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন নিখিলের দিকে, চশমাটা ডান হাতে আরেকটু উপরে ঠেললেন, প্রশ্নটা সরাসরি বিদ্ধ করেছে বোঝা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, ‘হু, মনে আছে। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল রঞ্জন মাইতি, মেদিনীপুরে থাকত, প্রোফাইলে তাই ছিল, তার লেখা একটা গল্প নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল, মনে আছে আমার”।
“একটু খুলে বলুননা, ছেলেটি কি আপনার গল্পটির পূর্ণাঙ্গ অনুকরণ করেছিল,আপনাকে না জানিয়ে?”
কোন গহীন আঁধারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন লেখক…বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, লেখক বলতে থাকলেন,
“দেখো নিখিল, আজ আমি জীবনসায়াহ্নে এসে গেছি প্রায়। কতদিন আছি তা বলতে পারবনা, তবু মনে হয়, এসময় এসে সত্যি কথাটাই বলে যাবো।
না, ছেলেটি মোটেও আমার গল্পটি নেয় নি। হয়ত সে অনুপ্রাণিত হয়েছিল কিছুটা, তাই একই বিষয়ের উপর লিখেছিল, তবে অবশ্যই তার নিজস্ব ভাবনায়”।
নিজের টেমপারামেন্ট থেকে একটু সরে এলো নিখিল, গলার স্বর কঠিন হল, লেখকের চোখে সোজা তাকিয়ে থেকে বলে ফেলল,
“অথচ সেদিন আপনার ফ্যানেরা, একটু কাঁচা বাংলায় যাকে বলে পেটোয়া, এমন নাজেহাল করেছিল ছেলেটিকে, চুরির অপবাদে তাকে এতটাই কোণঠাসা করেছিল….”
লেখকের দৃষ্টি আহত, কিছুটা অসহায়ের মত লাগল তার গলা, খানিক্ষণের নীরবতা ভেঙে থেমে থেমে বললেন,
“ঘটনার বেশ কিছু দিন পর আমি অনেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ছেলেটির কথা, কিন্তু ওকে আর পাইনি কেউ, প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেট করা ছিল, তুমি কি জানো শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল? ”
“ছেলেটির কলম চিরদিনের জন্য ভোঁতা করে দিয়েছিল সেদিন আপনার লোকেদের নিষ্ঠুর আচরণ, গালাগাল আর নোংরা ভাষা।
আপনি বলছেন, ছেলেটি হয়ত অনুপ্রাণিত হয়েছিল আপনার লেখায়, আপনি সত্যি করে বলুন তো, কতখানি মিল ছিল আপনার লেখার সাথে?”
বেশ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে দিগন্তবাবুকে, চশমা খুলে সামনের টেবিলে রাখলেন, দুহাতের করতলে মুখটা ঢাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর,
“দুটো গল্পের চলন, বিন্যাস, পরিণতি একদমই আলাদা ছিল। একদম মৌলিক গল্প ছিল ছেলেটির। এ যেন অনেকটা একই উৎস থেকে উত্থিত দুই নদী, নিজের নিজের মত করে বয়ে চলেছে।
আজ প্রকাশ্যে স্বীকার করছি, আমার থেকেও ওর গল্পের মান অনেক, অনে…ক উঁচু ছিল।”
নিখিলের গলার স্বর কঠিন, এতক্ষণ কথোপকথনে স্বরের আন্তরিকতাটুকু উধাও হলেও কোনরকম রূঢ়তা নেই। সে বলে চলে,
“বিষয়টা হয়ত এক ছিল। কিন্তু একই বিষয়ের উপর চিরকাল বহু লেখা হয়েছে, এটাই তো শিল্প, সাহিত্য। এই আকাশে যে যেমন ভাবে পাখা মেলতে পারে। শেকসপীয়র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এদের অমর সৃষ্টির উপর বার বার নতুন করে সাহিত্য থেকে সিনেমা তৈরি হয়েছে, নাটক তৈরি হয়েছে। অমর কোন কিছুর কাছে মানুষ বার বার ফিরে গেছে সময়ের দাবীতে, এটা তো শাশ্বত সত্য।”
নিখিলকে একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছে, সামনে রাখা জলের গ্লাসটা হাতে নিল। এক চুমুক জল খেয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লেখকের দিকে উত্তরের আশায়।
“ঠিকই বলেছ হে। আমিও তো কোন চিরনতুন সৃষ্টি করিনি।
তাই যদি হয় তবে তো আমারও অনুচিত হয়েছিল নবারুণ মিত্রের অমন ঐতিহাসিক বিষয়ের উপর গল্প লেখা। কিন্তু আমি যখন লিখেছিলাম নবারুণদা আমাকে খুব উৎসাহ দিয়েছিল।”
দিগন্ত বাবুকে একটু বিধ্বস্ত লাগছে। কোথাও যেন আত্মবিশ্বাস টাল খেলো, মনে হল যেন গ্লানিতে ডুবে আছেন। চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন, চোখ দুটো বন্ধ করে,
“এটাই আসলে বড়মানুষি। নবারুণদার মত বড় হৃদয়ের মানুষ যা পেরেছিল, আমি তা পারিনি, সন্তানের বয়সী একটি ছেলে আমাকে ছাপিয়ে যাবে, মন থেকে মেনে নিতে পারিনি সেদিন “।
“সেদিন আপনার একটা মন্তব্যে সবাই চুপ করে যেত। আপনি প্রতিষ্ঠিত নামকরা লেখক, তাই আপামর লোকজন এক তরফা আপনার হয়েই কথা বলে গেল। ছেলেটি বার বার করে বলতে চেয়েছে, গল্পে কোনও মিল নেই, হয়ত বিষয়বস্তু এক, কেউ শোনেনি সেদিন ওর কথা। আর আপনি! আপনি শুধু বসে বসে সবটুকু দেখলেন, হয়ত উপভোগও করলেন ছেলেটির হেনস্থা। একটা উঠতি কলমকে আপনি সেদিন শেষ করে দিয়েছিলেন”
নিখিল জাত সাংবাদিক, নিজের আবেগকে পেশাগত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করাতে জুড়ি নেই ওর। উল্টোদিকের বয়স্ক মানুষটির স্বাস্থ্যের দিকে প্রখর দৃষ্টি, প্রশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লেখকের দিকে, হাতে করে এগিয়ে দিল জল ভরা গ্লাস।
লেখক জল খেলেন একটু, আস্তে করে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন গ্লাস, এরপর নিখিলের দুটো হাত ধরে বললেন, ” তার খবর জানো? আজ সবার সামনে আমি আমার ভুল স্বীকার করে নিলাম।
সেদিনে যে কাজটি করতে পারেনি আজ খোলা মনে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”।
দর্শকের দিকে মুখ রেখে, ঠোঁটে পরিচিত হাসি এনে “আজকের এই সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করার আগে চ্যানেলের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, আপনি শতায়ূ হন, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই।”।
ক্যামেরা অফ হয়ে গেছে। সব ইকুইপমেন্টস গুছিয়ে গাড়িতে উঠবে নিখিল। শ্লথ পায়ে দিগন্তবাবু নিজে এসেছেন গাড়ির কাছে বিদায় জানাতে।
গাড়িতে উঠতে যাবে, লেখকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল নিখিল, ” বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া লেখক আমিই, সেই রঞ্জন… নিখিলরঞ্জন… আপনার লেখার ভক্ত, ভালো থাকবেন স্যর। ”
জন্মদিনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে শেষের অংশটুকু এডিট করে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
–~০০০XX০০০~–